STORYMIRROR

Sourav Nath

Crime

4  

Sourav Nath

Crime

রহস্য

রহস্য

10 mins
3


সেই সন্ধ্যে থেকেই ঝড়ের দাপট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।  আজ রাতে বোধ হয় একেবারে রুদ্ররূপ ধারণ করবে।  কাঠের দরজার ফ্রেমে ঝড়ের করাঘাতে শিকলটা বারে বারে ঝন ঝন করে উঠছে।  সন্ধ্যে থেকে অনেক বারই ভ্রমিত হয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখতে গিয়েছি এই বুঝি সত্যি সত্যি কেউ দরজায় করাঘাত করছে।  কিন্তু প্রতি বারেই হতাশ হয়ে আবার ফিরে এসে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়েছি।  এত ঝড়ে এই শীতের রাতে কেই বা আর এখানে আসবে!  আর তাছাড়া আমারই বা কিসের এত প্রতীক্ষা?  তবে কি এখনও আমি কারও প্রতীক্ষা করে চলেছি!


কখনও চোখ বন্ধ করে আবার কখনও বা চোখ খুলে নিস্তব্ধ প্রকৃতির বুকে পরিচিত কোনও পদক্ষেপের প্রতীক্ষা করে চলেছি।  টেবিলের উপর সাদা পাতাগুলো বুক পেতে নিরলস প্রতীক্ষা করে চলেছে কলমের আঁচড়ে নিজেদের ক্ষত বিক্ষত করে তুলতে।  শুধু কি তাই!  অন্য ভাবে বলতে গেলে কলমের আঁচড়েই হয়তো সাদা পাতার শূন্য জীবন পূর্ণতা পেয়ে অলঙ্কারে সাজে উঠবে।  আসলে সব কিছুরই কিছু না কিছু ভালো মন্দ উভয় দিকই থাকে।  শুধু দেখাটা নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির উপর।


মাঝে মাঝে আমি আমার নিজের জীবনটাকেও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখবার চেষ্টা করি।  কিন্তু কিছুতেই কোনও উত্তর মেলাতে পারি না।  প্রতিটা মানুষেরই জীবনে একটি করে গোপন রহস্য থাকে যার গোপনীয়তা একমাত্র সে ছাড়া আর কেউ কখনই জানতে পারেনা।  আসলে কাউকে সে রহস্য জানতে দেওয়া যায় না।  সারাটা জীবন ধরে মানুষ সেই গোপন রহস্যকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখবার এবং নানা যুক্তিসঙ্গত উপায়ের মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে করতে কখন যে পুরো জীবনটাকেই কাটিয়ে দেয় সে কথা বোঝাই যায় না।  জীবনটা যেন ঠিক জানালার কাঁচে জমে থাকা বরফের মত।  বরফগুলো যেমন আপ্রাণ চেষ্টা করছে কাঁচের গায়ে লেপটে থাকার জন্য, আমরাও হয়তো কোনও কিছুকে ঠিক সেভাবেই আপ্রাণ আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করে চলেছি। 


মাঝে মধ্যে মাথার ভিতরটা যেন সমস্ত কিছু ফাঁকা হয়ে ওঠে।  সমস্ত চিন্তা যেন বাতাসে উবে গিয়ে আবার ফিরে যেতে চায় সেই কিছু চাওয়া ও না পাওয়ার দুনিয়ায় যেখানে কিছু চরিত্রেই চলমান চালচিত্র যেন সেই বিচ্ছেদের শেষ মুহূর্তেই আটকে থাকতে চায়।  হয়তো তার নিজস্ব পূর্ণতার আশায়।  কিন্তু সমস্ত স্বপ্ন কি পূর্ণতা পায়!  নিদ্রা ভঙ্গের পরে কত শত স্বপ্নই তো অব্যক্তই রয়ে যায়, ঠিক যেমন কাঁচের বুক থেকে খসে পড়া বরফ ধীরে ধীরে পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করে নিয়ে অন্ধকারে পাহাড়ের বুকে মুখ লুকচ্ছে। 


কিন্তু আমি জানি, আমার মন বলছে যে এভাবে আমার গল্পের শেষ কিছুতেই হতে পারে না।  সেই কারণেই হয়তো আমি এখনও নিরলস প্রতীক্ষা করে চলেছি।  জানি, আমি যা করেছি সেটা ক্ষমার অযোগ্য।  তাইতো আমি এখানে এক পাণ্ডব বর্জিত স্থানে একাকী নিজেকে যেন প্রতি নিয়ত বন্দী করে রেখে প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি।


সেই সকালে শিম্বা এসে রান্না করে রেখে গেছে।  তিন দিন ধরে এক নাগাড়ে তুষার ঝড় হয়ে চলেছে।  তার সত্ত্বেও যে শিম্বা এক বেলা করে আসছে, তাতেই আমি কৃতার্থ।  কত বছর যে এখানে আছি তার আর হিসেব রাখি না।  তবে বহু বছর যে হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।  তবে এত বছরেও আমার মন এতটা বিচলিত কিছুতেই হয়নি ঠিক যতটা আজকে হচ্ছে।  জানিনা, আজকে কোনও অঘটন ঘটতে চলেছে কিনা।  তবে কোনও এক অব্যক্ত কারণে আমার মন যেন বার বার আমাকে বিচলিত করে তুলছে। 


ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত্রি বারোটা পার হয়ে গিয়েছে।  একা একা থাকলে মন বিচলিত হওয়াটা স্বাভাবিক।  অবশেষে আরাম কেদারাটা ছেড়ে উঠে বসলাম।  শীতের রাতে রক্ত জমে যেন একেবারে বরফ হয়ে যাচ্ছে।  এক পাত্র হুইস্কি চরিয়ে দিলেম।  তাতেও ঠিক পোষাল না।  আরও দু পাত্র চরিয়ে দিলাম।  মনে হল রক্তের বেগটা যেন আগের থেকে একটু ত্বরান্বিত হল।  শরীরে কিছুটা উষ্ণতা অনুভব করলাম।  তারপর আরাম করে বিছানায় শরীরটাকে ছড়িয়ে দিলাম।  শীতের রাতে এলকোহলের আবেশে ঘুম আসতে দেরীও হলনা কিছু মাত্র। 



রাত তখন কত হবে ঠিক মত আন্দাজ করতে পারলাম না।  অন্ধকারে হাতড়ে ফোনটা খুঁজতে লাগলাম।  কিন্তু পেলাম না।  হয়তো টেবিলের উপরে রেখেই শুয়ে পড়েছি।  কিছুক্ষণ অন্ধকারে চোখটা সয়ে গেলে আন্দাজ মত সুইচের দিকে হাত বাড়িয়ে আলোটা জ্বালাবার চেষ্টা করলাম।  কিন্তু কোনও ফল হলনা।  লোডশেডিং হয়ে আছে।  দিনের বেশিরভাগ সময়েই লোডশেডিং হয়ে থাকে।  এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কি আছে!  অন্ধকার আরও কিছুটা হাতড়ে টেবিল থেকে ফোনটাকে খুঁজে বের করলাম।  দেখলাম, রাত প্রায় দুটো বাজে।  আরও একটু কান পেতে দরজায় শব্দটা শোনার চেষ্টা করলাম।  হয়তো এবারেও বাতাসের ঝাপটায় দরজায় আঘাত হচ্ছে।  কিন্তু এবারের আওয়াজটা যেন একটু অন্য রকম বলে মনে হচ্ছে।  বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, দরজায় কেউ বাইরে থেকে ভারী হাতে আঘাত করছে।  হাড় হিম করা এই তুষার ঝড়ের রাতে কোনও স্বাভাবিক বুদ্ধির মানুষ তো ঘর থেকে বেরোবার কথা কল্পনাও করতে পারবে না।  তার উপর এমন নির্জন স্থানে হঠাত করে কারোর এসে পড়াটাও খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।  আর তাছাড়া এত রাতে আমার সাথেই বা কার কি প্রয়োজন থাকতে পারে। 


তবুও দ্বিধাগ্রস্ত মনেই ধীরে ধীরে দরজার দিকে পা বাড়ালাম।  হিমশীতল ছিটকিনির গায়ে হাত দিতেই বাইরের ঠাণ্ডার পরিমাণ বেশ কিছুটা  আঁচ করতে পারলাম।  ফায়ার-প্লেসের আগুনটা কখন যে নিভে গেছে বুঝতেই পারিনি।  নিকষ কালো অন্ধকারের সাথে আমার মোবাইল ফোনের মৃদু আলো যেন প্রচণ্ড লড়াই করে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।  অনুভব করলাম, ঠাণ্ডায় আমার হাতের আঙ্গুলগুলোও যেন কিছুটা অসাড় হয়ে গেছে।  ছিটকিনির উপর কিছুটা জোরে চাপ দিতেই খুট করে একটা মৃদু শব্দ তুলে ছিটকিনি খুলে গেল।  যেন মনে হল নিশ্ছিদ্র অন্ধকারময় নিঝুম রাতে নিরবিছিন্ন ঘুমে আঘাত ঘটায় ছিটকিনিটা মৃদু আপত্তি জানাল। 


আমাকে আর কষ্ট করে দরজা খুলতে হল না।  ক্ষণিকের মধ্যেই হাওয়ার একটা প্রচণ্ড দাপটে দরজার পাল্লা দুটো এক ঝটকায় খুলে জেতেই দমকা হাড় হিম করা ঠাণ্ডা বাতাস যেন ক্ষণিকের মধ্যে আমাকে প্রবল বেগে আক্রমণ করল।  অকস্মাৎ হাওয়ার বেগে আমি বেশ কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়লাম, হয়তো রাতে মাত্রাতিরিক্ত হুইস্কির প্রভাবও হতে পারে।  তবুও যাহোক নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে চোখের সামনে হাত দিয়ে হাওয়ার বেগকে কিছুটা প্রতিহত করবার চেষ্টা করে আমি দেখলাম মাথায় হ্যাট আর ওভার কোট পরিহিত এক ভদ্রলোক আমার দরজার সামনে দণ্ডায়মান।  বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করলাম ভদ্রলোককে চেনবার।  কিন্তু তাঁকে আমার কিছুমাত্র পূর্বপরিচিত বলে মনে হল না।  দেখলাম ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই আপাদমস্তক ভিজে একেবারে জবজবে হয়ে আছেন।  তবুও যেন তিনি কিছুমাত্র বিচলিত নয়। 


আমি কিছু জিজ্ঞেস করে ওঠবার আগেই তিনি নিজেই বলে উঠলেন, 'ভিতরে আসতে পারি?'

    

যদিও ভদ্রলোককে আমার পূর্ব পরিচিত বলে মনে হল না।  তবুও এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তুষার ঝড়ের রাতে যদি কেউ গৃহদ্বারে আশ্রয় চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তো আর তাকে কোনও মতেই ফেরানো যায় না।  তাই কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই বললাম, 'আসুন!'



গোল টেবিলের মাঝখানে ফোনের আলোটা জ্বেলে রাখলাম।  অন্ধকার ঘরে টেবিলের দু প্রান্তে আমাদের মুখগুলো যেন জীবন্ত প্রেতমূর্তির মত জেগে আছে।  ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি আপাদমস্তক ভিজে গেলেও সাবলীল ভঙ্গীতে পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছেন।  এই হিমশীতল ঠাণ্ডা যেন তাঁকে কিছুমাত্র বিচলিত করতে পারছে না।


ফায়ার প্লেসে আগুনটা আবার জ্বালালে ভালো হত।  কিন্তু শুকনো কাঠ শেষ হয়ে গেছে।  কাল সকালে শিম্বা কাঠ নিয়ে আসবে।  অগত্যা আর কোনও উপায় নেই।


আমি গলায় মৃদু আওয়াজ তুলে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলাম।  কিন্তু তার আগেই আগন্তুক আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলে উঠলেন, 'তাহলে ফ্লোরেন্সের মৃত্যুটা কি সত্যিই স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল?'


এই অবস্থায় আমি ভদ্রলোকের কাছ থেকে ঠিক এমন একটা প্রশ্ন কিছুতেই আশা করতে পারিনি।  তবে ফ্লোরেন্সের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার কারণে আমি অকস্মাৎ চমকিত হলাম।  ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার স্মৃতিশক্তির পাতা ওলটপালট করেও কিছুতেই আমার ভদ্রলোককে পূর্বপরিচিত বলে মনে হল না।


আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভদ্রলোক আবার বলে উঠলেন, 'তাহলে কি ধরে নিতে পারি যে, আসলে সেটা ছিল একটা কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার?'


এবারে আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।  আমি অবিলম্বে বলে উঠলাম, 'না না, তা হতে যাবে কেন?  ওটা তো আসলে একটা দুর্ঘটনা ছিল।'


ভদ্রলোক এবারে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, 'তাহলে তার ব্লাডে পয়জেন এলো কোথা থেকে?'


আমি এবারে একটু থতমত হয়েই বললাম, 'সে কথা তো আমি বলতে পারব না।'


ভদ্রলোক এবারে টেবিল চাপড়ে বলে উঠলেন, 'আমাকে দেখে কি আপনার আহাম্মক বলে মনে হয়?'


আমি বললাম, 'সে কি, সেকথা আমি কখন বললাম?'


ভদ্রলোক এবারেও বেশ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, 'তাহলে পরিষ্কার করে ঘটনাটা কেন খুলে বলছেন না?'


এবারে কেন জানিনা আমি অকস্মাৎ এক ঘোরের জগত থেকে বেরিয়ে এলাম।  আমার মনে হল ভদ্রলোক আসলে কে, কোথা থেকেই বা এসেছেন, আর আমি কেনই বা তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছি? 


এতগুলো প্রশ্ন একসাথে মাথার মধ্যে এসে জট পাকিয়ে গেল।  আমি একসাথে সবগুলো প্রশ্ন করতে না পেরে শুধু এক ঝটকায় জিজ্ঞেস করে উঠলাম, 'আপনি কে?'


ভদ্রলোক আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলেন না।  তিনি নির্বিকার ভাবে তাঁর ওয়েস্ট কোর্টের পকেট থেকে চুরুটের কেসটা বের করে একটা চুরুট ধরিয়ে শান্ত স্বরে আবারও একটি প্রশ্ন করলেন, 'আপনি মার্গারেটকে কেন হত্যা করলেন, সে তো নির্দোষ ছিল।'


ভদ্রলোকের প্রশ্নগুলো শুনে আমার আর সাহস হল না তাঁর পরিচয় জানতে।  তবে এটুকু অবশ্যই বুঝতে পারছি যে, ভদ্রলোক আমার সম্পর্কে এমন কিছু জানেন যা অন্য কারো পক্ষেই জানা অসম্ভব।  তবে মার্গারেটের প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মুখ থেকে যেন কোনও শব্দ বেরোতে চাইল না।  আমি জানি, মার্গারেট সত্যিই নির্দোষ ছিল।  কিন্তু মার্গারেটকে হত্যা না করে আমার কোনও উপায় ছিল না।  কারণ শেষ পর্যন্ত সে সমস্ত কিছু জেনে ফেলেছিল।  মার্গারেটের বিকলাঙ্গ শরীরে একমাত্র সজীব ও প্রাণবন্ত দুটো চোখই ছিল সম্বল।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই দুটো চোখই ওর সর্বনাশের কারণ হল।  আমি যখন ফ্লোরেন্সের খাবারে বিষ মেশাচ্ছিলাম, তখন মার্গারেট আমাকে দেখে ফেলেছিল।  আমি জানতাম যে মার্গারেটের পক্ষে কাউকে সে কথা বলা সম্ভব ছিলনা।  কারণ সে শারীরিক দিক থেকে ছিল সম্পূর্ণ বিকলাঙ্গ, সামান্য কথাটুকুও সে বলতে পারত না।  তাই যখন আমি তাকে গলা টিপে হত্যা করছিলাম, তখন সে শুধু নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে ছিল।  মার্গারেট যদি বেঁচে থাকত, তাহলে আমি কোনও দিনই তার চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না।  কিন্তু আজও যেন মার্গারেটের শেষ মূহুর্তের চাহনি আমাকে তাড়া করে বেরায়।


ভদ্রলোক আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার আমাকে প্রশ্ন করলেন, 'ফ্লোরেন্সকে তো আপনি সত্যিই ভালোবাসতেন, তার প্রতি তো অতটা নিষ্ঠুর না হলেও পারতেন।'


ভদ্রলোকের প্রশ্নে আমি তাঁর চোখের দিকে এক পলক তাকালাম।  কি গভীর সে চোখের দৃষ্টি।  যেন আমার বুকে ভেদ করে সমস্ত রহস্য এক নিমেষের মধ্যে উদ্ঘাটন করে আনতে চাইছে।  তিনি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।  সে চাহনির সামনে মাথা নত করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। 


আমি আমার অজান্তেই মাথা নত করে ফেললাম।  আমার মনে হল সেদিন হয়তো ফ্লোরেন্সের প্রতি অতটা নিষ্ঠুর না হলেই ভাল হত।  ফ্লোরেন্সকে তো আমি সত্যিই ভালবাসতাম।  শুধু তাই নয়, ফ্লোরেন্সকে আমি আজও ভালোবাসি।  কিন্তু অত্যন্ত ভালোবাসার মানুষটি যখন অপরজনের মুখোসের আড়ালে থাকা মানুষটা চিনে ফেলে, তখন তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে না দিয়েই বা উপায় কি থাকে।  আমি ফ্লোরেন্সকে কিছুতেই হত্যা করতাম না যদিনা সে আমার ও সোফিয়ার অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনে ফেলত।  যদিও ফ্লোরেন্স একদিনের জন্যও আমার কাছ থেকে কোনও কৈফিয়ত চায়নি।  সে শুধু মাত্র মুখ লুকিয়ে কাঁদত।  গভীর রাতে তার কান্নার ফোঁপানি যেন আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।  আমি ফ্লোরেন্সকে হত্যা করেছিলাম, কারণ আমি তাকে ভালবাসতাম।  আর ভালোবাসার মানুষ যখন নিঃশব্দে শাস্তি দেয়, সে শাস্তির ভার বহন করা মোটেই সোজা কথা নয়।  ফ্লোরেন্স যদি আমাকে ঘৃণা করত, যদি আমাকে ভর্তসনাও করত, তাহলে হয়তো আমি কিছুতেই তাকে হত্যা করতাম না।  কিন্তু ফ্লোরেন্স তা না করে আমাকে নীরবে শাস্তি দিয়ে চলেছিল।  এই বিবেকের দংশন আমার পক্ষে আর সহ্য করা কোনও মতেই সম্ভব হচ্ছিল না।  তাই আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন ফ্লোরেন্সের খাবারে বিষ মেশাতে বাধ্য হয়েছিলাম।  আমি জানি ফ্লোরেন্স শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল যে আমি তাকে হত্যা করতে চলেছি, তবুও সে সেদিন নির্বিকারে শেষ বারের মত আমার হাত থেকে খাবার গ্রহণ করেছিলো।  ফ্লোরেন্সকে কি আমি শুধুমাত্র হত্যা করেছি!  ফ্লোরেন্স সব কিছু জেনেও আমার হাত থেকে শেষ বারের মত খাবার গ্রহণ করেছিলো।  এটাকে তো অপরপক্ষে আত্মহত্যাও বলা যেতে পারে। 


ভদ্রলোকের চুরুট ততক্ষণে প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।  তবুও চুরুটের শেষ অংশটাকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে তিনি আমাকে আবারও প্রশ্ন করলেন, 'আর শেষ মেশ সোফিয়াকেই বা আপনি হত্যা করলেন কেন?'


ভদ্রলোকের একেকটা প্রশ্ন বাণে যেন আমি জর্জরিত হয়ে পরতে লাগলাম।  কিন্তু কিভাবে যে তিনি এতসব কিছু জানলেন, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না।  তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেবার মত শক্তি আমার শরীরে ছিল না।  আর তঁর গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবার মত সাহসও আমার মধ্যে ছিল না।  আমি এতক্ষণ পর্যন্ত ভদ্রলোকের একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিইনি।  তবুও তিনি যেন আমার মনের মধ্যে চলতে থাকা ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারছেন।  এবারে যেন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।  আমি প্রচণ্ড রাগে, তীব্র ঘৃণায় চিৎকার করে উঠে বললাম, 'কারণ সোফিয়াকে আমি কখনই ভালোবাসোতে পারিনি।  সে আমার জীবনে সাময়িক মোহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।  এই নির্জন পাহাড়ে তাকে নিয়ে যখন একাকী আবার নতুন করে সংসার পাততে এলাম, তখন বুঝলাম যে ফ্লোরেন্সের স্মৃতি যেন কিছুতেই  আমাকে সোফিয়ার কাছে যেতে দিতে চাইছে না।  আমি সব কিছু থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে অবশেষে সোফিয়াকেও পাহাড়ের খাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম।  আমি অবশেষে সোফিয়াকেও হত্যা করলাম।  হ্যাঁ, আমি খুনি।  তবে যা করেছি সবই ফ্লোরেন্সকে ভালোবেসে করেছি।'


লক্ষ্য করলাম, ভদ্রলোকের চুরুট ততক্ষণে পুরোটাই শেষে হয়ে গেছে।  তিনি হঠাত উঠে দাঁড়ালেন, আর তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, 'ভালোবাসা! আপনি কি আদৌ ভালোবাসার অর্থ বোঝেন?'


ভদ্রলোককে উত্তর দেওয়ার মত কোনও ভাষাই আমার জানা ছিল না।  আমি আবার আমার মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলাম।


হঠাত কলিং বেলটা বেজে উঠতেই আমি বিছানা থেকে ধড়মরিয়ে উঠে বসলাম।  মনে হয় শিম্বা এসে গেছে।  আমি কাল রাতের ঘটনাটা মনে করতে করতে যখনই ছিটকিনিটা খোলবার জন্য হাত বাড়ালাম, দেখলাম ছিটকিনিটা তো খোলাই আছে!  কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে রাত্রে শুতে যাবার আগে আমি ছিটকিনিটা ভালোভাবে আটকিয়ে ছিলাম।  কাল রাত্রের সমস্ত ঘটনাবলী যদি শুধুমাত্র স্বপ্নই হয়ে থাকে, আমি নিশ্চিত যে দরজায় ছিটকিনি আটকানোটা কোনও মতেই স্বপ্ন ছিল না।  



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime