Latifur Rahman

Tragedy Others

4.0  

Latifur Rahman

Tragedy Others

সুজিত রায় মরে গেছে

সুজিত রায় মরে গেছে

5 mins
220



এত তাড়া-তাড়ী ঘুম ভাঙ্গে না কখনো। এই নিয়ে প্রায় মা বকুনি দেয়।

তাতে কি?

রোজ রোজ এমন গালাগাল শুনতে শুনতে প্রত্যেক মানুষের আর জবাব দেয়ার কিছু থাকেনা। এটা অনেকটা, যে বলার সে তা বলবেই বরঞ্চ না বললেই তার অমঙ্গল হবে। আর যে শোনার সে তা হজম করবেই এটা নিয়মের মতো। বাবা মার এমন সস্তা বকুনি হজম করার ক্ষমতা নীলার আছে।

আর বেকার হলে কথাই নেই। বেকার ছেলেমেয়েরা কখনো মাছের মুড়ো পায়না।

সারারাত ঘুম হয়নি। স্বপ্নের চাকুরির প্রথম অফিস কাল। অপেক্ষার রাত্রি বুজি বড় হয়। না হলে সকাল হতে এত দেরি হল কেন।

কি রে তুই পুজোর ঘরে!

হা মা আজ প্রথম অফিসে জয়েন করব।

কিন্তু তুই ত বললি সোমবার।

বড়বাবু আজই জয়েন করতে বলেছে।

একা যাবি?

যেতে পারবো এক-ঘন্টার পথ। আলীপুর পোস্ট অফিসের সামনে বাস। বেলডেভিয়ার রোড হয়ে ভবানী ভবনের পাশেই অফিস।

কখন বেরুবি?

এখনি। কিন্তু অফিস নাকি দশটায়?

একটু আগে বেরুব।

নীলা ফ্রেশ হয়ে প্রিয় সেই নীল শাড়ী টা পড়ল।

শাড়ি তে খুব সুন্দর লাগে রে মা তোকে।

অসুন্দর ছিলাম বুজি?

শুধু একটা রুটি খেয়ে হবে?

দুপুরে অফিস কেন্টিন এ খেয়ে নিব মা।

বাড়ির কাছাকাছি আলীপুর পোস্ট অফিসের সামনে বাস থামে।

দেয়ালে সাঁটান বাসের সময়সূচি সকাল আটটায়, এগার টা আর একটায়। নীলা তার নোট বুকে তুলে নিল। এটা তার নতুন পথের শুরু।

কোলকাতা আর আগের মত নেই। মানুষ বেড়েছে, রাস্তাঘাট বেড়েছে, সাথে যানবাহন বেড়েছে। পাবলিক বাসে যাতায়াত এখনো নারীর জন্য নিরাপদ হয়ে উঠেনি। বাংলার নারী বাদী সংগঠনগুলো রোজ রোজ মিছিল মিটিং আর মানববন্ধন করে। তাতে কার কি আসে যায়?

বাসের লোকেরা হাত ধরে বাসে তোলে আর নামার সময় ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এইতো গতকাল হাওড়ায় এক বৃদ্ধাকে এভাবেই ধাক্কায় মেরে ফেলেছে।

বাস আসার ত সময় হলো। তাই বলে একজন যাত্রী নেই। যেখানে বাসে চড়ার জন্য হুমড়ি খেতে হয়, সেখানে আজ ত একজন যাত্রী ও নেই। এটা ত অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মত। মানুষ বেশি লোকের জমায়েতে যেমন অসস্তি বোধ করে আবার একা থাকতে ত ভয় করে।

আশেপাশে তেমন লোকজন নেই। রাস্তা পুরো ফাঁকা। কখনো কখনো দু একটা রিকশা চলছে।

নীলার রক্তপ্রবাহ এখন আগের মত নেই। সময় ও ফুরিয়ে আসছে। তবে কি আজ বাস বন্ধ? তা হবে কেন? তাহলে কি?

নীলা ঘামতে শুরু করে। মানুষ শুধু গরমে ঘামে না, দুশ্চিন্তায় ও ঘামে।

দিদি মনি এখান থেকে চলে যান।

মাথা ঘুরিয়ে দেখে পিছনে একটা আধা বুড়ো লোক তাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছে।

কেন?নীলা প্রতিবাদ করে।

যাবেন কই?

ভবানী ভবন।

কিন্তু শ্রমিক ফেডারেশনের লোকজন ত আজ অবরোধের ডাক দিয়েছে। বাস বন্ধ। দেখছেন না রাস্তায় লোকজন নেই। আপনি কালকে যান।

কাল মানে?

আর কোন উপায় নেই। দেখেন আপনার যা আপনার ইচ্ছে। লোকটা চলে যায়।

কি করবে এখন সে?

চাকরির বাজার যে কেমন সেটা নীলার চেয়ে আর কে বেশী জানে।

বিয়ানীবাজার থেকে পঞ্চাশ টাকার কেনা চটি জুতা তিন মাসের বেশি চলেনা। প্রতি সপ্তাহে দু তিন পরিক্ষায় যেতে যেতে জুতার আর দম থাকে না। কাকা পিসা না থাকলে চাকরি যে আর মেলেনা সেটা ত দেখাই গেল। অমলকুমার। মায়ের স্কুল বন্ধু খুব দয়া না করলে এই চাকুরী কি মিলত?

এক অন্তহীন সময়ের মুখোমুখি নীলা। সময়মত অফিসে জয়েন না করলে চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে না।

নীলার ভাবনার অন্ত নাই।

আপনি নীলা?

জি।

এই শহরে কে চেনে তাকে?

শ্যামলা কিন্ত সুন্দর। বত্রিশ বছরের হবে ছেলেটা। আমতা আমতা করতে থাকে নীলা।

আমি জানি আমার সাথে যেতে আপনার আপত্তির কারণ থাকবেই।

কে আমি?

কিভাবে আপনারে জানি এমন প্রশ্ন করবেনা।

তবে আমি আপনার অফিসে নিরাপদেই পৌছে দিব, এই বিষয় নিয়ে ভাবতে হবেনা। ছেলেটা এমনই হড়হড়ে বলছিল যে নীলার বলার সুযোগ ছিলো না।

কখনো অপরিচিত বাইকের সওয়ার হতে হয়নি কখনো। এটা অস্মভব কল্পনায় ছিল এত দিন। মানুষের কি ধারনায় থাকে কখনো, আগামীকাল কি হবে? 

নীলা জানেনা সে কি করবে? অচেনা অজানা পর মানুষের শরীর ঠেসিয়ে,,,,,,,,,,,

না। থাক। আমি পরে যাব।

অচেনা, অজানা মানুষ ঘর করছে না? পথ চলছে না? একদিন অন্তত চড়ুন। আর হয়তো দেখা নাও হতে পারে।

নীলা কথা বাড়ায় না। সে জানে কখনো কখনো পরিস্থিতি মানুষের ভাববার সময় দেয়না।

নীলা উঠে পড়ে।

ভাল ভাবে বসুন। ভাববেন না আমি ভাল চালাতে পারি না। জীবনে কখনো এক্সিডেন্টে পড়িনি।

থাক।

বলতে হবে না।

ভাল চালক তা বুজব কিভাবে?

ফাঁকা রাস্তায় কি পরিক্ষা নেয়া যায়?

নীলা সহজ হতে চাইছে।

আসলেই ত গ্যাঞ্জাম ছাড়া পরিক্ষা দেয়া যায় না।

তবুও নয়। নীলার পাল্টা জবাব।

মানে?

তখন ত আমি বাসে যেতাম।

হুম বুদ্ধিমান ত।

বুদ্ধিমতি।

হেরে গেলাম আপনার কাছে।

কখনও নয়।

সহজে জিততে আমার ভাল লাগেনা।

বেলডেভিয়ার রোড এভাবে কখনো বাইকে পার হয়নি নীলা। রাস্তার দু'ধারে এখন সারি সারি দালান দাঁড়িয়ে। কলকাতা তার রুপ বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। গেল বছরে যখন নীলা মাসীর বিয়েতে গিয়েছিল ঐ লাল দালানটা সেখানে গজায়নি তখনও।

বিশাল পুকুর ছিল সেখানে। শান বাধানো ঘাট, সেই ঘাটেই কপোত কপোতী রা সারি বেধে বসত বিকেলবেলা ।

কে জানে কত বিচ্ছেদ ঘটেছে সেই ঘাটে?

কত কথার ফুলঝুরি, কত সপ্নের জাল বুনেছে দুজনেই। কল্পনায় নামিয়েছিল জোসনার চাঁদটা। পুকুরের রঙিন পদ্ম, শাপলা প্রেয়সীর খোপায় খোপায়।

সেই দিন আজ দেখি বিলিন হয়ে গেছে, নগরায়ন আমাদের প্রানের জায়গা দখলে নিয়েছে। দালানকোঠা আমাদের টাকাকড়ি দেয় সত্যি কিন্ত মনের স্পন্দন হত্যা করে।

কি চুপ কেন?

আমরা ত প্রায় এসে পড়েছি। খুব তাড়াতাড়ি এসে পড়লাম তাই না?

নীলা বলে, কি যে বলেন অনেক্ক্ষণ ত বসে আছি।

ভ্রমণে ভাল সংগী জুটলে পথকে খুব ছোট বলে মনে হয়। আমি তাড়াতাড়ি কখনো এর আগে আসিনি।রাস্তাটা আজ যেন ছোট হয়ে গেছে। ছেলেটা বলে।

এই আপনার অফিস। সাবধানে নামুন। নীলা নেমে পড়ে।

আপনি আমার জন্য অনেক বড় উপকার করলেন।

মানুষের তাই করা উচিত।

নীলা নেমেই সোজা চলে রিসিপশনে।

জি এখানে বসুন, এরপর কুড়ি মিনিট পর ১২৩ নম্বর রুমে স্যারের সাথে দেখা করবেন তিনি আপনাকে সব বুজিয়ে বলবেন।

নীলা মাথা নাড়ে। আচ্চা।

প্রকান্ড অফিস নীলার। সবকিছুই পরিপাটিভাবে সাজানো। দামী আসবাবপত্র আর দেয়ালের রঙের সাথে নীলার শাড়ি মিশে গেছে।

১২৩ নাম্বারে এখন নীলা। সুজিত রয়। সিনিয়র ডিরেক্টর।

স্যার আসব।

আসুন।

আরে আপনি!

হুম আমিই ত সুজিত রয়। আপনার বস।

জি স্যার।

আমাকে অবাক করেছেন আপনি।

তা বটে। বড়বাবু আপনার ফাইল দিয়েছে। সেখানে আপনার বায়োডাটা পেলাম। আর রাস্তায় যে আপনার দেখা হবে এটা আমাকে ও অবাক করেছে।

যাইহোক এই ফাইলগুলো পড়ে নিবেন। কাজ বুজে নিতে সুবিধা হবে।

আমি আসানসোল যাচ্চি।

কখন আসবেন?

আসবো না বোধহয় আর। আমার বদলী হয়েছে।

হয়তো কখনো দেখা হবে নয়তো কখনো নয়।

আর শুনুন, আপনার কিন্তু বাস খুলেছে, সাবধানে যাবেন।

নীলার মুখে আর কোন কথা সরেনা।

টলমল চোখে লম্বা নিঃসাস ছেড়ে বসে পড়ে।


আর কোনদিন সুজিত এর সাথে নীলার দেখা হয়নি, কথা হয়নি।

সুজিত এর সাথে তার কোন প্রেম হয়নি বা বিচ্ছেদ হয়নি কিন্তু মনে একটা রেখাপাত করেছিল সেটা শুকাতে লেগেছিল বহুকাল।

পরদিন অফিসে গিয়ে নীলা বাসন্তী দেবীর কাছে প্রথম খবর জানতে পারে সুজিত গতকাল এক্সিডেন্টে মারা গেছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy