Aritra Das

Classics Inspirational

3  

Aritra Das

Classics Inspirational

উদ্ঘাটন - দ্বিতীয় অধ্যায়

উদ্ঘাটন - দ্বিতীয় অধ্যায়

5 mins
708


[পূর্ব প্রকাশিতের পর...]


...আবার আস্তে আস্তে চেতনা ফিরে আসছে হনুমন্তের। একটা অস্পষ্ট খসখস্ আওয়াজ তাঁর অর্ধচেতনার মধ্যেই যেন কানে আসছিল বহুদূর থেকে, চেতনা প্রায় সম্পূর্ণ ফেরৎ আসতে আসতেই তাঁর মনে হল আওয়াজের উৎস খুব যেন কাছেই কোথাও। যদিও তাঁর সম্পূর্ণ চেতনা এবং দৃষ্টি এখনও ঠিক ফেরৎ আসে নি, কিরকম যেন অবসন্ন, নিদ্রাবিহ্বল, ঘোর লাগা ভাব; কিন্তু তাও, কিছুটা চোখ মেলে তাঁর মনে হল যেন ঘরের ভিতরে রয়েছেন তিনি। প্রায়ান্ধকার একটি কক্ষ, কক্ষের ভিতরে আলো-আঁধারির সহাবস্থান।


-“আমার এটা জানবার দরকার যে তুই কে আর কোথা থেকে আসছিস। জেনে তো আমি যাবই, এখন সেটা সহজভাবে হবে না কঠিনভাবে, সেটা নির্ভর করছে তোর ওপর।”


একটা গম্ভীর গলার আওয়াজে সম্পূর্ণ ঘোর কেটে গেল হনুমন্তের। দেখা গেল ঠিকই ধরেছিলেন তিনি; একটি আধা-অন্ধকার বিশাল কক্ষের মাঝখানে এনে শুইয়ে রাখা হয়েছে তাঁকে। ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখে সামনের দিকে তাকাতেই চমকে সিধা হয়ে বসলেন তিনি!


শালপ্রাংশু চেহারার একজন দশাসই রাক্ষস সিংহাসনে বসে খরদৃষ্টিতে সোজা তাকিয়ে রয়েছেন তাঁর দিকে, আর তাঁর সামনে রাখা খানদশেক করোটী! তারই মধ্যে একটিকে তুলে নিয়ে সেটির মাথা চাঁছছিলেন উনি, একটি ক্ষুদ্র কিন্তু বেশ ভারি ছুরি দিয়ে। সবকটি করোটীর মধ্য দিয়ে একটি শক্তপোক্ত দড়ির বা লতার মত জিনিষ গিয়ে একটি গোলাকার বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছে। বোঝাই গেল দশটি মাথার খুলি দিয়ে একটি মালা গঠন হয়েছে; কিন্তু এই মালার তাৎপর্য কি তাই বোঝা গেল না!


-“দশানন… রাবণ?” আলগোছে কথাটি বেরিয়ে এল হনুমন্তের মুখ দিয়ে।


-“মহারাজ রাবণ!” – বজ্রকন্ঠে বলে উঠলেন রাবণ – “যা যা জানতে চেয়েছি সব উগড়ে দে মুখ থেকে। না হলে তোর মৃত্যু আসবে দেরি করে। আর যদি সব ঠিক বলিস তাহলে মৃত্যু আসবে তাড়াতাড়ি! সিদ্ধান্ত তোর।”


কথা কয়টি বলেই আবার শান্তভাবে হাতের খুলির পরিচর্যা শুরু করলেন রাবণ। এতক্ষণে সেদিকে ভালো করে চোখ গেল হনুমন্তের। অস্বাভাবিক গড়ণ খুলিগুলির! সবকটির মাথার পিছন দিকটি বেঢপ আকারের, যেন হাত দিয়ে টেনে টেনে লম্বা করা হয়েছে সেগুলিকে।


এদিকে রাবণও ঠিকই খেয়ালে রেখেছিলেন হনুমন্তের হাবভাব। তিনি বুঝেছিলেন, এ কোন সাধারণ মানব নয়। প্রতিহারীদের মুখে তিনি ঠিকই খবর পেয়েছিলেন যে এই মানব-বাঁদরটি বাগানে মিথিলার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। চারিদিক থেকে কানা-ঘুষায় এও শুনেছেন যে এই মানব-বাঁদরটি নাকি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র্যভাবে হাওয়ায় উড়ে রাজপ্রাসাদের চৌহদ্দীর মধ্যে প্রবেশ করেছে! দেখা দরকার এর পরিচয় কি, কোথা থেকে এসেছে। তারপর পরের পরিকল্পনা। উপস্থিত তিনি পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন এর মনস্তাত্তিক কাঠিন্য কদ্দুর। তাই এর জ্ঞান ফেরৎ আসবার আগেই তিনিও তৈরি হয়ে বসেছিলেন একে বাজিয়ে দেখবার জন্য। যদিও এখনও অবধি একটু বিস্ময় বাদে কোন ভয়েরই প্রতিফলন ধরা পড়ে নি এই মানবের চোখে-মুখে।


-“তোর নাম কি?” অবশেষে হাতের খুলি নামিয়ে পাশে সরিয়ে রেখে তাঁকে প্রশ্ন করলেন রাবণ। তাঁর হাতের কাজ শেষ হয়েছে।


-“হনুমন্ত।”


-“দেবনাগরী ভাষা শিখলি কেমন করে? দিব্যি সব বুঝতে,বলতে পারছিস দেখছি। কে শিখিয়েছে তোকে?”


চুপ করে গেলেন হনুমন্ত। এই প্রশ্নের উত্তরে অন্য যে তথ্যগুলি বাইরে বেরিয়ে আসবে তা সমীচীন নয়, এই ভেবেই চুপ করে যাওয়া।


-“হুঁ। বুঝলাম। আমার সেনাপতিটিকে কি তুইই মেরেছিলি নাকি?”


এবারেও চুপ থাকলেন হনুমন্ত। চুপ করে থাকাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ।


কেমন যেন ক্ষেপে গেলেন রাবণ! করোটীর মালা একদিকে সরিয়ে রেখে খোলা ছুরি হাতে রেগে যেন এগিয়ে এলেন দুপা! তারপর বললেন-


-“মুখ খুলবি, নাকি তোর পাকস্থলি কেটে তোর মুখে পুরে দেব, হতভাগা?”


এবারে রোখ চেপে গেল হনুমন্তেরও। একদৃষ্টে কিছুক্ষণ রাবণের দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে তিনি বললেন দাঁতে দাঁত চেপে-


-“বলব না!”


আর সহ্য করতে পারলেন না রাবণ। ছুরিটিকে হাত থেকে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসে হনুমন্তের মুখে মারলেন এক ঘুঁষি। দড়ি দিয়ে খুব শক্তভাবে তাঁর হাত বাঁধা থাকায় কোন প্রতিরোধ করতে পারলেন না তিনি; ঘুঁষি খেয়ে পাথরের মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে পড়লেন। তাজা রক্তের ঝিলিক বেরিয়ে এল হনুমন্তের দাঁতের ফাক দিয়ে, মাড়ির কষ বেয়ে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে একপেশে হয়ে শুয়ে থেকে শক্তি সঞ্চয় করে আবার উঠে বসলেন তিনি।


রাবণ তখনও প্রবল রাগে ফুঁসছিলেন। এবারে গলা ধরে হনুমন্তকে এক ঝটকায় খাড়া দাঁড় করিয়ে কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন-


-“এবার?”


জবাবে ঘাড় নাড়লেন হনুমন্ত। সন্মতি মিলতে তাঁকে ছেড়ে দিলেন রাবণ। একটু দম নিয়েই তিনি বললেন-


-“আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার ঐ অভদ্র সেনাপতিটিকে আমিই মেরেছি। কিভাবে সেটা জানতে চাইলে আমার হাত খুলে দিন, আপনার প্রশ্নের উত্তর আমিই দেব, আজ একইভাবে আপনাকে বধ করে!”


এই উত্তরে খর দৃষ্টিতে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ হনুমন্তের চোখের দিকে একটানা চেয়ে রইলেন রাবণ; তারপর কোন কথা না বলে হনুমন্তকে ছেড়ে দিয়ে মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিলেন তাঁর ছুরি। তারপর এগিয়ে এসে হাতের ছুরিটা হনুমন্তের গলা লক্ষ্য করে চালাতে যাবেন, এমন সময়-


প্রবল এক বিস্ফোরণ! মনে হল যেন একপাল হাতি ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে, এমনভাবে তাসের ঘরের মত ভেঙে গেল একদিকের দেওয়াল! রাবণ আর হনুমন্ত দুজনেই ছিটকে পড়েছিলেন দুদিকে; সৌভাগ্যবশতঃ রাবণের হাত থেকে ছুরি ছিটকে যায় আর সেটির নাগাল পেয়ে যান হনুমন্ত। দুজনেই অল্পবিস্তর চোট-আঘাত পেয়েছিলেন; তবে ঘটনার আকষ্মিকতায় আর ছিটকে আসা প্রস্তরখণ্ডের প্রভাবে খানিক্ষণের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন রাবণ। এই সুযোগে হাতের রজ্জু কেটে বন্ধনমুক্ত হয়ে দেওয়ালের উন্মুক্ত ভাঙা অংশ দিয়ে পালিয়ে যান হনুমন্ত। প্রহরীরা দৌড়ে আসতে আসতে তিনি তখন রাজপ্রাসাদের বাইরে, ‘শান্তিবন’এর উদ্দেশ্যে ধাবমান।


-“এসেছিই যখন, আমার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করে তবেই যাব”- দাঁত কিড়মিড় করে কথা কয়টি বলে নিজেকে উদ্দীপ্ত করলেন তিনি; তারপর চেয়ে নিলেন গদা। সামনেই পড়ে গেছিল দুজন অস্ত্রধারী রাক্ষস, প্রথমজনের পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে লাফ দিয়ে উঠেই দ্বিতীয়জনের মাথায় গদা মেরে তাঁকে আহত করলেন উনি; তারপর পলকে ঘুরে গিয়েই প্রথমজনকে সজোরে প্রহার! শত্রুরা ভূপতিত হতেই তিনি আর অপেক্ষা করলেন না,দৌড় লাগালেন বাগানের সেই অংশে যেখানে মা মিথিলার দর্শন পেয়েছিলেন উনি। পথমধ্যে বেশ কয়েকবার শত্রুসৈন্য তাঁর মখোমুখি এসে দাঁড়ায় বটে, কিন্তু ওপর থেকে অদৃশ্য আগুনের গোলা এসে তাঁর যাত্রাপথ মসৃণ করে দেয়। বাকি বিক্ষিপ্ত কয়েকজন রাক্ষস; হয় তারা গদার ঘায়ে মারা পড়ে, নয়তো প্রাণত্যাগ করে গদা নিঃসৃত মারণরশ্মির প্রভাবে...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics