Sourav Nath

Tragedy Classics Fantasy

3  

Sourav Nath

Tragedy Classics Fantasy

রুদ্রবীণা

রুদ্রবীণা

14 mins
247


 

  

 পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী দেবাদিদেব মহাদেব পার্বতীর অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি করেন রুদ্রবীণার। ওস্তাদ মীরজাফর আলি মুসলমান হলেও ছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত। রুদ্রবীণার তারে আলাপের ঝঙ্কার তোলবার আগে তিনি মুদ্রিত নয়নে দেবাদিদেব মহাদেবকে স্মরণ করতেন। তবে তিনি যে পাক কোরান শরিফের শ্রদ্ধা করতেন না বা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরতেন না এমনটা একেবারেই নয়। কিন্তু যার বীণার তারে ঝঙ্কার তোলা তার পেশা ও নেশা তাকে স্মরণ না করে তিনি পারতেন না। সঙ্গীতের প্রতি একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা তাঁকে ধর্মের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। তিনি বলতেন, ঈশ্বর-আল্লাহ্‌ সবই এক, শুধু তাকে ডাকা আর পাওয়ার মধ্যে প্রভেদ। সঙ্গীতের কোন জাত হয়না।

   কিন্তু মীরজাফর আলির মনের মধ্যেকার অন্ধকার সঙ্গীতের আলোয় আলোকিত হলেও, তখনকার সমাজ কিন্তু তাঁর এই ধারণা, এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। সমাজে তাঁকে নিয়ে নানা রকম কানাঘুষো লেগেই ছিল। তাঁর সঙ্গীতের একনিষ্ঠ ভক্ত ও তাবড় তাবড় সমঝদাররাও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধ মত পোষণ করত। এতসব কিছু সত্ত্বেও সমস্ত কিছুই মোটামুটি ঠিকঠাক চলছিল। আসল গণ্ডগোলটা সৃষ্টি হল তাঁর এক হিন্দু ছাত্রীকে কেন্দ্র করে। ঘটনাক্রমে ছাত্রীর নাম ছিল পার্বতী। পার্বতী যেমন রূপবতী ছিল ঠিক তেমনই গুণবতীও বটে। মীরজাফর আলির প্রিয়তম ছাত্রী ছিল পার্বতী। তবে সেটা তার রূপের কারণে একেবারেই নয়। সঙ্গীতের প্রতি পার্বতীর ভক্তি ও শ্রদ্ধার কারণে মীরজাফর আলির মনে পার্বতী এক অন্য স্থান তৈরি করেছিল। পার্বতী যখন বিবাহযোগ্যা হল, তখন পার্বতীর বাবা তার জন্য সু-পাত্রের সন্ধান করতে করতে এক বিশাল জমিদার বংশে তার বিবাহ স্থির করল। মীরজাফর আলিও পার্বতীর বিবাহের খবরে বেশ খুশিই হলেন। কিন্তু পাত্র পক্ষের একটাই শর্ত - বিয়ের পরে পাত্রী গান বাজনা একেবারেই করতে পারবে না। জমিদারের উপর মা লক্ষ্মী যতটা সন্তুষ্ট ছিলেন, মা সরস্বতী ছিলেন ততটাই রূষ্ঠ। জমিদারের মতে এসব গান বাজনা বাইজীদের সাজে, গৃহবধূর নয়। 

   মীরজাফর আলি দেখলেন পার্বতীর এতদিনের সাধনা, এত প্রতিভা এক নিমেষে নষ্ট হয়ে যাবে। গুরু হয়ে তিনি তাঁর চোখের সামনে এমনটা কিভাবে হতে দিতে পারেন! তিনি বুঝলেন, পার্বতীর গুণের কদর করতে পারে এমন যোগ্য ও সমঝদার লোকের সন্ধান করা তার পিতার পক্ষে কোনমতেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে তিনি যে পার্বতীকে বিবাহের প্রস্তাব দেবেন, এমনটা সমাজের কেউই একেবারেই মেনে নেবে না। মীরজাফর আলি দোটানায় পড়ে গেলেন। পার্বতীর মত একটা প্রতিভা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে এমনটা তিনি কোনমতেই মেনে নিতে পারলেন না। তিনি বুঝলেন, পার্বতীর গুণের কদর করবার মত মানুষ তিনি ছাড়া এই জগতে আর কেউই নেই। তাঁর কাছে একমাত্র একটাই পথ খোলা ছিল, সেটি হল পার্বতীকে তাঁর স্ত্রী রূপে গ্রহণ করা। কিন্তু মীরজাফর আলি জানতেন এ সমাজ তাঁকে এই কাজে কিছুতেই স্বীকৃতি দেবে না। তবুও তিনি পার্বতীর বাবাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। এর ফল যে কি হতে পারে সেকথা তিনি বেশ ভাল করেই জানতেন। তবুও তিনি একটা শেষ চেষ্টা করে দেখলেন। অবশেষে কোন পথ আর খোলা না পেয়ে তিনি পার্বতীকে সকলের এবং সমাজের অমতেই বিবাহ করলেন। 

   মীরজাফর আলিকে হিন্দু সমাজ তো গ্রহণ করলই না উপরন্তু মুসলিম সমাজও তাঁকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করল। এমনিতেই তাঁর হিন্দু ধর্মের প্রতি আকর্ষণ সকলের চোখেই শূলের মত হয়ে বিঁধত, তার উপর হিন্দু জাতের মেয়েকে বিবাহ করবার পর সে আগুনে যেন ঘৃত সংযোগ হল।

   হিন্দু এবং মুসলমান - এই দুই সমাজ থেকেই বিতাড়িত দুটি মানুষের কাছে এক অজানা পথে পাড়ি দেওয়া ছাড়া আর কোন পথই খোলা ছিলনা। সেই কারণে মীরজাফর আলি পার্বতীকে নিয়ে চলে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে যেখানে তাঁদের কেউ চেনেনা, কেউ কখনই তাঁদের দেখেনি। যাবার সময় শুধু সঙ্গে নিলেন রুদ্রবীণা। মীরজাফর আলি আর পার্বতী এই দুটি জীবন যেন রুদ্রবীণার দুই প্রান্তের দুটি তুম্বা যার মেল বন্ধন গড়ে উঠল সঙ্গীতের এক পবিত্র সম্পর্কের তার দিয়ে, যে সম্পর্ক হল রুদ্রবীণার সুরের ঝঙ্কারের মতই নিষ্পাপ এবং সুমধুর। 

মীরজাফর আলি আর পার্বতী সঙ্গে করে আরও একটা জিনিস নিয়ে গেলেন সেটা হল দুই সমাজের কাছ থেকে দুই প্রকার অভিশাপ। পার্বতীর পিতা রাগে, দুঃখে আর ঘেন্নায় মেয়েকে অভিসম্পাত করলেন, "যে যবনের প্রেমের কারণে তুই তোর পিতাকে ত্যাগ করলি, তাকে নিয়ে তুই কখনও সুখে ঘর বাঁধতে পারবিনা।" আর অপর দিকে মীরজাফর আলির পিতা তাঁর একমাত্র পুত্রের অসামাজিক আচরণের কারণে মীরজাফর আলিকে অভিসম্পাত করলেন, "যে রুদ্রবীণার কারণে তুই তোর জাত, কুল, মান, মর্যাদা আর ধর্মকে অপমান করলি, সেই রুদ্রবীণাই হবে তোর অকালমৃত্যুর কারণ।"

   মীরজাফর আলি আর পার্বতীর নববিবাহিত দুটি জীবন দুই কুলের এবং দুই সমাজের অভিসম্পাতকে পাথেয় করেই অগ্রসর হল এক অজানা, অচেনা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। 

   মীরজাফর আলি আর পার্বতীর নবজীবন শুরু হল পথে পথে ঘুরে ঘুরে আর রুদ্রবীণার তারে সঙ্গীতের মূর্ছনা তুলে মানুষের মন জয় করে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে। তাদের না থাকল কোনও স্থায়ী ঠিকানা, না থাকল কোনও স্থায়ী বাসস্থান। দু বেলা দু মুঠো আহার আর রেওয়াজ করবার মত শান্ত, নিরিবিলি কোনও স্থান এই নিয়েই কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর। 

   কিন্তু এত দুঃখের সত্ত্বেও মীরজাফর আলি আর পার্বতীর সুখের সংসারে হয়তো বিধাতাপুরুষের কিছুমাত্র সমর্থন ছিলনা। সেই কারণেই হয়ত মীরজাফর আলি কয়েকবছরের মধ্যেই ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হলেন এবং একলা ফেলে গেলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী পার্বতী আর সদ্যজাত, সদ্য প্রষ্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় এক ফুটফুটে পুত্র সন্তানকে। পরলোকে যাত্রাকালে তিনি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় রুদ্রবীণাকে সমর্পিত করলেন তাঁর স্ত্রী পার্বতীর হাতে আর বলে গেলেন, 'মৃত্যুর কুঠারাঘাতে আমাদের পার্থিব সম্পর্ক বিচ্যুত হলেও এই রুদ্রবীণাকে তুমি আমার প্রতিমূর্তি বলেই গণ্য করবে। এই রুদ্রবীণার মাধ্যমেই আমি তোমার পাশে সর্বদা অবস্থান করব। আমাদের পুত্রকে তুমি এমন করে তালিম দেবে, যাতে এই রুদ্রবীণার ঝঙ্কারে সে সমগ্র জগতে ঝড় তুলতে পারে।' 

   পার্বতী কিন্তু তার স্বামীর কথা রাখেনি। তার মনের মধ্যে এক প্রকার বদ্ধমূল ধারণা ইতিমধ্যেই বটবৃক্ষের শিকড়ের ন্যায় গভীরে এবং সবিস্তারে শাখা বিস্তার করে স্থির বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে যে এই রুদ্রবীণা তার জীবনে অভিশাপ ব্যতীত আর কিছুই নয়। একমাত্র এই রুদ্রবীণার কারণেই সে সমাজচ্যুত, ধর্মচ্যুত হয়ে একাকী এই জনসমুদ্র মাঝে সদ্যজাত এক পুত্রকে নিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হয়েছে। তাই সে এমন এক নতুন জীবন শুরু করবে যেখানে রুদ্রবীণার কোন স্থান থাকবে না। সে তার পুত্রকে কিছুতেই আর রুদ্রবীণার তালিম দেবে না। স্বামীর স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ সে রুদ্রবীণাকে একেবারে পরিত্যাগ করলনা ঠিকই, কিন্তু সেটিকে এমন ভাবে কোনও গোপন স্থানে রাখার সিদ্ধান্ত করল যেখান থেকে আর সেটিকে কখনই আর কারও পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না হয়, সে ছাড়া এই রুদ্রবীণার ঠিকানা আর কারো পক্ষেই যেন জানা সম্ভব না হয়।  

   কাছেই ছিল অতি প্রাচীন এক শিবের মন্দির। অচীনপুর নামক এক গ্রামের এই শিবের মন্দিরেই পার্বতী তার সংসার নিয়ে শেষ বারের মত আশ্রয় নিয়েছিল। শিবের বেদীর নিচে এক গোপন স্থানে পার্বতী সেই অভিশপ্ত রুদ্রবীণাকে গোপনে এবং সকলের অগোচরে লুকিয়ে রাখল এবং প্রতিজ্ঞা করল তার পুত্রকে ঘুনাগ্রেও এই রুদ্রবীণার কথা কখনই জানতে দেবে না। 



   বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ভারবর্ষে স্বাধীনতা এলো। জমিদার প্রথার বিলোপ হল। তারও পরে কেটে গেল আরও সত্তরটা বছরেরও বেশি। তবুও আজ একশোর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পার্বতীর মনে হয় এই তো সেদিনের কথা যেদিন সে মীরজাফর আলির হাত ধরে সমাজ থেকে, পরিবার থেকে বিচ্যুত হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল। জলের স্রোতের মত যেন দিনগুলো কেমন করে কেটে গেল, পরিবর্তন হল সমাজের রীতি নীতির, পরিবর্তন হল মানুষের ভাবনার। কিন্তু আজও পার্বতী তার জীবনের গোপন কথা তার পুত্রের কাছে একটি বারের জন্যও বলেনি, বলেনি তার স্বামী ওস্তাদ মীরজাফর আলির প্রতিভার কথা যে প্রতিভার মোহে একদা সকল সঙ্গীত-প্রেমী মোহিত হত, যে প্রতিভার টানে সে বাধ্য হয়েছিল তাঁর হাত ধরে ধর্মকে আর সমাজকে পরিত্যাগ করতে। 

   স্বামীর ধর্মকে শিরোধার্য করে পার্বতী ইসলাম ধর্মকেই তার জীবনের ধর্ম বলে বরণ করে নিয়েছে, শুধু তাই নয় নিষ্ঠা ভরে সে সেই ধর্মের পালনও করে চলেছে। এখনও পর্যন্ত দুর্গা পুজোর ঢাকের কাঠির শব্দে তার হৃদয় আন্দোলিত হলেও ঈদের নামাজে সে নিষ্ঠা ভরে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করে। আল্লাহ্‌র কাছে সে প্রার্থনা করে যাতে তার বংশের আর কেউ ঐ অভিশপ্ত রুদ্রবীণার সংস্পর্শে না আসতে পারে।

    পার্বতীর একমাত্র পুত্র রমজান আলি সঙ্গীতের বড় ভক্ত। রুদ্রবীণার টান তার রক্তের মধ্যেও আছে। টেলিভিশনে আর অনলাইনে সে রুদ্রবীণার আলাপ শুনতে বড়ই ভালবাসে। পার্বতী বহুবার চেষ্টা করেছে রমজানকে রুদ্রবীণার নেশা থেকে বের করে আনতে, কিন্তু পারেনি। রক্তের টান যাবে কোথায়? তার ধমনীতেও যে ওস্তাদ মীরজাফর আলির রক্তের স্রোত বইছে। রমজানের বয়স এখন প্রায় সত্তরের দোরগোড়ায়। রমজানের একটি মাত্র পুত্র নুর এ বাসার আলি। বড় ভাল ক্লাসিক্যাল গায় ছেলেটা। নুরকে দেখে পার্বতীর তার স্বামী মীরজাফর আলির কথা মনে পড়ে। অবিকল মীরজাফর আলির শরীরের গঠন পেয়েছে নুর। যেমন দেখতে মীরজাফর আলির মত, ঠিক তেমনই সঙ্গীতের সমঝদারও বটে। গানের থেকে নুরের বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আগ্রহ বেশি। পার্বতী বোঝে আসল টানটা কোথায়। কিন্তু কিছুতেই সে নুরকে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেয় না। প্রাণপণে সে এখনও পর্যন্ত তার বংশকে বাদ্যযন্ত্রের থেকে দূরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু আর বেশিদিন বোধ হয় সেটা সম্ভব হবার নয়। এখন তার বয়স হয়েছে। জীবনে বহু উত্থান পতনের সম্মুখীন হতে হতে তার শরীর আজ বড়ই ক্লান্ত। বয়সের ভারে তার শরীর আর চলে না। কে কি করছে সেটা আর সবসময় দেখাও সম্ভব হয় না। তবুও সে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় যাতে করে অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত তার প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে। সে জানে ওস্তাদ মীরজাফর আলির আত্মা আজও হয়তো শান্তি পায়নি। তবুও যে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে তার থেকেও যারা আজও পৃথিবীতে বেঁচে আছে তাদের প্রতি কর্তব্য পালনটাকে সে বেশী প্রয়োজন বলে মনে করে। সে কোন মতেই আর তার বংশের সর্বনাশ দেখতে প্রস্তুত একেবারেই নয়। কিন্তু আল্লাহ্‌ হয়ত পার্বতীর সেই প্রচেষ্টাকে সফল হতে দিতে চান না। হয়ত পূর্বপুরুষের সেই অভিশাপ থেকে আজও তার বংশ মুক্ত হতে পারেনি। সেই কারণেই হয়ত তার পুত্র রমজান আলি বর্ডারে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে গুরুতর অবস্থায় জখম হয়ে আজ বিছানায় শয্যাশায়ী। ইন্ডিয়ান আর্মির লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদে চাকরিরত অবস্থায় সে অবসর সময়ে তাঁবুতে বিশ্রাম নিতে নিতে রুদ্রবীণার আলাপ শুনছিল। ঠিক সেই সময় আততায়ীদের হাতে গুরুতর অবস্থায় জখম হয় রমজান আলি। পার্বতীর মনে তত দিনে অভিশপ্ত রুদ্রবীণার ধারণা অনেকটাই লঘু হয়ে এলেও রমজান আলির জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা যেন তার মনে অগ্নিতে ঘৃত সংযোগের কাজ করল। তবে কেবলমাত্র যদি একটি ঘটনা হত সেটাকে না হয় মনের ভুল বলে মনে করা যেতে পারত। এই তো সেদিন নুর এ বাসার আলি বিদেশ থেকে ক্লাসিক্যাল কনসার্ট শেষ করে ফেরবার সময় বিমান দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্রায় দুই মাস বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছিল। আল্লাহ্‌র অপার কৃপায় সে কোন মতে সুস্থ হয়ে উঠেছে। পার্বতী যানে, এই বংশে সঙ্গীতের চর্চা বন্ধ না হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাই তো সে কোনমতেই সঙ্গীতের চর্চাকে প্রশ্রয় দিতে চায় না। তবুও যেন সে কিছুতেই সঙ্গীতকে তার বংশ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনা। কোন এক অদৃশ্য টানে যেন তার সন্তান সন্ততিরা সঙ্গীতের পিছনে ছুটে চলেছে, যে টানকে উপেক্ষা করা নদীর উজানে নৌকা দাঁড় করানোর মতই অসম্ভব এক কাজ। 

   নুর এ বাসার আলির ছেলে ইব্রাহিম আলির আবার স্প্যানিশ গিটার বাজাবার বড় ঝোঁক। এখনকার বাংলা ব্যান্ড না কি সব উঠেছে, সেখানে বেদম নাচতে নাচতে স্টেজে গান গায়। সেদিন দুপুরেই তো সে কোলকাতার কোন এক স্টেজে গীটার হাতে গান গাইতে গাইতে স্টেজ ভেঙ্গে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে ঘরে এসেছে। 

   পার্বতীর দুশ্চিন্তাকে পরিবারের সকলে তুচ্ছ জ্ঞান করলেও পার্বতী যানে এতগুলো ঘটনা নিছক কাকতালীয় একেবারেই নয়। তার বংশ এখনও রুদ্রবীণার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি। সে কারণেই সঙ্গীতের সমান্তরালে একের পর এক বিপদ তার বংশের পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। এর প্রতিকার একমাত্র একটি পথেই হতে পারে, সেটি হল এই বংশ থেকে সঙ্গীতের চিরতরে অবসান। না হলে এর ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে কথা ভাবলেই পার্বতীর বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। 

   তবে ভবিতব্যকে আটকাবার শক্তি আমাদের মত সাধারণ মানুষের হাতে কি আর আছে! আমরা মানুষেরা যতই সাবধানতা অবলম্বন করি না কেন, যা ঘটবার তা তো ঘটবেই। আজ ইব্রাহিমের নাকি একটা স্টেজ শো আছে, পায়ের অবস্থা এখনও ভাল নয়, কোন মতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে ছেলেটা। তবুও তাকে যেতে হবে। কোনও এক গ্রামে নাকি কলেজের বাৎসরিক অনুষ্ঠান আছে। পার্বতী ইব্রাহিমের পাশে এসে তার মাথায় স্নেহ ভরে হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করল, আর একটু বিশ্রাম নিলে হত না!

   ইব্রাহিম বলল, 'না বড় দাদী আমাকে কষ্ট করে হলেও যেতে হবে। আগে থেকে বুকিং হয়ে আছে, নাহলে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে।'

   'কোথায় যেতে হবে শুনি, কতদূরে সেই গ্রাম?,

   ইব্রাহিম বলল, 'গ্রামের নাম অচীনপুর।'

   'অচীনপুর!' বিস্ময়ের সাথে পার্বতী অচীনপুর নামটা এমন ভাবে উচ্চারণ করল যার ফলে ইব্রাহিম বেশ আশ্চর্য হল।

   'কি হল দাদী, তুমি এমন করে উঠলে কেন?'

   'না, কিছু না। এমনিই আরকি।'

   'তোমার শরীর ঠিক আছে তো?'

   'আমাকে তোর সাথে নিয়ে যাবি?'

   'তুমি যাবে আমার সাথে?'

   'হ্যাঁ, যাবো।'

   'কিন্তু এই শরীরে তুমি কি অতদুর যেতে পারবে দাদী'

   'কেন রে, আমি কি এতটাই বুড়ি হয়ে গেছি?'

   'একদম নয়, আমার দাদী তো এখনও যুবতী আছে। সে কি কখনও বুড়ি হতে পারে? ঠিক আছে আমি আব্বুকে বলে তোমার যাবার বন্দোবস্ত করছি। কিন্তু আব্বু যদি সম্মতি না দেয়?'

   'তোর আব্বু আমাকে আটকাবার কে রে! তোর আব্বুকে এখনও কান ধরে ঘোরাবার মত শক্তি আমার শরীরে আছে।'   

   এই বয়সে সত্যিই এতটা ধকল সহ্য হবার নয়। কোলকাতা থেকে অচীনপুরের দূরত্ব অনেকটাই। তবুও কারোর কাকুতি মিনতিতে পার্বতী কর্ণপাত পর্যন্ত করলনা। অবশেষে তার জেদের কাছে সকলেই হার মানতে বাধ্য হল। কিন্তু অচীনপুরে যাবার আসল কারণটা যে আসলে কি সেটা পার্বতী কারোর কাছেই প্রকাশ করল না। পার্বতী কাউকেই বলে বোঝাতে পারলনা যে সেখানে যাওয়াটা তার কতটা প্রয়োজন। অচীনপুর গ্রামের নামটা শোনামাত্র পার্বতীর মনে এমন এক অনুভূতি এলো যা কারোর কাছেই প্রকাশ করবার মত নয়। ঠিক যেমন কোনও সায়েন্টিস্ট দীর্ঘদিন, দীর্ঘ-বছর সাধনা করবার পর হঠাৎ কোন এক দিনে তার সমস্যার উত্তর চলে এলে তার মনের মধ্যে হয়, অনেকটা সে রকমই। সে বুঝল অচীণপুরে ইব্রাহিমের সফর নিছক কাকতালীয় ঘটনা নয়। অদৃষ্টের টানেই আজ হয়তো তার ডাক এসেছে অচীণপুর থেকে। এখনও যদি পার্বতী সচেতন না হয়, এখনও যদি তার পরিবারের একের পর এক অঘটনকে সে একেবারে হালকা করে নিয়ে থাকে, তাহলে এর পরিণাম মারাত্মক হতে পারে। সে মনে মনে বলল, হে আল্লাহ্‌ আমাকে শক্তি দাও আমি যেন আমার বংশকে অন্তিম সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। 

   সকলের কাকুতি মিনতি, ওজর আপত্তিকে উপেক্ষা করে, পার্বতী সকলের অমতেই অচীনপুরের উদ্দেশ্যে ইব্রাহিমের সঙ্গে যাত্রা শুরু করল। যে পার্বতী এক সময় তার স্বামীর হাত ধরে হিন্দু এবং মুসলিম এই দুই সমাজের সঙ্গে লড়াই করে জীবনের এতটা পথে পাড়ি দিয়েছে, সেই পার্বতীকে রোখার ক্ষমতা কি এই সব হাঁটুর বয়সী ছেলেদের আছে! বয়সের ভারে শারীরিক ভাবে দুর্বল হলেও মানসিক দিক দিয়ে কিন্তু সে সেই সত্তর বছর আগের মতই আছে। যে মন বাস্তবের মাটিতে লড়াই করে তার জয়পতাকা উত্তোলিত করেছে, সেই মন কি এত সহজে দুর্বল হতে পারে! 



   দিন বদলের সাথে সাথে বদলেছে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, বদলেছে মানুষের রুচি। যে গ্রামে এক সময় দূর থেকে দূরান্তরে ছিল ফাঁকা ধু ধু প্রান্তর, মাইলের পর মাইল জুরে ছিল শুধুই নিস্তব্ধতা আজ সেই অচীনপুর গ্রামকে দেখলে যেন চেনাই যায় না। পুরাতন মানুষ, পুরাতন মুখের বদল ঘটেছে, বদলেছে প্রকৃতির রূপ। এ যেন অচেনা, অজানা এক অচীনপুর। পার্বতী কিছুতেই যেন সেই সত্তর বছর আগেকার অচীনপুরকে আজকের অচীনপুরের সাথে মেলাতে পারলনা। চারিদিকে চোখ মেলে সে যেন কিছু একটা খুঁজে চলেছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেনা কিছুতেই। 

   বহুদিন পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পার্বতী যেন নিজেকে সকলের সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারলনা। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে সে নিজের একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। আজকের বাস্তবের মাটিতে সে জগতের সাথে যেন তার মন গড়া জগতের কিছুমাত্র সাদৃশ্য সে খুঁজে পেল না। পার্বতীর মাথা ঘুরতে লাগল। সমস্ত জগৎ যেন লাট্টুর মত দোল খেতে খেতে তার চোখের সামনে ঘুরতে লাগল। পার্বতীর বৃদ্ধ, দুর্বল পদযুগল কোনমতে আর তার শরীরের ভার যেন ধরে রাখতে পারলনা। পৃথিবী যেন বাসুদেবের দোলায় চড়ে নিজের মনেই দুলতে লেগেছে। পার্বতী সে দোলার দুলুনিতে নিজেকে কিছুতেই আর ধরে রাখতে পারলনা। নিমেষেই লুটিয়ে পড়ল তার শরীর মাটির কোলে, তারপর সব অন্ধকার।

   ইব্রাহিম যে এত বড় একজন স্টার সেটা পার্বতী কল্পনাই করতে পারেনি। আজকের জগৎ সম্পর্কে সে কোনও খবরই রাখেনা। পার্বতীকে অচেতন হতে দেখে মিডিয়ার লোকজনের মধ্যে হঠাৎ এক কম্পন শুরু হয়ে গেল। ইব্রাহিম রকস্টার বলে কথা। এখন ইব্রাহিমের নামের আগে ওস্তাদ কথাটা ব্যবহার না হলেও স্টার কথাটা কিন্তু প্রচলিত। আজ থেকে সত্তর বছর আগে হলে হয়ত স্টার ইব্রাহিমকে ওস্তাদ ইব্রাহিম বলে ডাকা হত। পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন হলেও অন্তর্নিহিত অর্থটা কিন্তু সেই একই রয়ে গেছে। 

   পার্বতীকে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে সে কিছুটা সুস্থ বোধ করল। সকলের দিকে তাকিয়ে সে কিছুক্ষণ সময় নিলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে। তারপর ইব্রাহিমকে বলল, 'অচীণপুরে একটা পুরাতন শিবের মন্দির ছিল, সেটা কোথায় বলতে পারিস দাদু ভাই?'

   ইব্রাহিম এর আগে কখনও অচীণপুরে আসেনি এবং তার পরিবারের কারো কাছ থেকে অচীণপুরের নামও শোনেনি। দাদীর মুখে অচীণপুরের শিবের মন্দিরের প্রসঙ্গ শুনে তার মনে হল দাদী নিশ্চয়ই কখনও অচীণপুরে এর আগে এসেছে। তবে দাদী যদি এসেই থাকে তবে তার সাথে আসবার আগে তো একথা একবারও বলেনি! ইব্রাহিম দাদীকে জিজ্ঞেস করল, 'তুমি অচীণপুরে কি এর আগে কখনও এসেছ দাদী?'

   পার্বতী বলল, 'সে সব কথা পরে হবে। তুই আগে বল এখানে একটা প্রাচীন শিবের মন্দির ছিল, সেটা ঠিক কোথায়? আমি কিছুই চিনতে পারছি না।'

   ভীরের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল, 'সে শিব মন্দির তো চৌপথীর মোড়ে'

   পার্বতী বলল, 'হ্যাঁ ঠিক, চৌপথীই বটে। চৌপথীর ধারে সেই শিবের মন্দিরে আমাকে এখনই নিয়ে চল, আমি এখনই সেখানে যাবো।'

   সমস্ত ঘটনা যেন নিমেষের মধ্যে এক নাটকীয় পরিবর্তনের মোড় নিলো। সেই নাম না জানা ব্যক্তি, যে চৌপথীর ঠিকানা জানে, সে চলল আগে আগে সকলের পথপ্রদর্শক হয়ে আর বাকি সকলে চলল তার পিছু পিছু।

   কিছুক্ষণের মধ্যেই চৌপথীর মোড়ে সেই শিবের মন্দিরের কাছে সকলে এসে জড়ো হল। পার্বতী দেখল সেই প্রাচীন শিবের মন্দিরের পরিবর্তন ঘটেছে। একদা নিরালা, নির্জন পরিবেশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা শিবের মন্দিরের আর সেই ভগ্ন দশা আর নেই। তার প্রাচীর থেকে শুরু করে মেঝে পর্যন্ত নতুন করে নির্মিত হয়েছে। ভক্তদের ভিড়ে শিবের মন্দির পরিপূর্ণ।

   পার্বতী জিজ্ঞেস করল, 'মন্দিরে এত ভিড় কেন রে আজ?'

   সেই নাম না জানা ব্যক্তি বলল, 'ও মা ঠাকুমা জানোনা, আজ তো শিবরাত্রি।'

   'শিবরাত্রি?' কতদিন পরে পার্বতীর সেই ছেলেবেলাকার কথা মনে পড়ে গেল। সারা দিন নির্জলা উপবাসের পর শিবের মাথায় জল ঢালত সে। এখন তো সে সব গল্প কথা। পার্বতী মন্দিরের আঙ্গিনায় পদার্পণ করল। আজ থেকে সত্তর বছর আগে যদি লোকে দেখত যে, কোন এক মুসলমান শিবের মন্দিরে পদার্পণ করেছে, তাহলে এতক্ষণে বেজায় গণ্ডগোল বেধে যেত। এখন দিনকালের পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের মনে জাতপাতের বিরুদ্ধে শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। বলা যেতে পারে মানুষ এখন অনেকাংশেই ধর্মের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। 

   পার্বতী দেবাদিদেব মহাদেবকে ভক্তি ভরে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। ইব্রাহিম তো তার মুসলমান দাদীর কাণ্ড দেখে একেবারে অবাক। কোন এক মুসলমান বৃদ্ধা যে এভাবে হিন্দু দেবতাকে প্রণাম করতে পারে একথা তো সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনা। তার উপর সেই বৃদ্ধা যদি তার নিজের দাদী হয়ে থাকে যাকে কিনা সে জন্ম থেকে কেবল আল্লাহ্‌র কাছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখেছে, তাহলে তো অবাক হবারই কথা।

   নিমেষের মধ্যে ঘটনার পর ঘটনা যে ভাবে ঘটে চলেছে, যেভাবে উত্তরোত্তর প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে বাকি সকলে অবাক হলেও পার্বতীর কিন্তু সে সব দিকে কিছুমাত্র ধ্যান নেই। সে যেন আজ কোন এক বিশেষ এক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য জীবন পণ করেছে আর সে উদ্দেশ্যেই সে সকলকে অবাক করে দেবাদিদেব মহাদেবের বেদীর দিকে বৃদ্ধ বয়সের ক্ষীণ পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। তাকে বাধা দেবার মত শক্তি যেন আজ কারোর মধ্যে নেই, তাকে বাধা দেবার মত আগ্রহও কারোর মধ্যে লক্ষ্য করা গেলনা। 

   বহু কষ্টে মহাদেবের বেদী পর্যন্ত গিয়ে সে হাঁপিয়ে পড়ল। তারপর শরীরে আরও কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে সে সকলকে অবাক করে দিয়ে মহাদেবের বেদীর নিচে থেকে বের করে আনল সেই সত্তর বছর আগেকার স্মৃতির ধুলোর আবরণে আবৃত অভিশপ্ত রুদ্রবীণাকে। 

   এই সেই রুদ্রবীণা যার জন্য হয়ত সে এখনও পর্যন্ত জীবিত আছে, এই রুদ্রবীণার তারের সাথেই যেন তার জীবনের তার এখনও পর্যন্ত এই পৃথিবীর মাটিতে শক্ত হয়ে গেঁথে আছে। এই রুদ্রবীণার কারণেই হয়ত ওস্তাদ মীরজাফর আলির আত্মা এখনও পর্যন্ত শান্তি পায়নি, এই রুদ্রবীণার ধ্বংসের সাথেই হয়তো তার তার বংশের অভিশাপ মুক্তির উপায় লুকিয়ে আছে।

   পার্বতী রুদ্রবীণাকে তার কোলের উপর সযত্নে স্থাপন করে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে সেটাকে আবার তার স্বরূপে ফিরিয়ে আনল। তারপর সকলকে আরও অবাক করে দিয়ে মন্দিরের আঙ্গিনায় রুদ্রবীণার তারে ঝঙ্কার তুলল। রুদ্রবীণার তারের ঝঙ্কারের সাথে সাথে তার সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সত্তর বছর পরে যেন এক অনন্য অনুভূতি তার শরীরের প্রতিটা কোষকে আন্দোলিত করে তুলল। রুদ্রবীণার তারে পার্বতী সুরের আলাপ শুরু করল। কি মধুর সে ঝঙ্কার, কি মাদকতা সেই সুরে! পার্বতী মুদ্রিত নয়নে নিপুণ হস্তসঞ্চালনে রুদ্রবীণাকে তার আঙুলের তালে যেন কথা বলাতে লাগল। তার দু চোখ বেয়ে বারি ধারার মত অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। তার হাতে যেন ওস্তাদ রমজান আলি এসে অবস্থান করেছেন। জীবনের সবথেকে সুমধুর সুর যেন আজ রুদ্রবীণার তারের মাধ্যমে ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে। 

   অপার করুণাময় আল্লাহ্‌র হয়তো এই নির্দেশ ছিল, হর হর মহাদেবের হয়তো এই ইচ্ছে ছিল যা বুঝতে পার্বতীর জীবনের সত্তরটা বছর সময় লেগেছে। আজ সেই নির্দেশের, সেই ইচ্ছের সে অবশ্যই পালন করবে। 

   এক সময় পার্বতীর বৃদ্ধ অঙ্গুলি ক্লান্ত হল, রুদ্রবীণার তারে সুরের মূর্ছনা ম্লান হয়ে এলো। পার্বতীর শরীর ধীরে ধীরে শয্যাশায়ী হল। রুদ্রবীণা মন্দিরের মেঝেতে আঘাত পেয়ে দ্বিখণ্ডিত হল। পার্বতী আর উঠল না। রুদ্রবীণার সাথে সাথে সে যেন সেদিনই সে তার বংশের উপর থেকে অভিশাপের অবসান ঘটাল। পার্বতী যেন দুই সমাজের সেই প্রাচীন অভিশাপকে নিজ হস্তে বরণ করে নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে রুদ্রবীণার খণ্ডনের মাধ্যমে যাত্রা করল মৃত্যুলোকে আর মুক্ত করল তার পরিবারকে রুদ্রবীণার অভিশাপ থেকে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy