Aritra Das

Classics

3  

Aritra Das

Classics

উদ্ঘাটন - প্রথম অধ্যায়

উদ্ঘাটন - প্রথম অধ্যায়

5 mins
685


-“অভিনন্দন পুত্র হনুমন্ত! বিশ্বের ইতিহাসে তুমিই প্রথম মানব যে সশরীরে উড়তে পারছ! আজ থেকে তুমি আর ইতিহাস নও, আজ থেকে তুমি দেবত্ব লাভ করলে।”


ওপর থেকে আওয়াজ ভেসে এল পবনদেবের। যদিও এইসময় তৃতীয় কোন ব্যক্তি নেই ধারে কাছে, থাকলে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে নিশ্চই ভির্ম্মি খেয়ে যেত।


আকাশে তখন উড়ন্ত একা এক মানব! উড়োজাহাজের যুগে অবশ্য ‘আকাশে ওড়া’ হয়তো সকলের কাছে জলভাত হয়ে গিয়েছে; কিন্তু যে দৃশ্যের কথা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে তা নিতান্তই অদ্ভুত! একজন অনুন্নত সভ্যতার মানুষ আকাশে উড়ছে এবং তাও কোন প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই! কোন উড়নযান নেই, পিঠে কোন ডানা লাগানো যন্ত্রের উপস্থিতি নেই, তাও একজন মানুষ উড়ছে একটা মৃদু মৌমাছির গুঞ্জণের মত শব্দের সঙ্গে, এটাই তো সবচেয়ে বড় বিস্ময়! যেকোন দর্শকদের কাছেই এটা সবচেয়ে আজগুবি এবং ঘোর অবাস্তব!


-“সবই তো বুঝলাম পিতা, কিন্তু আপনি নিজে পর্দার পিছনে অদৃশ্য থেকে আমাকে দৃশ্যমান করে রেখে রাজবাড়ির অন্দরে শত্রুর একেবারে মুখের সামনে প্রেরণ করছেন;এই বুদ্ধি আপনার মাথায় এল কি করে বলুন তো?” আন্দাজে ওপরের দিকে তাকিয়ে পবনদেবের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন হনুমন্ত।


-“রাজবাড়ির অন্দরে মিথিলাকে বন্দিনী করে রাখবার খবরটা সঠিক। ওখানেই আশেপাশে কোথাও আমাদের একজন প্রতিনিধি দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে আছেন। রাজপ্রাসাদ চত্বরে একজন গান্ধর্বীর উপস্থিতির ব্যাপারে তিনিই প্রথম আমাদের জানিয়েছিলেন। তবে উনি ঐ গান্ধর্বীর সঠিক অবস্থানের খবর নিতে পারেন নি। এখন, তদন্ত করে দেখতে তো হবে!”


-“আমাকেও অদৃশ্য করে রাখতে পারতেন!” – মৃদুস্বরে অনুযোগ করলেন হনুমন্ত।


-“ও, এইজন্য বুঝি অভিমান হয়েছে? পুত্র হনুমন্ত, যদি এটা সম্ভব হত তাহলে তোমার জন্যও একই ব্যবস্থা করা হত। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়! দেবতা শুলিনের গবেষণাগৃহ থেকে অদৃশ্যকরণের এই প্রযুক্তি বেশিদিন হল বেরোয় নি। এটি তাঁর গবেষণার প্রাথমিক স্তরের একটি সাফল্য মাত্র, বিষয়টি এখনও গবেষণাধীন। খুবই স্বল্পসংখ্যক দেবতাদের জন্য ধার্য করা হয়েছে এই যন্ত্র। তবে তার চেয়েও বড় কথা, যেসব নির্বাচিত দেবতারা একে পরিধান করছেন তাঁদের দেহাংশের সঙ্গে এর যোগসাধন করা হয়েছে। সেই দেবতা বাদে অপরাপর যেকোন প্রাণী একে পরিধান করা মানেই সাক্ষাৎ মৃত্যু! ইচ্ছে থাকলেও আমি তোমায় মৃত্যুদণ্ড দিতে পারব না!”


অনেকটা পথ উজিয়ে এসেছেন তাঁরা উপকূল থেকে। রৌরব রাজ্যের প্রান্তসীমায় এসে উচ্চতা বেশ কিছুটা কমিয়ে এনেছেন পবনদেব। হনুমন্তের মুখে বসানো ছিল মুখোস, কৃত্রিম শ্বাসগ্রহণে সহায়তা করে এই মুখোস। উচ্চতা কমিয়ে আনবার পর অনুমতি পাওয়া যায় এই মুখোস খুলে গলার কাছে নামিয়ে রাখতে। প্রকৃতপক্ষে, ‘সুমন্ত’কে নিয়ে রৌরব রাজ্যে প্রবেশ করেন নি পবনদেব। তাঁকে রেখে আসা হয়েছিল শত্রুদের নজর এড়িয়ে একটি গুপ্ত জায়গায়। হনুমন্তকে এরপর নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধে কৃত্রিম ডানার সাহায্যে রৌরব রাজ্যে প্রবেশ করেন তিনি। এতে সুবিধা হল এই যে এর ফলে নিষ্ক্রান্ত আওয়াজের পরিমাণ কম, ফলে সতর্ক প্রহরীদের নজর এড়িয়ে বিচরণ করা সম্ভব সহজেই। এছাড়া অদৃশ্য থাকতে পারার সুবিধা তো আছেই। এই অবস্থায় একমাত্র তাপ-সংবেদী দর্শন ছাড়া অন্য কোন চোখে উনি ধরা পড়বেন না। কোন সাধারণ চোখে তো নয়ই।


-“সমস্ত যোজনা মনে থাকবে তো পুত্র হনুমন্ত?”


-“আজ্ঞে হ্যাঁ পিতা।”


-“বেশ। মূল রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গণে তোমাকে নামাব না। ওর পিছনে যে বাগান আছে সেখানে তোমাকে নামিয়ে দেব। ওখান থেকে সোজা উত্তরে হেঁটে গেলে ‘শান্তিবন’পাবে। সেখানেই আশা করছি মিথিলার সন্ধান পাওয়া যাবে। মানচিত্র মনে আছে তো?”


-“আজ্ঞে হ্যাঁ পিতা।”


-“বেশ। তুমি তৈরি হও।”


হনুমন্ত তখন মনে মনে ভাবছেন পিতাশ্রীটি কেমন যেন। মানচিত্রটি সঙ্গে দিয়ে দিলে দোষ কি হত? তিনি তো তখন আর বুঝতে পারেন নি মানচিত্র হস্তান্তরের ব্যাপারে পবনদেবের অনীহার কারণ! যদি মানচিত্র কোনভাবে শত্রুপক্ষের হাতে চলে যায় তবে রাক্ষসরা সতর্ক হয়ে মিথিলার স্থান পরিবর্তন করে দিতে পারেন। তখন আবার বিপদ!


রাজপ্রাসাদের বাইরে বাগানে অবশেষে শেষ হল এই একঘেঁয়ে উড়ান। নির্বিঘ্নেই তাঁরা অবতরণ করলেন বাগানের জমিতে। কাজটি অবশ্য খুঁতহীন হল না; রাজপ্রাসাদের কয়েকজন বাসিন্দা সাক্ষী থাকলেন তাঁর এই উড়ানের। রাবণ সতর্ক হয়ে যাবেন এইবার। সময় কম পাবেন হনুমন্ত, এর মধ্যেই কার্য শেষ করতে হবে।


-“সব তাহলে ভালো করে মনে করে কোরো পুত্র। মনে আছে তো মিথিলার সঙ্গে দেখা হলে কি বলতে হবে?”- শেষবারের মত ঝালিয়ে নিচ্ছেন সব পবনদেব।


-“আজ্ঞে হ্যাঁ পিতা! আমি আসি তাহলে? সময় খুবই স্বল্প।”


-“বেশ। আমিও আসি তাহলে। মনে রেখ, বেরনোর সময়..ঘন্টাঘর..সবচেয়ে উঁচু, শীর্ষে। ওখানেই আমি তুলে নেব তোমাকে।”


পিতাকে নমস্কার করে মিথিলা অণ্বেষণে বেরিয়ে পড়লেন হনুমন্ত।


*******************************************************************************************************************************************


রাবণরাজার বিশাল বাগানে মিথিলাকে খুঁজে পাওয়ার কার্যটা খুব সহজসাধ্য হয়নি অবশ্য। এর পরিব্যপ্তী বিশাল। কিন্তু তার থেকেও বড় বিষয় – জায়গায় জায়গায় দর্শনার্থী, বাগান পরিচারকের দল বা সতর্ক প্রতিহারীর কড়া পাহারা। সকলের চোখ এড়িয়ে একজন মহিলার সন্ধান করা- সমস্যা আরেক জায়গাতেও অবশ্য। ‘সলপা’য় বসবাসকালে মিথিলা সেখানে একাই গান্ধর্বী। তাও বেশিরভাগ সময়তেই হনুমন্ত তাঁকে দেখেছেন মুখঢাকা অবস্থায়। কিন্তু এখানে প্রচুর রাক্ষসী এবং গান্ধর্বীর সমাহার! এতজন মহিলাকে, বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে এতগুলি একইরকম চেহারার প্রাণীদের একইসঙ্গে একই পরিবেশে আগে কোনদিন দেখেন নি হনুমন্ত। তাঁর অনভ্যস্ত চোখ মানিয়ে নিতে পারছে না এই নতুন পরিবেশের সঙ্গে। ফলশ্রুতি- একবার দুবার ভুল হয়ে যাওয়া।


এই খানিক্ষণ আগে যেমন, একজন রমণীকে মিথিলা ভেবে ভুল করে তার সামনে এসে দাঁড়াতেই মহিলা আর্তনাদ করে অজ্ঞান! এই সুযোগে ভালো করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল, ঐ রমণী মিথিলা নন!


এইভাবে বাগানের এক অংশ থেকে আরেক অংশে ঘুরতে ঘুরতে একটা সময় পরে একটি অশ্বথ্থ গাছের গোল করে বাঁধানো গোড়ায় এসে শ্রান্তিতে বসে পড়লেন হনুমন্ত। বসে বসে তিনি যখন ফন্দি আঁটছেন এরপরে কোথায় কোথায় খোঁজা যায়, ঠিক এই সময়তেই কাছাকাছি কোথাও কান্নার আওয়াজ পেলেন তিনি। কিন্তু কান্নার আওয়াজ আসছে কোথা থেকে? কৌতুহলি হয়ে উঠলেন হনুমন্ত। এ তো গাছের পিছন থেকেই আসছে মনে হচ্ছে! তাই তো! শুধু মুণ্ডটা বাড়িয়ে দেখলেন হনুমন্ত, একজন রমণী গাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে বসে কাঁদছেন।


বেশ কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে মুখ তুলে চাইলেন মিথিলা। হনুমন্তও তখন পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর সামনে; মুখ তুলতেই দুজনের চোখাচুখি হল।


-“মা মিথিলা!”


-“হনুমন্ত!!”


দুজনেই চিনতে পারলেন একে অপরকে। অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠলেন হনুমন্ত। তাঁর আরাধ্য কার্য সম্পাদন হয়েছে, খুঁজে পাওয়া গিয়েছে মা মিথিলাকে। একইসঙ্গে একটা ফন্দি এসে গেল তাঁর মাথায়; ধারে-কাছে কেউ নেই, এই অবস্থায় বহন করে ওঁনাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে কেমন হয়?


-“মা, প্রভু বীরভদ্র আমাকে দিয়ে খবর–”


কথা শুরু করতেই আচমকা পিছন দিক থেকে একটি তীক্ষ্ণ সূঁচের মত কিছু এসে বিঁধল হনুমন্তের ঘাড়ের কাছে। চমকে উঠে হাত দিয়ে জিনিষটিকে ঘাড়ের কাছ থেকে টেনে বের করে আনলেন হনুমন্ত; সামনের দিকে তাকিয়ে দেখেন মায়ের মুখটা পাংশু হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, ভয়ার্ত মুখ নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন হনুমন্তের পিছনে! অকষ্মাৎ বিশ্বচরাচর দুলে উঠল তাঁর চোখের সামনে। পরক্ষণেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics