সপ্তম দোল ও মাদরাল জয় চন্ডী
সপ্তম দোল ও মাদরাল জয় চন্ডী
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয় নগরের মতো।উত্তর ২৪ পরগনার মাদরাল গ্রামে সুপ্রাচীন জয়চণ্ডী মায়ের মন্দির আজ । লোক মুখে কথিত আছে যে একসময়ে এখানকার জঙ্গলে ভবানী পাঠক এসেছিলেন।তিনিই দেবী বিগ্রহ কুণ্ড থেকে উদ্ধার করে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পূজা ব্যবস্থা করেন। এ লোক বিশ্বাস । কারণ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্য গল্প শোনা যায়। নতুন মন্দিরটি আঁটচালা। ছোট মন্দির তবে সামনে নাট মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরের দরজার উপর শিলা ফলক লেখা থেকে জানা যায় এটির প্রতিষ্ঠা বাংলা সন ১৩৪৩।।এখানে অনুরাগের ভোগ রান্না করা হয় ।অনুরাগের ভোগ কি প্রশ্ন উঠেছে নিশ্চিত মনে। আগে এই অঞ্চল জঙ্গল ভরা ছিলো। আর এই জঙ্গল সাফ করে , লোকজন জঙ্গলের কাঁচা কাঠে রান্না করতেন। কাঁচা কাঠের রান্না করতে গিয়ে, চোখের জল বেরোতো তাই একে অনুরাগের বলা হতো ।মন্দিরের মধ্যে গর্ভগৃহে দ্বিভূজা বর ও অভয় প্রদানকারী মা জয়চণ্ডী বিরাজমান।পাশে একটি ছোট বিগ্রহ আছে যে বিগ্রহ এবং দুটি শিলা কুণ্ড থেকে উদ্ধার হয়েছিল।
মাদারাল এই জয় চন্ডী পূজা সপ্তম দোলে মেলা খুব বিখ্যাত গ্রামীণ মেলা।
বলা হয় মাদার আলি এই জঙ্গলময় অঞ্চলে এসে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন। মাদারআলি থেকে মাদরালি হয়ে আজ মাদারাল নামটা এসেছে।
ব্যারাকপুর,বারাসত,নৈহাটি, ভাটপাড়া এই অঞ্চল সেই সময় ছিলো ঘন জঙ্গল ভরা। এই অঞ্চলের মাঝখানে বর্তির বিল ছিল । এসব অঞ্চলে তখন ডাকাতদের বাস ছিলো। নৈহাটির রঘু ডাকাত,গৌর ডাকাত , ভাটপাড়ার মধু ডাকাতদের দখলে ছিলো অঞ্চল । এই ডাকাতদের আরাধ্য দেবী ছিলেন জয়চন্ডী । শোনা যায় দেবীর কাছে নর বলিও হতো। জয় চন্ডীকে পূজা দিয়ে ডাকাতেরা ডাকাতি করতে বের হত। সেই সময় এলাকাটি জয়চন্ডীর জঙ্গল নামে জানতো লোকে। সেই সময় গঙ্গার সাথে তিনটি খাল নোয়াই খাল,ইছাপুর খাল মুক্তারপুর খাল , যুক্ত করেছিল বর্তির বিলকে। তাই ডাকাতেরা ডাকাতি করে এই খাল পথে বর্তির বিলে এসে গা ঢাকা দিতো।
ইংরেজদের কড়া ডাকাতদের দমন করা হয় । এর সাথে এই বসতি স্থাপন হতে শুরু করে। ডাকাতেরা ডাকাতি করা ছেড়ে দেয়। ডাকাতেরা তাদের আরাধ্য দেবী জয়চন্ডীকে পুকুরে বিসর্জন দিয়ে চলে যায় । বহুবছর এই অঞ্চলের ধনী ব্যবসায়ী হারু গুড়া স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুকুর থেকে জয়চন্ডী মাকে উদ্ধার করেন। এবং মাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন।হারু গুড়ার আসল পদবী ঘোষ । কিন্তু গুড়ের ব্যাবসা করে বিশাল ধন সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন বলে,লোক মুখে পদবী পাল্টে যায় ঘোষ থেকে গুড়া।হারু গুড়া জয়চন্ডীকে সপ্তম দোলের দিন পেয়েছিলেন। সেই সময় থেকে সপ্তম দোলে উৎসব ও জয়চন্ডী মায়ের পুজো হয়ে আসছে, এবং বসেছে এই মেলা।
তবে কেউ কেউ বলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে স্থানীয় জগৎ চক্রবর্তী মহাশয় স্বপ্নাদেশ পেয়ে চন্ডী দিঘির থেকে উঠিয়ে আনেন জয়চন্ডীর মূর্তি। এবং ভগ্ন প্রায় মন্দির টিকে সংস্কার করে, মূর্তি কে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে , নিত্য পূজার ব্যবস্থা করেন। 1937 সালে ভাটপাড়ার জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ মহাশয় জয়চন্ডীর মন্দির সংস্কার করিয়েছিলেন। প্রতিবছর ফাল্গুনী পূর্ণিমার ছয়দিন পর সাড়ম্বরে জয়চন্ডীর পূজা এবং সপ্তম দোল উৎসব পালিত হয়। সেই উপলক্ষে মেলা বসে এখানে। মেলার স্থায়িত্বকাল সাতদিন।এই মেলার বয়স কিন্তু একশো বছরের পেরিয়ে গেছে । অনেক লোক কাহিনী আছে এই মন্দির ঘিরে। বলা হয়। রঘু ডাকাতের এলাকা ছিল এই অঞ্চল। রঘু ডাকাত মায়ের কাছে নরবলি দিয়ে ডাকতি করতে যেতো । একটি বাচ্চা ছেলেকে ধরে নিয়ে আসে বলির জন্য। মা চন্ডীর কাছে প্রার্থনা করে বাচ্চাটি, তার জীবন বাঁচাতে। শোনা যায় শুদ্ধিকরনে জন্য স্নান করাতে দিঘির জলে ডুব দেবার পর বাচ্চাটিকে আর পাওয়া যায় না।বাধ্য হয়ে রঘু ডাকাত বলি না দিয়ে বের হন ডাকাতি করতে। রঘু পালিয়ে বাঁচলেও সেইদিন তার দল ধরা পড়ে পড়ে যায়। ফিরে এসে জয়চন্ডীকে তরোয়াল দিয়ে আঘাত করে তাতে জয়চন্ডীর নাক কেটে যায়। এবং তিনি জয়চন্ডীকে দিঘির জলে বিসর্জন দিয়ে ডাকাতি করা ছেড়ে দেয়।
আর এর বহু বছর পরে হারু গুড়া স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুকুর থেকে জয়চন্ডীকে উদ্ধার করে। রঘু ডাকাতের মূর্তিটি ছিলো সোনার । সেই মূর্তি চেলি কাপড়ে ঢাকা থাকে । তবে অষ্টোধাতুর মুর্তিটি দেখা যায় ।সপ্রথমে রঘুডাকাতের তৈরী করা মন্দিরে পুজো হতো। পুরানো মন্দির ভেঙ্গে গেলে, নুতন মন্দির তৈরি হয়েছে
এই মন্দির লাগোয়া বিশাল পুকুর নাম দুই সতীনের পুকুর। এই অঞ্চলের এক ব্যাক্তির দুই বৌ ছিলো। দুই বৌয়ের ঝগড়া লেগে থাকতো, রেষারেষিও ছিলো। একদিন এক বৌ গ্ৰামের মানুষের জলের কষ্ট দেখে ঠিক করলেন একটি পুকুর কাটাবেন। তাই দেখে দ্বিতীয়জন ও ঠিক করলেন সেও একটা পুকুর কাটাবেন। তারপর দুটো পুকুর কাটা হলো পাশাপাশি মাঝখানে মাটির বাঁধ দিয়ে। পরবর্তী কালে বাঁধ ভেঙে দুটো পুকুর এক হয়ে যায়। আর মন্দিরের কিছুটা পিছনে রয়েছে একটি দিঘি সেই দিঘি থেকে জয় চন্ডীমাকে পাওয়া যায়। মেলার দশদিন মূর্তি মন্দিরে থাকে।তারপর পুরোহিতের বাড়িতে চলে যায়।দশদিন ছাড়া মন্দির ফাঁকা থাকে মন্দির বেদিতে চলে পুজোপাট।এককালে মেলা খুব বড় ও জমজমাট হতো এখন মেলার জৌলুস হারিয়েছে।
(মাদারাল যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে কাঁকিনাড়া যাবেন। কাঁকিনাড়া স্টেশন
স্টেশন থেকে মেলা ২/৩কিলোমিটার
পথ ।)