শিপ্রা চক্রবর্তী

Classics Fantasy Inspirational

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Classics Fantasy Inspirational

তাল

তাল

4 mins
360



কদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে শহর তলী থেকে গ্রাম চারিদিকে এখন জল থৈ থৈ অবস্থা। ভোলা বর্ষার দিনে ভোর বেলায় উঠে মাথায় প্লাস্টিকের বস্তাটা চাপিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে তাল খুঁজতে। সামনে জন্মাষ্টমি তালের বেশ চাহিদা এখন বাজারে। এই সুযোগে কিছু রোজগার হলে বাবার ওষুধের টাকাটা জোগাড় করতে সুবিধা হবে। ভোলা কাদা জল পেরিয়ে পৌঁছাল পূর্ব দিকে দত্তদের পুকুর পাড়ে। এই পুকুর পাড়ে তাল গাছ গুলোতে প্রত‍্যেক বছর অনেক অনেক তাল আসে। বেশ বড় বড় কালো মুশমুশে তাল। ভোলা তাল গাছের কাছে গিয়ে দেখল, হ‍্যাঁ... মনে মনে যা ভেবেছে ঠিক তাই, তাল পড়ে আছে দুটো ডাঙ্গায় আর দুটো জলে। ভোলা সময় নষ্ট না... করে ঝপ করে জলে ঝাপ দিল, তারপর তাল দুটো তুলে নিল, আর তার সাথে কিছু টাটকা কলমির শাক তুলে ডাঙায় উঠল, এবং চারটে তাল বস্তায় ভরে নিল।

---------ভোলার মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল। ভোলা নিজের মনেই বলে উঠল, ভালোই হল তাল কটা বিক্রি হলে অনেক কটা টাকা আসবে। আর এই শাককটা মাকে দিয়ে বলবো, ভালো করে রসুন দিয়ে ভাজতে। গরম গরম ভাত শাক ভাজা দিতে খেতে কি.... ভালো লাগে। ভোলা বস্তা কাঁধে চাপিয়ে বাড়ির পথে চলল।

সূর্য তখন পূর্ব আকাশে মেঘের আড়াল থেকে নিজের হাস‍্যেজ্বল মুখ মেলে ধরার আপ্রান চেষ্টা করছে। ভোলা বাড়ি ফিরে পরনের ভিজে পোষাকটা ছেড়ে মাকে শাক কটা দিয়ে বলে উঠল.....

--------আমি তাল চারটে বেচে আসি এসে ভাত খাব। আর যা.... টাকা হবে তা.... দিয়ে বাবার ঔষুধ আজগের মতো কেনা হয়ে যাবে। তুমি অত চিন্তা করোনা মা!

-------ফুলটুসি ভোলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল সাবধানে যাস বাবা। আর মনে মনে বলে উঠল, ভোলা আমার কত বুঝদার ছেলে হয়েছে। এখন থেকেই সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করছে। বাবার ওষুধের টাকার জোগাড় করছে। লোকটা যে.., আর কদিন বাঁচবে কে... জানে? গরীবের ঘরে কি..... আর এই রাজ রোগের চিকিৎসা হয়!!

ভোলার বেড়িয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফুলটুসি বলে উঠল দুগ্গা.... দুগ্গা...। আর ঘরের ভীতর থেকে তখন তীব্র কাশির আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল।

**************************

ভোলা একটা ধামাতে করে তাল চারটে নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে ফুটপাতের ওপর বসল। আশেপাশে সব ফলের দোকান কত রকমের ফল সুন্দর সুন্দর করে সাজানো আছে। তবে বৃষ্টির জন‍্য বড় রাস্তায় বেশ জল জমেছে। গাড়ি গুলো যখন জোড়ে যাচ্ছে তখন একটু একটু জলের ছিঁটে আসছে ফুটপাতের ওপর।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল, থেকে থেকে ঝেপে বৃষ্টি আসছে আবার থেমে গিয়ে সূর্যিমামা মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। ভোলারও পেটেও ক্ষীদে উঁকি দিচ্ছে কিন্তু এখন ও বাড়ি ফিরবে কি.... করে! এখনও পর্যন্ত একটা তালও বিক্রি হয়নি। ভোলা পথ চলতি মানুষ থেকে, গাড়িতে যাওয়া মানুষ সবাইকে উদ্দেশ‍্য করে বলে চলেছে......

--------তাল... নেবে গো...., তাল...., ভালো তাল মিষ্টি তাল। কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দিচ্ছেনা ভোলার ডাকে। ভোলা নিজের মনে মনে বলে ওঠে, আজ আর মনে হচ্ছে একটাও বিক্রি হবে না! খালি হাতেই ফিরতে হবে বাড়ি। মাও.... কত আশা করে আছে আমি দুটো পয়সা নিয়ে যাব, বাবার ওষুধ কিনবে, আর দুদিন থেকে বাবার শরীরটাও যেন খারাপ হয়েছে একটু বেশী। খুব কষ্ট পাচ্ছে বাবা। কিন্তু আজ আর তাল বিক্রি হবে না বলেই মনে হচ্ছে। হঠাৎ ভোলার ভাবনার মাঝে একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেল........

----------কিরে কত করে তাল দিচ্ছিস?

ভোলা ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এসে সামনে তাকিয়ে দেখল, ওর মায়ের বয়সি একজন মহিলা, তবে ওর মায়ের মত রুক্ষ, রুগ্ন শরীর নয়, বেশ জেল্লা আছে, ধপধপে সাদা গায়ের রঙ, পড়নে কি সুন্দর লাল টুকটুকে শাড়ি, কপালে লাল টিপটা জ্বলজ্বল করছে।

--------ভোলাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহিলাটি ভোলার মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠল, কিরে... কত টাকায় তাল বেচ্ছিস...???

----------ভোলা ভালোবাসার স্পর্শ পেয়ে হাসিমুখে বলে উঠল পঞ্চাশ টাকা করে, খুব ভালো তাল। তুমি যে.... দামে নেবে নাও!!!

-----------মহিলাটি হাসতে হাসতে বলে উঠল, বাজারেতো আশিটাকা বলছে, তা.... তুই এত কম বলছিস কেন????

--------ভোলা সরল হাসি দিয়ে বলে উঠল, আমি তাল কিনিনি গো....., কুড়িয়ে এনেছি গাছ তলা থেকে তাই কম দামেই দিচ্ছি, তুমি নেবে কটা বল....???

---------মহিলাটি বলে উঠল, চারটেই দিয়ে দে.... আমার বাড়িতে বড় করে জন্মাষ্টমির পূজো আছে।

---------ভোলা অবাক হয়ে বলে উঠল, চারটেই নেবে তুমি....!!!

---------মহিলাটি বলে উঠল, কেন.... চারটে দিবিনা তুই....???

---------ভোলা ভয় পেয়ে বলে উঠল, পাছে রাগ করে একটাও না নেয়, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না....না দেবনা কেন??? কোথায় রাখতে হবে বলো, আমি রেখে দিচ্ছি।

----------মহিলাটি একটা সাদা গাড়ি দেখিয়ে বলে উঠল ঐ.... গাড়িতে। ভোলা ধামাটা মাথায় তুলে মহিলাটির সাথে এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে তালকটা তুলে দিল। মহিলাটি ভোলার হাতে একটা চকচকে হলুদ রঙের দুশোটাকার নোট তুলে দিল। ভোলা টাকাটা হাতে নিয়ে এপিট ওপিঠ ভালো করে দেখতে লাগল।

---------ভোলার কান্ড দেখে মহিলাটি হেসে বলে উঠল, আসল টাকা...,নকল নয়!!!

-----------ভোলা বলে উঠল, এত সুন্দর টাকা আগে দেখিনি, তাই... ভালো করে দেখছিলাম একেবারে নতুন চকচক করছে।

--------মহিলাটি ব‍্যাগ থেকে একটা কেকের প‍্যাকেট বার করে ভোলার হাতে দিয়ে বলল, এটা নে.... খাবি।

--------ভোলা টাকা টা পকেটে ভরে, কেকের প‍্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলে উঠল, তুমি.... খুব ভালো, সবাই তোমার মত কেন ভালো হয়না!!!

------মহিলাটি হেসে উঠল।

গাড়িটা আসতে আসতে মিলিয়ে গেল রাস্তার বাঁকে। ভোলা বৃষ্টি মাথায় জমা জলের মধ‍্যে ছপাৎ ছপাৎ করে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরল, এবং মায়ের হাতে টাকাটা দিয়ে বলে উঠল এই দেখো নতুন টাকা একেবারে চকচকে, এতে বাবার ওষুধ কেনা হয়ে যাবে তো... মা... আজগের মত???

-------ফুলটুসি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল, খুব হবে...রে বাপ আমার, খুব হবে।

-------ভোলা বলে উঠল, খুব খিদে পেয়েছে মা, তাড়াতাড়ি দুটো খেতে দাওতো।

ফুলটুসি যত্ন করে ছেলেকে খেতে দিল। গরম ভাত আর কলমির শাক ভাজা। এতেই ভোলার চোখটা আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল। এই খাবারের মধ‍্যেই ভোলা যেন অমৃতের স্বাদ খুঁজে পেল। আবার কালকে নতুন ভোরকে সাক্ষী রেখে শুরু হবে নতুন করে আরও একদিন বেঁচে থাকার লড়াই, টিকে থাকার লড়াই।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics