Saswati Roy

Classics

3  

Saswati Roy

Classics

উৎসর্গ (স্বীকারোক্তি)

উৎসর্গ (স্বীকারোক্তি)

19 mins
1.0K


#এক


ছোটবেলা থেকেই খুব ডানপিটে হওয়ায় ভয়ডর আমার বরাবরই একটু কম। লোডশেডিং এ মোমবাতি আনতে যেতে হলেও আমি গেছি, মাঝরাতে কোনো বিচিত্র শব্দ পেলেও বাবা, মা, ভাইকে উঠতে না দিয়ে সেই শব্দের উৎস আমি খুঁজেছি। আর সবার মতো ভূতের বই পড়তে বা ভূতের সিনেমা দেখতেও দারুন ভালো লাগে। তবে সেসব দেখেশুনে হাউমাউ করে চিৎকারও করিনি কোনোদিন বা রাতবিরেতে বাথরুম যেতে হলে বাথরুমের বাইরে পাহারাও বসাইনি। ভূতপ্রেতে বিশ্বাস ছোট থেকেই করতাম না। পরে বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে মন আরও কুসংস্কার মুক্ত হয়ে গেছিলো। কিন্তু কিছুদিন আগে আমার সাথে যা হলো তারপর নতুন করে সব কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে। একটু গোড়া থেকে বলি। তখন সবে এক সপ্তাহ হলো রাজারহাটে নতুন ফ্ল্যাটে এসেছি। প্রথম যেদিন ফ্ল্যাটটা দেখতে এলাম, ব্রোকারের কাছে শুনেছিলাম ফ্ল্যাটের মালিক আমেরিকাতে থাকেন। ইন্ডিয়াতে এলে ওরা দূর্গাপুরে নিজেদের বাড়িতে ওঠেন। সেখানে ওদের পুরো পরিবার থাকে। ফ্ল্যাটটা ওরা কিনেছিলেন শুধু ভাড়া দেবার জন্য। একেবারেই নতুন ফ্ল্যাট। আমাদের আগে আর একটি পরিবার মাত্র আড়াই বছর থেকে গেছে। তারা চলে যাবার পর রং টং করে ঝাঁ চকচকে একেবারে ঘরদোর। আমার তো এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল। দুটো বেশ বড় বড় বেডরুম, দুটোর সাথেই অ্যাটাচড্ বাথরুম,একটা স্টাডি, লিভিংরুম, মডিউলার কিচেন, পেল্লাই দুটো ব্যালকনি। টুকুসেরও খুব পছন্দ হয়ে গেলো। অভীক শুধু একবার বললো - একটা পুজো দিয়ে নিলে হতো না? আমি তো চরম নাস্তিক, বলে দিলাম -এটা কি নিজেদের বাড়ি নাকি? নিজেরা বাড়ি করলে তখন ওসব দেখা যাবে। আমাদের নরেন্দ্রপুরের বাড়ি থেকে অভীকের নতুন অফিস অনেকটাই দূর হয়ে যাচ্ছিলো। আর তাছাড়া ও বাড়ির সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ছিল প্রাইভেসি। যৌথ পরিবারে নিজের জন্য খুব একটা সময় পাওয়া যায় না। যেটা আমার লেখালিখির জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। অনেকদিন ধরেই এই নিয়ে মন কষাকষি চলতে চলতে অবশেষে অভীক মেনে নেয় আমার কথা। আমরা মালপত্র নিয়ে একটা শনিবার শিফ্ট করেছিলাম। পরেরদিনটা রবিবার, গোছগাছ করার সময় পাবো। আবার সোমবার থেকেই তো বরের অফিস আর ছেলের স্কুলের জন্য দৌড় শুরু হয়ে যাবে। শাশুড়ি মা অবশ্য একবার বলেছিলেন -তোমরা আর দিন পেলে না নতুন বাড়িতে ওঠার। শনিবার, মঙ্গলবার বাড়ি ছাড়া উচিৎ নয়। যথারীতি আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম সে সব কথা। সব গুছিয়ে বসে গেলাম আমরা। একটা বেশ ভালো কাজের মেয়েও পেয়ে গেছি। সে ই আবার রান্নার জন্য একটি মেয়েকে ঠিক করে দিয়েছে। নামটা ভারী অদ্ভুত, "নিয়তি"। এরা দুজনেই নিজের নিজের কাজে এতটাই দক্ষ যে এদের পিছন পিছন ঘুরে টিকটিক করে কাজ শেখাতে হয় না। ছেলে আর বর বেরিয়ে গেলে আমিও আমার লেখায় পুরোপুরি মন দিতে পারছি। মুখের কথা খসতে না খসতেই চা- কফি যখন যা চাই মুখের সামনে হাজির হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির হাতের রান্নারও তুলনা নেই। আমার বর আর ছেলেও বেশ খুশি নিত্যনতুন রান্না পেয়ে। কিন্তু এমন অফুরন্ত সুখ বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বরও দেখতে পারেন না। ল্যাপটপটা হঠাৎ গড়বড় করতে শুরু করলো। একটা লেখার অনেকখানি হয়তো টাইপ করে ফেলেছি, হঠাৎ দেখছি লেখাটা মুছে যাচ্ছে। কিছুতেই থামাতে পারছি না। ভাবলাম প্রতি লাইনের শেষে লেখাটা সেভ করবো। করলামও। ওমা কোথায় কি, কোনো লেখাই তো সেভ হয়নি। বারবার সার্চ অপশনে গিয়ে নাম দিয়ে খুঁজলাম। নাহ কিচ্ছু সেভ হয়নি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অনেকটা লিখে ফেলেছিলাম গল্পটা। প্রায় নতুন ল্যাপটপ, এমন তো হবার কথা নয়। বিকালে নিয়ে গেলাম সার্ভিস সেন্টারে। ওরা দেখেশুনে কিছু পেলো না। সফ্টওয়্যার আপডেট করে আমার হাতে ল্যাপটপটা আবার ধরিয়ে দিলো। পরের দুদিন বেশ চললো ল্যাপটপ। তৃতীয় দিন থেকে আবার সেই হতচ্ছাড়া সমস্যা শুরু হলো। রাগের চোটে ল্যাপটপটা আলমারিতে তুলে রেখে কাগজ কলম নিয়ে বসলাম। লিখছি লিখছি...পরপর শব্দরাও বেশ এসে যাচ্ছে, হঠাৎ নিয়তি এসে হাজির। -বৌদি! - হুম... -বৌদি, বলছি কি? বাধ্য হয়ে লেখা ছেড়ে ওর দিকে চাইলাম। - বলো। টেস্ট করতে হবে মাংসটা? টুকুস একদম ঝাল খেতে পারে না বলে ওর রান্নাগুলো নিয়তি সাধারণত আমায় দিয়ে চাখিয়ে নেয়। - না বৌদি, লঙ্কা দেইনি ঝোলে। আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে যাবো। ভাতটা বসিয়ে দিয়েছি, তুমি যদি একটু নামিয়ে নাও। অন্যমনস্কভাবেই বলে উঠলাম - ঠিক আছে তুমি যাও। আমি নামিয়ে নেবো ভাত। নিয়তি চলে যেতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম ভাতের জল ফুটে উঠেছে। আঁচটা একদম কমিয়ে ঘরে এলাম। দশ মিনিট পরে গেলেই চলবে। আবার লেখাটা নিয়ে বসলাম। বেশ ডুবেও গেলাম। খুব বেশি হলে গোটা দশেক লাইন লিখেছি , একটা বিশ্রী পোড়া গন্ধে ঘোর কেটে গেলো। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম ভাত পুড়ছে। অবাক হয়ে গেলাম। কি করে সম্ভব অনেকটা জল ছিলো তো! গ্যাসের দিকে চাইতেই দেখলাম আঁচ পুরো বাড়ানো। বুকটা হিম হয়ে এলো অজান্তেই। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি সিম করে গেছিলাম গ্যাস। তাহলে কি করে... খুব বেশি চিন্তা করার সময় পেলাম না এটা নিয়ে, ডোরবেলটা বেজে উঠেছে। এই অসময়ে কে এলো। ভাবতে ভাবতে গিয়ে দরজা খুলতেই সামনে অভীক।


- তু..তুমি এখন?

- আর বোলো না। পেনড্রাইভটা ফেলে গেছি। সকালে মনে করে ব্যাগে ঢোকালাম। প্রেসেন্টেশন দিতে গিয়ে দেখি পেনড্রাইভ নেই। কি যে লজ্জায় পড়তে হলো ক্লায়েন্টের সামনে। আচ্ছা টুকুস কি আমার ব্যাগে হাত দিয়েছিল?


- কি যাতা বলছো ? ও তো তোমার অফিস যাবার আগে স্কুলে চলে যায়।


ঝামড়ে উঠলাম আমি। অভীক বোধহয় একটু অবাক হলো আমার আচরণ দেখে। তবে মুখে বললো না কিছু। হনহন করে শোবার ঘরের দিকে চলে গেলো। মিনিট খানেক পর যখন ফিরে এলো, হাতে কালো রঙের পেনড্রাইভ শোভা পাচ্ছে। অপ্রস্তুত মুখে বললো


- বিছানার ওপরেই ছিলো। তুমি দেখোনি?

- তুমি যাবার পর থেকে আমি লিভিং রুমেই ছিলাম। পেনড্রাইভ পুনরুদ্ধার হতে এবার ঘ্রাণেন্দ্রিয় সজাগ হয়েছে অভীকের।


- কিরকম পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে। গ্যাসে কিছু বসানো নাকি? অভিকের সামনে গলগল করে উগরে দিলাম ভাত পুড়ে যাবার বৃত্তান্ত। অভীক শুনে হাসতে হাসতে বললো


- তুমি নিশ্চয়ই গ্যাসটা কমাতে ভুলে গেছিলে। - বিশ্বাস করো, আমি নিজের হাতে গ্যাসের আঁচ কমিয়েছিলাম।


- তাহলে নিশ্চয়ই লিখতে লিখতে উঠে এসেছিলে? - হ্যাঁ, কিন্তু....


- ব্যস, আর বলতে হবে না।

আমায় আর কিচ্ছু বলতে না দিয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেল অভীক। কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করলো না। ও অফিসের জন্য বেড়িয়ে যেতে রান্নাঘরে এলাম। ভাতগুলো ডাস্টবিনে ফেলে ডেকচিটা সিঙ্কে নামিয়ে রাখলাম। পুড়ে একেবারে কালো হয়ে রয়েছে ডেকচিটা। ওবেলা ফুলি এসে এই দাগ তুলতে পারলে হয়। নতুন করে আর ভাত না বসিয়ে ভাবলাম কটা রুটি বানিয়ে রাখি। ছেলেটা স্কুল থেকে ফিরে খাবে। রাতের রুটির জন্য আটা মাখাই ছিল। চটপট রুটি কটা গড়ে স্নানে ঢুকলাম। শাওয়ারের জলধারাতে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে মন। সত্যি, গল্প লিখতে লিখতে বড্ড বেশি কল্পনাপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি। একা একাই হেসে ফেললাম আমি।


#দুই


এরপর দুটো দিন বেশ নিজস্ব ছন্দে কেটে গেলো। কোথাও কোনো ওঠাপড়া নেই। নতুন লেখাটাও শেষ হয়ে এসেছে। এদিকে ল্যাপটপটার যা দশা, টাইপ করাটা এখন বড়ো সমস্যা। টুকুস ক্লাস ফোরে ওঠার পর ওকে অলিম্পিয়াডের জন্য একটা স্পেশাল কোচিংয়ে ভর্তি করে দিয়েছি। একদিন ওকে কোচিং ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে পাশের সাইবার ক্যাফেতে ঢুকে পড়লাম। ঘন্টাখানেক ঝড়ের গতিতে টাইপ করে নামিয়ে ফেললাম লেখাটা। ওখানে বসেই নিজের ব্লগে পোস্ট করে দিলাম। এক কপি প্রিন্টও নিয়ে নিলাম। বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরলাম আজ। অভীকও আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। তিনজন মিলে অভীকের নিয়ে আসা এগরোল হাতে জমিয়ে বসেছি। টুকুসের আজ টেস্ট ছিল কোচিংয়ে। ভালই স্কোর করেছে। সেই নিয়ে আহ্লাদিত আমরা দুজনেই। এগরোলে কামড় বসাতে বসাতেই চলছে টুকুসের ভবিষ্যত পরিকল্পনা। হঠাতই একটা ফোন এসে তাল কেটে দিলো। আমার এক সাহিত্যিক বান্ধবীর ফোন। সে যা জানালো তাতে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। আধ খাওয়া রোলটা হাত থেকে পড়ে গেল। আমার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চোখ মুখ দেখে অভীকও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।


বারবার জিজ্ঞাসা করছে

- অ্যাই সুমি, কি হলো বলবে তো?


- মঞ্জরী বললো....

- কি বললো? থেমে গেলে কেন?

- বললো, আআআজ বিকালে যে লেখাটা আমি ব্লগে পোস্ট করেছি সেটা নাকি...

- কি সেটা?

- কয়েকজন পাঠক বলছে সেই লেখাটা কয়েকদিন আগে অন্য একজন লেখক পোস্ট করেছে।


-মানে? কি করে? তুমি কি আর কাউকে পড়িয়েছিলে লেখাটা? কোনোরকমে দুদিকে মাথা নাড়লাম।


- তাহলে সে পেলো কি করে? একই লেখা দুজনের তো হতে পারে না। ব্লগটা ওপেন করে দ্যাখো না একটু।


হাত সরছিলো না আমার। অভীকই আমার ফোনটা নিয়ে ব্লগ ওপেন করলো। সত্যিই পাঠকদের মন্তব্যের বন্যা বইছে। সবারই প্রায় এক কথা " দিদি আপনার কাছ থেকে এটা আসা করিনি"। বেশ কয়েকজন তো রীতিমতো আক্রমণাত্মক। সরাসরি "গল্পচোর" লিখেছে। কি মনে হতে অভীককে বললাম - দ্যাখো তো কার গল্প কপি করেছি বলছে। একটু খুঁজতেই পাওয়া গেল, একজন পাঠক লিখেছেন এটি প্রতিমা গাঙ্গুলি নামে একজন সুপরিচিত লেখিকার গল্প। কিরকম একটা খটকা লাগায় আমি গল্পতে চোখ রাখলাম। আমার সামনে আকাশ ভেঙে পড়লেও হয়তো এতো অবাক হতাম না আমি। সত্যিই এই গল্পটি আমার লেখা নয়। তবে এই গল্পটি আমার পড়া। এমনকি গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগায় আমি লেখিকার ভূয়সী প্রশংসাও করেছিলাম ফেসবুকে। কিন্তু আমি যে লেখাটি পোস্ট করেছিলাম সেটি সম্পূর্ণ অন্য লেখা। অস্ফুটে বলে উঠলাম


- এটা কি করে সম্ভব! আমি তো নিজে টাইপ করে পোস্ট করেছি। অন্য গল্প পোস্ট হয়ে গেলো কি করে?


এদিকে আমার গুণমুগ্ধ পাঠকদের মন্তব্যে, প্রশ্নে আমার ব্লগ ভরে উঠছে। অভীক টেম্পোরারিলি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা অচল করে দিলো। এরপরেও রেহাই পেলাম না। যে সব লেখক বন্ধুরা আমার ফোন নম্বর জানেন তারা জনে জনে ফোন করে আমার খবর নিতে লাগলেন । এক কথা দু কথার পরই আমায় জানাতে শুরু করলেন কোন পেজে আমায় নিয়ে কি কি সমালোচনা হচ্ছে। অভীক আমায় ক্রমাগত ভরসা যুগিয়ে যাচ্ছিলো। বলছিল এসব কথায় কান না দিতে কিন্তু আমি কেমন যেন ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে পড়ছিলাম। একটা ঘটনা বারবার আমার স্মৃতিতে আসছিলো। খুব ছোটবেলায় পড়া একটা বইয়ে এরকমই একটি ঘটনার উল্লেখ ছিলো। সেখানেও একজন লেখক তার নিজের লেখা প্রকাশককে দেবার পরে জানা গেছিল সেটি অনেক বছর আগে প্রকাশিত। কিন্তু সেটা তো একটা ভৌতিক গল্প ছিলো। বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। একই ঘটনা আমার সাথে ঘটল কি করে। তবে কি আমার সাথেও সেরকম কিছু ঘটছে..... আর ভাবতে পারছিলাম না। আমার একটু ঘুমের বড়ো দরকার। আজকাল আর কলম ধরি না। নিজের প্রতি বিশ্বাসটাই কেমন যেন হারিয়ে গেছে। সারাদিন চুপ করে বসে থাকি। কখনো সবার থেকে দূরে পালাতে ইচ্ছে করে। কখনো আবার মনে হয় সবার মাঝে লুকিয়ে বসে থাকি, তাহলে আমার আর কোনো ভয় নেই। ভয়টা যে কিসের সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। অভীক আমায় সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। লাভ হয়নি কিছু। আমার শরীর দিন দিন ভেঙে পড়ছে। অভীক এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে আমার দেখাশুনা করেছে। এবার ওরও ছুটি ফুরিয়ে এসেছে। সেটা ভেবেই ভয়টা যেন আমায় আরও আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরছে। অভীক বোধহয় বুঝতে পারছিল আমার মনের অবস্থাটা। ফুলিকে বারো ঘন্টার জন্য কাজে রেখে দিলো অভীক। কাজের মেয়েরা আসে যায়, আমার যেন কোনো কিছুতেই কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বুঝতে পারি ওরা আমায় নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে। করুক, তবু তো বাড়িতে আমায় একা থাকতে হয় না। ডাক্তার বলেছে আমায় আবার লিখতে। লিখলেই নাকি আমি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবো। অভীকের জোরাজুরিতে বসেওছিলাম একদিন লেখা নিয়ে। কিন্তু শব্দগুলো সব কেমন যেন গুলিয়ে গেলো। তবু মনে সাহস এনে জোর করে লিখতে চাইছিলাম। হঠাৎ মনে হলো কলম আমার হাতে থাকলেও আমি লিখছি না। দিনের আলো কমে এসেছে তখন। ফুলি ঘরের আলোটাও জ্বালিয়ে দিয়ে যায়নি। আধো আলো, আধো অন্ধকারেও দেখলাম সাদা পাতায় ধীরে ধীরে কিছু অক্ষর ফুটে উঠছে। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম খাতার ওপরে। স্পষ্ট গোটা গোটা অক্ষরে লেখা "আমি লেখা চুরি করেছি"।


- একি..! কি আবোল তাবোল লিখছো? অভীকের গলা। কখন এলো অভীক? কই আমি তো কিছু টের পাইনি!

- এটা... এটা আমি লিখিনি। জড়িয়ে জড়িয়ে বললাম আমি। - লেখোনি মানে, স্পষ্ট তোমার হাতের লেখা। আর এই ফুলিটা গেল কোথায় ? অভীক ঘর থেকে বেরোতেই লোডশেডিং হয়ে গেলো। ফুলি... ফুলি... ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে অভীক। মনে হচ্ছে যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে অভীকের গলাটা। আমি কোথায় আছি বুঝতে পারছিলাম না। ঘরের ভিতরটা চাপ চাপ অন্ধকার। আমায় যেন গিলে খেতে আসছে অন্ধকারটা। প্রাণপণে চিৎকার করে একটু আলো চাইতে গেলাম, কিন্তু আমার গলা থেকে শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ বেরোল।



#তিন


সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শে অভীক আমার এপিলেপ্সির চিকিৎসা করাচ্ছে। ফুলিও আজকাল আর আমায় চোখের আড়াল করে না। আমি জানি তার দরকার নেই। কারণ অন্য একজন আমায় সারাদিন নজরবন্দী করে রাখে। এমনিতে সে কিচ্ছু করে না। শুধু আমি লিখতে বসলেই সবকিছু গোলমাল করে দেয় সে। যে লেখা আমার বেঁচে থাকার রসদ যোগাত আজ সেই লেখাই আমার কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ বুঝতে পারি সে আমাকে কিছুতেই লিখতে দেবে না। কিন্তু লেখা ছাড়া আমি বাঁচবই বা কি নিয়ে? আমার ছেলেটাও তো আজকাল আর আমার কাছে আসে না। অভীক জোর করে নিয়ে এলেও সে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। কি দেখে ভয় পায় টুকুস? তবে কি সত্যিই আমার মধ্যে কিছু বদল ঘটেছে? সারা দুপুর আজ শুয়ে শুয়ে এই চিন্তাই করছিলাম। চিন্তা করা ছাড়া আর তো কিছু করারও নেই। আগে চিন্তাগুলোকে শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখতাম। আর এখন হাতে কলম ধরি বা মোবাইলে কিছু টাইপ করি বেশ বুঝতে পারি ঠিক ওই সময়েই ঘরের বাতাস কেমন ভারী হয়ে আসে। স্পষ্ট টের পাই কেউ যেন আমার ঘাড়ের ওপর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে আমি কি লিখছি। ভয়ে কুঁকড়ে যাই আমি। জানি আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি যে সত্যিই অন্য কারুর অস্তিত্ব টের পাই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবো হবো করছে। ফুলিটা অন্যদিন জেগে থাকে আজ অঘোরে ঘুমিয়ে চলেছে। টুকুস স্কুল থেকে ফিরে সুইমিং ক্লাসে গেছে। বাড়িটা যেন বড্ড খাঁ খাঁ করছে আজ। একবার ভাবলাম ফুলিকে ডাকি। তারপর মনে হলো থাক, বেচারি সারাটা দিন অনেক পরিশ্রম করে। টুকুসের পুরো দায়িত্বই তো এখন ওর ওপর। কিন্তু এই মুহুর্তে ঘরের ভেতরের নিস্তব্ধতায় মনে হচ্ছিলো বিশ্ব চরাচরে যেন আমি একাই জেগে আছি। অস্বস্তিটা তাড়াতে পায়ে পায়ে পূবের ব্যালকনিতে এলাম। মরে আসা দিনের আলোয় ভুতুড়ে দেখাচ্ছে লম্বা ব্যালকনিটা। রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখলাম টুকুস নীচে দাঁড়িয়ে। আমায় দেখে হাত নেড়ে কি যেন বলছে। পাঁচতলার ব্যালকনি অবধি পৌঁছচ্ছে না ওর আওয়াজ। -কিছু বলছিস? জিজ্ঞাসা করলাম টুকুসকে। কিন্তু আমার দুর্বল স্বর টুকুসের কানে পৌঁছলো না। টুকুস এদিকে হাত নেড়েই যাচ্ছে। আমায় ডাকছে কি? আগে টুকুসকে আমিই সুইমিংয়ে নিয়ে যেতাম। কতদিন হয়ে গেলো বাড়ির বাইরে একটু পা রাখিনি। আজ টুকুসের ডাক পেয়ে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠলো। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠলাম - আমি আসছি টুকুস। টুকুস হাসি হাসি মুখে হাত নেড়েই যাচ্ছে। কি মিষ্টি দেখাচ্ছে টুকুসের মুখখানা। এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। -কি করছো বৌদি, পড়ে যাবে যে। ফুলির ডাকে চমকে উঠলাম। নীচের দিকে তাকাতেই মাথাটা দুলে উঠল। কখন যে আমি রেলিংয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি নিজেই বুঝিনি। ফুলি শক্ত করে আমায় ধরতে, ধীরে ধীরে নেমে এলাম রেলিং থেকে। -তুমি ওভাবে রেলিংয়ে উঠছিলে কেন বৌদি? বিহ্বলের মতো বলে উঠলাম - টুকুস ডাকছিলো যে। - টুকুস তো সেই কখন ফিরে এসেছে। ওকে দুধ দিয়ে তোমায় ডাকতে এসে দেখি তুমি রেলিংয়ে... আমি না এলে তো এক্ষুণি পড়ে যেতে। - কি যা তা বলছিস। ওই তো টুকুস। নীচের দিকে আঙ্গুল দেখাতে গিয়ে দেখলাম কোথায় কি! ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পার্কে কেউ কোত্থাও নেই। মাথা কাজ করছিলো না আর। ব্যালকনির মেঝেতেই বসে পড়লাম। - এখানে ধুলোর মধ্যে বসে পড়লে কেন? চলো ঘরে চলো। ফুলি জোর করে আমার হাত ধরে তুলতে গেছিলো। আমি চোখ তুলে তাকাতে, ছিটকে সরে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে আমায়। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ফুলি আমার বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এই ভুতুড়ে বাড়িতে কাজ করতে সে আর রাজি নয়। তার জায়গায় বহাল হয়েছে একটি নতুন মেয়ে। যাবার আগে ফুলি জানিয়ে গেছে সেদিন সে আমার মুখে অন্য কারুর ছায়া দেখেছিল। অভীক যদিও এসব কথায় কান দেয়নি, তার সমস্ত চিন্তা এখন আমার আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে। আমার মাকে কিছুদিনের জন্য এখানে আসতে বলেছে অভীক। তাতে যদি আমার মনটা একটু ভালো হয়। মা আসতে সংসারের চাকা আবার ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করলো। আমিও যেন একটু ভালোর দিকে। বিকালে টুকুস পার্কে গেলে আমি আর মাও সঙ্গে যাই। ঘরের গুমোট পরিবেশ থেকে সাময়িক মুক্তি। কিন্তু আমি জানি সে আশেপাশেই আছে। আমার চারপাশে সে যেন এক অদৃশ্য বলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। তাকে ফাঁকি দেবার কোনো উপায় নেই। একদিন সব খুলে বলেছিলাম মাকে। পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও, মা অন্তত অভীকের মতো হেসে উড়িয়ে দেয়নি ব্যাপারটা। বাড়িতে সকাল সন্ধ্যা পুজোর ব্যবস্থা করলো মা। আমার গলায় মা কালীর ছবি দেওয়া লকেট পরিয়ে দিলো। আমি চরম নাস্তিক হয়েও মায়ের এই বিশ্বাসকে অবহেলা করতে পারলাম না। হয়তো ভিতরে ভিতরে দুর্বল হয়ে পড়াই এর কারণ। তবে কি ধীরে ধীরে আমিও ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে পড়ছি নাকি এ শুধুই কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে মনের জোর ফিরে পেতে চাওয়া। যাই হোক না কেন সবই তো নিজেকে ভালো রাখার জন্য। টুকুস আজকাল হোমওয়ার্ক নিয়ে আমার কাছে এসে বসে। অনেকদিন পর ওকে পড়াতে পেরে আমিও তৃপ্ত হচ্ছিলাম। আমার প্রকাশক এবং অভীক দুজনেই ফেসবুকে একটি স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন যে "আমার ল্যাপটপের সফ্টওয়্যারে কিছু সমস্যার কারণে সেদিন অন্য লেখকের গল্প আমার নামে পোস্ট হয়ে গেছিলো। এর জন্য তারা আমার হয়ে ক্ষমাও প্রার্থনা করেছে।" বলাবাহুল্য আমার লেখার অনুরাগী প্রায় সকলেই এই কথা বিশ্বাস করেছেন। কারণ আমার অতি বড়ো শত্রুও বলতে পারবে না যে আমার লেখক জীবনে আমি এরকম কোনো কুরুচিকর কাজ কোনোদিন করেছি। আমি মোটামুটি স্বাভাবিক হতে মাও ফিরে গেছে। কতদিন আর নিজের ঘরদোর ফেলে এখানে পড়ে থাকবে মা। তাছাড়া বাবা ওখানে একা। রান্না খাওয়া নিয়ে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো। মা চলে যেতে আমি আবার পুরোনো রুটিনে ফিরে গেলাম। বাদ রাখলাম শুধু একটা কাজ। আমার লেখা। নিজের ব্লগটা আর খুলি না। জানি হয়তো পাঠকদের থেকে নতুন লেখার অনুরোধ পাবো। কিন্তু লেখার উপায় তো নেই আমার।



#চার


শ্রাবণ মাসের বিদায় নেবার সময় হয়ে এসেছে। যাবার আগে টানা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সূর্য দেবতাও মুখ লুকিয়ে আছেন বেশ কদিন হলো। স্যাঁতসেঁতে হয়ে রয়েছে ঘরদোর। সারাদিনে একটা বড়ো কাজ এখন ব্যালকনিতে ভিজে কাপড় শুকোতে দেওয়া আর বৃষ্টি এলেই সেগুলোকে তুলে নিয়ে আসা। রান্নার মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। রান্না করলে কিছুটা সময় তো কাটে। নাহলে অবসর পেলেই তো হাত নিশপিশ করে কিছু লেখার জন্য। মাথার মধ্যে কতো শব্দ যে ঘুরপাক খায় কিন্তু কিচ্ছু করার নেই আমার। ভাবনাটা আসতেই ছোট্ট একটা শ্বাস পড়লো। সব তো ঠিক ছিলো কেন এমন হলো। আড়ালে বসে কে এমন খেলা করছে আমার সাথে? তার কি ক্ষতি করেছি আমি? আজকাল আর ভয় না এসব চিন্তাই কুরে কুরে খায় আমাকে। এমনই এক দিনে অবনীবাবুর ফোন পেলাম। অবনী দাশগুপ্ত আমার প্রথম তিনটি উপন্যাসের প্রকাশক। বয়োঃজ্যেষ্ঠ মানুষ, আমাকে খুবই স্নেহ করেন তিনি। আমার জীবনের এই চরম দুঃসময়ে,আমার খুব কাছের মানুষেরাও আমায় ভুল বুঝতে শুরু করেছিল কিন্তু অবনীবাবু একটি দিনের জন্যেও আমায় অবিশ্বাস করেননি। নিয়ম করে আমার খোঁজ নিয়েছেন। সাহস জুগিয়েছেন। লেখক মহলে যতবার আমার বিপক্ষে সওয়াল উঠেছে উনি আমার পক্ষ নিয়েছেন। এই মুহুর্তে যেটুকু সম্মান আমার অক্ষুণ্ণ রয়েছে তা শুধুই অবনীবাবুর জন্য। আজ অবনীবাবুর ফোন পেয়ে মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। আসন্ন কলকাতা বইমেলার জন্য আমায় বারবার লেখা দিতে অনুরোধ করলেন উনি। বইমেলার নাম শুনে আমিও খুব নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। বইমেলা মানেই তো নির্দিষ্ট দিনে বুকস্টলে বসা, নতুন বইয়ের গন্ধ, পরিচিত লেখকবন্ধুদের সাথে আড্ডা আর সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো আমার পাঠক বন্ধুদের অনুরোধে নিজের লেখা বইতে সই দিয়ে যাওয়া। কিছুক্ষণের জন্য হলেও বাকি সব ভুলে গিয়ে এক নতুন ভাবনায় ডুবে গেলাম। মনে মনে নতুন গল্পের একটা আউটলাইনও করে ফেললাম। নাহ্, আর কোনো কিছুকে ভয় পাবো না। আবার লেখা শুরু করতে হবে। আমার বন্ধন আমার মুক্তি সব ওই শব্দগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে। সত্যিই তো যে আমি বরাবর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছি সেই কিনা আজ এক অদৃশ্য শক্তিকে ভয় পেয়ে লেখালিখির থেকে শতহস্ত দূরে!! মনের জোর ফিরে পাচ্ছিলাম। আজ রাতেই বসতে হবে লেখাটা নিয়ে। আজ তাড়াতাড়ি ডিনারের পাট চুকিয়ে নিলাম। সারাদিনের দুষ্টুমিতে ক্লান্ত টুকুসও বালিশে পড়তে না পড়তেই ঘুমিয়ে কাদা। অভীক মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছিলো, আমার লিখতে যাবার তোড়জোড় দেখে সে বেশ অবাক। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। চোখ পাকিয়ে বললাম - অ্যাই তখন থেকে ফিকফিক করে হাসছো কেন? -তোমায় দেখে। - আমায় দেখে হাসির কি আছে। আমি কি জোকার? - ধুর পাগলি, জোকার হতে যাবে কেন? অনেকদিন পর তোমায় এভাবে দেখছি তো। খুব ভালো লাগছে। অন্যমনস্ক মুখে বলে উঠলাম - সত্যি গো, কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলাম। কি যে সব হচ্ছিলো... - কিচ্ছু হচ্ছিলো না। বলেছি না, আর ওসব নিয়ে ভাববে না। যাও, লিখতে যাও। বলোতো এক কাপ কফি করে দি। আমার গালটা আলতো করে ছুঁলো অভীক। - উহ্হ্হ তোমার মতলব বুঝি না ভেবেছো? কিচ্ছু লাগবে না আমার। অনেক রাত হয়েছে এবার চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়ো তো। শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে স্টাডিতে এলাম। লিখতে বসতে গিয়েও ভাবলাম অভীকের আইডিয়াটা মন্দ নয়। এক কাপ কফি খেলে ভাত ঘুমটা তাড়ানো যাবে। রান্নাঘরে গিয়ে কফি করে স্টাডিতে এসে বসলাম। কি মনে হতে দরজাটা লক করে দিলাম। স্টাডিরুমটা বেশি বড়ো নয়। এক সেট চেয়ার-টেবিল আর একটা ডিভানে মোটামুটি ভরে গেছে ছোট্ট ঘরখানা। আজ আর ল্যাপটপে লেখার রিস্ক না নিয়ে খাতা কলম টেনে নিলাম। ঘণ্টা দেড়েকের মতো টানা লেখার পর পিঠটা বেশ ব্যথা ব্যথা করতে শুরু করলো। মনে মনে ভাবলাম অনেকদিনের অনভ্যাসের ফল, একটু শুয়ে শুয়ে লিখলে হয়তো ব্যথাটা কমবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ডিভানে এলিয়ে দিলাম শরীরটা। আবার কলম চলতে শুরু করলো। ভালই এগোচ্ছে লেখাটা। আরও কিছুক্ষণ লেখার পর অনুভব করলাম চোখের পাতা যেন ভারী হয়ে আসছে। হাত ঘড়িতে চোখ রাখলাম। সোয়া দুটো বাজে। ইশ, এত রাত হয়ে গেছে। কাল সকালে তো আবার টুকুসের স্কুলের জন্য ওঠা আছে। কিন্তু লেখাটাও এত সুন্দর এগোচ্ছিল, এই অবস্থায় ছেড়ে উঠতেও ইচ্ছা করছে না। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখটা লেগে গেল নিজেও বুঝতে পারলাম না। হয়তো অনেক দিন পর লিখতে পারার সুখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো কেমন গুমোট লাগছে ঘরটা। গায়ের ওপর কিছু একটা যেন চেপে বসেছে। আমি তো চাদর গায়ে দেইনি। কোনোরকমে আধবোজা চোখে দেখলাম, যা ভেবেছি তাই। টুকুস! ঘুমের মধ্যে আমায় পাশে না পেয়েই উঠে এসেছে। এত বড়ো হয়ে গেছে তাও মা কে জড়িয়ে ধরে না শুলে ঘুম আসে না ছেলের। আলতো করে ঠেললাম টুকুসকে। - একটু সরে শো বাবা। আমি পড়ে যাবো তো বিছানা থেকে। সরে যাওয়া তো দূরের কথা, টুকুস আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো আমায়। ওকে সরাতে না পেরে হাল ছেড়ে দিলাম। ঘুমের রেশটা কেটে গেছে টুকুসের ছটফটানিতে। টুকুস একটা হাত আর পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে রয়েছে আমাকে। ওর শরীরের ভার যেন ক্রমশ বাড়ছিলো। সরাতে চেয়েও সরাতে পারছিলাম না ওকে। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে খিলখিল করে হেসে উঠলো টুকুস। অস্বাভাবিক হাসিটা। এমন করে তো ও হাসে না! হঠাৎ মনে হলো টুকুস এ ঘরে ঢুকলো কি করে? দরজা তো আমি নিজের হাতে বন্ধ করেছিলাম। তাহলে আমার পাশে কে শুয়ে? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? কিন্তু স্বপ্নেও কি এভাবে চিন্তাশক্তি কাজ করে? গায়ে একটা চিমটি কেটে বুঝতে চাইছিলাম যা ঘটছে তা সত্যি কিনা। পারলাম না, হাত পা কেমন অচল হয়ে রয়েছে। চিৎকার করে অভীককে ডাকতে চাইলাম। একটা ফোটা শব্দ বেরোল না গলা থেকে। গলাটা যেন কেউ ভিতর থেকে চেপে ধরে রয়েছে। ঢোক গিলতেও পারছি না। ধীরে ধীরে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। তবে কি আমি মরে যাচ্ছি? উফ্ মা গো মৃত্যু কি এতো ভয়ংকর? ********************** ************************** রাজারহাটের ফ্ল্যাটটা ছেড়ে আপাতত আমরা নরেন্দ্রপুরের বাড়িতেই শিফ্ট করেছি। ডাক্তার বলেছিলেন আমাকে সুস্থ করতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিবেশ বদলাতে হবে। সেদিন অনেক রাতেও আমি শোবার ঘরে না আসায় অভীক আমায় ডাকতে গেছিলো। অনেকবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে, লক ভেঙ্গে আমায় অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে অভীক। তিনদিন পর চোখ খুলে দেখেছিলাম আমি হসপিটালে। আমাকে ঘিরে কতগুলো উদ্বিগ্ন মুখ। আমার বাবা, মা, শাশুড়ি মা, অভীক, টুকুস। পরম নির্ভরতায় আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। চেনা পরিবেশে ফিরে, কাছের মানুষদের যত্নে, ভালোবাসায় দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছিলাম আমি। তবু একটা প্রশ্ন মনের ভিতরে সব সময় খচখচ করত। এতদিন ধরে কি হচ্ছিলো আমার সাথে? জানি না এর উত্তর কোনোদিন পাবো কি না!! আজ দুপুরে বইয়ের আলমারিটা গুছিয়ে রাখছিলাম। নীচের তাকে এক গাদা পুরোনো ডায়রি জমে আছে। ধুলোয় ভর্তি সব। টেনে নামালাম ডায়রিগুলোকে। হঠাৎ চোখ আটকে গেলো 2016 সালের ডায়রিটায়। সব কটা ধুলো ভর্তি ডায়রির মধ্যে এটা একদম চকচক করছে। আশ্চর্য লাগলো দেখে। তবে কি আমাদের অনুপস্থিতিতে এই বাড়ীরই কেউ আমার আলমারিতে হাত দিয়েছিলো? কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব, চাবি তো আমি সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলাম। অন্যমনস্কভাবেই ডায়রির পাতা উল্টাতে লাগলাম। একটা পাতায় এসে হঠাৎই থেমে গেলাম। তারিখ 10ই অগাস্ট 2016.... গোটা গোটা অক্ষরে আমি লিখেছি, "আজ একজন আমার লেখা একটি গল্প চুরি করেছে। আমার নাম না দিয়ে গল্পটি সম্পূর্ণ কপি করে পোস্ট করেছে। আমার কয়েকজন পাঠক বন্ধুর সাহায্যে এই চুরি আমি ধরতে পেরেছি। এবার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবো।" মুহুর্তের মধ্যে ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। এক বয়স্কা মহিলা আমার লেখাটি কপি করেন এবং সত্যিই আমি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। শুধু আমি নই, আমার পাঠকবন্ধুরাও লেখাচোর বলে বলে এমন প্রচার করে যে উনি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। গত তিন বছরে খ্যাতির শীর্ষে থেকে এই ছোট্ট ঘটনাটা মন থেকে প্রায় মুছে গেছিলো। আজ আবার মনে পড়তে কেমন অপরাধবোধ হচ্ছে। এই একই অপবাদ তো আমিও কদিন আগেই পেয়েছি। আচ্ছা উনিও কি আমার মতই ভুলবশত অন্যের লেখা পোস্ট করে ফেলেছিলেন? ভদ্রমহিলার মুখটাও স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে এখন ফর্সা, গোলগাল, চোখে চশমা আর হ্যাঁ নাক আর ঠোঁটের মাঝখানে একটা কালো তিল। কিন্তু নামটা কি যেন ছিলো....অনেক চেষ্টা করেও নামটা মনে করতে পারলাম না। উত্তরটা পেলাম ঠিক দুদিন পরে অভীকের এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে। আমার মন ভালো করার জন্য আজকাল মাঝে মধ্যেই অভীক আমায় বেড়াতে নিয়ে যায়। আজ গেছিলাম ওর ব্যাচমেট সৌম্যর বাড়িতে। প্রায় একশো বছরের পুরোনো বাড়ি ওদের। দুর্গাপুজো হয় এখনো। সৌম্যর স্ত্রী পরমাই সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলো আমায়। বেশ লাগছিল। পুরো বাড়ি প্রদক্ষিন করে একটা হলঘরে এলাম। এ ঘরের দেওয়াল এই বংশের পুর্বপুরুষদের ছবিতে ছবিতে ঢেকে গেছে। পরমা আমায় পরিচয় করাচ্ছিলো ছবিগুলোর সাথে। - এ ঘরের সবার সাথে পরিচিত হতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। এদিকে এসো সৌম্যর বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দি তোমার। সৌম্যর বাবা মা দুজনেই যে গত হয়েছেন, অভীকের মুখেই তা শুনেছিলাম। পরমার সাথে এগিয়ে গেলাম ছবির দিকে। - ইনি আমার শ্বশুরমশাই আর ইনি হলেন শাশুরি মা। শ্বশুরমশাইকে চোখে দেখিনি। শুনেছি সৌম্যর মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে উনি চলে যান। আর শাশুড়ি মা এই বছর তিনেক হলো। পরমার কথাগুলো আমার কানে ঢুকছিলো না। এক দৃষ্টে সৌম্যর মায়ের ছবিটা দেখছিলাম। সেই ফরসা, গোলগাল মুখ, চোখে চশমা আর... আর নাকের নীচে সেই কালো তিল। অস্ফুটে বললাম - উনি কিভাবে...? - শাশুড়ি মায়ের কথা বলছো? মায়ের মৃত্যুটা খুব স্যাড গো। মেডিক্যাল সায়েন্স হয়তো বলবে সেরেব্রাল স্ট্রোক। কিন্তু আমি জানি সেই স্ট্রোকের কারণ। - কি কারণ? - সে এক ব্যাপার জানো। মা কে সৌম্য স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিল। আমিই মাকে ফেসবুকের নেশা ধরাই। একা মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা ফেসবুকে গল্প পড়তেন। একদিন কোনো একজনের একটা গল্প মায়ের খুব ভালো লেগে যায়, মা তো অতো শেয়ার টেয়ার করা বোঝেনি। হয়তো কপি করে নিজের ওয়ালে পোস্ট করে দিয়েছিলেন। সেই নিয়ে মা কে তারা খুব বিশ্রী ভাষায় অপমান করে। এমনকি সেই লেখিকাও। আমরাও মাকে বকাঝকা করেছিলাম না বুঝেই। মা এই অপমানটা নিতে পারেননি। পরদিন ভোর রাতেই মায়ের..... আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করছিলো না আমার। কারুর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী এটা ভেবে হৃদপিণ্ডটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বারবার ক্ষমা চাইলাম। জানি কিছু কিছু অপরাধের ক্ষমা হয় না কিন্তু আমিও তো না বুঝেই অপরাধটা করে ফেলেছি। বাড়ি ফিরে বইমেলার জন্য লেখা অসমাপ্ত উপন্যাসটায় হাত দিলাম। জানি আর বাধা আসবে না। তবে এবার আর আমার আত্মীয়-স্বজনদের নয়, বইটা উৎসর্গ করবো আমার সেই পাঠিকাকে, যাকে জীবিতাবস্থায় আমি তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি। এতে হয়তো আমার অপরাধের গ্লানি কিছুটা হলেও মুছবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics