Debdutta Banerjee

Classics

0.5  

Debdutta Banerjee

Classics

তেরোর গেরোয়

তেরোর গেরোয়

6 mins
684


তেরো সংখ‍্যাটাকে সবাই কেনো অপয়া বলে অনয়া বোঝে না। একটা নির্দোষ সংখ‍্যার উপর সকলের এই রাগের কারণ ওর ছোট্ট মাথায় ঢোকে না। কিন্তু এই তেরো সংখ‍্যাটা যেন অনয়ার জীবনে একটা অভিশাপ। ছোট কাকুর বৌভাতের দিন পড়েছিল তেরো তারিখ। তাই ঠাম্মা সেদিন অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। চোদ্দ তারিখ হয়েছিল বৌভাতের অনুষ্ঠান। তাতে অবশ‍্য একটা দিন বাড়তি পাওনা হয়ে বেশ আনন্দ হয়েছিল অনয়ার। তবে সেবার পূজার ছুটিতে ওদের দার্জিলিং ঘুরতে যাওয়া বানচাল হয়ে গেছিল এই তেরোর গেরোয়। চারমাস আগে ভোর বেলা লাইনে দাঁড়িয়ে বাবাই যখন টিকিট কেটেছিল ওটা যে তেরো তারিখের টিকিট, আর ঠাম্মা যে কাউকে ঐ দিন যেতে দেবে না বাবাই বুঝতেই পারেনি। আসলে ছুটিটা তো ঐ দিন থেকেই পড়েছিল। ঠাম্মা ঘুরতে যাওয়ার পনেরো দিন আগে যেই শুনল টিকিট তেরো তারিখের বলে দিল যাওয়া হবে না। দাদু, মা, ছোট কাকু নতুন কাকি সবাই চুপ। ঠাম্মার এই তেরো সংখ‍্যার প্রতি বিরক্তির কারণ সবাই জানে। অনয়ার খুব রাগ হয়েছিল সেবার। আজ আবার ক্লাস টেষ্টে অঙ্কে তেরো পেয়েছে ও। বাড়ি ফিরলেই কপালে মায়ের বকা নাচছে। অনয়ার জন্মদিনও তেরো তারিখ তার উপর শনিবার অমাবস‍্যায় জন্ম বলে ঠাম্মা মুখ কালো করে হাসপাতালে দাঁঁড়িয়েই নাকি অপয়া বলেছিল ওকে। বাবাই তখন আদর করে সেটা বদলে ওর নাম রেখেছিল অনয়া।একমাত্র বাবাই ওকে ভালোবাসে। কিন্তু বাবাই তো শহরে থাকে, মাসে মাত্র একবার আসে। 

পরশু বাবাই আসবে আর অনয়ার জন‍্য কত কি নিয়ে আসবে।

 বাড়ি ফেরার পথে কালো বেড়ালটাকে আদর করে বাঁঁচিয়ে রাখা টিফিনটা খাইয়ে দেয় অনয়া। বেচারা বেড়ালটা কালো বলে ওকেও সবাই অপয়া বলে দূর দূর করে সবসময়। অথচ মিতিনদের লেজ মোটা হলুদ হুলোটা সবার বাড়ি চুড়ি করে খেয়েও কত আদর পায়। তাইতো এই মেনীটাকে ওর নিজের মত সমব‍্যাথী মনে হয়। রোজ বিকেলের দুধটা মায়ের চোখ বাচিয়ে মেনিকে খাওয়ায় ও। ওর ঐ বিড়াল প্রীতিও ঠাম্মার চক্ষুশুল। কালো বিড়াল নাকি অলক্ষ্মী। এসব কথা সারাক্ষণ বলে চলেছে ঠাম্মা। বিড়ালটা মাঝে মাঝে ওর পড়ার ঘরের জানালায় এসে মিয়াও মিয়াও বলে ডাকে। ঠাম্মার কানে গেলেই শুরু হয় কীর্তণ। -''বেড়াল কাঁঁদা ভালো নয়, অলুক্ষুণে কালো বেড়াল...'' আরো কত কি বলতে থাকে।

গত মাসে ওর পড়ার ঘরে ইঁঁদুর হয়েছিল খুব। বইপত্র কেটে দিয়েছে দুবার। মেনী কয়েকটা ইঁদুর মেরেছিল বলে ঠাম্মার কি চিৎকার। গনেশের বাহন হল ইঁঁদুর। এরাও নাকি ঘরের লক্ষ্মী। দাদুর ব‍্যবসার লক্ষ্মী। অথচ স্কুলের মিস বলে ইঁদুর খুব নোংরা, প্লেগের জীবাণু বহন করে।কিন্তু এদের কে বোঝাবে!

 সেদিন বাড়ি ফিরেই অনয়া দেখে ভীষণ হুরুস্থুলু ব‍্যাপার, ওদের গৃহদেবতা লক্ষ্মীদেবীর গলার সোনার হার চুরি গেছে। সারা বাড়ি তোলপার হচ্ছে। ছোট কাকু আর নতুন কাম্মা এক সপ্তাহ আগেই ফিরে গেছে কলকাতায়, কাজের জায়গায়। ওরাও থেকে থেকে ফোন করছে। মিনু দিদি আর কনিকা মাসি এ বাড়িতে কাজ করে।বাইরের লোক বলতে ওরাই একমাত্র তিনতলায় ছাদের ঘরে যায়। আর তো বাইরের কেউ ঢোকে না।ওদের বার বার করে জিজ্ঞেস করছে ঠাম্মা আর মা। মিনুদিদি পা ছড়িয়ে দেওয়ালে মাথা ঠুকে কাঁঁদছে আর বলছে -''শেষে চুরির অপবাদ। ও মা লক্ষ্মী, দেখো গো মা! এই বাড়িতে এত খাটি, কুটোটি নি নি গো মা, তাতে এখন এরা এসব বলছে। "

কনিকা মাসি গম্ভীর হয়ে বলছে -''শেষ বয়সে শেষে তোমরা আমাদের চুরির দায়ে জেলে দেবে ? এ ও ছিল কপালে। ''

দাদু গম্ভীর হয়ে পায়চারী করছে আর বলছে -''বাসি ফুলের সঙ্গে ফেলে দাওনি তো? খুঁজে দেখো আবার।''

মা বলছে -''সব ফুল নেড়ে দেখে এসেছি বাবা। কোথাও নেই। প্রায় দু ভরির ভারি হার। গত কাল ও মায়ের গলায় ছিল।''

অনয়ার অঙ্ক খাতার কথা আর বলা হয় না। তাড়াতাড়ি খেয়ে ও নিজের ঘরে ঢুকে যায়। সন্ধ‍্যায় ও থমথমে পরিবেশ। দাদু বাধ‍্য হয়ে থানায় জানিয়েছে। দুজন মোটা গোঁফ ওয়ালা পুলিশ এসে মিনু দিদি আর কনিকা মাসির সঙ্গে কি সব কথা বলছে থেকে থেকেই। রাতে আজ একাই পড়াশোনা করল অনয়া। শুয়ে শুয়ে ভাবে আজ তো তেরো তারিখ নয়। তবে কেনো এমন হলো!!

পরদিন স্কুল যেতে হল ম‍্যাগি খেয়ে। কনিকা মাসি কাজে আসেনি। হয়তো আর আসবে না। মিনুদিদি এ বাড়িতেই থাকে। সে রাঁধতে জানে না। আজ টিফিনেও জ‍্যাম ব্রেড। 

বিকেলে বাড়ি ফিরেই অনয়া বোঝে এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ঠাম্মা থেকে থেকেই -''মা গো , পাপ নিও না। একি অমঙ্গল হল গো!'' বলে সুর তুলছে। কখনো বলছে -''সোনা হারানো খুব বাজে।হবে না! এক অপয়া রয়েছে ঘরে, এ ঘরে কি লক্ষ্মী থাকবে?'' অনয়া বোঝে না এতে তার দোষ কোথায়!দাদু আজ দোকান খোলেনি। মায়ের মুখ গম্ভীর, বাবাই নাকি দুপুরের পর আর ফোন তুলছে না। ফোনই লাগছেই না।

মিনুদিদি বিকেলের দুধটা ওর টেবিলে রেখে বলে যায় -''আমার হয়েছে যত জ্বালা, মাস পুরলে চলে যাবো আমিও কাজ ছেড়ে।''

প্লাষ্টিকের বাটিটায় দুধটা ঢেলে পা টিপেটিপে অনয়া বাগানে বেরিয়ে আসে। পিছনের ভাঙা চোরা আবর্জনা রাখার ঘরটার পাশেই মেনী থাকে এসময়। কিন্তু আজ নেই। দুধটা ফেলে রাখলে হুলো খেয়ে যাবে। তাই বাটি হাতেই ও বাগানে খুঁজতে বার হয়। মৃদু স্বরে মেনীকে ডাকতেই সে মিয়াও করে সারা দেয় গোলাপ গাছের ঝোপের নিচ থেকে। বাটি নামিয়ে চুকচুক আওয়াজ করে অনয়া। কিন্তু মেনী কি যেন করতে ব‍্যস্ত। মাটি খুড়ে কি করছে ও ! অনয়া এগিয়ে যায়। গোলাপ ঝাড়ের নিচের নরম মাটি দু পায়ে খুড়ছে মেনী। ওর কি শরীর খারাপ? শরীর খারাপ হলে কচি দুব্বো খায় ওরা মা বলেছিল। গোলাপ ঝাড়ের নিচে দুব্বো গাছ আছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে অনয়া দেখে মেনিটা একটা কি যেন টেনে বার করতে চাইছে, চকচক করছে জিনিসটা। 

আরে, এই তো সেই হারটা!! তাড়াতাড়ি মেনীর সঙ্গে দু হাতে মাটি খুড়ে হারটা খুঁজে পায় অনয়া। লাফাতে লাফাতে দুধের বাটি ভুলে ঘরে ছোটে ও।

আর তখনি একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় বাড়ির সামনে। অনয়া দেখে বাবাইও চলে এসেছে। ওর আর খুশির সীমা নেই। ওর চিৎকারে মা ঠাম্মা সবাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। মা তো কেঁদেই ফেলেছে বাবাইকে দেখে।

-'' আজই চলে এলাম, বুঝলে। কি সব বললে চুরি হয়েছে বললে। তাই আর কি !'' বাবাই অনয়াকে কোলে তুলে নেয়।

-''এই দেখো, চোরাই মাল। আর কে খুঁজে দিয়েছে জানো। আমার মেনী, ঐ কালো বেড়ালটা।'' অনয়ার হাতে মাটি মাখা হারটা দেখে সবাই অবাক। 

মুহুর্তে বাড়ির পরিবেশ বদলে যায়, আপাতত মেনিকে ড্রইং রুমের মেঝেতে বসিয়ে আদর করে দুধ খাওয়াচ্ছে ঠাম্মা। আর বাবাইয়ের কোলে বসে মেনীর হার খুঁজে দেওয়ার গল্প করছে অনয়া। দরজার পাশে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে মিনু দিদি। ঠাকুরের বাসুন নামিয়ে রোজ বাগানে দুব্বো আনতে যায় ও বাসন মাজার জন‍্য। সে সময় হারটা বাগানে পুতে এসেছিল, কাজ ছেড়ে দেবে বলে গান গাইছিল। সময় সুযোগ বুঝে তুলে নিত। খবর পেয়ে কনিকা মাসিও এসেছে ফিরে। ছোট কাকুদের ফোনে জানানো হয়েছে সব। এত বছরের পুরানো কাজ, ভালো মায়না, কেউ কি ছাড়তে চায়।

হঠাৎ বাবাই বলে ওঠে -'' যে মেনীকে অপয়া বলতে সেই কিন্তু আজ হিরো। ওর জন‍্যই হারটা পাওয়া গেলো। আর আজকের বাংলা তারিখটাও কিন্তু তেরো। আজ কিন্তু খুব ভালো দিন। আর আমার মেয়েকে তোমরা তেরোর খোটা দেবে না বলে দিলাম।ওর আর মেনীর জন‍্য আজ লক্ষ্মীর হার ফেরৎ এলো। ''

ঠাম্মা আজ প্রথমবার অনয়াকে আদর করে বলে -''ও তো এ বাড়ির জ‍্যান্ত মা লক্ষ্মী ।'' 

মিনু হঠাৎ কেঁদে এসে বাবাইয়ের পা জড়িয়ে বলে -''বড়দা, লোভের বশে করে ফেলেছি গো। আমার কাজটা খেয়োনি গো। আমি আর এসব করবোনি গো। ও বড়মা তোমার লক্ষ্মীর দিব‍্যি বলছি গো। ''

দাদু বলে -''ঠিক আছে, ঠিক আছে।আবার দিব‍্যি!! কুসংস্কারগুলো আজ থেকে বাতিল। সেই আনন্দে একটু মিষ্টি নিয়ে আয় তো মিনু।ডায়বেটিস আজ আর মানছি না।'' 

সবাই হেসে ওঠে। আর তখনি অনয়ার মনে পড়ে অঙ্ক খাতার নম্বরটা বাড়িতে বলাই হয়নি। তবে বাবাই যখন আছে চিন্তা নেই। মা কে এক ঝলক দেখে নিয়ে চুপি চুপি কানে কানে বাবাইকে বলতেই বাবাই বলে -''কুড়িতে তেরো তো অনেক নম্বর রে। আমিও এত নম্বর পেতাম না ছোট বেলায়। আজ তো মিষ্টি আসবেই সবার জন‍্য।''

আনন্দে ঝলমল করে ওঠে অনয়ার মুখ। আর তেরোকে কেউ খারাপ বলতে পারবে না।মেনীও ওদের ঘরে ঢোকার ছাড়পত্র পেয়ে গেলো আজ থেকে। কি মজা!! কালো মেনীটা কি বুঝল কে জানে, দুধ শেষ করে ঠোটটা চেটেই ডেকে উঠল মিয়াও মিয়াও। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics