Sourav Nath

Romance Fantasy Others

4  

Sourav Nath

Romance Fantasy Others

টানাপড়েন #lovelanguage

টানাপড়েন #lovelanguage

18 mins
442


                                            ১


  


   শরত এসে গেছে। আকাশে পেঁজা মেঘের সারি সাদা সাদা তুলোর মত হয়ে ভেসে চলেছে। মেঘের ফাঁকে নীল আকাশের লুকোচুরিতে আকাশটাকে একটা খেলার মস্ত বড় মাঠ বলে মনে হচ্ছে। যৌবনের সতেজ রূপ যেন পরিবেশে ফুটে উঠেছে। এ সময় সঙ্গী বিহনে মনটা যেন কাতর হয়ে ওঠে। শরীরের এড্রেনাল গ্রন্থিগুলো যেন সদলবলে হানা দিয়েছে। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও যুদ্ধে পরাজিত পলাতক সৈনিকের মতো অবস্থা। কিন্তু যাবো কোথায়! যেখানেই যাই শত্রুগুলো সেখানেই তাড়া করে বেড়ায়। বলে, ‘পালাবি কোথায়! আমার হাত থেকে আস্ত আস্ত মুনি ঋষিরাও পার পায়নি, তারাও সব একে একে কুপোকাত হয়েছে, আর তুই তো কোন ছাড়!


   সাধুবাবা হাত দেখে বলেছেন, ‘হুম! অবস্থা খুবই সাঙ্ঘাতিক! শুক্র খুবই সতেজ! একাগ্রে সাধনা কর। তবে ওকে বাগে আনতে পারবি। সাধুবাবার কথায় বেশ কিছুদিন সাধনা করলাম। পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন। কিছুক্ষণ পরেই পায়ে ঝিন ঝিন লেগে গেল। পা দুটো ছড়াতেই ধ্যানভঙ্গ। পরীক্ষায় ফেল। আবার শত্রুর তরোয়ালের খোঁচায় শরীরটা যেন জর্জরিত হতে লাগলো। ধ্যান করার সহজ পন্থায় পদ্মাসন ছেড়ে পা মুড়ে বাবু হয়ে বসলাম। চোখ বন্ধ। সব অন্ধকার। সাধুবাবা বলেছেন, ‘কপালে আলো দেখবি। বন্ধ চোখে রঙিন আলো। সেই আলো ক্রমে স্পষ্ট হতে হতে সাদা হবে। তখনই বুঝবি তুই শুক্র বিজয়ী হয়েছিস’। কিন্তু আলোর দেখা কই! সবই তো অন্ধকার। চোখ দুটোকে ঘষে নিতেই লাল লাল আলো। যেন অন্ধকার আকাশে তারার মেলা। বাহ, এই তো হচ্ছে! সাধুবাবার রাস্তায় আমি এগোচ্ছি! আর একটু হলেই হল। তারপর আমিও সাধুবাবার মত সিদ্ধ পুরুষ হয়ে শুক্র বিজয়ী হব।


   এমন সময় দরজায় খুট খুট শব্দ। কে হতে পারে! ক্যাবলা এসেছে বোধ হয়। দরজা খুলতেই দেখি খুন্তি হাতে মা এসে হাজির। আমি বললাম, ‘একি! মা তুমি এখানে!’ মা বললেন, ‘সেই সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে করছিসটা কি! পড়াশোনা তো একেবারে ডগে উঠে গেছে। যা না, সারাদিন দরজা বন্ধ করে বসে না থেকে পূজোর সময় বাইরে থেকে একটু ঘুরেই আয় না!’ সাধু বাবা বলেছেন, ‘সাধনার পথে বাধা প্রবল। একাগ্রে সাধনা করেছ কি দরজায় বাধা এসে হাজির হবে। আরও একটু সাধনায় অগ্রসর হলেই সুন্দরী রমণীর হাতছানি! এর পথ খুবই পিছল। একটু বিগড়েছ কি, ধপাস করে একেবারে কুপোকাত’। কিন্তু মা’র কাছে এসব কিছুই বলা যাবে না। তার উপর তিন্নিটা জানতে পারলে সকলকে বলে বেড়াবে যে দাদা শুক্রজয়ী সাধনা করছে। এর থেকে ভালো বাইরে একটু ঘুরে আসা।


   চকচকে রোদ্দুরে ঢাকের চামড়া টান টান হয়ে গেছে। পাড়ার প্যান্ডেলের সামনে ঢাকিরা তার উপর চড়বড়ে বোল তুলে নেচে নেচে বাজাচ্ছে। ছোট ছেলেটা – ঢাকির ছেলে টেলে হবে বোধ হয়, কেমন একই রকম দেখতে – কাঁসর হাতে বাজাচ্ছে আর মাঝে মাঝে প্যান্টটাকে কোমর থেকে তুলে নিচ্ছে। পটাপট করে বাচ্চাগুলো পিস্তলে ক্যাপ ফাটাচ্ছে আর বন্দুক থেকে গল গল করে ধোঁয়া উঠছে। ক্যাপের গন্ধে চারিদিক ভরপুর। ক্যাবলা আর অভি অলরেডি মিষ্টি আর ডলির পিছনে সেই সকাল থেকে বোধ হয় হত্যে দিয়ে পড়ে আছে।


   ক্যাবলার আসল নাম হল কেবল চন্দ্র রায় আর অভির আসল নাম হল অভিষেক হালদার। নাম দুটো ক্রমে অপভ্রংশ হতে হতে ক্যাবলা আর অভিতে এসে থেমে গেছে। অভি নামটা তবু মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ক্যাবলার ক্যাবলা নামটা নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি আছে। ওর ওই নামের জন্যই বোধ হয় মেয়েরা পটার আগেই পগার পার হয়। ক্যাবলার কিন্তু চেষ্টার অন্ত নেই। ওর প্রেমে পড়ার প্রবল ইচ্ছে। মেয়ে দেখেছে কি একেবারে তার পিছনে হাজির। একেবারে গায়ে পড়া বলা চলে। সব সময় কেমন ছোঁকছোঁকে স্বভাব।


   দূর্গমন্ডপের সামনে একটা ফাঁকা যায়গায় গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। বেশ রংচঙে পরিবেশ। আর পাঁচটা দিনের থেকে একদম আলাদা। চেনা মানুষগুলো কেমন নতুন নতুন লাগছে। আমাদের পাড়ার রিয়াকে দেখলাম। অন্যান্য দিনে ওর সঙ্গে কথা বলি। আজকে যেন কেমন লজ্জা করছে ওকে ডাকতে। শাড়ী পড়লে মেয়েদেরকে কেমন বড় বড় বলে মনে হয়। ফেস পাউডার, আই লাইনার, মাস্কারা মিলে যেন এক মায়াবী গন্ধ। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে রিয়ার মায়াবী ঘ্রাণ নিলাম। আঃ কি মিষ্টি সুবাস। যেন মর্ত্যে অপ্সরার আবির্ভাব! অপ্সরার নামটি মনে পড়তেই আমার চমক ভাঙল। সাধু বাবার কথা মনে পড়ল। শুক্র বিজয়ের পথে বাধা! আমি সরে এলাম। রিয়া আমাকে ডাকল, ‘অনুপম, আরে এই অনুপম!’ ঠিক যে ভয়টা করেছিলাম, তাই হল। মুখটা কাঁচুমাচু করে বললাম, ‘আমাকে ডাকছিস!’ রিয়া বলল, ‘তোকে ডাকবোনা তো আর কাকে ডাকবো! এখানে আর কে আছে শুনি! সেই কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না!’ আমি বললাম, ‘কই, ঠিক শুনতে পাইনি তো!’ ‘এই আমাকে কেমন লাগছে রে!’ রিয়া চকচকে মায়াবী চোখ নিয়ে কথাগুলো বলল। ‘হ্যাঁ, ভালোই তো লাগছে। বেশ সুন্দর। কেমন সুন্দর সেজেছিস!’ আমার কথায় রিয়া মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘ধ্যাত, মিথ্যুক কোথাকার!’ আমি বললাম, ‘আমি খামোখা তোকে মিথ্যে বলতে যাবো কেন! সত্যিই তো তোকে সুন্দর লাগছে’। ‘তবে তুই আমার দিকে তাকিয়ে দেখিসনি কেন! সেই কখন থেকে ডাকছি, আর তুই কিনা উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস!’


   রিয়ার কথায় আমি কি বলব, উত্তর খুঁজে পেলাম না। আমার সাধুবাবার কথা মনে পড়ল। সাধনার পথে অগ্রসর হলে মায়ার খেলা চারিদিক থেকে শুরু হয়ে যায়। আমার সাধনা নিশ্চয়ই ঠিক পথে এগোচ্ছে। নাহলে এমন ঘটনা তো ঘটবার নয়! এখনই আবার ধ্যানে বসতে হবে, নাহলে এতক্ষণের সাধনা সব আবার পণ্ড হয়ে যাবে। আমি আর কিছু না বলে যেই না বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি, রিয়া অমনি আমার সামনে হাত দুটোকে মেলে আমার পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো।


   উফ! কি যন্ত্রণা! একদিকে এড্রেনাল গন্থির উৎপাত, তার উপর আবার এরকম সুন্দরীর মায়া! আমি যেন ভিতর থেকে দুমরে মুচড়ে একেবারে শেষ হয়ে যেতে লাগলাম। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম। খুব ইচ্ছে করছে রিয়াকে কাছ থেকে দেখতে। কি সুন্দর লাগছে ওকে! দু-বাহু প্রসারিত, উগ্র সেন্টের মাদক গন্ধ, শ্যাম্পু করা খোলা ফুরফুরে চুল, যেন আবক্ষ অপ্সরার জ্যান্ত মূর্তি! কিন্তু এসব কিছুই আমার দেখা বারণ। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে আমার গলা পর্যন্ত উঠে এলো। রিয়া আমার বুকে হাত দিয়ে ঠেলে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে বলত তোর! এরকম করছিস কেন?’


   আমি কিছু উত্তর দিতে পারলাম না। পাথরের মূর্তির মত আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বলতে পারছিনা কিছুতেই। আবার আমার বুকে হাত দিয়ে রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে অনুপম! তোর শরীর খারাপ লাগছে নাকি!’


   আমি চোখ খুলে তাকালাম। রিয়া যেন গভীর সমুদ্রের মত নীলাভ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যেন ক্রমশই সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যেতে লাগলাম। ফুরফুরে চুলগুলো রিয়ার মুখে এসে পড়েছে। যেন চন্দ্রমার উপর কালোর আঁকিবুঁকি। এমন সময় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ক্যাবলা আমার পিঠে চটাস করে থাপ্পড় মেড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে অনুপম! মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন!’ আমি মনে মনে ভাবলাম, কি করে তোকে বলব রে ক্যাবলা আমার মনের টানাপড়েনের কথা! ও কথা তোর বোধগম্য একেবারেই হবার নয়। ক্যাবলার দিকে আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদেরকে দেখে অভিও যেন হন্তদন্ত হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। রিয়াকে দেখে অভি বলে উঠল, ‘হেব্বি লাগছে রে রিয়া তোকে! এক্কেবারে ফাটাফাটি!’


   অভির কথায় আমার বেশ রাগ হল। রিয়া আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে ঠর ঠর করে ওর বান্ধবীদের দিকে ফিরে গেল। ঘটনার এরকম পট পরিবর্তনে অভি কেমন যেন ভ্যাবলার মত হয়ে গিয়ে বলল, ‘যা: শালা, কি হল!’ আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। বললাম ‘আমি এখন আসিরে ক্যাবলা, বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে’। আমি যখন চলে আসছিলাম, তখন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রিয়া তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর অভি কেমন ফ্যালফ্যাল করে রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।


 


                                              ২


 


   দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। তখনও আমি ধ্যানমগ্ন। কান দুটো কেমন বোঁ বোঁ করছে। পিঠে মশা কামড়াচ্ছে। রক্ত খেয়ে খেয়ে বোধ হয় মশাগুলোর পেট ফুলে একেবারে ঢোল হয়ে গেছে। কিন্তু নড়া যাবেনা কিছুতেই। ইতি মধ্যেই কয়েকবার থাকতে না পেরে পিঠ চুলকে নিয়েছি। উফ! আর থাকা যাচ্ছে না। ধ্যানের পথে বাঁধা প্রবল। চোখে আলো দেখছি না। শুধু সকালবেলার রিয়ার আবক্ষ মূর্তিটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কেমন দু-হাত বাড়িয়ে রিয়া যেন আমাকে ডাকছে। বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। আমি বার বার রিয়াকে আমার মন থেকে সরিয়ে দিচ্ছি। রিয়া তবু আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন বলছে, ;এই অনুপম, বলনা আমাকে কেমন লাগছে?’


   খুব ঘুম পাচ্ছে। একটু শুতে পারলে ভালো হয়। শিরদাঁড়া যেন টন টন করছে। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বসে বসে কেমন কুঁজো হয়ে যাচ্ছি। সম্বিৎ ফিরলে আবার শরীরটাকে টান টান করে নিচ্ছি। নিঃশ্বাস যেন ক্রমে গভীর হচ্ছে। রিয়া আবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ওর চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়েছে। বলছে, ‘এই অনুপম শুনতে পাচ্ছিস না! আমি কখন থেকে তোকে ডাকছি!’ রিয়ার গন্ধ যেন আমার নাকে এখনও লেগে রয়েছে। নাকের কথা মনে পড়তেই মনে হল, আমার নাকের ডগায় ইদানীং একটা ব্রণ উঠেছে। বেশ ব্যাথা করছে। লাইফ সায়েন্সে পড়েছি, এগুলো বয়ঃসন্ধিক্ষনের ব্রণ। কয়েকটা গালেও উঠেছে। ক্যাবলার দু গালে ব্রণর কালো কালো ছাপ হয়ে গেছে। আমার গালেও কি তাই হবে নাকি! রিয়ার চোখে পড়লে ও কি ভাববে! আমার মুখের দিকে রিয়া যদি আর না তাকায়! আমার চোখ দুটো খুলে গেল। উঠে পড়লাম। নিজের গালে একবার হাত বোলালাম। ঈশ! বেশ কয়েকটা ব্রণ গালের উপর ঢিবি হয়ে রয়েছে। তিন্নির কাছে গোলাপ জল আছে। এখন মনে হয় তিন্নি ঘুমোচ্ছে। রাত্রে ঠাকুর দেখতে বেরোবে। এই ফাঁকে একটু নিয়ে এলে হয়। ও ঘুম থেকে ওঠার আগে একটু মেখে নিলেই হবে। কিচ্ছু বুঝতে পারবে না। আস্তে আস্তে পা টিপে তিন্নির ঘরে গেলাম। ওর ড্রেসিং টেবিলেই গোলাপজলটা রাখা আছে। সুট করে ওটাকে নিয়েই আমি আমার ঘরে চলে এলাম। আমার ঘরে ড্রেসিং টেবিল নেই। গোদরেজের আলমারিটায় একটা আয়না লাগানো আছে। আমি দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দু গালে বেশ করে গোলাপ জল ঘষে নিলাম। ঈশ! অনেকটা গোলাপ জল শেষ হয়ে গেল। তিন্নি জানতে পারলে চেঁচামেচি করবে। আমি আবার চুপি চুপি তিন্নির ঘরে গিয়ে গোলাপজলটা রেখে এলাম। ঘরের দরজা জানালা খুলে দিলাম। দেখি, রিয়া ছাদে উঠে গাছে জল দিচ্ছে। রিয়া এখন শাড়ি পড়ে নেই। ঘরোয়া জামা কাপড় পড়ে আছে। আমি ছাদে উঠে গেলাম। কিন্তু ইচ্ছে করেই রিয়ার দিকে তাকালাম না। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন ভাবে দাঁড়ালাম যাতে রিয়া আমাকে সহজেই দেখতে পায়। মনে মনে বললাম, রিয়া, অন্তত একবার আমাকে ডাক। ঠিক তার পরেই রিয়া আমাকে ডেকে বলল, ‘এই অনুপম!’ আমি ইচ্ছে করে যেন না শোনার ভান করলাম। ভাবলাম, আরও একবার ডাকুক, তবে সাড়া দেবো। রিয়া আমাকে আবার একবার ডাকল, ‘আরে এই অনুপম! শুনতে পাচ্ছিস না, তোকে কখন থেকে ডাকছি!’ ঈশ! কি মিথ্যুক রিয়াটা! মাত্র দু বার ডেকেই বলে কখন থেকে ডাকছি! আমি এবার রিয়ার দিকে ঘুরে তাকালাম। যেন ওর প্রথমের ডাকটা আমি সত্যিই শুনতে পাইনি। বললাম, ‘কিরে রিয়া! তুই কি আমাকে ডাকছিস!’ রিয়া বলল, ‘তোকে ছাড়া আর কাকে ডাকবো বল, তুই ছাড়া কি এখানে আর কেউ আছে যে তাকে ডাকবো!’ রিয়া কি সোজা কথা বলতে পারেনা! সব কথাই কেমন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে। আমি বললাম, ‘কই না তো, আমি তো শুনতে পাইনি!’ রিয়া বলল, ‘কি করছিস ছাদে একা একা!’ আমার খুব বলতে ইচ্ছে করল, আমি তো তোকে দেখার জন্যই ছাদে উঠেছি। আমি বললাম, ‘কই কিছু না তো! এমনিই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুই কি করছিস, গাছে জল দিচ্ছিস বুঝি!’ রিয়া আবার বলল, ‘কেন, আমাকে দেখে তোর কি মনে হচ্ছে, আমি এখানে দাঁড়িয়ে স্নান করছি বুঝি!’ উফ, আবার সেই বাঁকা বাঁকা কথা। মেয়েরা বুঝি এরকমই হয়! বাবা কিছু জিজ্ঞেস করলে মাও এরকম বাঁকা বাঁকা উত্তর দেয়। তিন্নিটাও আজকাল এরকম করেই কথা বলতে শিখেছে। আমি বললাম, ‘ও, তাই বুঝি!’ রিয়া বলল, ‘আজ সন্ধ্যাবেলায় কি প্ল্যানিং রে তোর!’ আমি বললাম, ‘কই, তেমন কিছুই নেই তো!’ রিয়া বলল, ‘তুই ঠাকুর দেখতে যাবিনা!’ আমি বললাম, ‘সে রকম কিছু ভাবিনি এখনও’। রিয়া বলল, ‘কেন, তোর বন্ধু ক্যাবলা আর অভির সঙ্গে বেরবি না!’ বলেই রিয়া হাতে জলের পাইপটা নিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠল। আমি ভাবলাম এতে আবার এত হাঁসির কি হল! আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। রিয়ার হাঁসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জলের পাইপটাও দুলে দুলে উঠছিল। আর তার মধ্যে থেকে ঢেউ খেলে খেলে জল গাছের উপর বিক্ষিপ্ত হয়ে আছাড় খেয়ে পড়ছিল। আমার মনের মধ্যেও যেন রিয়ার হাতের জলের পাইপের মতো দোদুল্যমান অবস্থা। ওটা যেন পাইপ নয়, রিয়ার হাতে আমার হৃৎপিণ্ড। রিয়ার হাসির সঙ্গে আমার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটাও যেন দুলে দুলে আছাড় কাছাড় খেতে লাগলো। আমি নিজের মনে সাহস সঞ্চার করলাম। আমি না পুরুষ মানুষ! আমাকে এরকম নরম হয়ে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। আমিও তৎক্ষণাৎ রিয়াকে কাউন্টার করলাম, ‘আজ সন্ধেয় তোর কি প্ল্যানিং?’ রিয়া হাসতে হাসতে থমকে গেল। বলল, ‘কেন, আমার প্ল্যানিং জেনে তোর কি লাভ! তুই কি আর আমার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাবি!’ আমি বললাম, ‘কেন যাবনা? নিশ্চয়ই যাবো!’ আমার কথার উত্তরে রিয়া যেন থমকে গেল। কিন্তু পরক্ষনেই লাফিয়ে উঠে বলল, ‘এই অনুপম, সত্যিই তুই আমার সঙ্গে যাবি!’ আমি বললাম ‘বললাম তো নিশ্চয়ই যাবো’। রিয়া বলল, ‘তবে ক্যাবলা আর অভিকে সঙ্গে নিলে কিন্তু আমি তোর সঙ্গে যাবনা’। আমি বললাম, ‘কেন ওরা আবার কি দোষ করল!’ রিয়া বলল, ‘ওরা কেমন সবসময় আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দ্যাখে! আমার ওদের মোটেই পছন্দ হয় না’। আমি ভাবলাম তবে রিয়া কি আমাকে পছন্দ করে! আমার শরীরটা কেমন শিহরিত হয়ে উঠল। এই বুঝি এড্রেনাল গ্রন্থির আবার ক্ষরণ হয়ে গেল। আমি নিজেকে সংযত করলাম। সাধুবাবা বলেন, ‘পুরুষ মানুষের সংযমী হওয়া দরকার। পুরুষ মানুষের মধ্যে সব সময় একটা ভারীত্ব ভারীত্ব ভাব না থাকলে তাকে পুরুষ মানুষ বলে ঠিক যেন মানায় না। আমি আত্ম সংযমী হয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে। তাই হবে। আমি ওদের সঙ্গে নেবোনা। তবে আমারও একটা শর্ত আছে’। রিয়া চোখ দুটোকে বড় বড় করে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি শর্ত আছে শুনি!’ আমি বললাম, ‘তুইও কিন্তু কাউকে সঙ্গে নিতে পারবিনা। আমরা আজ সন্ধ্যেয় শুধু দুজনে বেরোব’। রিয়ার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। হাতের পাইপটা ছাদের উপর ফেলে রেখে ও ছুট্টে ছাদ থেকে চলে গেল। পাইপটা ছাদের উপর গড়াগড়ি খেতে খেতে গল গল করে তার পেট থেকে জল উগরে দিতে লাগলো। আমি কিছুই যেন মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলাম না। ভ্যাবলার মত রিয়ার ছাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে রিয়া আবার ফিরে এলো। জলের ট্যাঙ্কের ট্যাপটা থেকে পাইপটা আলাদা করে জল বন্ধ করে দিল। মুখে কিছু কথা বলল না। শুধু কয়েকবার আমার দিকে ফিরে ফিরে তাকাল। আমি মনে মনে ভাবলাম, ওকে ভুল কিছু বলে বসলাম নাকি! চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমি ওকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। জলের পাইপটা গুটিয়ে ছাদের এক কোনে রেখে যাবার সময় রিয়া বলে গেল, ‘সন্ধ্যে ঠিক ছটায়, আমাদের বাড়ির সামনের তিন নম্বর ল্যাম্প পোষ্টের নিচে। মনে থাকে যেন’। আমার বুকের হৃৎপিণ্ডটা যেন আবার তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। এই বুঝি আবার আমার এড্রেনাল গ্রন্থির ক্ষরণ হয়ে গেল।


   সন্ধ্যে ঠিক ছটার সময় আমি রিয়ার বাড়ির সামনের তিন নম্বর ল্যাম্প পোষ্টের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তার মোড়ে হ্যালোজেনের চড়া আলোয় ল্যাম্প পোষ্টের ল্যাম্পের আলো ম্লান হয়ে গেছে। রিয়া ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার সামনে এলো। কিন্তু দাঁড়ালোনা। শুধু বলল, ‘চলে আয়’। আমিও রিয়ার পিছনে পিছনে মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে চললাম। রিয়াকে যেন সকালবেলার থেকে আরও বেশী সুন্দরী লাগছে। কেমন অচেনা অচেনা লাগছে। রিয়ার ফ্রকের চুমকীগুলোয় আলো পড়ে চকচক করছে। রাস্তার চারিদিকে আলোর খেলায় রিয়ার রূপও যেন ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে। বক্সের গানের শব্দ রাস্তার মোড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রিয়া চকমকি জামা পড়ে এগিয়ে চলেছে। আর আমি চলেছি ওর পিছু পিছু। রিয়ার শরীর দুলছে। আর তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে দুলছে ওর ঘাগরা। কেমন এক আজব কায়দায় ময়ূর পুচ্ছের মতো মেলে ধরা চুলের সারি যেন বর্ষায় ময়ূরের নৃত্য বলে মনে হচ্ছে। যেন কোনও এক মনোমোহিনী – মনোমুগ্ধকারিনী মায়ার জালে মোহিত করে আমাকে কোথাও টেনে নিয়ে চলেছে আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলেছি ওর পিছু পিছু। এরকম কতক্ষণ ধরে হাঁটতে হবে জানিনা। ফুচকার স্টল, চাউমিন, তন্দুর, বেলুন, ঘুঘনীর দোকান সব একে একে পার হয়ে যাচ্ছে। রিয়া হেঁটে চলেছে আর আমিও চলেছি ওর পিছু পিছু।


   সাহেব বাগান, দক্ষিণা কালী মন্দির, ভোগী রামের চপের দোকান পার হয়ে তিন মাথার মোড়ে সিগন্যালের নীচে রাস্তার রেলিংয়ের ধারে একটু অন্ধকারে এসে রিয়া দাঁড়ালো। আমিও রিয়ার পিছন পিছন এসে থমকে দড়িয়ে পরলাম। ঠাকুর দেখতে এলাম। কিন্তু প্যান্ডেল কোথায়! এতো শুধু রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেই চলেছি! প্রায় ঘণ্টা খানেক এক নাগাড়ে হেঁটে রিয়া হাঁপিয়ে গেছে। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। জামার উপরেও ঘামের ভেজা ভেজা ছাপ লেগেছে। রিয়া আমার মুখের দিকে ঘুরে তাকাল। যেন পাবলো পিকাসোর আঁকা জলজ্যান্ত এক ছবি মূর্তিমান হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। রিয়াই প্রথম নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল, ‘এই অনুপম আমাকে কেমন লাগছে রে!’ সেই সকাল থেকে রিয়া একই কথা জিজ্ঞেস করে চলেছে। আমি বললাম, ‘তোকে তো ভালোই লাগছে। তুই কি শুধু এই কথাটাই জিজ্ঞেস করবার জন্য আমাকে এতটা হটিয়ে আনলি!’ রিয়া বলল, ‘না না, তা মোটেই নয়। আসলে লিলি, রুপা, সোনাই এরা দেখতে পেলে ঠাট্টা করবে’। আমি বললাম, ‘কেন, ওরা ঠাট্টা করবে কেন! আর তাছাড়া ওরা আমাদের দেখতেই বা পাবে কেমন করে?’ রিয়া বলল, ‘তুই একেবারে হাঁদা। কিচ্ছু বুঝিস না। পুজোর সময় সহজে লুকানো যায় না। ঠিক কেউ না কেউ দেখে ফেলবে’। আমি বললাম, ‘দেখে ফেললেই বা হয়েছেটা কি! আমরা তো ঠাকুর দেখতে এসেছি!’ রিয়া বলল, ‘ঠিক তাই। আমরা ঠাকুর দেখতে এসেছি। সেই কারণেই বলছি’। আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। রিয়া বলল, ‘এখন যদি ক্যাবলা আর অভি তোকে আর আমাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলে, তাহলে কি হবে বল!’ আমি মনে মনে ক্যাবলা আর অভির কথা চিন্তা করলাম। ক্যাবলার কথা না হয় ছেরেই দিলাম। ও তো সত্যি সত্যিই ক্যাবলা। কিন্তু অভিটা বড্ড ফাজিল। রিয়াকে দেখলেই বলবে – তোকে হেব্বি লাগছে রে রিয়া! কেমন গায়ে পড়া যেন অভিটা। রিয়া বলল, ‘কি হল, চুপ করে আছিস যে! কিছু বল!’ কি বলব আমি! আমার তো কোনও কথাই মনে আসছে না। এরকম সিচ্যুয়েশানে আগে কখনও পড়িনি। চার পাশে কেউ সেরকম নেই। রাস্তার উপর দিয়ে হুস হুস করে গাড়ি যাচ্ছে। এদিকটায় ব্লাইন্ড স্ট্রীট। কোনও ঠাকুর নেই। তাই ভিড়ও সেরকম নেই। রিয়া আমার হাত দুটোকে খপ করে ধরল। আমি আবার শিউড়ে উঠলাম। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। রিয়া আমাকে ফিস ফিস করে বলল, ‘এই অপূ, আমাকে তোর কেমন লাগে রে!’। রিয়ার হাত দুটো কাঁপছে। আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ছে ওর। আমি রিয়ার চোখের দিকে তাকালাম। রিয়া আমাকে কখনও অপূ বলে ডাকে না। আজ ডাকল। ওর চোখ দুটো যেন জ্বলছে। আমি কিছু উত্তর দিতে পারলাম না। রিয়া আবার আমার হাত দুটোকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বল না অপূ, আমাকে তোর কেমন লাগে?’ আমি বললাম, ‘ভালো!’ রিয়া বলল, ‘শুধু ভালো! আর কিছু না!’ আমি বললাম, ‘খুব ভাল!’ রিয়া আবার বলল, ‘খুব ভালো! আর কিছু না!’ আর কি বলব আমি! আমি বলার মত আর কোনও ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমি আবার চুপ করে গেলাম। রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। রিয়া আমার হাত দুটো ছেড়ে দিল। আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়া মাথা নিচু করে রিয়া বলল, ‘আমার কিন্তু তোকে খুব ভালো লাগে অপূ।‘ রিয়া আবার চুপ করে গেল। আমিও চুপ করে থাকলাম। তারপর রিয়া আবার বলল, ‘আমি তোকে খুব ভালো বাসি’। রিয়ার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। আমার বুকে হৃৎপিণ্ড যেন আবার লাফিয়ে উথল। বুকটা আবার ঢিপ ঢিপ করছে। ঢিপ ঢিপ আওয়াজটা বোধ হয় আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। সাধুবাবার কথা মনে পড়ছে। আমি কি তবে পথভ্রষ্ট হচ্ছি! আমার শুক্রজয়ী সাধনা কি তবে সব পণ্ড হয়ে গেল! কি করব কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না। রিয়া ঠিক সেরকম করেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ও বোধ হয় আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাইছে। কিন্তু ওকে বলার মত কোনও ভাষা আমার কাছে নেই। আমারও যে খুব ইচ্ছে করছে ওকে বলতে যে রিয়া আমিও তোকে খুব ভালোবাসি। রিয়ার হাতটা খুব ধরতে ইচ্ছে করছে। কি সুন্দর নরম হাত ওর। মাখনের মত তুলতুলে। এই প্রথম কোনও যুবতী মেয়ের হাত ধরলাম আমি। এ যেন এক আশ্চর্য অনুভূতি।


 


                                             ৩


 


   সেবার উচ্চমাধ্যমিকে কোনও মতে থার্ড ডিভিশনে পাশ করলাম আমি। অঙ্কে মাত্র দু নম্বরর জন্য ব্যাক পেতে পেতে বেঁচে গেলাম। বাবা তো একেবারে রেগেই আগুন। ‘মাধ্যমিকে সবকটা বিষয়ে লেটার নিয়ে পাশ করা ছেলে কিনা উচ্চ মাধ্যমিকে থার্ড ডিভিশনে পাশ করে!’ আমার কিছুই বলার নেই। ভিজে বেড়ালের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা বলল, ‘উফ! ছাড়ো তো! যা হবার তাতো হয়ে গেছে! এর পর থকে না হয় অপূ ভালো করে পড়াশোনা করবে’। বাবা বললেন, ‘থাক, আর পড়াশোনা করে লাভ নেই। রেজাল্ট যা করেছে, তাতে আর ভালো কোনও কলেজে কেন, খারাপ কোনও কলেজেও চান্স পাবে না’। বাবা খবরের কাগজটাকে কথা বলতে বলতে মাঝে মধ্যে নামাচ্ছেন আর কথা বলা হয়ে গেলেই কাগজটাকে আবার চোখের সামনে মেলে ধরছেন। বাবার রাগের চোটে খবরের কাগজটা মাঝখান থেকে ছিঁড়ে একেবারে ফর্দাফাঁই না হয়ে যায়! আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে। বাবা রাগে ফুঁসছেন। রিয়া অঙ্কে লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। ওর কাছে মুখে দেখাতে পারবো না। ঈশ! কি ভাবছে রিয়া! বাবার কথায় আমার একটুও লজ্জা করছে না। আমার লজ্জা করছে রিয়ার কথা ভেবে। বাবা অনবরত খারাপ খারাপ বিশেষণে আমাকে ভূষিত করে চলেছেন। ওসব কথা আমার আর কানে ঢুকছে না। রিয়ার মুখটা খুব মনে পড়ছে। এত সব কাণ্ড তো ওর জন্যই হল। ওর প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে আমার ডুবু ডুবু অবস্থা। আর ও ঠিক সাঁতরে সুট করে পার হয়ে গেল। আচমকা বাবা জোরে চীৎকার করতেই আমি আবার চমকে উঠলাম। ‘কি হল! আমি কি বলছি, কথাগুলো কানে যাচ্ছে, নাকি যাচ্ছে না!’ আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘আজ্ঞে যাচ্ছে’। বাবা আবার বলতে লাগলেন, ‘যত্ত সব ক্যাবলা-হ্যাবলা লোফার বন্ধুগুলোর সঙ্গে সারা দিন ওঠা বসা! ফেল করবে না তো কি পাশ করবে! সঙ্গ দোষে রঙ্গ নষ্ট। পাশের বাড়ির রিয়াকে দ্যাখ! কত সুন্দর মেয়েটা। কেমন অঙ্কে লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে! ওর পা ধুয়ে জল খেলেও তুই উদ্ধার হয়ে যাবি’। রিয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই বাবার সুর যেন নরম হয়ে যাচ্ছে। আর আমার প্রসঙ্গ উঠলেই আবার তেলে বেগুনে যেন জ্বলে উঠছেন। বাবার পিছনের দিকের জানালাটা খোলা আছে। রিয়া ছাদে উঠে আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ও আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আমাদের কথাও বোধ হয় শুনতে পাচ্ছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই রিয়া ফিক করে হেসে উঠল। রিয়াকে দেখে আমার খুব রাগ হল। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম না। জানালার কাছ থেকে একটু সরে এলাম যাতে রিয়াকে দেখা না যায়। রিয়াও আবার একটু সরে দাঁড়ালো। ওর সাথে আবার চোখাচোখি হয়ে গেল। উফ! কি দুষ্টু মেয়ে রিয়াটা! যেদিন থেকে আমার জীবনে ও এসেছে, সেদিন থেকে আমার বুকে ঝড় উঠেছে। সাধুবাবা ঠিকই বলেছিলেন। সাধুবাবা আর নেই। সপ্তা খানেক হল দেহ রেখেছেন। আমাকে পরামর্শ দেবার মত আর কেউ নেই। এই সময় সাধুবাবাকে খুব দরকার ছিল আমার। এমন সময়েই সাধুবাবাকে দেহ রাখতে হল! এদিকে বাবার বকুনি যেন আর থামতেই চায় না। ননস্টপ বাবা আমাকে বকে চলেছেন। মাঝে মধ্যে জোরে ধমকানিতে যেন চমকে চমকে উঠছি। তিন্নিটা যেন আজ খুব আনন্দ পেয়েছে। আমাকে বকলে ওর খুব আনন্দ হয়। রিয়ার সঙ্গে তিন্নির আজকাল খুব ভাব হয়েছে। তিন্নি আমাদের ব্যাপারে সব জানে। মাকেও বোধ হয় বলে দিয়েছে। তবে বাবার কানে কথাটা এখনও ওঠেনি। বাবা জানতে পারলে আর রক্ষে নেই। অভিও এবার থার্ড ডিভিশনে পাশ করেছে। কিন্তু ক্যাবলাটা এবার ডাহা গাড্ডু মারলো। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছি। বাবা বকাবকি করে চলেছেন। এমন সময় মা যেন রেস্কিউ টিমের মত আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বাবাকে বলল, ‘এবার ছাড়ো। অনেক বকাঝকা হয়েছে। যা অপূ, এবার তুই চানে যা। আমার রান্না হয়ে গেছে’। আমি আর কাল বিলম্ব না করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। আড় চোখে দেখলাম, খবরের কাগজের ফাঁক থেকে বাবা তখনও আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে রয়েছেন। উফ বাব্বা! বুক থেকে যেন একটা পাথর নামলো! এতক্ষণ যেন একটা ঝড় বয়ে গেল!


   দুপুর বেলা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। একটুও ঘুম আসছে না। সাধুবাবা দেহ রাখার পর আমার ধ্যানও ডগে উঠে গেছে। ধ্যানের কথা ভাবলেই কেমন ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু শুলে আর ঘুম আসছে না। রিয়া অলরেডি পাঁচটা মিসড কল করেছে। আমি ধরিনি। টেক্সট মেসেজও করেছে। লিখেছে, ‘আমাকে ক্ষমা কর অপূ। আগে জানলে আমিও থার্ড ডিভিশনে পাশ করতাম’। উঁহু! ন্যাকা! যেন ঘায়ের উপর নুনের ছিটে দিচ্ছে! আমি ওর টেক্সটের কোনও উত্তর দিলাম না। ফোনটাকে সুইচড অফ করে দিলাম।


   কিন্তু একটু যে শান্তিতে শোব তাঁরও উপায় নেই। দরজায় ঠক ঠক করে তিন্নি ডাকছে, ‘এই দাদা ওঠ! রিয়া ফোন করেছে!’ দরজা খুলে দেখলাম তিন্নির হাতে তখনও রিয়ার ফোন বাজছে। আমি বললাম।‘ ওকে বল, আমি এখন ওর সঙ্গে কথা বলব না। আমার ভালো লাগছে না’। আমি আবার তিন্নির মুখের উপর ধপ করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পরলাম। তিন্নি আরও কিছুক্ষণ দরজা ঠক ঠক করে টোকা দিয়ে আমাকে ডাকল। কিন্তু আমি কোনও উত্তর না করায় তিন্নি টোকা মারা বন্ধ করে চলে গেল। আমি আবার চুপ করে শুয়ে পরলাম। বাবা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। কিন্তু আমি অতটা নয়। যা হবার হবে। আমার তাতে কোনও মাথা ব্যাথা নেই। আমি শুধু চিন্তিত রিয়াকে নিয়ে। আমার থার্ড ডিভিশনে পাশ করায় রিয়া কি ভাবছে!


   আবার কিছুক্ষণ পরে দরজায় খুট খুট করে শব্দ হল। আবার নিশ্চয়ই কেউ আমাকে ডাকছে। কিন্তু কে হতে পারে! তিন্নি হবে বোধ হয়! আমি কোনও উত্তর করলাম না। চুপ করে শুয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার দরজায় খুট খুট করে শব্দ। এবার আমার তিন্নির উপর খুব রাগ হল। খুব দুষ্টু হয়েছে তিন্নিটা । এবার খুব করে বকা দেবো। এই ভেবে তেড়েমেরে উঠলাম। দরজা খুলে যেই না তিন্নিকে বকা দিতে যাবো, দেখি দরজার সামনে রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি কি চোখে ভুল দেখছি! রিয়ার পিছনে বাবা দাঁড়িয়ে। বাবাকে দেখে আমি চুপ করে রইলাম। বাবা বিরক্তির সুরে বললেন, ‘পরীক্ষায় থার্ড ডিভিশনে পাশ করে খেয়ে দেয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমানো হচ্ছে! কখন থেকে মেয়েটা দরজায় টোকা মারছে, আর এদিকে বাবুর ঘুমই ভাঙেনা!’ আমি সেই রকমই চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা এবার গলাটা একটু চরিয়েই বললেন, ‘কি হল, চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কি! মেয়েটা কি সারাক্ষণ তোমার দরজার গোড়াতেই দাঁড়িয়ে থাকবে!’ আমি তৎক্ষণাৎ দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। রিয়া ফিক করে হেসে আমার ঘরে এসে ঢুকল। বাবা যাবার সময় একবার আমার দিকে কটমট করে দেখলেন আর নিজের মনেই ফিস ফিস করে বললেন, ‘রাসকেল কোথাকার!’


   রিয়া আমার ঘরে এসে ঢুকল। ওকে বলার মত আমার কিছুই নেই। আমি ঠিক সেইরকমই মাথা নিচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। স্কুলে ফার্স্ট হওয়া স্টুডেন্ট আমি। এত অপমানিত আমি কখনও হইনি। আমার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এলো। নিজের কান্না আর কোনমতে চেপে রাখতে পারছিনা আমি। বুকের মধ্যে থেকে সমস্ত ক্ষোভ আর যন্ত্রণা যেন এক সাথে উঠে আসতে চাইল। মনের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তিকে আমি ধরে রাখতে পারলাম না কিছুতেই। নিমেষের মধ্যেই আমি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম। ছোট শিশুদের মতই যেন মানসিক অবস্থা আমার। আমার মানসিক টানাপড়েনের কথা কাউকে বোঝাই কেমন করে! কে বুঝবে আমার এই মনের কথা! কে আমাকে এই জটিল ধাঁধাঁ থেকে বেরোবার পথ দেখাবে! আমি যেন কোনও এক স্রোতে ভেসে চলেছি, যার না আছে কোনও হাল না আছে কোনও নাবিক। এ বিশাল সমুদ্রে সাঁতার কাঁটার মত দক্ষতা আমার নেই। কেউ কি আছে যে আমাকে আমার মত করে সাঁতার কাটা শেখাবে!


 


                                            ৪


 


   এই ঘটনার পর কেটে গেল আরও কয়েকটা বছর। প্রতিদিনের মত বাবা আজও তাঁর অভ্যাস মত ইজি চেয়ারে পা ঝুলিয়ে হাতে খবরের কাগজটা নিয়ে বসে আছেন। রান্না ঘর থেকে রান্নার বেশ মিষ্টি সুবাস আসছে। বাবার দিকে উঁকি মেরে দেখলাম, এডোলেসেন্স সাইকোলজি এন্ড হাউ টু গাইড দেম বিষয়টি নিয়ে আজকের কাগজের এডিটোরিয়ালে আমার যে লেখাটি ছেপেছে, বাবা সেটা বেশ মনোযোগ সহকারে পড়ছেন। হাতে আর বেশী সময় নেই। আমার অফিসে বেরোবার সময় হয়েছে। রিয়া ডাইনিং টেবিলে আমার খাবার সাজিয়ে রাখল। খাবার মাঝে রিয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই আজকের রান্নাটা কেমন হয়েছে গো! নতুন রেসিপি, মায়ের কাছ থেকে শিখলাম’। আমি বললাম, ‘হুঁ’। রিয়া বলল, হুঁ মানে!’ আমি বললাম, ‘বেশ ভালো’। রিয়া বলল, ‘বেশ ভালো! আর কিছু না!’ আর কি বলব আমি! কি বললে যে রিয়া স্যাটিশফাই হবে, সেটা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। নারী মনস্তত্ব বোঝা চাট্টিখানি কথা নয়। স্বয়ং ঈশ্বরও আজ পর্যন্ত নারী মনস্তত্ব বুঝে উঠতে পারেন নি, আমি তো কোন ছাড়!


   বেসিনে হাত ধুয়ে টা ওয়েলটা নিয়ে মুখ মুছে অফিসে বেরোবার আগে আমি মাকে আর বাবাকে প্রণাম করলাম। বাবার মুখের স্মিত হাসি দেখে বুঝলাম, আমার লেখা পড়ে বাবার বেশ ভালো লেগেছে। তিন্নিটারও এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। ওর জন্য দেখাশোনা চলছে। তবে আগের মত ও আর দুষ্টু নেই। আমার উপর সদা প্রসন্ন মায়ের কথা নতুন করে আর কিছু বলার নয়। তবে বাবা আর আমার উপর অসন্তুষ্ট একেবারেই নন। জার্নালিজমের চাকরীতে প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাবা নিজে পছন্দ করে রিয়াকে বাড়ির বউ করে এনেছেন।


   আমি জানিনা সে সময় আমি ঠিক ছিলাম নাকি ভুল ছিলাম। এও জানিনা যে, সাধুবাবা ভুল ছিলেন, না ঠিক ছিলেন। সাধুবাবার মতো সিদ্ধপুরুষকে বোঝার মত সাধ্যই বা আমার কতটুকু! তবে এই বয়সে এসে এতটুকু বুঝেছি যে, আমার জীবনে সেই সময় যা ঘটেছিল, সেটা হয়েছিল আমার এডোলেসেন্স পিরিয়ডের কারণে। তবে সেদিন আমি আমার সমস্যা সমাধানের কোনও পথ খুঁজে পাইনি। সেদিন আমাকে আমার মনের অবস্থা বুঝে গাইড করবার মতো কেউ ছিল না। সেই সময় আমার প্রয়োজন ছিল একটা রোল মডেলের যে আমাকে সঠিক দিশা দেখাতে পারত। কিন্তু সবার জীবনে তো আর সবসময় মূর্তিমান রোল মডেল পাওয়া যায় না, যাকে দেখে সে নিজেকে তার মত করে গড়তে পারে! সেই সময় আমাকে যদি কেউ গাইড করে থাকে সেটি হল আমাদের মহাকাব্য। আমি অনুভব করলাম, সেই আদিম যুগ থেকে আমরা সবসময় খারাপ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে আসছি। সে শক্তি বাহ্যিক হোক, বা শারীরিক। খারাপ শক্তি সাময়িক ভাবে আমাদের প্যারালাইজড করলেও তার প্রভাব কখনই চিরস্থায়ী হতে পারেনা। যদি তার প্রভাব চিরস্থায়ী হত, তবে আজ পৃথিবীর কোনও অস্তিত্বই থাকত না। আমাদের যেটা সবথেকে বেশী প্রয়োজন, সেটা হল, পজিটিভ এটিটিউড। নেগেটিভ এনার্জিকে পরাস্ত করতে হলে একমাত্র অস্ত্র হল, পজিটিটিভ এটিটিউড। রামায়ণে বনবাসী রামচন্দ্র বা মহাভারতে অজ্ঞাতবাসে পাণ্ডবরা যেমন তাদের পজিটিভ এনার্জিকে কোনদিন পরাজিত হতে দেননি, আমিও সেইরকম করেই আমার জীবনে একেবারে হতাশ হয়ে পড়িনি। আজ আমার চেষ্টা শুধু একটাই, আর যাতে আমার মতো মানসিক টানাপড়েনের শিকার হয়ে কেউ যেন হন্যে হয়ে না ঘোরে। আর যেন কেউ পথভ্রষ্ট হয়ে নিছক কান্নার আশ্রয় নিয়ে মনে মনে গুমরে না মরে।


   তাই আমার এ নতুন প্রয়াস। এডোলেসেন্স পিরিয়ডের সাইকোলজি নিয়ে আমার প্রয়াস এখন সর্বস্তরে আলোচিত, বহু চর্চিত এক বিষয় হয়ে উঠেছে। মাঝে মধ্যে আমার মন্তব্যে সমালোচনার ঝড়ও বয়ে যাচ্ছে। এই সমালোচনার মাধ্যমেই আমি এখনও বহু কিছু শিখছি, দিনে দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছি। আলোচনাই তো আলোর একমাত্র দিশা! আলোচনাই তো আমাদের বলে, ‘আলোয় চ না!’


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance