Sourav Nath

Abstract Fantasy Others

3  

Sourav Nath

Abstract Fantasy Others

উন্মুক্ত বন্ধন

উন্মুক্ত বন্ধন

15 mins
171


রাত বিরেতে পুকুর পারে

মামদো ভুতে আড্ডা মারে।

শঙ্খচূর্ণী হিংসে ভরে

আড়চোখেতে ঝারি মারে।


   ঠাম্মা ঝারি মানে কি?

   ওসব তুই বুঝবিনা। ও হল এক ধরনের তাকানো।

   কেমন তাকানো ঠাম্মা, ও পাড়ার হুলো দাদা যেমন করে দিদির দিকে তাকায় তেমন?

   নাতির কথা শুনে ঠাম্মার তো চক্ষু একেবারে চড়কগাছ। তুই এতসব কি করে জানলিরে হতচ্ছাড়া? ঐ সব ধেড়ে বাঁদরগুলোর সঙ্গে মিশে মিশে এ সব আঁশকুড়ো আর পাঁশকুড়ো শিখছিস বুঝি?

   বা রে, এসব যদি আঁশকুড়ো পাঁশকুড়ো কথা হয়, তবে তুমিই বা আমাকে বলছ কেন? মা তো কাল রাতে বাবাকে বলছিল, ও পাড়ার হুলো দাদা নাকি দিদির দিকে রোজ রোজ ঝারি মারে। এবার থেকে মা নিজে দিদিকে ইশকুলে দিয়ে আসবে আর নিয়ে আসবে।

   ও তাই বল দাদু ভাই। আমি তো ভেবেছিলুম তুই বুঝি বদ সঙ্গে পড়ে এসব শিখছ। দুষ্টু সোনা আমার! মিষ্টি সোনা আমার!

   আচ্ছা ঠাম্মা, শঙ্খচূর্ণী হিংসে করে মামদোর দিকে ঝারি মারে কেন?

   নাতির কথায় তো ঠাম্মা একেবারে হেসেই কুপোকাত। আসলে শঙ্খচূর্ণীর মামদোকে ভারী পছন্দ। মনে মনে সে মামদোকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু শঙ্খচূর্ণী তো বিধবা ভুত, তাই তার বিয়ে করার উপায়ও নেই। ভুত সমাজে বিধবাদের বিয়েকে ভালো চোখে দেখা হয় না তো। সেই কারণে শঙ্খচূর্ণী মামদো ভুতের দিকে হিংসে করে ঝারি মারে।

   ঠাম্মার কথা শুনে নীলাম্বর বেশ মজা পায়। তাহলে শঙ্খচূর্ণীর কি হবে ঠাম্মা? তার কি আর কোনদিন বিয়ে হবেনা? শঙ্খচূর্ণীকে দেখতে কেমন ঠাম্মা? আমার শঙ্খচূর্ণীর জন্য খুব দুঃখ হচ্ছে। শঙ্খচূর্ণী যদি আমার সামনে আসে, তাহলে আমি শঙ্খচূর্ণীকে বিয়ে করব। মানুষ সমাজে তো বিধবাদের বিয়ে হয়।

   তুই তো ভারী পাকা হয়েছিস দেখছি! কার কাছ থেকে ওসব পাকা পাকা কথা শিখছিস? পাড়ার ধেরে ছেলেগুলোর সঙ্গে তোর খেলা এবার বন্ধ করতে হবে দেখছি।

   বা রে! সবসময় ঐ পাকা ছেলেদের দোষ দিয়ে কি হবে? ওরা কি আমাকে ওসব শিখিয়েছে নাকি? আমি বুঝি কিছু বুঝিনা? ঐ তো ও পাড়ায় মিলির বিধবা মাসির বিয়েতে আমরা সেদিন নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম, তোমার মনে নেই বুঝি? 

   ও, তাই বল। তুই এতসব কথা বেশ মনে রেখেছিস দেখছি, তাহলে তো তোকে শঙ্খচূর্ণীর সঙ্গে বিয়ে দিতে হয়। 

   তারপর কি হল ঠাম্মা, মামদোর কি শঙ্খচূর্ণীকে পছন্দ হল?

   ওরে আমার দুষ্টু, তুই তো বেশ ডেঁপো হয়েছিস দেখছি! একটা সামান্য ছড়ার মানে করতে করতে তো বেশ পেয়াজের খোসা ছাড়াতে লেগেছিস দেখছি!

   কি সব আবোল তাবোল বলছ তুমি ঠাম্মা, এখুনি তো মামদো আর শঙ্খচূর্ণীর কথা বলছিলে। এর মধ্যে আবার পেয়াজ এলো কোথা থেকে?

   আর নয়, অনেক হয়েছে ওঠ ওঠ। মা যদি জানে তুই এত পাকা পাকা কথা শিখেছিস, তাহলে কাঁচা কঞ্চি বাদ পড়বেনা কিন্তু। 

     নীলাম্বর তার ঠাকুমার কাছ থেকে এরকম অনেক অনেক রূপকথার গল্প শুনে বড় হয়েছে, ঠাকুমার সঙ্গে কতই না খুনসুটি করেছে। আজ পর্যন্ত সে কাউকেই তার ঠাকুমার থেকে ভাল গল্প বলতে শোনেনি। গল্প বলাটা একটা শিল্প। এর জন্য প্রতিভার দরকার হয়। যার তার মুখ থেকে গল্প শুনে মজা পাওয়া যায় না। নীলাম্বরের মনে পড়ে ঠাকুমা কেমন করে কথার ভাঁজে ভাঁজে, কথার পরতে পরতে সুরের চাপান উতরের মাধ্যমে গল্পের এক একটা শব্দকে ফুটিয়ে তুলত, কেমন করে শান্ত - অশান্ত বাক্যালংকারের মাধ্যমে গল্পকে এক মোড় থেকে অন্য মোড়ে চালিত করত। গল্প বলার এমন ট্রেনিং আজকের দিনে কোন ট্রেনারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। সামান্য এক একটা শব্দের প্রাসঙ্গিকতা, তার গুরুত্ব প্রথমে নিজেকে অনুভব করতে হয় তার পরে কারোর মনে অনুভূতি ফোটাবার প্রসঙ্গ আসে। নীলাম্বরের মনে পড়ে ঠাকুমা বলতেন, 'গল্প বলা কি চাট্টিখানি কথা ভাই! এর জন্য মগজ লাগে, এর জন্য সুর লাগে, এর জন্য আবেগ লাগে। 

   নীলাম্বর ছেলেবেলায় তার ঠাকুমার কাছ থেকে এক একটা গল্প বিভিন্ন রকম আঙ্গিকে শুনেছে। একই গল্প, একই সব চরিত্র - কিন্তু বলার ভঙ্গিমার তফাতে ঠাকুমা হিরোকে কখনও ভিলেন আর ভিলেনকে কখনও হিরোতে পরিণত করতেন। এক আশ্চর্য শিল্প সত্ত্বা ছিল তার ঠাকুমার গল্প বলার মধ্যে। ঠাকুমা যখন মৃত্যু শয্যায় শয্যাশায়ী, তখন তিনি নীলাম্বরকে হাত নেড়ে ডেকে বলেছিলেন, 'আমি না থাকলে তুই রাত্তির বেলা আকাশের ঐ তারাটির দিকে তাকিয়ে থাকবি, ওখানে আমি থাকব, ওখান থেকেই আমি তোকে গল্প বলে শোনাব।'

   ঠাকুমার মৃত্যুর পর থেকে নীলাম্বর প্রতি রাত্রে ঐ তারাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কান পেতে সে ঠাকুমার গল্প শোনার চেষ্টা করেছে। ঠাকুমা কিন্তু আর গল্প বলেননি। একদিন নীলাম্বরের ঠাকুমার ওপর বড় রাগ হল। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল - তুমি বড্ড মিথ্যেবাদী হয়েছ ঠাম্মা, তুমি যে বললে আমাকে রোজ গল্প শোনাবে, কৈ তোমার কথা রাখলে কৈ?

   একদিন তো রেগে মেগে নীলাম্বর ঠাম্মাকে বলেই ফেলল - ঠিক আছে, তোমার বড় অহংকার হয়েছে দেখছি। আজ থেকে আমি আর তোমার কাছ থেকে গল্প শুনতে চাইবনা। আজ থেকে আমি তোমাকে রোজ একটা করে গল্প বলে শোনাব। দেখবে আমিও অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প বলতে পারি, আমিও নিজের মন থেকে নতুন নতুন গল্প, নতুন নতুন ছড়া তৈরি করতে পারি। 

   সেই দিন থেকে শুরু হল নীলাম্বরের গল্প বলার, গল্প লেখার, ছড়া লেখার হাতে খড়ি।

   দেখতে দেখতে প্রায় পঁচিশটা বছর কেটে গেছে। নীলাম্বর কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি দিনও তার কথার অন্যথা করেনি। সে প্রতিদিন রাত্রে আকাশের দিকে তাকিয়ে তার ঠাকুমাকে একটা করে স্বরচিত গল্প শোনায়। কবে যে নতুন নতুন গল্পে তার খাতার পর খাতা ভরে গেল, সে যেন বুঝতেই পারলনা। 

   তবে এ সব গল্প এতদিন পর্যন্ত ছিল শুধুমাত্র তার ঠাকুমার জন্য। নীলাম্বরের পাশে এতদিন পর্যন্ত সঙ্গী বলতে রাতের আকাশের অজস্র নক্ষত্রদের ভিড়ের মধ্যে কোনও একটা নক্ষত্রে তার ঠাকুমা ছাড়া আর কেউই ছিলনা। কিন্তু আজ তার নতুন এক সঙ্গী হয়েছে। নীলাম্বরের আজ ফুলশয্যা। বাসর ঘরে নববিবাহিতা স্ত্রীর পাশে শয্যায় শায়িত হবার থেকেও তার কাছে বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল তার ঠাম্মাকে একটা গল্প বলে শোনানো। তবে আজ আর সে ঠাম্মাকে একলা গল্প বলে শোনাবে না। সঙ্গে নিলো তার নববিবাহিতা স্ত্রী রাত্রিকে। বাসরের শয্যাকে অনাদৃত, রিক্ত অবস্থায় রেখে নীলাম্বর রাত্রিকে নিয়ে ছাদের একটি কোণে গল্পের খাতা হাতে বসল। নববিবাহিতা স্ত্রী রাত্রিকে নীলাম্বর বলল, আজ আমি তোমাকে আমার এক প্রিয় মানুষের সঙ্গে পরিচয় করাবো। তুমি চল আমার সঙ্গে।

   রাত্রি যখন ছাদে এসে পৌঁছল, তখন দেখল তারা দুজনে ছাড়া ছাদে আর কেউই নেই। বিয়ের আগে নীলাম্বরের সঙ্গে রাত্রির কখনও পরিচয় হয়নি। বলতে গেলে আজই তাদের প্রথমবার একে অপরের কাছে পরিচিত হবার দিন। কিন্তু নীলাম্বরকে দেখে তো রাত্রির মাথা খারাপ বলে মনে হয়নি। তবে কি ছেলেটার মাথা টাথা কিছু খারাপ আছে! রাত্রির মনের মধ্যে এরকম অনেক প্রশ্নের স্রোত বয়ে যেতে লাগল। সে মুখে কিছুই বলল না। শুধু সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি যে কে, সেটা দেখার জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল।  

   নীলাম্বর প্রতিদিনকার মতই হাতে গল্পের খাতা নিয়ে ছাদে এসে খোলা আকাশের দিকে তাকাল। আজকে যেন নক্ষত্রগুলোকে অনেক বেশি উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে তার। নক্ষত্রগুলো যেন নীলুর অনেক কাছে চলে এসেছে। রাত্রিকে কাছে ডেকে নীলাম্বর আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল তার প্রিয় ঠাম্মাকে। নীলাম্বর আরও একটা নতুন গল্প পড়ে শোনাল। তবে আজকে শ্রোতা আর একজন নয়, আজ তার দু-দুজন শ্রোতা।  

   ঠাকুমাকে নীলাম্বর আজ বেশ একটা রোম্যান্টিক গল্প বলে শোনাল। আজ তার ফুলশয্যা, গল্প রোম্যান্টিক না হলে সাজে। মেয়েরা বোধ হয় এইরকমই অনুভূতিপ্রবণ, রোম্যান্টিক পুরুষদেরই পছন্দ করে। রাত্রির মনে প্রথম রাত্রেই নীলাম্বর তার এক বিশেষ জায়গা করে নেয়, যে জায়গা তৈর করতে অনেক পুরুষদেরই সারা জীবনটাই কম পড়ে যায়। 

   তুমি তো বেশ ভাল লেখো। 

   ভালো লিখি কিনা জানিনা, তবে ঠাম্মা আমাকে ছোটবেলায় অনেক গল্প শোনাত। ঠাম্মা মৃত্যুশয্যায় আমাকে প্রতিদিন আকাশে নক্ষত্রদের দিকে তাকিয়ে থাকতে বলেছিল। ঠাম্মা বলেছিল, সে আমাকে প্রতিদিন সেখান থেকে গল্প বলে শোনাবে। ঠাম্মা তার কথা রাখেনি। সেই থেকে আমি নিজে ঠাম্মাকে প্রতিদিন একটা করে গল্প বলে শোনাই। আমার ঠাম্মা হল আমার ইন্সপিরেশন। আমি এসব গল্প কেবলমাত্র আমার ঠাম্মার জন্যই লিখি।

   এই গল্প যদি ছেপে বের হয়, তাহলে তোমার কত নাম হবে তুমি কি তা জানো?

   আমার নাম নিয়ে কাজ নেই। আমি শুধু মাত্র আমার ঠাম্মার জন্যই গল্প লিখি, আর কারো জন্য নয়।

   আমি যদি বলি এবার থেকে আমার জন্য লিখতে, তাও কি তুমি লিখবে না?

   আমার ঠাম্মা বলত, শঙ্খচূর্ণী নাকি খুব হিংসুটে। তোমাকে আজ আমার শঙ্খচূর্ণীর মতই মনে হচ্ছে।

   আমি বুঝি হিংসুটে? 

   ঠিক তাই।

   তোমার মনের মানুষ হতে গেলে যদি আমাকে তোমার ঠাম্মার উপর হিংসে করতে হয়, তাও সই। কিন্তু কথা দাও, এবার থেকে তুমি আমার জন্যও গল্প লিখবে।

   নীলাম্বর রাত্রির কপোল চুম্বন করে বলে, লিখব, নিশ্চয়ই লিখব। তোমাকেও আমি প্রতিদিন একটা করে গল্প বলে শোনাব। 

   নীলাম্বরের জীবনটা এবার থেকে যেন কথকঠাকুরের মত হয়ে পড়ল। প্রতিদিন রাত্রে সে দুটো করে গল্প দুজনকে পড়ে শোনায়। কিন্তু গল্প লিখতেও তো সময় লাগে। প্রতিদিন দুটো করে গল্প লিখতে গিয়ে তার অফিস কাছারি মাথায় উঠল। প্রতিদিন কাঁহাতক আর অফিসে দেরী করে যাওয়া যায়। একদিন তো বসের থেকে বেশ ঝাড় খেল নীলাম্বর। সংসারে তার মন বসেনা, অফিসে যেতে কিছুতেই আর ইচ্ছে করে না। এদিকে বাড়িতে নববিহিতা স্ত্রীর একমাত্র চাহিদা প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প শোনার - একে অগ্রাহ্যই বা সে করে কি করে। রাত্রি বোধ হয় নীলাম্বরের মনের কথা বুঝতে পারল। একদিন রাত্রে নীলুর পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনতে শুনতে রাত্রি নীলাম্বরকে বলল, এবার থেকে আর অফিসে গিয়ে লাভ নেই।

   সেকি! অফিসে না গেলে খাব কি?

   মনের খিদের কাছে পেটের খিদের কি তুলনা চলে?

   মানে?

   মানে আর কিছুই নয়, আমি বাবাকে সব বলেছি।

   বাবাকে বলেছ মানে, কি বলেছ তুমি?

   আমি বাবাকে বলেছি তোমার কথা, তোমার ঠাম্মার কথা, তোমার লেখার কথা।

   বাবা শুনে কি বললেন?

   বাবা বললেন, তুমি শুধু লেখো। ওতেই তোমার প্রকৃত উন্নতি লুকিয়ে আছে।

   কিন্তু, সংসারের কি হবে?

   ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি যতদিন না প্রতিষ্ঠিত লেখক হয়ে উঠছ, বাবা আমাদের সবরকম সহযোগিতা করবেন।

   কিন্তু সেটা কি ভাল দেখায় রাত্রি?

   কেন, আমি তোমার কেউ নয় বুঝি? তোমার ঠাম্মাই বোধ হয় তোমার সব? আমার ইচ্ছের, আমার শখের বুঝি কোন দাম নেই তোমার কাছে?

   সেটা তুমি কিছুতেই ভেবনা রাত্রি। আমি তোমাকে আর আমার ঠাম্মাকে আলাদা করে দেখিনা। তোমরাই তো আমার সবথেকে কাছের মানুষ। একজন দূর থেকে আমার গল্প শোনে, আর একজন আমার পাশে থেকে। এই নিয়েই দিব্য সুখে আছি। এর থেকে বেশি আর কিই বা চাই!

   তাহলে কথা দাও কাল থেকে আর তুমি অফিসে যাবেনা। কাল থেকে শুধু লিখবে।

   ঠিক আছে, তাই না হয় হবে। কিন্তু লেখা ছাপার কি হবে?

   সে দায়িত্বটা না হয় আমিই নিলাম। 



   কাজের মধ্যে থাকলে সময়ের হিসেব থাকেনা, তার উপর সে কাজ যদি মনের মত হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। নীলাম্বরের দিন শুধু গল্প লিখেই কেটে চলল। কত দিন যে এ ভাবে কাটল, তার কোন হিসেব তার কাছে নেই। একদিন রাত্রি নীলাম্বরের হাতে একটা সাহিত্য পত্রিকা দিয়ে বলল, দ্যাখো তোমার লেখা ছেপেছে।

   এই প্রথমবার নীলাম্বর তার হাতের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখল। সেদিন তার মনের মধ্যে যে অফুরন্ত আনন্দ, যে স্যাটিশফ্যাকশন অনুভব করল, সে কথা সে ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারলনা, সে ছাড়া আর কারো বোঝার কথাও নয়।

   বছর খানেকের মধ্যে নীলাম্বরের লেখা সাহিত্য পত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় হৈ চৈ ফেলে দিল। পাবলিশারদের অনুরোধে নীলাম্বর দিনের পর দিন রাতের পর রাত শুধু লিখতেই থাকল আর লিখতেই থাকল। নীলাম্বরের গল্প অবলম্বে কয়েকটি আর্ট ফিল্ম থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমা পর্যন্ত তৈরি হল। বলা বাহুল্য এর পাশাপাশি অর্থেরও কমতি হলনা কোন অংশে। 

   নীলাম্বর তার শহরতলীর পুরাতন বাড়ি ছেড়ে শহরের দামী ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত হল, নতুন বাড়ির সাথে নতুন গাড়িও হল। চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে তার জীবন আরও উন্মুক্ত হল। সবকিছুই যেন তার জীবনে খরস্রোতা নদীর মত বহমান হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। কিন্তু নদীর এক কুল গড়লে যেমন আর এক কুল ভাঙে, ঠিক সেরকমই কখন যে নীলাম্বর তার জীবনের সবথেকে কাছের দুটি মানুষের থেকে দূরে চলে যেতে লাগল, সেটা সে ভেবে দেখার মত সময়ও পেলনা। এখন তো তার মান-সম্মান, খ্যাতি একেবারে তুঙ্গে। সারাদিনে যে কতসব সেমিনার কত প্রোগ্রাম এটেন্ড করতে হয় তার কোন হিসেব নেই। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, শহর থেকে শহরতলী, গ্রাম থেকে মহানগরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। এক বছরের ফুটফুটে ছেলেটি যে কখন পাঁচের গণ্ডি পেরোল সেটা নীলাম্বরের চোখেও পরলনা। এখন আর নীলাম্বর কাউকে গল্প শোনাবার মত ফুরসৎ পায়না। নতুন ফ্ল্যাটের ছাদে উঠে ঠাম্মাকে গল্প শোনাবার মত বা রাত্রিকে পাশে বসিয়ে নতুন নতুন গল্প পড়ে শোনাবার মত সময় আর তার হাতে নেই। এখন যে তার প্রচুর পাঠক, তার লেখার যে এখন প্রচুর ডিমান্ড। 

   নীলাম্বরের নতুন এসিস্টান্ট নবনীতা বেশ সুশিক্ষিতা এবং সুন্দরিও বটে। শুধু তাই নয়, সাহিত্য বিষয়ে বেশ বোদ্ধাও বটে। নীলাম্বরের প্রুফ রিডিং থেকে শুরু করে তার নিত্যদিনের বিভিন্ন সেমিনার বা প্রোগ্রামের দেখাশোনার ভারও তার উপর। একটি দিনও তার ছুটি নেবার মত অবসর নেই। প্রথমের দিকটা রাত্রি পুরো ব্যাপারটা দেখাশোনা করলেও ছোট ছেলেটাকে নিয়ে সে এখন আর একা পেরে ওঠে না। সেই কারণেই নবনীতার এপয়েন্টমেন্ট। 

   কল্পকাহিনীর থেকে বাজারে এখন প্রেমের কাহিনীর ডিমান্ড খুব বেশী, তার সঙ্গে যদি শরীরের রসায়ন একটু থাকে তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। বেশ রম রম করে রসালো রসালো প্রেম কাহিনীর বই বাজারে কাটতে লাগলো নীলাম্বরের। এখন আর গল্প লিখতে গেলে তাকে বেশী ভাবতে হয়না। এক এক দিনে এক একটা গল্প তো নামবেই নামবে। গল্পের বিষয় বস্তু যাই হোকনা কেন, প্রচ্ছদটা চটকদার হলে অর্ধেক বই তো সেখানেই কাটবে। তার উপর গল্পের মধ্যে একটু আধটু স্পাইশি ওয়ার্ডের ব্যবহার হলে তো আর কোন কথাই নেই। সবই তো থোড় বড়ি খারা প্রকৃতির গল্প, শুধু ক্যারেক্টার আর প্লটের একটু রদবদল। এই কয়েক বছরে বিষয়টা বেশ করায়ত্ত হয়ে গেছে নীলাম্বরের। প্রথম প্রথম তাকে খুব ভেবে চিনতে লিখতে হত। কিন্তু এখন আর বেশী ভাবা ভাবির প্রয়োজন হয়না। পাঠক থেকে শুরু করে পাবলিশার এমনকি প্রডিউসারেরও পছন্দ তার রসালো প্রেমের কাহিনী। এসব গল্প লিখে আয়ও প্রচুর।

   নীলাম্বর শুধু রসালো প্রেমের কাহিনী লিখতে থাকল। কত যে গল্প লিখল তার কোন হিসেব তার কাছে নেই। কিন্তু প্রেমের কাহিনী তো আর এমনি এমনি বেরোয়না, এর জন্য প্রেমে পড়তে হয়। সেই কবে বিয়ের পর রাত্রির সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল নীলাম্বর। লেখার চাপে সে প্রেম তো কয়েকমাসের মধ্যে ডগে উঠেছিল, তারপর ছেলেটা হবার পর থেকে তার তো আর প্রসঙ্গই ওঠেনা। নবনীতাকে বেশ মনে ধরে নীলাম্বরের। প্রেম নিবেদন করবার জন্য ভাষার তো আর অভাব নেই তার কাছে। তাই বেশ সহজেই সে একদিন নবনীতার কাছে তার প্রেম নিবেদন করল। লেখক মানুষের প্রেমে পড়েনা এমন মেয়ে খুব কমই বোধ হয় আছে, তার উপর প্রেমিক যদি নীলাম্বরের মত নামজাদা লেখক হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। বলা বাহুল্য নবনীতা সে সব মেয়েদের দলে একেবারেই পড়েনা। লেখার সাথে সাথে প্রেম পর্বও বেশ চলতে লাগল রম রম করে। প্রেমের সঙ্গে শরীরের রসায়নও বাদ পড়লনা কোন অংশে। লেখায় যদি বাস্তবতার ছোঁয়া না থাকে, তাহলে লেখাতেই বা প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় কি ভাবে! কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াও তো আর অন্ধ নয়, তার উপর নীলাম্বরের মত নামজাদা সাহিত্যিকের প্রেম কাহিনী যদি ছাপা যায়, তাহলে তো বাজারে গরম গরম কাহিনীটি নিয়ে একেবারে হৈ চৈ পড়ে যাবে এবং হলও তাই। অচিরেই নীলাম্বর আর নবনীতার প্রেম কাহিনী নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া আর নিউজ মিডিয়ায় একেবারে হৈ চৈ পড়ে গেল। 

   খবরটা নীলাম্বরের স্ত্রী রাত্রি থেকে শুরু করে তার শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত কারোরই চোখ এড়ালনা। বড় বড় মানুষদের এসব ছোট ছোট জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। এসব খবর না থাকলে কি লাইম লাইটে আসা যায়? নীলাম্বর আর নবনীতার প্রেম কাহিনীর জোয়ারে নীলাম্বরের বইয়ের বিক্রি দ্বিগুণ থেকে চতুর্গুণ হয়ে গেল। সমাজে তার পরিচয় যেন আরও বহুগুণ বেড়ে গেল। যারা নীলাম্বরকে তখনও পর্যন্ত চিনতনা, তারাও তাকে চিনে গেল এবং তার লেখা বইয়ের ডিমান্ড স্বভাবতই আরও বহুগুণে বেড়ে গেল। 

   কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম বড়ই নিষ্ঠুর, এখানে যেমন জন্ম আছে তেমন মৃত্যুও আছে, যেমন নাম আছে তেমন দুর্নামও আছে, যেমন উন্নতি আছে তেমন অবনতিও আছে। নীলাম্বরের ক্ষেত্রেই বা সে নিয়মের রদ বদল হয় কি ভাবে! চটুল প্রেম কাহিনী সাময়িক ভাবে নীলাম্বরের খ্যাতি এনে দিলেও বেশি দিন সেটি আর স্থায়ী হলনা। একই রকমের কাহিনী, একই রকমের প্লট কতদিন আর মানুষের মন জয় করবে? নীলাম্বরের জীবনের খরস্রোতা নদীর মাঝে কখন যে চোরাবালির চর পড়তে শুরু করেছিল, সেটি বোঝবার মত বুদ্ধি তার ছিলনা। আর ছিলনা বলেই সে তখনও পর্যন্ত সেই চোরা স্রোতের মধ্যেই তার নাম, যশ, খ্যাতির চূড়া প্রতিষ্ঠা করবার বৃথা প্রয়াস করে চলেছিল। অন্য দিকে নদীর স্রোত ইতিমধ্যেই তার গতিপথ পরিবর্তন করে নতুন সভ্যতা, নতুন ক্যারেক্টার, নতুন প্লটকে বেছে নিয়েছে যেখানে নীলাম্বরের অস্তিত্ব ধুয়ে মুছে একেবারে সাফ হয়ে গেছে, যেখানে পৌঁছান নীলাম্বরের পক্ষে আর কখনই হয়ত সম্ভবপর নয়। 

   নীলাম্বরের যখন সম্বিত ফিরল, যখন সে প্রকৃত অর্থেই বুঝতে পারল যে সময় তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়েছে, তার জীবনের স্রোতের চোরাবালির বাঁধ ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে তখন বড়ই দেরি হয়ে গেছে। বলা বাহুল্য নীলাম্বরের জীবনে নবনীতার আর কোনও ভূমিকা নেই। নবনীতা পুরাতন চাকরীর সাথে সাথে পুরাতন প্রেমিককেও পরিত্যাগ করেছে। নীলাম্বর যখন জীবনের ব্যর্থতার ভারে জর্জরিত হয়ে পিছনের দিকে ফিরে তাকাল, সে দেখল আলেয়ার পিছনে ধাওয়া করতে করতে কখন যে সে তার জীবনের মরূদ্যানকে হারিয়ে এসেছে সেটি সে বুঝতেও পারেনি। সময়ের পরিহাসে পিছনের দিকে ফিরে যাওয়ার রাস্তাও যেন তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। 

   আজ নীলাঞ্জন জীবনের ঘোড়দৌড়ে বড়ই ক্লান্ত, বড়ই একা সে আজ। আজ তার চারপাশে চূড়ান্ত ব্যর্থতার গ্লানি আর শূণ্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই। যদি কিছু থেকে থাকে, সেটি হল মাথার উপরে উন্মুক্ত আকাশ আর রাতের আকাশে অজস্র নক্ষত্রের ভিড়। বহু বছর পর নীলাঞ্জন আবার মুখ তুলে রাতের উন্মুক্ত আকাশে নক্ষত্রের ভিড়ের দিকে তাকাল। তার মনের মধ্যেকার গ্লানি তার চোখের মধ্যে দিয়ে অশ্রু ধারা হয়ে ঝরে পড়ল। অশ্রুসজল নয়নে সে দেখল, রাতের আকাশও যেন ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল, অজস্র নক্ষত্র তার চোখের সামনে থেকে ঝাপসা হতে হতে সাদা হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল। কালো অন্ধকারের করাল গ্রাসের আলিঙ্গনে নীলাম্বরের শেষ সম্বল, শেষ ভরসা, তার ছোট্ট বেলাকার একমাত্র সঙ্গী, তার ঠাম্মাও যেন আজ তার জীবন থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিলো। 



   এ বছর শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে তো আজ কাল আর ঠাণ্ডাই পড়েনা। তবুও যেন এ বছর শীতটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। এরকম শীতে গরম গরম গল্প শুনতে কার না ভাল লাগে। আগেকার মত বাঙ্গালীর পড়াশোনার অভ্যাসটা না থাকলেও গল্প শোনার অভ্যাসটা কিন্তু ঠিক তেমনই রয়ে গেছে। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় গল্প, রাস্তার মোড়ে কি চায়ের দোকানে গল্প, ক্লাবে কি গড়পাড়ের মাঠের ধারে গল্প করার মত সময় মানুষের হাতে না থাকলেও গল্প বলার আর গল্প শোনার নিত্য নতুন উপায় কিন্তু মানুষ ঠিক আবিষ্কার করে ফেলেছে। পৃথিবীটা যেন ছোট হতে হতে মানুষের পকেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সিনেমা থেকে ওয়েব সিরিজ, সোসাইটি থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সমস্ত কিছুর খোলনলচে পালটে রদ বদল হলেও বেসিক ব্যাপারটা কিন্তু সেই একই রকম থেকে গেছে। এখনও মানুষ গল্প পড়তে ভালবাসে, গল্প শুনতে ভালবাসে। নীলাম্বরের না আছে পিছুটান, না আছে বড় হবার চিন্তা। স্ত্রী রাত্রি ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকে। ছেলেটির বয়স বছর দশেকের হবে বোধ হয়। স্ত্রী পুত্রকে দেখতে তার বড় সাধ হয়। কিন্তু সে মুখ কি তার আর আছে? চরিত্র থেকে শুরু করে নাম যশ সবই তো তার গেছে। আজ সে বড় একলা। কিন্তু রাতের খোলা আকাশের দিকে সে আজও তাকিয়ে থাকে। সে আজও রাতের নক্ষত্রদের ভিড়ে তার ঠাম্মাকে খুঁজে বেড়ায়। সে আজও গল্প লেখে আর নক্ষত্রদের দিকে তাকিয়ে রাত্রির অন্ধকারে সে নিজের মনেই গল্প বলে শোনায়। এরকম করে কেটে গেল আরও পাঁচটা বছর। মানুষের মন থেকে নীলাম্বরের নাম এতদিনে ধুয়ে মুছে গেছে বোধ হয়। নিউজ পেপারে এখন প্রতি নিয়ত নবনীতার খবর বের হয়। সে এখন বেশ নামজাদা পলিটিশিয়ান। কোন এক নামকরা লেখকের স্ত্রী সে এখন। নীলাম্বর নিজের মনেই হাসে। হাসে তার ভাগ্যের পরিহাসের উপর, হাসে সময়ের স্রোতের খামখেয়ালীর উপর। এতদিনে আসল ব্যাপারটা তার কাছে বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। এতদিনে সে বুঝেছে যে, মানুষের মনে স্থায়ী স্থান অধিকার করবার জন্য প্রয়োজন নিষ্কলঙ্ক সৃষ্টির। যখনই কোনকিছুকে কলুষতা গ্রাস করে, প্রকৃতির রোষ তার উপর অবশ্যম্ভাবী রূপে ঝড়ের রূপে দস্যুদলের মত হানা দিয়ে তাকে একদিন না একদিন ছারখার করে দেয়। প্রকৃতির রোষের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার মত ক্ষমতা কারোরই নেই। 

   একাকী, সংসার থেকে পরিত্যক্ত একজন মানুষ নীলাম্বর এক টুকরো খড়কুটোর মত প্রকৃতির খেয়ালে, প্রকৃতির তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে বহু দেশ, বহু সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে। সে দেখেছে বহু জাতি, বহু মানুষ। সে দেখেছে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার ও না পাওয়ার জীবন্ত কাহিনী। সে উপলব্ধি করেছে মানুষের উত্থান-পতনের ইতিহাস। নীলাম্বরের লেখার খাতার প্রতিটা ছত্রে ছত্রে আর মনগড়া কল্পনার আঁচড় আজ নেই। আজ যেটা তার খাতার প্রতিটা ছত্র অধিকার করে আছে, সেটি হল তার জীবনের বাস্তবতার কঠিন মাটির বুক চিরে তুলে আনা এক একটি কাহিনী যার প্রতিটা শব্দে, প্রতিটা অক্ষরে অক্ষরে রয়েছে হীরের মত চোখ ধাঁধানো আলোর উজ্জ্বলতা। আর এমন উজ্জ্বলতা রোধ করবার মত দুঃসাহস আর কার মধ্যেই বা থাকতে পারে! সূর্যের কিরণ যেমন কোন কিছুরই বাধা মানেনা, ঠিক সেইরকমই মানুষের প্রতিভাকেও কোন কিছু গ্রাস করে রাখতে পারেনা। বলা-বাহুল্য নীলাম্বরের মধ্যে লেখনিসত্ত্বার প্রতিভা চিরকালই ছিল। শুধুমাত্র অভাব ছিল যেটার, সেটা হল পৃথিবীর রঙ্গিন মোড়কের আড়াল থেকে তার প্রকৃত সত্ত্বাটুকুকে উপলব্ধি করবার। আজ যখন নীলাম্বরের চোখের সামনে থেকে মিথ্যের প্রলেপের স্তর ভেদ করে পৃথিবীর প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে, তখন তার চারপাশে মিথ্যা প্রহেলিকার জালে আবদ্ধ হয়ে মিথ্যা ফানুসের মত সম্মান নামক মরীচিকার পিছনে ছুটে চলা মানুষদের দেখে তার অন্তরে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি ব্যতীত আর কিছুই অনুভূত হয় না। নীলাম্বর এখন এ সব কিছুরই ঊর্ধ্বে। যার কিছু চাহিদাই নেই তার আবার কিসের দুঃখ!

   কিন্তু সময়ের স্রোতের গতিধারা বোঝবার মত ক্ষমতা আমাদের মানুষের আর কতটুকুই বা আছে! আমরা তো সময়ের হাতের পুতুল ব্যতীত আর কিছুই নয়। নীলাম্বরের জীবনের খরস্রোতা নদীর প্রবাহ যা তাকে পিছনে ফেলে অন্য দিকে প্রবাহিত হয়েছিল, সেটি যে আবার কখন তার গতিপথ পরিবর্তন করে নীলাম্বরের জীবনভিমুখি হল, সেটিও নীলাম্বরের চোখে পড়লনা। প্রখর সূর্যের কিরণের মতই নীলাম্বরের প্রতিভার প্রকাশ আরও একবার জগতকে আলোকিত করে তুলল। একেই হয়ত বলে সময়ের পরিহাস। নীলাম্বরের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় লেখা সমগ্র বিশ্বে প্রশংসার ঝড় তুলল। কতই না পুরস্কারের জন্য তার লেখা অনুমোদিত হল। কিন্তু পুরস্কার নেবে কে! নীলাম্বর কোথায়! যে শূন্যের অর্থ একবার উপলব্ধি করেছে, সে কি আর অন্য সংখ্যার পিছনে ছোটে? নীলাম্বর আজ উপলব্ধি করেছে শূন্যের থেকে বড় সংখ্যা আর কিছুই হতে পারে না। তাই সে নিজেকে উজাড় করে, নিজেকে শূন্য করে পৃথিবীকে তার এক একটি গল্প উপহার দিতে লাগল। আজ নীলাম্বরকে দেখতে কেমন বা সে কোথায় থাকে, সে খবর কেউই জানে না। তার মৃত্যুর পরও হয়ত তার মৃতদেহকে কেউই সনাক্ত করতে পারবে না। কিন্তু নীলাম্বর যতদিন বাঁচবে ততদিন মানুষকে প্রকৃতির প্রকৃত গল্প, মানুষের বেঁচে থাকার গল্প একের পর এক উপহার দিতে থাকবে। যদি কেউ কখনও তাকে চিনতে পের থাকে, যদি তার সঙ্গে আমৃত্যু কেউ সঙ্গে থেকে থাকে, সে হল নীল আকাশ আর সেই আকাশের বুকে লেগে থাকা অজস্র নক্ষত্রের ভিড়। প্রকৃতির এই ভিড়ের কাছে, এই সম্মানের কাছে মানুষের ভিড় আর মানুষের সম্মানের মূল্যই বা আর কতটুকু! 

     প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, সৌন্দর্য থেকে উৎসারিত লেখার স্রোতে নীলাম্বর নিজেকে ভাসিয়ে দিল। মূক প্রকৃতির নীরব ভাষা নীলাম্বরের লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল, তার হৃদয়ে আনন্দধারার সঞ্চার করল। সে অনুভব করল তার ছেলেবেলাকার অনুভূতি, ঠিক যেমনটি অনুভব করত তার ঠাম্মার মুখ থেকে রূপকথার গল্প শুনে।   


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract