সূর্যের দিকে
সূর্যের দিকে
কালভার্টটার নীচে লুকিয়ে বসেছিল বুধন। বড় ঝামেলায় পড়ে গেছে সে। বেশ দিন কাটছিল তার বন-বাদারে,খাল পাড়ে ঘুরে কিন্তু গাঁয়ের ইস্কুলে নতুন হেডমাস্টার এসে সব গন্ডগোল করে দিল। তার বাবাকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে ইস্কুলে ভর্তি করে দিল। তাও ঠিক ছিল ভর্তি হলেও সে একদিনও ইস্কুল মুখো হয়নি। তার বাবা-মা লোকের বাড়িতে মজুর খাটতে কিংবা জঙ্গলে কাঠ আনতে চলে গেলেই সে মুক্ত বিহঙ্গের মত বেরিয়ে পড়ত কিন্তু এই সেদিন হেডমাস্টার তাদের ঘরে এসে তার বাবার কানে কিসব ফুসমন্তর দিয়ে গেল তারপর থেকে বাবা ধরেছে বুধনকে ইস্কুলে যেতেই হবে। হেডমাস্টার আবার বলে গেছে সামনের বছর তার যমজ ভাই-বোন দুটোকেও ইস্কুলে ভর্তি করবে।
" খোকা এখানে কি করছ?" বুধন তাকিয়ে দেখল বেণী বৈরাগী। বেণী ভারী সুন্দর গান গায়। গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায় সে।
" কি গো উত্তর দিচ্ছ না যে?" রাস্তার উপর থেকে বলে বেণী।
" আমি হেথায় লুকি আছি। তুমি কিন্তু কাউকে বোলোনি।"
" ওমা!সেকী কথা। লুকিয়ে আছ কেন?"
" আর বোলোনি বড়মাস্টার গুজুরগুজুর করে কি যে বলে দিল তারপর থেকে বাবা ধরেচে আমাকে ইস্কুলে যেতেই হবে। "
" সে তো ভালো কথা।"
" মোটেই ভালো কথা লয়। ইস্কুল মোটে ভালো জায়গা লয়।"
" আচ্ছা। বুঝলুম। এখন আমি আসি।" বেণী আবার গান ধরে এগিয়ে চলল গ্রামের পথে। বুধন নিশ্চিন্ত হয়ে ডাঁসা পেয়ারাটায় কামড় বসালো।
" এই যে বুধন সাড়ে এগারোটা বাজে। স্কুল যে দশটা চল্লিশ থেকে বসে।" গলার স্বরটা শুনে বুধন এমন চমকালো যে তার হাত থেকে আধখাওয়া পেয়ারাটা টুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। বুধনের সামনে একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব ঘোষ।
" চল আমার মোটরসাইকেলে চেপেই আজ তুই স্কুলে চল।" বুধন চোখ পিটপিট করে দেখল একটু দূরে একটা মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। এই জিনিসটায় চেপে ফটফট করে যাওয়ার ইচ্ছে তার বহুদিনের।
" কি রে চল।" গুটিগুটি পায়ে বুধন এগিয়ে চলল। সে ভালো করেই জানে আজ না গেলে তার বাবার কাছে খবর যাবে আর বাবা রেগে গেলে তার কপালে দুঃখ আছে তাছাড়া ওই ফটফটি মোটরসাইকেলটার আকর্ষণও আছে।
" বুধন আর একটু ভাত নিবি?" বুধন ভাতের থালা থেকে মুখ তুলে দেখল নীলশাড়ি পরা দিদিমনিটা জিগ্যেস করছে তাকে। অবাক হয়ে সে জিগ্যেস করে," আরও ভাত দিবে?"
" কেন দেবে না? তুই পেট ভরে খা।" যারা ভাত-তরকারি দিচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্যে দিদিমণি বলল," ও দিদি, বুধনকে আর একটু ভাত, তরকারি দাও।"
খাওয়া শেষে থালা ধুয়ে কল থেকে জল ধরে খাওয়ার পর বুধনের মুখটা তৃপ্তিতে ভরে গেল। পেট ভরে গরম গরম ভাত-তরকারি বহুদিন খায়নি সে। মাস দুই আগে মধু পালদের ঘর ছাইতে চালের উপরে উঠেছিল তার বাবা। কিকরে যেন সেখান থেকে পড়ে যায়। ডান হাতটা গেল ভেঙে। কোমরেও বেশ লেগেছিল। অনেকদিন কাজকর্ম বন্ধ রেখে ঘরে বসে ছিল বুধনের বাবা। যেটুকু পয়সাকড়ি ছিল চিকিৎসা করতে শেষ হয়ে গেল। বুধনের মা জঙ্গল থেকে কাঠ এনে কখনও লোকের বাড়িতে কামিন খেটে যেটুকু রোজগার করত তাতে কি আর রুগীর চিকিৎসার সাথে সাথে পাঁচটা প্রাণীর পেট চলে! ভোরবেলা এক হাঁড়ি ভাত আর কচু সিদ্ধ রেঁধে তাতে জল ঢেলে দিয়ে কাজে চলে যায় মা। যার যখন খিদে পায় ওই জলঢালা ভাত আর একটু লংকা দিয়ে কচু চটকে খেয়ে নেয় তারা। রাত্রিবেলা তো বেশিরভাগ দিন পেটভরে জল খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। পাশে বসা গৌরীকে বুধন চুপিচুপি জিগ্যেস করল," হ্যাঁরে, ইস্কুলে রোজ এমনি পেট ভরে ভাত-তরকারি দেয়?" গৌরী চোখ ঘুরিয়ে বলল," হ্যাঁ, রোজই তো আমরা খাই। তুই ইস্কুলে আসুনু তো আর জানবি কি করে। আজ তো কুমড়ার ঘ্যাট খেলি কাল শুক্কুরুবার, কাল ডিম খাবি।"
গুটিগুটি পায়ে স্কুলের গেটটায় ঢুকেই পড়ল বুধন। কাল ক্লাসে ওই কিসব পড়া হচ্ছিল একটুও ভালো লাগেনি বুধনের। একদিনও স্কুল না আসায় সে বুঝতেও পারেনি কিচ্ছুটি তায় আবার চুপচাপ ওই একখানা ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকা মোটেই পছন্দ হয়নি তার কিন্তু তাও আজকে সে চলে এল। গরম ভাত-তরকারির স্বাদটা এখনও যেন তার জিভে লেগে আছে।
" বুধন এদিকে আয় তো বাবা।" বড়মাস্টার তাকে ডাকছে। বুধন এগিয়ে গিয়ে দেখল বড়মাষ্টার অনেকগুলো গাছের চারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
" ছ্যার, এগুলা কি হবে?" কালকে বুধন শিখেছে মাস্টারকে ছ্যার বলতে হয়।
" বাগান করব রে। কত ফুল হবে। বেগুন চারা, পেঁপে চারা এসবও এনেছি। ফল হলে গাছের টাটকা জিনিস দিয়েই তোদের রান্না হবে। এখন তুই এই দাদাদের সঙ্গে হাত লাগা দেখি সবাই মিলে বাগানটা তৈরি করে ফেলি।" ছ্যারের কথা শুনে বুধনের ভারী আনন্দ হলো এসব কাজ তার খুব পছন্দের। সেও অন্য ছেলেদের সঙ্গে লেগে পড়ল। কাজ শেষ হতে বড়ছ্যার তাকে বললেন," বুধন, তোকে কিন্তু বাগানের দেখাশোনা করতে হবে। গাছে জল দিতে হবে।" বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নাড়লো বুধন।
সাদা গোল বস্তুটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল বুধন। তার ভাগ্যে একটা আস্ত ডিম বিশ্বাসই হচ্ছে না তার। ডিমটা মুখের সামনে এনে কামড়াতে যেতেই হঠাৎ করে ছোট ভাই-বোন দুটোর মুখটা মনে পড়ে গেল বুধনের। আস্তে করে হাতটা পেছন দিকে নিয়ে গিয়ে প্যান্টের পকেটে ডিমটা ঢোকাতে যেতেই,
" বুধন, ডিম এখানেই খেতে হবে। বাড়ি নিয়ে যাওয়া বারণ।" লম্বা দিদিমনিটা কোমরে হাত দিয়ে বুধনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাধ্য হয়ে বুধন ডিমটা একটু একটু করে ভেঙ্গে খেতে লাগলো কিন্তু ভাই-বোন দুটোর জন্য চোখের কোণে জল জমা হলো। ভাই-বোনকে পরের বছর ইস্কুলে ভর্তি করে দিতেই হবে তাহলে ভাই-বোনও ডিম পাবে।
" সাহেবদা, বুধন যে কিছুই শিখছে না। ক্লাস ওয়ান অথচ অ,আ টাও সব লিখতে পারছে না।" নীলিমা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন।
" শিখবে, সব শিখবে। শুধু ওর মনে শেখার ইচ্ছেটা জাগাতে হবে। যাই হোক আজ থেকে অঞ্চল স্পোর্টসের প্রস্তুতি শুরু করে দিতে হবে বুঝেছ।"
" ঠিক আছে।"
বুধন হাঁ করে চারিদিকে দেখছিল। তারা সরিষবণী গ্রামে এসেছে। এখানেই হবে প্রাইমারী স্কুলের অঞ্চল স্পোর্টস। পুরো মাঠটা রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো। মাঠের মাঝখানে চক দিয়ে ট্র্যাক কাটা। একধারে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমাগমে গমগম করছে জায়গাটা। বুধনের দু চোখে অপার বিস্ময়। বড়ছ্যার তার জামার পেছনে সেফটিপিন দিয়ে একটা কাগজ আটকে দিয়েছে আসলে বুধনও একজন প্রতিযোগী কিনা। সে ' ক' বিভাগ বালকদের আলুদৌড় প্রতিযোগিতায় নামবে। বুধনের নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। বড়ছ্যার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত কিন্তু ছোটছ্যার আর দিদিমণি দুজন যারা খেলবে তাদের বেশ খাতির করছে,খেয়াল রাখছে। তাদের মধ্যে আবার বুধনের আদর-যত্নটা একটু বেশিই হচ্ছে সে যে সবার চেয়ে ছোট। তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে দিদিমণির দেওয়া প্যাকেট থেকে লুচি-মিষ্টি খেতে খেতে হঠাৎ বুধনের চোখ চলে গেল মাঠের ধারের কদম গাছটার নীচে। আরে এ যে বেণী বৈরাগী!এক ছুটে বেণীর কাছে চলে এল বুধন,
" বেণী দাদা, তুমি হেথায় কি কচ্চ?" বেণী মাথা নেড়ে বলে," আরে দ্যাখ না, আমি কাল এ গাঁয়ে ভিখ মাংতে এসেছিলুম। সরিষবনীর হেডস্যার আমাকে ধরে বলে আজ এখানে খেলাধুলা শুরুর আগে স্টেজে উঠে দুকলি গাইতে হবে তারপর খেলা দেখে খেয়েদেয়ে তবে আমার ছুটি। তা তুই এখানে?"
বুধন বুক চিতিয়ে বলে," আমি যে হেথায় খেলব গো। ছ্যাররা আর দিদিমনিরা অটয় চাপিয়ে লিয়ে এসচে আমাকে।" বেণী মুচকি হেসে বলে," তাহলে সেদিন হেডমাস্টারকে তোর খবরটা দিয়ে ভালোই করেছিলুম বল?" বুধনের চোখ দুটো গোল গোল হয়ে যায়," বেণী দাদা, তুমি বড়ছ্যারকে খপর দিয়েছিলে!"
" ওই কাঁসিগুলান কি হবে গ দিদিমণি?"
" ওগুলো যারা জিতবে তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে।"
" আমি যদি ফাসট হই আমাকেও দিবে?"
" অবশ্যই দেবে। এখন চল খেলা শুরু হবে।"
বুধন আরেকবার পুরস্কারের থালাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে। তাদের ঘরে মোটে চারটে কাঁসি আছে। তারা যখন সবাই একসাথে খায় তখন তার মা একটা ফাটা টিনের ডিশে খায়। সেটা ধুতে গিয়ে তার মায়ের হাতও কেটে গেছে একবার। স্টার্টিং লাইনে এসে দাঁড়ালো বুধন। প্যান্টটায় হাত দিয়ে নিজের মনেই হেসে ফেলল। স্কুলে প্র্যাকটিসের সময় তার ছেঁড়া-ফাটা ঢিলে প্যান্টটা খুলে যাবে বলে হাতে ধরে দৌড়াত সেজন্য নিলী দিদিমণি তার ছেলের পুরানো জামা-প্যান্ট এনে দিয়েছে বুধনকে। এবার বুধন নিশ্চিন্তে দৌড়াবে। বড়ছ্যার বলেছে সামনের বছর সেও ইস্কুলের জামা-প্যান্ট পাবে।
" রেডি অন ইয়োর মার্ক, গেট সেট গো।" হুইসেলটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে গেল একঝাঁক কচি পা। বুধন প্রানপনে চেষ্টা করছে তাড়াতাড়ি করার। স্কুলে যেমন নিয়ম শিখিয়ে দিয়েছে তেমনি করেই করছে সে। একটুও ভুল হলে যে তাকে খেলা থেকে বাদ দিয়ে দেবে। দড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে বুধন তার আগে একটা মাত্র ছেলে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সে গতি বাড়ালো মায়ের জন্য তাকে কাঁসি পেতেই হবে। শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মাস্টারমশাইদের হাতের ওপর আছড়ে পড়ল বুধন।
" চেস্ট নাম্বার তের। ডালিমপুর প্রাইমারী স্কুল ফাস্ট।"
খাওয়ার শেষে বাকি ছেলেদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল বুধন এমন সময় বেণী বৈরাগীকে দেখতে পেয়ে ছুটে তার কাছে গিয়ে বলল," বেণী দাদা, আমি ফাঁসট হইচি।" বুধনের চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বেণী বলল," সে তো আমি দেখলুম।"
" তুমি কি এখন ঘর যাবে?"
" ঘর? সে এককালে ছিল বটে যখন আমার মা-বাবা বেঁচে ছিল এখন পথই আমার ঘর। পথেই জীবন পথেই একদিন…...। যাই হোক এখন আসি রে।"
" বেণী দাদা, সেদিন তুমি বড়ছ্যারকে আমার কথা বলে দিয়ে ভালোই করেছিলে গো।"
" তাই নাকি?"
" হুম।"
বুধন একদৃষ্টিতে বেণীর ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্তাচলে যাওয়া সূর্যের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে একসময় বেণী দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
" বুধন, চল। অটোয় উঠে পড়। তোদের ডালিমপুরে পৌঁছে দিয়ে তারপর আমি বাড়ি যাবো।" বুধনকে ডাকেন সাহেব।
" ছ্যার।"
" কি রে কিছু বলবি।"
বড়ছ্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে বুধন বলে ওঠে, " ছ্যার, তুমি সেদিন জিগাস কচ্ছিলে না ইস্কুলটা কেমন লাগচে আমার।"
" হুম, তুই তো উত্তর দিলি না।"
" ইস্কুলটা খুব ভালো জায়গা গো ছ্যার।"
" সত্যিই?"
" হ্যাঁ গো। ছ্যার, এবার থেকে আমি মন দিয়ে লিখাপড়াও করব। তুমি আমাকে একটু পড়া শিকি দিবে। বন্দুরা তো অনেক পড়া শিকে গেচে।" সাহেব বুধনের কাঁধে হাত রাখেন, ভরসার হাত। অস্তগামী সূর্যের আলোয় বুধন আর তার বড়ছ্যার দুজনের মুখটাই চকচক করছে বুধনের হাতে ধরা নতুন থালাটার মত।
দূরে বাঁশঝাড়ের পেছনে সুয্যিমামা ডুব দিয়েছে। মুনির মুখটা শুকনো। তাকে ছেড়ে এই প্রথম বুধন একলা কোথাও গেছে। ছেলেটা সারাদিন কি করছে, কি খেয়েছে কে জানে। বুধনের জন্য দুটি পান্তাভাত রেখে দিয়েছে সে। ছেলেটা এসে যদি খায় তাই।
" মা আ আ আ আ….।" বহু প্রতীক্ষিত ডাকটা কানে আসতেই মুখে হাসি ফুটলো মুনির।
" মা, দ্যাক তোর জন্নে লোতন কাঁসি লিয়ে এসচি। তোকে আর ফাটা কাঁসিতে খেতে হবে নি।" মায়ের হাতে নতুন থালাটা ধরিয়ে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বুধন। মা-ছেলের মন ভুলানি হাসিতে ঝুপসি আঁধারেও জোৎস্না ছড়িয়ে গেল।