মহব্বত #lovelanguage
মহব্বত #lovelanguage
১
'তু খালি ই বল, তু হামার সাথে চলবি কি না?'
'দূর হ শালা বুড়ো ভাম, তোর লগে আমি গতর দিব? তার আগে আমি গলায় রসি দিব সেও আচ্ছা।'
'হামি কি কুছু বুঝিনা? ঐ মাষ্টার তোর মাথায় মহব্বতের গুল খিলিয়েছে। তবে একটা বাত জেনে রাখিস, এই দুলু ভাইয়ের মুড়ো যদি একবার বিগড়ে যায়, তোবে সে উহার বাপকেও ছাড়েনা।'
'আরে যা যা! এমন কত্ত দেখলাম! মেলা হাওয়ায় ফর ফর না করে যদি পারিস তো চেষ্টা করে দ্যাখ। তখন বুঝব কত দুধ আর কত জল।'
দুলু ভাইয়ের মুখের উপর কথা বলার মত সাহস এ অঞ্চলে কারোর নেই। তার উপর কিনা মুখের উপর এ তো একপ্রকার চ্যালেঞ্জ বলা যেতে পারে। কিন্তু দুলু ভাইও ছাড়বার মত পাত্র নয়। একটা সামান্য মাষ্টার কিনা তার ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে দিল। বয়স কালে এমন কত ছোঁড়াকে সে গায়ব করে দিয়েছে। এখন একটু বয়স হয়েছে বটে, মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত বয়স বাড়লেও, তার মনটা এখনও কচি কাঁচা মেয়ে দেখলেই কেমন যেন দুমরে মুচরে ওঠে। শালা বয়সটাকে যদি ধরে রাখা যেত, তাহলে অন্তত মিঠুর এমন কাঠ ঠোকরার মত কথা সহ্য করতে হত না। কালকের মেয়েছেলের কথার কি ধার! বুক ভেদ করে যেন এপার ওপার হয়ে যায়।
মিঠু হল কাঠখোট্টা মেয়ে। ওর মুখে কোনও কথা আটকায় না। মেয়েছেলে হলেও ভয় নামক শব্দের সঙ্গে ওর পরিচিতি এখনও হয়নি। কোমরে করে ডেচকি ভর্তি কাচা কাপড় নিয়ে নদীর ঘাট থেকে ঠমক ঠামক দুলকি চালে সে দুলু ভাইয়ের দিকে কেবল মাত্র 'হু!' শব্দ করেই বুঝিয়ে দিয়ে এলো যে সে দুলু ভাইয়ের কথায় কোনও পাত্তাই দেয় না।
আমি অনেকক্ষণ ধরেই বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সমস্ত কিছুই লক্ষ্য করছিলাম। দুলু ভাই যে মাষ্টারের কথা উল্লেখ করল আমিই হলাম সেই মাষ্টার। আমার বাবা হলেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। চাকরী সূত্রে তাঁকে নানা যায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। আমি এই বছরেই ইংরাজিতে মাষ্টার ডিগ্রী কমপ্লিট করেছি। বাবার পথ অনুসরণ করে সরকারী চাকরীর জন্য পড়াশোনা করছি। মাস খানেক হল বাবার সাথে এসে থাকছি। বাবা এখানে একাই থাকেন। সপ্তাহান্তে একবার বাড়িতে যাতায়াত করেন। আমার মা হলেন স্কুলের হেড দিদিমণি। চাকরী সূত্রে তাঁকে কোলকাতায় থাকতে হয়। কোলকাতার কোলাহল থেকে নিরিবিলি এই গ্রামাঞ্চলে পড়াশোনায় ভালো মন বসে। সেই কারণেই আমি বাবার সঙ্গে থাকবার জন্য চলে এলাম। বিকেলের দিকটায় পড়ায় মন বসে না। তাই কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। একদিন গ্রামের মোড়ল প্রমথ বাবু আমাকে এসে ধরে বললেন, 'আচ্ছা খোকা, তুমি তো ম্যানেজার সাহেবের ছেলে তাই না?' শহরে সাধারণত কেউ গায়ে পড়ে আলাপ করে না। গ্রামে থাকবার অভিজ্ঞতা আমার একেবারেই নেই। তাই লোকটাকে দেখে প্রথমে আমার খটকা লাগল। কিন্তু কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরে মনে হল লোকটা নেহাত মন্দ নয়, এই একটু খোলামেলা মনের আরকি। আলাপ করবার পরে জানতে পারলাম যে তিনি হলেন এই গ্রামের মোড়ল। কথার ফাঁকে তিনি আমাকে এক সময় তাঁর একমাত্র ছেলেকে পড়াবার প্রসঙ্গ তুললেন। বিকেলের দিকটা আমার খুব একটা কাজও থাকে না। এখানে কোনও বন্ধু বান্ধবও নেই। তাই আমিও বিকেলে পড়াবার জন্য রাজি হয়ে গেলাম। এক দিকে ভালই হল। সর্বক্ষণ বই মুখে দিয়ে বসে থাকতেও ভাল লাগে না। তবু কাউকে পড়ালে একটু একাকীত্বটাও দূর হবে। এই কথা ভেবে আমি আর না করলাম না। পরের দিন থেকেই শুরু করে দিলাম আমার টিউশন ক্লাস। ছেলেটা নেহাত খারাপ নয়। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি বেশ ভালই আছে। পড়াতে বেশ ভালই লাগল। মিঠুকে সেদিনই আমি প্রথম দেখলাম প্রমথ বাবুদের বাড়িতে। বাপ মা মরা একলা সহায় সম্বল হীন একটি মেয়ে। গত বছরে করোনায় তার বাপ-মা দুজনেই একসাথে মারা গেলে প্রমথ বাবু মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। ছোটবেলা থেকেই বাংলায় থাকতে থাকতে মিঠুর ভাষা অনেকটা বিহারি হিন্দি টান থাকলেও বাংলা বলতে বা বুঝতে তার খুব একটা অসুবিধা হয় না। মেয়েটিকে দেখতে বড় সুন্দর। প্রথম দেখাতেই আমি মিঠুর প্রেমে পড়ে গেলাম। আমি জানতাম এ প্রেমের পরিণতি কি হতে পারে। কিন্তু প্রেম কি জাত-কুল-ভাষা মানে? প্রেমের গ্রন্থির তারে একবার ঝঙ্কার লাগলে তার প্রতিধ্বনি শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রকে আন্দোলিত করে তোলে। মিঠুর চোখের চাহনিতে প্রথম দিনেই আমার প্রতি তার দুর্বলতা দেখেছিলাম। একলা যুবতী মেয়ে পুরুষ সঙ্গ চায়। তবে যে সে পুরুষ তার পছন্দ নয়। তার রুচির একটা উচ্চতা আছে। দুলু ভাইয়ের মত অনেকেই মিঠুর অমৃত সুধা পানের নিমিত্ত চাতকের ন্যায় লোলুপ জিহ্বা নিয়ে নিরলস প্রতীক্ষায় রয়েছে। এ কথা মিঠু ভালোমতোই জানে।
প্রমথ বাবুদের বাড়িতে লোকজন বলতে সেরকম কেউই নেই। একমাত্র ছেলে প্রাণোতোষ ক্লাস ফাইভে পড়ে। সস্ত্রীক এক পুত্র নিয়ে সংসার তাঁর। চতুর্থ ব্যক্তি বলতে মিঠু ছাড়া আর কেউই নেই। প্রমথ বাবু গ্রামের আর পাঁচটা ঝামেলা সামলাতে গিয়ে বাড়িতে সময় খুব কমই দিতে পারেন। প্রমথ বাবুর স্ত্রী সারাদিন বাড়ির কাজকর্ম আর রান্নাবান্না নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আমি যখন পড়াতে যাই তখন তাঁর বিশ্রামের সময়। দোতলার দুটি ঘর এক প্রকার ফাঁকাই পড়ে থাকে। আমি তার একটি ঘরে প্রাণোতোষকে পড়াই। মাঝে মাঝে মিঠু আসে কিছু একটা নিতে বা কিছু রাখতে। প্রথম প্রথম চোখে চোখেই কথা হত। ক্রমে সে কথা ভাষার রূপ নিলো। ধীরে ধীরে সে ভাষা প্রেমের ভাষা হয়ে উঠল। প্রাণোতোষকে কিছু একটা কাজ দিয়ে আমি প্রায়ই অন্য ঘরে মিঠুর সঙ্গে গল্প করতাম। মিঠুর প্রাণখোলা হাসি আর সরল মন আমাকে তার প্রতি আরও বেশী করে আকর্ষিত করে তুলতে লাগল। এই রকমই একদিন বিকেলে আমি প্রাণোতোষকে পড়াতে গেলাম। মিনিট দশেক পড়াবার পরে লোডশেডিং হয়ে গেল। প্রাণোতোষ গরমে আর পড়তে চাইল না। সে আমাকে বলল, 'স্যার আমি বরং বাইরে একটু খেলে আসি। কারেন্ট এলে আমাকে ডাকবেন, আমি ঠিক পড়তে চলে আসব।' আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রাণোতোষ এক ছুটে নিচে চলে গেল খেলতে। দরজার সামনে দেখি মিঠু হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে খিল খিল করে হাসছে। আমি বোকার মত মিঠুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আগুনের তাপে ভেসে যাচ্ছে মোমবাতির মোম। মোমবাতির হলুদ আলোর রেখা মিঠুর মুখটাকে যেন অনেকটা অতিপ্রাকৃত করে তুলেছে। মিঠুর একটা বিরাট ছায়া পিছনের দেওয়ালে জুরে রয়েছে। আলোর শিখাটা মিঠুর হাঁসির সাথে তালে তাল মিলিয়ে দুলছে। মিঠু মোমবাতিটা নিয়ে আমার পাশে চেয়ারে এসে বসল। আলোর শিখা দুলছে, আমাদের ছাওয়া দুলছে। দেওয়ালে আমাদের চলমান চলচ্চিত্র চলছে। আমার মনের অবস্থাও মিঠুর হাতের আলোর মতই দোদুল্যমান। প্রেম জাত কুল দেখানা, সময় জ্ঞান তো তার একেবারেই নেই আর তার ওপর স্থান-কাল-পাত্রের তো প্রসঙ্গই ওঠেনা। কি জানি কেন দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম মিঠুর চোখের ভাষা যেন কোনও এক অদৃশ্য টানে আমাকে তার দিকে টানছে। আমার বাস্তব বুদ্ধি যেন কিছুক্ষণের জন্য লোপ পেল। আমি বুঝতে পারছি যে আমি কিছু একটা করতে চলেছি, কিন্তু কিছুতেই যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিনা। আমার চোখ মিঠুর মুখের দিকে স্থির হয়ে গেল। নিঃশ্বাসের বেগ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকল। আমি মিঠুকে জরিয়ে ধরলাম তৎক্ষণাৎ। মিঠু তখনও হাতে মোমবাতিটা ধরে রেখেছে শক্ত করে। মোমবাতির আলো ঘরময় দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। আলো আঁধারির খেলায় আমরা দুজনেই মেতে উঠলাম। ঠিক তখনই বাইরের দরজায় দুলুভাই তার দলবল নিয়ে উপস্থিত হল গ্রামের মনসা পুজোর চাঁদা তুলতে। বাড়িতে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। প্রমথ বাবুর স্ত্রী তখন বোধ হয় পাড়ার মেয়ে বৌদের সঙ্গে ঘাটে গিয়ে গালগল্প করছেন। আমার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। মিঠু আমার বাঁধন ছেড়ে মোমবাতিটা টেবিলে রেখে সদর দরজা খুলতে বেরিয়ে গেল। আমি ব্যালকনি থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম দুলুভাই নিচে মিঠুর সঙ্গে কথা বলছে আর আমার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। পোড় খাওয়া চোখ দুলু ভাইয়ের। আমাদের মত প্রিম্যাচিওর্ড প্রেমিক প্রেমিকার মনস্তত্ত্ব বুঝতে তার কিছুমাত্র বাকি থাকল না। দুলু ভাইয়ের চোখের চাহনির দোদুল্যমানতা যেন আমাকে আপাদমস্তক বারে বারে মেপে নিচ্ছিল। কিন্তু পরক্ষনেই মিঠুর মুখের দিকে তাকাতেই তার চাহনির ধরন বদলে গেল। সে চাহনির মধ্যে যেন রসবোধ খেলে বেড়াতে লাগল। মিঠুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, 'তোর দিলে তো দেখছি মহব্বতের গুল খিলেছে। বলি নাগরটি কে? ওপর ওয়ালা নাকি নিচে ওয়ালা?'
মিঠু দুলু ভাইয়ের কথার কোনও উত্তর দিল না। সে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। দুলু ভাই আরও একবার মিঠুর দিকে বাঁকা ভাবে তাকিয়ে যাবার সময় শুধু মহব্বত কথাটা বেশ কয়েকবার রসিয়ে রসিয়ে ব্যঙ্গাত্মক আকারে উচ্চারণ করতে করতে বেরিয়ে গেল।
এর পরে আরও কয়েকদিন কেটে গেল। পাড়ার মনসা পূজো বেশ ধুমধাম করেই হল। কিন্তু মিঠু আমার সাথে আর কথা বলল না। আমি তো কিছুই করিনি। পরিস্থিতির পাকে পড়ে সব কিছু যেন কেমন গোলমাল হয়ে গেল। কথায় বলে যে বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেয়েছে তার আর মুখে অন্য কিছু রোচে না। আমারও যেন ঠিক তেমনই অবস্থা। পড়াশোনা ডগে উঠল। এই বছরের আই. বি. পি. এস. এর পরীক্ষা তেমন মনের মত হয়নি। জানিনা রেজাল্ট কেমন হবে। পরের বারের জন্য এখনই প্রস্তুতি শুরু করা দরকার। কিন্তু সেটা আর হচ্ছে কোথায়! মিঠুর মুখ ছাড়া তো আর কিছু দেখছি না চারিদিকে। যেদিকে তাকাই শুধু দেখি যেন মিঠু দাঁড়িয়ে আছে। আজ গাছের আড়াল থেকে মিঠুর দিকেই দেখছিলাম। দুলু ভাইয়ের কথায় জানতে পারলাম আমার প্রতি মিঠুর অনীহার কারণ। একটা সহায় সম্বল হীন মেয়ের কাছে সত্যিই এটা একটা খারাপ পরিস্থিতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি বুঝলাম, সেদিন আমি বোধ হয় ঠিক কাজ করিনি। আমার মনের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগল। কিন্তু মিঠুকে সে কথা বোঝাই কেমন করে! প্রাণোতোষকে পড়াতে যেতেও আর ইচ্ছে করছে না। এক সপ্তাহ হল আমি পড়াতে যাইনি। প্রমথ বাবু ইতি মধ্যেই বেশ কয়েকবার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে আমার খবর নিয়েছেন। আমি শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে এখনও পর্যন্ত ব্যাপারটাকে ঠেকিয়ে রেখেছি। এবার বোধ হয় তাঁকে বলে দিতে হবে যে আমি আর পড়াতে যাবোনা। কিন্তু তিনি তো একেবারে নাছোড়বান্দা। কি করে যে তাঁকে বোঝাই! এদিকে অনেকদিন হল মায়ের কাছেও যেতে পারিনি। আমি এখানে থাকাতে বাবার পক্ষেও সপ্তাহান্তে মায়ের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এই সপ্তাহে ঠিক করলাম মায়ের কাছে যাবো। সেই মত সব বন্দোবস্তও হয়ে গেল। এখানে থাকলে শুধুমাত্র মিঠুর কথাই মনে পড়বে। পড়াশোনায় মন বসবে না আর। তাই ঠিক করলাম যদি সম্ভব হয় মায়ের সাথে আলোচনা করে চাকরীর জন্য কোনও ভাল টিউশন নেব। এই বছর চান্স না পেলেও পরের বছরে আমাকে আই. বি. পি. এস. পি. ও. ক্র্যাক করতেই হবে।
পরের দিনই ব্যাগপত্র গুছিয়ে শহরে ফেরবার জন্য প্রস্তুত হলাম। বাবা সবে মাত্র অফিসে বেরিয়েছেন। আমি বই পত্রগুলো আলাদা একটা ব্যাগে ভরছি। আজ সন্ধ্যের ট্রেনের টিকিট আছে। বাবা অফিস থেকে স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। তাই সব কিছু গোছগাছ ফাইনালি করে নিচ্ছি। এমন সময় দেখি মিঠু আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি প্রথমটা মিঠুকে দেখে খুব অবাক হলাম। তারপর তাকে বাড়িত ভিতরে আসতে বললাম। মিঠু আমার কথার কোনও উত্তর দিল না। সে তখনও দরজার সামনেই ঠিক সেই রকম করেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, 'কি হল মিঠু, কথা বলছনা কেন? ভিতরে এসো!'
মিঠু তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি আবার বললাম, 'কি হল, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ভিতরে এসো!'
মিঠু এবারে উত্তর দিল। সে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, 'তু কি বাবু ই গেরাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিস?'
আমি বললাম, 'মোটেই না। আমি তো মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।'
মিঠু বলল, 'কিন্তু হামার মন বলছে তু আর ফিরবি না।'
আমি বললাম, 'এমনটা মনে করার কারণ?'
মিঠু এবার আমার বুকের উপর মাথা রেখে অঝর ধারায় কাঁদতে লাগল। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, 'হামি তোকে বহত মহব্বত করি বাবু। দুলু ভাই ঠিকই বলে, আমি তোকে বহত মহব্বত করি।'
আমি মিঠুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, 'আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি মিঠু। কিন্তু তুমি কাঁদছ কেন? কদিনের জন্য তো যাচ্ছি মাত্র। আবার তো আমি ফিরে আসব। এমন করে কি কাঁদতে আছে?'
মিঠু এবারে আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, 'তু ঠিক ফিরে আসবি তো বাবু?'
আমি বললাম, 'ঠিক ফিরে আসব।'
বিকেলে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছি, তখনও দেখলাম মিঠু দূর থেকে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখের জল মুছছে। আমি হাত নেড়ে ইশারা করে বিদায় জানালাম। কিন্তু মিঠু ঠিক তেমনই পাথরের মূর্তির মতই দাঁড়িয়ে রইল।
২
এর পরে কেটে গেল অনেক দিন, অনেকগুলো বছর। আমি প্রথম বারের আই. বি. পি. এস. পি. ও. ক্র্যাক করতে পারলাম না। দ্বিতীয় বারের আই. বি. পি. এস. পি. ও. তে চান্স পেয়ে আমার মুম্বাই ট্রান্সফার হয়ে গেল। বাবাও আমার চাকরী করবার কয়েকবছর পরেই রিটায়ার্ড করলেন। মায়ের চাকরীর মেয়াদও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমার জীবন এক নতুন ছন্দ খুঁজে পেল। চাকরীর ব্যস্ততা আমাকে আমার অতীতের ছোট খাটো স্মৃতি থেকে অনেক দূরে নিয়ে চলে গেল। এক কথায় বলতে গেলে আমার জীবনটা প্রায় একপ্রকার রোবটের মত হয়ে গেল। অফিসে দম বন্ধ করা প্রেশার আর বাড়িতে ফিরেও অন্য কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না। সারাদিনের ক্লান্তিতে অন্য কাজে মনই বসাতে পারিনা। চাকরী পাবার আগে জীবনটাকে যত সহজ বলে মনে করতাম, এখন আর জীবনকে সেভাবে দেখতে পাই না। কর্মময় জীবন আমার জীবন বোধের অর্থটা একেবারে পালটে দিয়েছে। এখন মনে হয় জীবনটা ডেবিট আর ক্রেডিট ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রফিট আর লসের হিসেব কষতে কষতে কেমন যেন স্বার্থপর হয়ে পরছি দিনে দিনে। শরীরে পোশাকের চাকচিক্যের আড়ালে যেন জীবনের ক্লান্তিকে ঢেকে রেখেছি। এই কয়েক বছরের চাকরী জীবনেই যেন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছি। মুম্বাইতে থাকা খাওয়ার খরচ কম নয়। শহর থেকে একটু দুরেই থাকতে হয়। বাড়ি ভাড়া একটু কম হয়। কোলকাতায় ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করে রেখেছি। কিন্তু চার বছরের আগে হবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে বাড়িতে বাবা আর মা আমার বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দেখাশোনা প্রায় পাকাও হয়ে গেছে। আসছে অগ্রহায়ণে আমার বিয়ে। সত্যি কথা বলতে কি এই কয়েক বছরে আমার একবারের জন্যও সেই গ্রাম্য মেয়েটির কথা মনে হয়নি। আমার মনের কোনও এক কোণে বিচ্ছিন্ন এক ঘটনার মত কোথাও হয়তো অগোছালো, এলোমেলো স্মৃতির ভিড়ে সে হারিয়ে গিয়েছে। আমার মনে হয় আমি তাকে আসলে কখনও ভালই বাসিনী। আমি হয়তো তাকে আমার সাময়িক মোহের বসেই পেতে চেয়েছিলাম। ভালোবাসা আমার কোনও মেয়ের সঙ্গেই কোনদিন হয়নি। প্রেমে আমি কখনই পড়িনি। সত্যি কথা বলতে গেলে ছেলেবেলা থেকে জীবনের ঘোড়দৌড়ে এসব কথা ভেবে দেখার মত সময়ও আমি পাইনি। কিন্তু একমাত্র মিঠুই ছিল আমার জীবনে একমাত্র নারীসঙ্গ। কিন্তু তাকেও তো আমি ভালবাসতে পারিনি। আমার মনে তার কোনও স্থানই আজ নেই। ভালবাসলে সে নিশ্চয়ই আমার মনের কোনও এক গোপন সঙ্গোপনে থাকত। কিন্তু আমার তো সেই গ্রাম ছেড়ে চলে আসার পরে তার কথা এক বারের জন্যও মনে পড়েনি! কিন্তু যেদিন আমি শেষ বারের মত গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিলাম, যখন দূর থেকে মিঠুকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছিলাম তখনও পর্যন্ত আমি মিঠুর চোখে যেটা দেখেছিলাম সেটা তো প্রেম ছাড়া আর কিছুই নয়! না, শুধু প্রেম বললে ভুল হবে প্রেমের থেকেও যদি বড় শব্দ কিছু থেকে থাকে সেটা হল মিঠুর কথায় মহব্বত। মিঠু কি আজও আমাকে মনে রেখেছে? নাকি আমার মত সেও সব কিছু ভুলে গেছে? জানিনা। আমি তো জানবার কখনও চেষ্টাই করিনি। এত বছর পরে কেন জানিনা আমার হঠাৎ মনে হল যে আমার অন্তত একবারের জন্য হলেও মিঠুর একটা খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আমি তো তাকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি তার কাছে ফিরে যাবো। আমার তো আর ফিরে যাওয়া হয়নি। মিঠুও হয়তো আমাকে আমারই মতই ভুলে গেছে। এতগুলো বছরে কত কিছুরই তো পরিবর্তন হয়ে গেছে। মিঠুও হয়তো কারোর সাথে নতুন করে সংসার পেতেছে অথবা অন্য কারোর সাথে আবার তার মহব্বত হয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে আরও কতগুলো দিন কেটে গেল। গতানুগতিক কাজের মধ্যে আমি মিঠুর কথা আবার ভুলে গেলাম। আমার বিয়ে হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, বছর চারেকের মধ্যে আমার কোলকাতায় ট্রান্সফারও হয়ে গেল। আমার চাকরীতে পদোন্নতিও হল। একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানও হল। বলতে গেলে আমার জীবন যেন ষোল কলায় পূর্ণ হয়ে উঠল। স্ত্রী-পুত্র-বাবা-মা আর চাকরী নয়ে আমি বেশ রসেবসেই ছিলাম।
একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম টেবিলে রাখা একটি বিয়ের কার্ড। কার্ডটি হাতে তুলে নিলাম। শুভ পরিণয় শ্রীমান প্রাণোতোষ ভট্টাচার্যের সহিত অনন্যা চক্রবর্তীর। অনন্যা নামটি আমার পরিচিত কারোর নয়। কিন্তু প্রাণতোষ নামটি আমার কাছে খুব চেনা চেনা বলে মনে হল। কার্ডটি আরও একটু পড়ে দেখলাম, পিতার নাম স্বর্গীয় প্রমথ ভট্টাচার্য। নামটি পড়েই আমার বুকের মধ্যে যেন এক ঝাঁক দমকা বাতাস এসে আমার গলা চেপে ধরে আমার শ্বাস রোধ করে তুলল। প্রমথ বাবু তাহলে আর বেঁচে নেই! বাবার কাছ থেকে শুনলাম প্রাণোতোষ নিজে এসেছিল তাদের তার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে। এই তো সেদিনের ছোট্ট ছেলেটি। এর মধ্যেই তার বিয়ের বয়স হয়ে গেল! দিন গুলো যেন নদীর স্রোতের মত বয়ে চলেছে। কোথা দিয়ে যে এতগুলো বছর হুস করে বেরয়ে গেল ঠিক মত বুঝতেই পারলাম না। কার্ডটি যতবার আমার চোখের সামনে এলো ততবার আমার মিঠুর কথা মনে পড়ে গেল। নিজেকে বড় স্বার্থপর বলে মনে হতে লাগল আমার। জীবনে কখনও কোনও অপরাধ করেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই। আমার মধ্যে একটি অপরাধ বোধ যেন আমাকে ভিতর থেকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগল। আমার খুব ইচ্ছে করল মিঠুকে একবার দেখতে। তাকে তো আমি কথা দিয়েছিলাম যে আমি আবার তার কাছে ফিরে আসব।
আমি অফিস থেকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে নিলাম। বাবা মার বয়স হয়েছে। এতদূরের ধকল সহ্য হবে না। আমাদের ছেলেটি খুবই ছোট। তাই আমার স্ত্রীর পক্ষেও সম্ভব হলনা আমার সঙ্গে যাওয়ার। অগত্যা আমাকে একলাই যেতে হল প্রাণোতোষের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। কত বছর পরে আবার সেই গ্রামে ফিরলাম। ষ্টেশনে নেমে আমার চোখ গিয়ে পড়ল দুরের সেই জায়গাটার দিকে যেখানে শেষ বারের মত আমি মিঠুকে দেখেছিলাম। আমার মুখে অস্ফুটেই যেন বেরিয়ে এলো, এই তো মিঠু আমি ফিরে এসেছি। সেদিনও এমনই সময়ে মিঠুকে আমি শেষ বারের মত বিদায় জানিয়ে ছিলাম। মিঠু দাঁড়িয়ে ছিল পাথরের মূর্তির মত। বিকেল গড়িয়ে ধীরে ধীরে সন্ধের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। গ্রাম্য পথ ধরে আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। আমি অনুভব করলাম আমার জীবনটা যেন অনেকাংশেই মেকানিক্যাল হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি প্রাণোতোষদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির গেটের সামনে সামিয়ানা, সানাইয়ের সুরের মূর্ছনা আর অগণিত মানুষের ভিড়ের মধ্যে আমার চোখ শুধু একজনকেই খুঁজে বেড়াতে লাগল। মিঠু। মিঠু কোথায়? আমি কোথাও মিঠুকে খুঁজে পেলাম না। আমি গেটের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুধু মাত্র একজনকেই খুঁজে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। এমন সময় প্রমথ বাবুর স্ত্রী আমাকে দেখে চিনতে পেরে আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। কিন্তু আমি আমার চোখে শুধু মাত্র একটিই জিজ্ঞাসা নিয়ে তাঁর চোখের দিকে তাকালাম। তিনি হয়তো আমার জিজ্ঞাসা বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, 'মিঠু আর নেই'।
আমি বললাম, 'আর নেই মানে? কোথায় সে?'
'মিঠু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।'
'কোথায় গেছে?'
'সে আমাদের ছেড়ে চিরকালের মত চলে গেছে।'
আমার বুকের মধ্যে আবার যেন এক ঝাঁক বাতাস চেপে বসে আমার গলা চেপে শ্বাস রোধ করতে শুরু করেছে। আমি বললাম, 'কিকরে?'
প্রাণোতোষ বাবুর স্ত্রী বললেন, 'সে সব অনেক কথা।'
আমি বললাম, 'আমি সব শুনব। আমাকে সব কথা বলুন। আমাকে যে শুনতেই হবে।'
'এই পরিস্থিতিতে এতসব কথা বলা সম্ভব নয়, আপনি অনেক দূর থেকে আসছেন। আজকের রাত্রিটা থাকুন, কাল সব বলব।'
প্রমথ বাবুর স্ত্রী আমাকে বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। আজ তাঁর একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। তাঁর দায়িত্ব প্রচুর। আমি কি সত্যিই স্বার্থপর? আজকের মত এমন একটা দিনে আমার বোধ হয় এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করা উচিৎ হয়নি।
আমি আর মিঠুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম না। পরের দিন বিকেলের ট্রেনে আমি ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় প্রমথ বাবুর স্ত্রী আমার সামনে চেয়ারে এসে বসলেন। তিনি বললেন, 'মিঠু কিন্তু আপনাকে সত্যিই খুব ভালবাসত।'
জুতোর ফিতেটা অর্ধেকটা বেঁধে আমি স্থির হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। কিন্তু তাঁর কথায় বাধা দেবার মত চেষ্টা করলাম না। প্রমথ বাবুর স্ত্রী বলতে লাগলেন, 'আপনার আর মিঠুর সম্পর্কে আমি আপনি চলে যাবার পরে মিঠুর কাছ থেকেই জানতে পারি। দুলু ভাই আপনার প্রসঙ্গ নিয়ে মিঠুকে যারপরনাই উত্তপ্ত করত। কিন্তু মিঠুর মনে স্থির বিশ্বাস ছিল যে আপনি ঠিক তার কাছে ফিরে আসবেন। আপনি তো মিঠুকে কথা দিয়েছিলেন তাই না?'
আমি মাথা নিচু করে ঠিক সেই রকমই বসে থাকলাম। আমার ভিতর থেকে একটা অপরাধ বোধ যেন আমাকে সেখান থেকে তাড়া করে অনেক দূরে ছুটে চলে যেতে ইশারা করছিল। আমি সেই রকমই স্থির হয়ে বসে থাকলাম। আমার সব কিছু শোনা দরকার।
প্রমথ বাবুর স্ত্রী বলতে থাকলেন, 'দুলু ভাইকে তো আপনি জানতেন, সে মোটেই ভালো লোক ছিল না। খুন, চুরি, ডাকাতি থেকে শুরু করে এমন কোনও গর্হিত অপরাধ বোধ হয় নেই যা সে করেনি। মিঠুর চোখ ধাঁধানো রূপে আপনি যেমন পাগল হয়েছিলেন, ঠিক সেই রকমই অনেকেই তার রূপে পাগল ছিল। মিঠু কিন্তু একমাত্র আপনাকেই ভালবেসেছিল। আপনি চলে যাবার পর থেকেই সে আপনার বাবার কাছ থেকে আপনার সমস্ত খোঁজ খবর নিত। সে জানত যে আপনি চাকরীর জন্য পড়াশোনা করছেন। সেকথা শুনে সে মনে মনে বড় খুশি হয়েছিল। তার বুকে আশা ছিল, আপনি চাকরী পেয়ে নিশ্চয়ই তার কাছে ফিরে আসবেন। আমাকে সে সব কথাই বলত। আমি ছাড়া এ জগতে তার আর কেউ ছিল না যে! সে তো পাগলী এটাও জানত না যে যাকে সে মন উজাড় করে ভালবেসেছে, সে বেমালুম তাকে ভুলেই গেছে। দুলু ভাইয়ের মত মানুষের মুখের উপর সে বলত, 'হামার মহব্বত যার তার জন্য নয় রে। আমার মহব্বতের মানুষ হামার কাছে একদিন ফিরবে, হামাকে বিহা করবে।' কিন্তু যেদিন আপনার চাকরী পেয়ে মুম্বাই ট্রান্সফারের খবর সে আপনার বাবার কাছ থেকে শুনল, সেই দিনেই সে বুঝে গিয়েছিল যে আপনি আর কোনদিনই তার কাছে ফিরবেন না। যদি ফিরতেন, তাহলে নিশ্চয়ই যাবার আগে একটি বারের জন্যও তার খোঁজ করতেন। আমরা গ্রামের মানুষ বাবু, সরল সিধা হতে পারি, কিন্তু একেবারে বোকা নই। আপনার চলে যাবার খবর পেয়ে মিঠু একেবারে মন থেকে ভেঙে পড়ল। দুলু ভাইয়ের কানেও খবরটা গেল। মিঠু তো আপনাকে ভালবেসে বদনাম হয়েই ছিল, তার উপর আপনার উপেক্ষা তাকে আরও বেশী করে বদনামের ভাগীদার করে তুলল। দুলু ভাই একদিন সুযোগ বুঝে মিঠুকে মাঝ রাতে তুলে নিয়ে গিয়ে তার উপর অত্যাচার করল, তাকে ধর্ষণ করল। পোড়ামুখী আর কাউকে মুখ দেখাতে সাহস পেল না। সেই রাতেই সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল। আমার স্বামী নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না। সকাল বেলায় তাঁর দলবল নিয়ে গিয়ে দুলু ভাইকে নিজের হাতে খুন করলেন। বিচারে তাঁর ফাঁসির সাজা হল। আপনারা শহুরে মানুষ বাবু। আপনারা হয়তো আমাদের মত অনুভূতিপ্রবণ নয়। মিঠু আপনাকে কোনদিনই বিরক্ত করতে চায়নি। সে যে আপনাকে প্রকৃত ভালবেসেছিল। কিন্তু আমার মনে হয় আপনাকে অন্তত একবারের জন্য হলেও মিঠুর নিঃস্বার্থ ভালবাসার এবং আপনার জন্য তার নীরব স্বার্থত্যাগের কাহিনী জানানো প্রয়োজন। সেই কারণেই আজ আপনাকে এতদূরে কষ্ট দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছি। আমি জানতাম, আপনি অবশ্যই আসবেন।'
৩
সেদিন আমি যেটা করেছিলাম, সেটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের মত মানুষেরা যারা কিনা একটু উচ্চমানের জীবন যাপন করে, তারা বোধ হয় নিচুস্তরের মানুষদের মানুষ বলে মনেই করে না। মিঠুর মত সহায় সম্বল হীন, আনস্মার্ট একটি মেয়েকে ভালবাসার আশ্বাস দেওয়া যায়, কিন্তু ভালবাসা যায় না। লোকচক্ষুর আড়ালে মিঠুর মত সরল সিধে মেয়েকে নিয়ে প্রেমালাপ করা যায়, কিন্তু তাকে সমাজে জীবন সঙ্গী বলে পরিচয় দেওয়া যায় না। লজ্জা। এতো লজ্জা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু একটি মেয়ে যে কিনা আমার জন্য তার শেষ সম্মান টুকু বিসর্জন দিতে পারে, যে কিনা একটি বারের জন্যও তার মহব্বতের প্রতিদান দাবি না করে নীরবে সমস্ত অপমান মুখ বুজে সহ্য করতে পারে তার কাছে আমি নীচ ছাড়া আর কি! সমাজের আদালতের কাঠগড়ায় যদি আমাকে দাঁড় করানো হয়, তাহলে ফাঁসির থেকেও জঘন্য সাজা যদি কিছু থেকে থাকে সেটি আমাকে দেওয়া উচিৎ। আমি যে ভদ্র সভ্য সমাজের কলঙ্ক।
বিকেলের ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনের দিকে রওনা হওয়ার সময় আমি শেষ বারের জন্য পিছনের দিকে ফিরে তাকালাম। সন্ধ্যের কালো ছায়া ইতিমধ্যেই বিকেলের শ্বাস রোধ করে তাকে হত্যা করে পরিবেশকে তার করাল গ্রাসে আচ্ছাদিত করতে শুরু করেছে। আমি আমার কল্পনার চোখে দেখলাম মিঠু যেন ঠিক সেদিনের মতই আমার দিকে তাকিয়ে তার আঁচলে চোখের জল মুছছে। দূরের দিকে হাত নেড়ে আমি ইশারা করলাম। বললাম, আমি চলে যাচ্ছি মিঠু। আমি আর কখনও ফিরে আসব না। যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও।

