পাগল
পাগল
১
সূর্যাস্তের সাথে সাথে ঠাণ্ডা হাওয়া যেন কেমন ভিজে ভিজে হয়ে আসছে। আরও একটু সন্ধ্যে বাড়লে চারিদিকে যখন ঠাণ্ডা অন্ধকারে ঢেকে গেল, তখন রাস্তার বাতিগুলো ফট ফট করে একে একে জ্বলে উঠল। রাস্তার গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলো অন্ধকারের বুক চিরে ছুটতে লাগলো। একটা হর্নের আওয়াজে কান দুটোর পর্দায় যেন কেমন ঝিন ঝিন করে আওয়াজ উঠতে লাগলো লোকটার। কালো গায়ের রঙের উপর কালো ধুলোর দীর্ঘদিনের জমে থাকা ছোপ বড় বড় গোঁফ দাঁড়ির ফাঁক দিয়ে যেটুকু মুখের চামড়া দেখা যাচ্ছে, সেটাকেও ঘন কালো অন্ধকারের মত লেপটে রেখেছে। শুধু চোখের লাল অংশটুকু যেন লোকটার শরীর থেকে একটু আলাদা রকম বলে মনে হচ্ছে। লোকটার শরীরের মলিনতা, তার চোখের উজ্জ্বলতাকে এতটুকুও গ্রাস করতে পারেনি।
একটা গাছের তলায়, যেখানে চওড়া রাজপথের পাশ দিয়ে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে একটা সাত ফুটের রাস্তা কিছুটা সোজা গিয়ে আবার দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে, ঠিক সেই খানে গাছের তলায় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো চাতালে কালো, সারা গায়ে নোংরা মাখা লোকটা একটা ছেঁড়া কম্বল গায়ে জড়িয়ে মাথার দিকটা ঘোমটার মতো টেনে বসে আছে। দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে মাঝে মাঝে কম্বল মোড়া লোকটা দুলে দুলে উঠছে। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা দমকা হাওয়া কম্বলের ফাঁক দিয়ে ঢুকে লোকটার শরীরের লোমগুলোকে খাঁড়া করে তুললেও, সেটা লোকটাকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে না। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত্রি যত বাড়তে লাগলো রাত্রির অন্ধকার আরও গাড় এবং শিশির ভেজা হয়ে উঠতে লাগলো। কুয়াশার ধোঁয়ায় লোকটা যেন ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যেতে লাগলো। সিমেন্টের চাতাল দিয়ে ঘেরা গাছটা কুয়াশার চাদরে ক্রমে ঢেকে যেতে লাগলো। কুয়াশার ধোঁয়া গাছের পাতায় মাখামাখি হয়ে জল হয়ে পাতা থেকে গড়িয়ে টপ টপ করে ঝড়ে পড়তে লাগলো মাটিতে। দু’এক ফোঁটা ঠাণ্ডা হিমের জল কম্বলের ছেঁড়া ফাঁক দিয়ে গায়ে এসে পড়লে লোকটা আর অপেক্ষা না করে সোজা বন্ধ হয়ে যাওয়া কস্মেটিক্স এর দোকানের টিনের শেডের তলায় গিয়ে বসল। সঙ্গে প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে রাস্তা থেকে কুড়ানো জলের বোতল থেকে কিছুটা জল আর এক টুকরো পাউরুটি বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে কম্বলের ঝোলা অংশটুকু সামলাতে সামলাতে দোকানের শাটারের গায়ে আরাম করে হেলান দিয়ে দিল। গাছের তলার স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা রকের থেকে এই জায়গাটা বেশ গরম। সামনের দিকের পিচ ঢালা রাস্তাটা ভিজে গিয়ে আরও কালো হয়ে গিয়েছে। গাড়ির হেডলাইটের আলোর প্রতিফলনে ভেজা রাস্তাটা মাঝে মাঝে চক চক করে উঠছে। চলন্ত গাড়ির শব্দগুলো দূর থেকে স্পষ্ট হয়ে হয়ে হুস করে দমকা শব্দ তুলে আবার ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
লোকটা এবার কম্বল সমেত পা’টা ছড়িয়ে দিয়ে দোকানের শাটারের গা ঘেঁষে শরীরটাকে এলিয়ে দিল। সারাদিনের ক্লান্তির পর চোখটা যেন সঙ্গে সঙ্গে জুড়িয়ে এলো তার। সারাদিন প্রচুর কাজ করতে হয় তাকে। সকাল থেকে নির্দিষ্ট কিছু দোকান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তার ভাগ্যে কিছুটা খাবার জোটে। একটা দোকান থেকে যতটুকু খাবার জোটে তাতে করে এত বড় শরীরের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। অগত্যা তাকে আবার অন্যত্র খাবারের সন্ধান করতে হয়। দোকানে ভিড় থাকলেও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। কাস্টোমারের ভিড়ের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে দোকানীর ব্যবসার ক্ষতি হলে পরের দিন আর খাবার পাওয়া যাবে না। তাই দিনের বেশীরভাগ সময়টাই লোকটার অপেক্ষা করতে করতেই কেটে যায়। এ ছাড়া রাস্তার ডাস্টবিনে যদি কখনও কখনও ভালো খাবার কিছু জুটে যায়, সে দিনটা তার বেশ ভালোই কাটে। আজ ডাস্টবিন থেকে একটা গোটা পাউরুটি পাওয়া গেছে। তার থেকে কিছুটা খেয়ে বাকিটা রেখে দিয়েছে পরে প্রয়োজনমত খাবে বলে।
দোকানের সমনের টিনের শেড থেকে টুপ টুপ করে কুয়াশার জল বৃষ্টির মতো ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ঝড়ে পড়তে লাগলো। লোকটা সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যেই লাল লাল চোখ দুটোকে বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাস্তার মোড়ের মাঝখানের সিমেন্টের চাতাল দিয়ে ঘেরা গাছতলায় যেখানে কালো লোকটা প্রথমে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসেছিল, সেখানে ঠিক তার পিছনের দিকটা বাদামি রঙের হাড় সর্বস্ব একটা বয়স্ক কুকুর লোকটার অলক্ষ্যে লেজ গুটিয়ে বসে ছিল। কুকুরটার আলাদা কোনও নাম নেই। জন্ম থেকেই কুকুরটাকে সবাই কুকুর বলেই ডাকে। বুড়ো বয়েসে লড়াই করে খাবার শক্তি তার ফুরিয়েছে। কম বয়সী কুকুর গুলোর সাথে মার পিট করে আর সে পেরে ওঠে না। একসময় কুকুরটার গর্জনে সারা পাড়া কাঁপত। সিংহের মত গায়ের লোম ফুলিয়ে যখন গর্জন করতে করতে ক্ষিপ্র গতিতে সে ছুটে যেত, তখন অনেক তেজস্বী ও সাহসী কুকুরও বাধ্য হত তার এলাকা ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু, আজ সেই শক্তি বা সাহস আর নেই কুকুরটার মধ্যে। আজ সকাল থেকেই প্রায় অভুক্ত অবস্থাতেই কুকুরটা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গাছতলায় এসে বসেছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীরটা তার কুঁকড়ে যেতে লাগলো। খিদে পেটে ঠাণ্ডাটা বোধ হয় একটু বেশীই লাগে!
বেশ কিছুক্ষণ লেজ গুটিয়ে বসে থাকার পর যখন কুয়াশা ভেজা শরীরে ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে শরীরের চামড়া ফুঁড়ে হাড়ের ভিতর পর্যন্ত ঠাণ্ডা পৌঁছে গেল, তখন কুকুরটা আর গাছতলায় বসে থাকতে পারলো না। গরমের লোভে সে ঐ লোকটার গা থেকে ঝুলে থাকা কম্বলটাকে দাঁত দিয়ে টেনে নিয়ে গায়ে দিয়ে দিল এবং গরমের আমেজে সেও কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত্রির গভীরতা যত বাড়তে লাগলো, ঘুমের আমেজও তত গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো।
ভেজা রাত্রির কালো অন্ধকার গভীর হতে হতে আবার ফর্সা হয়ে উঠতে শুরু করল। পূর্ব দিকে গগনচুম্বী বিল্ডিং এর ফাঁক দিয়ে আকাশের যতটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, কেবল মাত্র সেটুকু অংশই কিছুটা উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে। বাকিটা এখনও কুয়াশার চাদরে ঢাকা। রাত্রির গাড় ঘুম ক্রমে পাতলা হয়ে এলে লোকটা গায়ের কম্বলটা টেনে পাশ ফিরে শুতেই কুকুরটার পেটে হাঁটুর গুঁতোটা বেশ জোরেই লাগলো। হঠাৎ সুখ নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটলে কুকুরটা চমকে উঠে কেঁউ কেঁউ করে উঠল। আচমকা অনভিপ্রেত এরকম ঘটনায় লোকটাও চমকে উঠে এক লাফে কম্বল ফেলে রাস্তার দিকে ছিটকে গেল। লোকটাকে এভাবে ছিটকে যেতে দেখে কুকুরটাও রাস্তার উল্টো দিকে ছিটকে গিয়ে পিছনের দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে সামনের দু’টো পা’কে টান টান করে গলাটা যতদূর সম্ভব সামনের দিকে বাড়িয়ে পরবর্তী আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকলো। কুকুরটা আর লোকটার মাঝখানে কম্বলটা দু’টো দেশের মাঝে বর্ডারের মত করে পড়ে রইল।
বেশ কয়েক মুহূর্ত এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর দু’জনেই যখন বুঝল, যে তারা একে অপরকে আক্রমণের জন্য কেউই আর চেষ্টা করছে না, তখন কম্বলের দু’পাশে দু’জনই কিছুটা আশ্বস্ত হল। লোকটা আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে এসে কম্বলটাকে তুলে নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে হাই তুলতে আর মাথা চোলকাতে লাগলো। কুকুরটাও এবার লোকটার দেখাদেখি শরীরটাকে টান টান করে আলস্য ভাঙতে লাগলো। তারপর ল্যাজ নেড়ে নেড়ে লোকটার দিকে জিভ বের করে তাকিয়ে থাকলো। বোতলের জলে চোখ মুখ ধুয়ে প্যাকেট থেকে পাউরুটির টুকরোটা মুখের কাছে খাবার জন্য তুলে ধরতেই লোকটা দেখল যে, কুকুরটাও ঐ পাউরুটির টুকরোটার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কুকুরটার মুখের দিকে লোকটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর দু’হাতে অর্ধেক পাউরুটিটাকে আবার অর্ধেক করে একটা টুকরো কুকুরটার দিকে ছুঁড়ে দিল, আর বাকি অর্ধেকটা নিজের মুখে পুড়ে দিল। কুকুরটা এবং লোকটা দু’জনেই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো পাউরুটি চেবাতে লাগলো। লোকটা তার জীবনের একাকীত্বের মাঝে হঠাৎ একটা সঙ্গী পেয়ে বেশ খুশীই হল। অন্য দিকে কুকুরটারও একটা প্রভুর একান্তই দরকার হয়ে পড়েছিল।
দিনের আলো ক্রমে যত পরিষ্কার হতে শুরু হল, কুয়াশার সাদাটে ভাব নীলচে আকাশের আলোয় ক্রমে মিলিয়ে যেতে লাগলো। পিচ ঢালা রাস্তাটা এখন বেশ অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। রাস্তার ভিজে ভাব যত শুকনো হতে লাগলো, কাদাটে ভাবও তত পরিষ্কার হয়ে ধুলো হয়ে উড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর রোদের রেখা আরও স্পষ্ট হলে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রা আরও দ্রুত গতিতে শুরু হতে লাগলো। রাস্তার ধারে গাছটার শিশির ভেজা পাতাগুলো একটু আগেও চক চক করছিল, কিন্তু এখন আবার আস্তে আস্তে ধুলো পড়ে পাতাগুলো মলিন হয়ে যেতে লাগলো।
দোকানের যে অংশটাতে তারা দু’জনে বসেছিল, তার পাশে একটা পচা ফলের টুকরোর উপর সবুজ রঙের মোটা মোটা মাছিগুলো ভন ভন করছিল। কুকুরটা সেদিকে একটু এগিয়ে যেতেই তার পিঠে সদ্য লড়াই এর কারণ বশত দগদগে ক্ষত চিহ্নের জায়গাটাকে মাছিগুলো ঘিরে ধরল। অস্বস্তি ভরে কুকুরটা ঐ ক্ষতস্থানে জিভ দিয়ে চাটার জন্য চেষ্টা করল। পিঠের ক্ষতস্থানের দূরত্বের তুলনায় কুকুরটার জিভটা বড্ড ছোট। তবুও কুকুরটা চেষ্টা করল যতটা সম্ভব জিভটাকে টেনে লম্বা করে ক্ষতস্থানে বুলতে। তার ফলে সে কয়েকবার গোল করে পাকও খেয়ে গেল। কিন্তু তবুও কিছুতেই যেন সুরাহা হল না। শেষে কুকুরটা রাস্তায় উল্টে পালটে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। পিঠ চুলকানো হয়ে গেলে গা’টা ঝেড়ে নিয়ে দেখল, লোকটা কম্বল আর প্লাস্টিকের বস্তাটা মুড়ে কাঁধে নিয়ে সামনের রাস্তার দিকে এগিয়ে চলেছে। কুকুরটাও আর কাল বিলম্ব না করে লোকটার পিছন পিছন লেজ নাড়তে নাড়তে জিভ বের করে হাঁটতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে লোকটা একবার পিছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে হাসতেই, কুকুরটাও মনে মনে বেশ খুশি হল। এবার সে লোকটার থেকে দূরত্ব আগের থেকে অনেকটাই কমিয়ে লোকটার পায়ে পায়ে ঘুরতে লাগলো। পাড়ার যে মস্তান কুকুরগুলো কাল রাত্রে কুকুরটাকে ঘিরে ধরে কামড়াকামড়ি করে ধরাশায়ী করেছিল, তারা আর আজ কুকুরটার সামনাসামনি হতে সাহস করল না। শুধু দূর থেকে দু-একবার রাগের বশে ঘেউ ঘেউ করে চীৎকার করল। লোকটা পিছন ঘুরে একটা ইটের টুকরো নিয়ে ছুঁড়ে মারতেই মস্তান কুকুরগুলো লেজ গুটিয়ে ছুটে পালাল। তাই দেখে কুকুরটার আনন্দ যেন আর ধরে না। লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে সে’ও মস্তান কুকুরগুলোর উদ্দেশ্যে গর্জন করে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। প্রভুর বলে বৃদ্ধ কুকুরও যেন বলীয়ান হয়ে উঠল।
২
প্রতিদিনকার অভ্যাস বশত লোকটা বাঁধাধরা দোকান গুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো এবং সে নিজে যা খেল, তার অর্ধেকটা তার নতুন সঙ্গী কুকুরটাকেও দিল। সারাদিন তারা দু’জনে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো। রাস্তার ধারের খাবারের দোকান গুলোর পাশের ডাস্টবিনটা থেকে রাত্রের জন্য খাবার সংগ্রহ করে লোকটা প্লাস্টিকের বস্তাটার মধ্যে পুড়ে নিলো। তারপর আবার সোজা রাস্তা ধরে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে লোকটা হাঁটতে লাগলো। রাস্তায় পড়ে থাকা কোনও কিছু তার প্রয়োজন বলে মনে হলে, সেটাকে তুলে নিয়ে প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে পুড়ে নিতে লাগলো। কত দিন ধরে যে লোকটা এই ভাবে জিনিস সংগ্রহ করছে তা বলা যায় না, তবে তার প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে যে কি কি প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে, তা হয়তো তার নিজেরই জানা নেই। দিনের পর দিন তার বস্তার ভার কেবল বেড়েই চলেছে। তবুও লোকটার প্রয়োজন যেন ফুরোয় না। এই ভাবে সারা দিনের ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে দিনের আলো ক্রমে ফুরিয়ে এলে তারা দু’জনে মিলে আবার সেই গাছতলায় ফিরে এসে ষ্টেশনারীর দোকানটা বন্ধ হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
কুকুরটা এখন আর লোকটাকে ভয় পায় না। সে তার মাথাটা লোকটার কোলে তুলে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ল্যাজ নাড়ত লাগলো। লোকটা সস্নেহে কুকুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নেহ ভরে কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে! তুই কি এবার থেকে আমার সঙ্গেই থাকবি?’ লোকটার কথার ভাষা কুকুরটা কতটা বুঝল বলা যায় না, তবে লোকটার কথার প্রতিটা শব্দের মধ্যে যে পরম স্নেহ মাখানো আছে, সেটা ঐ অবলা দুর্বল কুকুরটা নিশ্চিত ভাবেই বুঝতে পারলো। তাই কুকুরটা তার নিজের ভাষাতেই কুই কুই করে সম্মতি জানালো। এই দুই ভিন্ন গোত্রের প্রাণীর মধ্যে যে ভিন্ন ভাষায় ভাবের আদান প্রদান ঘটল, তা বোঝা এই দুই প্রাণী ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভবপর হল না। তাদের এই স্নেহ ভরা ভাবের আদান প্রদানের সাক্ষী স্বরূপ নীরব রাত্রি নীরব হয়েই ঘুমিয়ে রইল।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাত্রি যত বাড়তে লাগলো, ঠাণ্ডা হাওয়া যেন আরও বেশী করে ঠাণ্ডা হয়ে উঠল। লোকটা কম্বলটাকে নিজের গায়ের উপর জরিয়ে নিয়ে বাকী অংশটা কুকুরটার গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর রাস্তার একঘেয়ে গাড়ির শব্দে তাদের দু’জনেরই চোখ জুরিয়ে এলো এবং লোকটা বসে বসে ঘুমের ঘোরে মাঝে মধ্যে সামনের দিকে ঢুলে ঢুলে পড়তে লাগলো।
রাত্রি প্রায় দশটা নাগাদ ষ্টেশনারীর দোকানের শাটারের ঘড় ঘড় শব্দে লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। কুকুরটাও এবার কম্বল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দোকানদারের চলে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। এই একদিনেই কুকুরটা লোকটার প্রতিদিনের রুটিন একেবারে মুখস্থ করে ফেলেছে। বাইকে স্টার্ট দিয়ে দোকানী চলে যেতেই দু’জনে টিনের শেডের তলায় গিয়ে আরাম করে আশ্রয় নিলো। তারপর লোকটা খড়মর করে প্লাস্টিকের বস্তার ভিতর থেকে রাত্রের জন্য ডাস্টবিন থেকে কুড়নো খাবার দু’ ভাগে ভাগ করে নিয়ে একটা ভাগ নিজে খেল এবং অপর ভাগটা কুকুরটাকে দিয়ে দিল।
দু’জনে নিশ্চিন্তে খাবার খেয়ে কম্বলটাকে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে লোকটা কুকুরটার গলায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আর কুকুরটাও গলাটাকে লম্বা করে প্রভুর হাতের স্পর্শ উপভোগ করতে লাগলো। মাত্র এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই লোকটা এবং কুকুরটার মধ্যে যে স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তা দেখে কে বলবে যে এরা মাত্র একদিন আগে পর্যন্তও কেউ কাউকেই চিনত না!
ক্রমে রাত যত গভীর হতে লাগলো, রাজপথে গাড়ির চলাচলও কমে যেতে লাগলো। দূর পাল্লার বাস আর মালবাহী লড়ি ছাড়া রাস্তায় আর কোনও জান-বাহন নেই বললেই চলে। কুয়াশার চাদরে রাস্তার বাতিগুলো ধূসর হয়ে জ্বলতে লাগলো। অন্ধকারের বুক চিরে আলো ঢোকার সামান্য রাস্তাটাও যেন কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা পড়ে গেল। লোকটা আর কুকুরটা কম্বল জরিয়ে সুখনিদ্রার গভীরে সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে লাগলো।
কয়েকদিনের মধ্যেই লোকটা আর কুকুরটা ক্রমে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। এখন তারা দু’জনে একসঙ্গে অনেক দূর পর্যন্ত সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও অচেনা রাস্তা বা অচেনা গলিতেও ঢুকে পড়ে তারা দু’জনে। এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় তারা। বৃদ্ধ কুকুরটা কিন্তু নতুন যায়গায় গেলে খুবই উৎকণ্ঠায় থাকে। তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় প্রায় সকলেই লোকটাকে চেনে। কিন্তু এলাকার বাইরে যখন লোকটা ঘুরে বেড়ায়, তখন অনেকেই তাকে পাগল বলে তাড়া করে। ছোট ছোট ছেলেগুলো ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে। আবার কখনও বা অন্য পাড়ার মস্তান কুকুরগুলো লোকটাকে ঘিরে ধরে কামড়াতে আসে। তবুও বৃদ্ধ কুকুর তার প্রভুকে বিপদে রক্ষা করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। কুকুরটা মনে মনে ভাবে, ‘কি দরকার এলাকার বাইরে বেরোনোর!’ কিন্তু পাগল লোকটা তার সঙ্গীর মনের কথা বুঝলেও তাকে বোঝাতে পারে না যে, সে ঘুরে বেড়ায় দু’টো প্রাণীর জীবন ধারণের জন্য একটু বেশী খাবারের সন্ধানে। এখন যে লোকটার দায়িত্ব কুকুরটার মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগানোর! এ কথা সে ঐ অবলা বৃদ্ধ কুকুরটাকে বোঝাবে কিভাবে!
এখন তারা আর সকালে বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে না। ভোরের আলো ফোটবার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে। সকালে কর্পোরেশনের গাড়ি সব ঝেড়ে-মুছে সাফ করে দেবার আগেই ডাস্টবিন থেকে ভালো ভালো খাবারগুলো সংগ্রহ করতে হবে। বৃদ্ধ কুকুরটা ডাস্টবিনের দিকে খুব একটা ঘেঁষে না। মস্তান কুকুরগুলো তাহলে তাকে ছিঁড়ে খাবে। লোকটা একটা ইটের টুকরো নিয়ে তেড়ে জেতেই কুকুরগুলো লেজ গুটিয়ে ছুটে পালাল। তারপর লোকটা তার কাঁধের প্লাস্টিকের বস্তায় ভালো ভালো খাবার গুলো ঢুকিয়ে নিলো। ভালো সাইজের মাংসের হাড় পেলে সে কুকুরটার জন্য সযত্নে সংগ্রহ করে নেয়। তারপর সেখান থেকে দূরে গিয়ে কোনও গাছতলায় বসে দু’জনে প্রাতরাশ সমাপ্ত করে। কুকুরটা বেশ অনেকক্ষণ ধরে প্রভুর পায়ের কাছে বসে মাংসের হাড় নিয়ে খেলা করতে থাকে।
কুকুরটা লোকটার জীবনে আসার পর থেকে বাঁধাধরা দোকানগুলো তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। কুকুরটার গায়ের ক্ষতস্থান থেকে বিচ্ছিরি একটা গন্ধ বেরোয়। তাই কুকুরটাকে দোকানের সামনে দেখলেই দোকানীরা মগে জল নিয়ে ছুঁড়ে মারে। তারপর থেকে লোকটাও ঐ দোকান গুলোয় যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এখন রাস্তার ডাস্টবিন ছাড়া আর তাদের কোনও উপায় নেই। যেদিন যতটা পারে তারা গোগ্রাসে খেয়ে নেয়, কেননা কে জানে কাল হয়তো কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হলে ভালো ভালো খাবারগুলো বৃষ্টির জলে থই থই করা ডাস্টবিনে মাখামাখি হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে! ইতি মধ্যেই শীতকালে দু’এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়ে এবারে শীতটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে।
লোকটা জানে, কুকুরটা মাছ আর মাংস খেতে খুব ভালোবাসে। তাই ভালো ভালো মাংসের টুকরোগুলো সে কুকুরটার দিকে এগিয়ে দেয়। কুকুরটা একবার মাংসের লোভে ড্রেনের ধারের বস্তি-বাড়ি গুলোর একটা রান্না ঘরে মাংস চুরি করতে ঢুকেছিল। কিন্তু ডানপিটে কালো মোটা বৌটা হাতের খুন্তিটা ছুঁড়ে এমন পায়ে মেরেছিল যে কুকুরটা এখনও পা-টা একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে।
ভাগ্যিস সেদিন খুন্তিটা কুকুরটার মাথায় লাগেনি, তাহলে হয়তো কুকুরটা এতদিনে মরে ভুত হয়ে যেত। লোকটার দেওয়া মাংসের টুকরোগুলো খেতে খেতে কুকুরটা তার লেজটা পিছনের খোঁড়া পায়ে বুলতে লাগলো।
৩
কলোনিতে একদিন খুব হৈ-চৈ পড়ে গেল। কোনও একটা বাচ্চা ছেলেকে নাকি ছেলে ধরায় তুলে নিয়ে গেছে। এলাকা কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল। কলোনির বৌ গুলো পর্যন্ত কোমর বেঁধে এদিক ওদিক ছেলেটার খোঁজ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে পুলিশের গাড়ি এলো। ধবধবে সাদা পোশাক পড়া পুলিশগুলো সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আবার কোথায় চলে গেল।
লোকটা আর কুকুরটা রাস্তার মোড়ে সেই গাছতলাটার পিছনে চুপটি করে বসে সব চুপচাপ লক্ষ্য করছিল। গোলমালের তীব্রতার আঁচ পেয়ে তারা দোকানের টিন শেডের আশ্রয় ছেড়ে গাছের পিছনে সুরক্ষিত যায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।
উত্তেজিত লোকগুলোর ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ বলে উঠল, ছেলেধরা নাকি পিঠে বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ছোট ছোট ছেলেদের অজ্ঞান করে বস্তার মধ্যে পুড়ে তার উপর নোংরা আবর্জনা ভরে নেয়, যাতে ছেলেটাকে আর দেখতে পাওয়া না যায়। তারপর ছেলেটাকে নিঃশব্দে পাচার করে দেয়।
লোকগুলোর কথা শুনে লোকটার খুব ভয় পেলো। লোকটা তার বাঁ হাত দিয়ে প্লাস্টিকের বস্তাটাকে মুঠো করে চেপে ধরল। গাছের পিছন দিক থেকে প্লাস্টিকের খড়মড় করে আওয়াজ শুনে লোকগুলো মুখ বাড়িয়ে দেখল, একটা পাগলাটে লোক প্লাস্টিকের বস্তায় আবর্জনা ভরে লুকিয়ে বসে আছে।
ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘ঐ যে বস্তা ওয়ালা লোকটা, ও-ই ছেলেদের বস্তায় করে ধরে নিয়ে যায়। মারো ওকে মারো। মার খেলে তবে ও মুখ খুলবে’।
লোকটা ভয়ে হাত-পা জড়ো করে গাছের গোরার দিকে শিটিয়ে গেল। মাথাটা নিচু করে ক্রমে হাঁটু দু’টোর ফাঁকে যতটা পারা যায় গুঁজে দিতে লাগলো। উত্তেজিত জনতা নিমেষের মধ্যে লোকটার উপর চরাও হয়ে চড়, কিল, লাথি, ঘুষি, জুতো, ঝাঁটা দিয়ে মারতে লাগলো। প্রভুকে মার খেতে দেখে বৃদ্ধ কুকুরটা তার যতটা সম্ভব শক্তি দিয়ে প্রভুকে বাঁচাবার চেষ্টা করল। কিন্তু কেউ একজন সজোরে কুকুরটার পেটে লাথি মারতেই কুকুরটা ছিটকে একেবারে রাস্তার ধারে চলে গেল। যন্ত্রণায় পেট মুচড়ে কাৎরাতে লাগলো কুকুরটা। উত্তেজিত জনতার মাঝখানে কুকুরটা তার প্রভুকে আর দেখতে পাচ্ছে না। এমন কি প্রভুর গলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না। এমনিতেই প্রভু খুব কম কথা বলে। সারাদিনে একটা কি দু’টো কথা বলে কিনা সন্দেহ।
মার খেতে খেতে লোকটা মাটিতে শুয়ে পড়ে হাত উঁচু করে যতটা পারা যায় নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু দুর্বল শরীরে আর বেশীক্ষণ সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত লোকটার শরীর মাটিতে এলিয়ে পড়ল। তার সত্ত্বেও আরও কিছুক্ষণ লোকটার উপর চড়, কিল, লাথি, ঘুষি, ঝাঁটার প্রহার চলতেই থাকলো। লোকটার মুখ ফেটে রক্ত বেরোতে লাগলো। চোখের ধার গুলো ফুলে উঠল। সারা গায়ে জুতোর সাদা সাদা ধুলোর ছাপ পড়ে গেল, আবার শরীরের কোথাও কোথাও ঝাঁটার কাঠির দাগ দগদগে হয়ে ফুলে উঠল। লোকটা মরার মত হয়ে চুপ করে শুয়ে রইল। শুধু লাল লাল চোখ দু’টো দিয়ে রাস্তার অপর পারে তার সঙ্গী বৃদ্ধ কুকুরটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে শুয়ে শুয়ে দেখল, তার প্লাস্টিকের বস্তা থেকে তার অতি প্রয়োজনীয় জিনিস গুলোকে লোকগুলো রাস্তায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। জলের বোতল, ভাঙা চিরুনি, জলের মগ, সিগারেটের প্যাকেট, ভাঙা ডিশ, ছেঁড়া কাঁথা, ছেঁড়া জুতো – সব একে একে রাস্তার উপর ছড়িয়ে পড়ছে। তার দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ তার করবার মত কিছুই নেই, এমন কি উঠে দাঁড়াবার শক্তিও আর তার শরীরে নেই।
প্লাস্টিকের বস্তার সব জিনিসগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেবার পর হারিয়ে যাওয়া ছেলেটাকে যখন বস্তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল না, তখন লোকগুলো দাঁত বের করতে করতে নিজেরাই নিজেদের বোকামির উপর হাসাহাসি করতে লাগলো। কিন্তু আশ্চর্য! এত মার খেয়ে পাগল লোকটা বেঁচে থাকলো নাকি মরে গেল, সেদিকে কেউ ঘুরেও তাকাল না। তারা হয়ত বুঝতেও পালন যে, এক নিমেষের মধ্যে তারা লোকটার সাজানো সংসার একেবারে ছারখার করে দিল।
লোকগুলো চলে গেলে বৃদ্ধ কুকুরটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে লোকটার মাথার সামনে এসে বসল। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে কুকুরটা জিভ বের করে ধুঁকতে ধুঁকতে অসহায়ের মতো লেজ নাড়তে লাগলো। কুকুরটার পেটে লাথিটা বেশ জোরেই লেগেছে। জিভটা যেন তার চোয়াল ছিঁড়ে নিচের দিকে নেমে আসতে চাইছে।
লোকটা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে এদিক ওদিক গড়াগড়ি খেতে লাগলো। চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে লোকটার গালের ধুলোয় মাখামাখি হয়ে কাদা কাদা হয়ে গেল। লোকটার গায়ের ছেঁড়া কালো আলখাল্লাটা, যেটা কোনও এক কালে বোধ হয় সাদা ছিল, সেটা আরও ছিঁড়ে গেল। কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা নোংরা প্যান্টটা খুলে গিয়ে কোমর থেকে নেমে গিয়ে শরীরটা প্রায় নগ্ন হয়ে পড়েছে।
প্রভুকে যন্ত্রণায় কাতর হতে দেখে বৃদ্ধ কুকুরটার চোখের কোণেও যেন জল চলে এলো। বয়সের ভারে কুকুরটার চোখ দু’টো ঝুলে গেছে। চোখের পাশের কালো কালো দাগগুলো দেখলে মনে হয় কুকুরটা বুঝি কাজল পড়ে আছে, জিভ বের করে পুরো দমে হাঁপাতে হাঁপাতে কুকুরটা একবার প্রভুর দিকে আর একবার রাস্তায় ছড়ানো জিনিসপত্রগুলোর দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকলো। এছাড়া তার আর কিই বা করবার থাকতে পারে! তার মতো তার প্রভুর জীবনও যে শক্তিশালী প্রাণী গুলোর হিংস্রতার কারণে সুরক্ষিত নয়, সেটা সে বেশ উপলব্ধি করতে পারল।
কিছুক্ষণ পরে পাড়ার মস্তান কুকুরগুলো সুযোগ বুঝে বুড়ো কুকুরটাকে ঘিরে ধরবার মতলব করে একে একে এসে হাজির হতে লাগলো। আস্তে আস্তে গলায় গড় গড় করে আওয়াজ করতে করতে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে খেঁকিয়ে উঠল। যন্ত্রণায় কাতর লোকটা টলতে টলতে বাঁ হাতে দড়ি বাঁধা প্যান্টটাকে কোমরের দিকে টেনে তুলে উঠে দাঁড়ালো। লোকটার গা থেকে এই শীত কালেও ঘাম ঝরে পড়ছে আর গা থেকে ঘামের উগ্র গন্ধ বের হচ্ছে। ডান হাতে প্লাস্টিকের বস্তাটাকে অবশিষ্ট মালপত্র সমেত টেনে সজোরে কুকুরগুলোর দিকে ছুঁড়ে মারল। কুকুরগুলো ভয় পেয়ে কেঁউ কেঁউ করতে করতে পালিয়ে গেলে লোকটা বাঁ হাতে প্যান্টটাকে চাগিয়ে ধরে এক দিকে হেলে দাঁড়িয়ে ধুলো আর ঘামে মাখামাখি নোংরা শরীরটাকে কোনও মতে চাগিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে খিল খিল করে হাসতে লাগলো। লোকটার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, মুখ ফেটে তাজা লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার সত্ত্বেও সে খিল খিল করে হাসছে। সে বোধ হয় সমাজের সুস্থ মানুষগুলোর পাগলামি দেখে হাসছে!
উবু হয়ে বসে লোকটা কুকুরটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, তোর মতো আমারও গায়ে ওরা কামড়ে দিয়ে গেল। এখন তোর আর আমার মধ্যে আর কোনও পার্থক্যই নেই’। এই কথা বলে লোকটা আবার খিল খিল করে হেসে উঠল। কুকুরটা ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরে মুখটাকে যতটা পারা যায় ফাঁক করে জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি আশ্চর্য জীবন্ত চোখ লোকটার! চোখে যেন অফুরন্ত প্রাণ শক্তি চোখটাকে স্বচ্ছ স্ফটিকের মত করে তুলেছে।
৪
‘কুকুর!’ লোকটা এবার গলায় একটু বেশ খুশী খুশী ভাব নিয়েই ডাকল, ‘কুকুর!’ – কুকুরটাকে লোকটা কুকুর বলেই ডাকে।
প্রভুর ডাক শুনে কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে লোকটার কাছে এগিয়ে এলো। লোকটার পা শুঁকল, হাত শুঁকল, তারপর পিছনের দিকের পায়ে ভর দিয়ে সামনের পা দু’টো লম্বা করে গলা উঁচু করে বসে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। লোকটা স্নেহ ভরে কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আর কুকুরটা কান দু’টোকে লম্বালম্বি ভাবে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে চুপ করে বসে রইল।
রেলের এই স্টেশনটায় লোকের ভিড় খুব একটা হয় না বললেই চলে। সব সময় স্টেশনটা প্রায় ফাঁকাই থাকে। তাই এখানে বেশ শান্তিতেই থাকা যায়। লোকজনের চাপ বা কোলাহল একেবারে নেই। লোকটার কাছে আর সেই প্লাস্টিকের বস্তা বা কম্বলটা নেই। শীত পেরিয়ে গরমটা বেশ পড়েছে। এখন আর কম্বলের দরকারই বা কি। এমন কি লোকটার গায়ের ছেঁড়া আলখাল্লাটারও আর দরকার নেই বলে সেটাকেও সে খুলে ফেলে দিয়েছে। এখন একেবারে ঝাড়া হাত-পা। সারা দিন শুধু কুকুরটার সঙ্গে খেলে বেড়ায় আর এদিক ওদিক এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়।
কিছুক্ষণ প্রভুর হাতের আদর খেয়ে কুকুরটা আবার একটু এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে চলে গেলে ওভার ব্রিজের নীচে ছাওয়ায় একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে লোকটা আবার কুকুরটা ডাকে, ‘এই কুকুর! কুকুর!’ প্রভুর ডাক শুনে কুকুরটা আবার লেজ নাড়তে নাড়তে কাছে চলে আসে। গরমের ফুরফুরে হাওয়ায় চোখে ঘুম জরিয়ে এলে লোকটা সেই একই ভাবে খুঁটিতে হেলান দিয়ে মাথাটা একদিকে কাত করে ঘুমিয়ে পরে। ফুরফুরে হাওয়ায় নাকের ডগায় নেমে আসা বড় বড় চুলগুলো সুর সুর করে উড়তে থাকে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলোর ভিতরে মাছিগুলো ভন ভন করে উড়তে উড়তে ভিতরে ঢুকে গেলে যখন সুড়সুড়ি লাগে, লোকটা ঘুমের ঘোড়েই দাঁড়িটা একবার চুলকে নেয়, তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
স্টেশনের ধার ঘেঁষে সোজা একটু গিয়ে রাস্তাটা যেখানে বাস স্ট্যান্ডে মিশেছে, সেখানে একটা পাঞ্জাবী ধাবায় কারখানার কুলি-মজদুররা প্রতিদিন খাওয়া দাওয়া করে। সেখানকার ডাস্টবিন থেকে প্রতিদিন প্রচুর টাটকা উচ্ছিষ্ট খাবার পাওয়া যায়। দুপুরে আর রাত্রে কুকুরটার আর লোকটার বেশ পেট ভরে খাবারের বন্দোবস্ত হয়ে যায়। ধাবার রাঁধুনির হাতের রান্নাও বেশ চমৎকার। খুব সুস্বাদু লাগে খাবারগুলো খেতে। পেট ভরে খেয়ে লোকটা ঢেকুর তুলতে তুলতে হাতের আঙুলগুলো পরম তৃপ্তি ভরে চাটতে থাকে।
পেট ভরে খাবার পর ফুরফুরে হাওয়ায় চোখের পাতাগুলো খুব ভারী হয়ে আসে। মাঝে মধ্যে জোরে হর্ন মেরে কয়েকটা লোকাল কিংবা এক্সপ্রেস ট্রেন যখন ঝপাং ঝপাং করতে করতে স্টেশন দিয়ে চলে যায়, তখন লোকটার ঘুমের গভীরতা একটু পাতলা হয়ে যায়। ভারী ভারী চোখের পাতাগুলো তুলে একবার কুকুরটার দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় সেটা কাছে পিঠে কোথাও আছে কিনা। যদি কাছাকাছি কোথাও থাকে, তবে আবার লোকটা চোখ বন্ধ করে দাঁড়ি চুলকে ঘুমিয়ে পড়ে। না হলে এদিক ওদিক তাকিয়ে একবার ডেকে নেয়, ‘কুকুর! এই কুকুর! এদিকে আয়!’
প্রভুর ডাক শুনে কুকুরটা ছুট্টে চলে এসে লোকটার দিকে তাকিয়ে পিছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে সামনের পা দু’টোকে সোজা করে বসে জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে। লোকটা একটু মুচকি হেসে কুকুরটার মাথায় হাত বুলতে বুলতে আবার ঘুমিয়ে পরে।
