সন্তান সুখ
সন্তান সুখ


(১)
-"মামবাপী, এবার তো হাসো। আমি না হলে যেতে পারবো না।"
-"আয় মা, সাবধানে থাকবি। আর পৌঁছেই জানাস। সোনা মা আমার।"
-" তুমিও সাবধানে থাকবে। সিগারেট খাবে না একদম। প্রমিস করেছ আমায়। আর আজ বাড়ি গিয়ে মনে করে প্রেসারের ওষুধটা খেও কিন্তু। আমি তো আজ আর মনে করাতে পারবো না।"
-"হ্যাঁ রে মা "
-" এই তো আমার গুড বয়। টাটা মামবাপী। ওখানে পৌঁছে কথা হবে আবার।"
-"টাটা"
রানী যতক্ষণ না চোখের আড়াল হল , ততক্ষণ ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে চারের সামনে ঠায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন পক্ককেশ প্রৌঢ়। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ট্যাক্সি বের দিকে। আজ থেকে আবার শুরু তার পঁচিশ বছর আগের একার জীবন।
উবের বুক করে দাঁড়াতে হলো না বেশিক্ষণ। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলেন - "নামটা বলবেন স্যার"।
-"বিরূপাক্ষ রায়।"
ড্রাইভার তথ্য মিলিয়ে শুরু করলো গাড়ি চালানো। গন্তব্য নিউ আলিপুর।
(২)
পঁচিশ বছর আগে এমনই এক ভোর বেলা কাগজ পড়ছিলেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সদ্য প্রথম শ্রেণীর একটি বহুজাতিক কোম্পানীতে চাকরি পেয়েছেন। সংসারে তার বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ নেই। নিউ আলিপুরে একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন লোন নিয়ে। সেদিন ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি হবার কথা। অফিস ছুটি নিয়েছেন সেই কারণে। রেজিস্ট্রি অফিসে যাবেন বলে কাগজপত্র গোছাচ্ছেন। এমন সময় ড্রইং রুমে বেজে উঠলো টেলিফোনটা। একটু বিরক্তই হলেন বিরূপাক্ষ রায়। "মা ফোনটা একটু ধরবে প্লিজ।" সোমা দেবী ফোনটা ধরেই বললেন " এক্ষুনি দিচ্ছি" তারপর ছুটতে ছুটতে এসে বললেন " যা , শিগগির ধর। পুলিশ ফোন করেছে।" বিরূপাক্ষ হন্তদন্ত হয়ে ফোনটা কানে নিতেই ওপ্রান্ত থেকে শোনা গেলো - " হ্যালো কসবা থানা থেকে বলছি।...." বাকি কথা সংক্ষেপে বললে এটাই দাঁড়ায় - বিরূপাক্ষর অভিন্নহৃদয় বন্ধু ধ্রুব দাস তার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে যাবার পথে একটি লড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে ধাক্কা মারে। ধ্রুব চালকের আসনে থাকায় সব থেকে বেশি চোট ধ্রুবই পায়। ধ্রুবকে বাঁচানো যায় নি। ধ্রুবর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মানে তৃণা বেসরকারি নার্সিংহোমে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। তাঁদের কারুরই নিকট কোনো আত্মীয় স্বজনের নাম ধাম কিচ্ছু পাওয়া যায়নি। অনেক হাতড়ে ধ্রুবর পার্সে থাকা একটি কার্ডে বিরূপাক্ষর নাম এবং নম্বর দেখে তারা বিরূপাক্ষর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তৃণার এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অস্ত্রোপচার এবং রক্তের প্রয়োজন। তাই বিরূপাক্ষকে এখনই মাদার কেয়ার নার্সিং হোমে গিয়ে বন্ডে সই করতে হবে। তারপর সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে মর্গে। সেখানেই তাকে বন্ধুর দেহ সনাক্ত করতে হবে।
ফোনটা রেখে কয়েক সেকেন্ড কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিরূপাক্ষ। তারপর " মা আসছি" বলে ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে গেছিল সে।
সেদিনও গাড়িতে যেতে যেতে এমনই বৃষ্টি নেমেছিল ঝমঝমিয়ে। মন খারাপের বৃষ্টি।
-" ও দাদা, কাঁচটা তুলে দিন। সিটটা ভিজে যাচ্ছে তো'।
সম্বিত ফিরে কাঁচটা তুলে একবার চোখ বোলালো ঘড়ির ডায়ালে। নটা পাঁচ। তার মানে এতক্ষনে বোর্ডিং হয়ে গেছে।
বিরূপাক্ষ একটা নাতিদীর্ঘ শ্বাস নিয়ে পিঠটা হেলিয়ে দিল কুশনে। তারপর আবার হারিয়ে গেলো স্মৃতির অতলে।
(৩)
" রানী দুধটা খেয়ে নাও মা, স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে।"
" মামবাপি, আজ তো তুমিও স্কুলে যাবে । আমি না হয় তখন তোমার সাথে স্কুলে যাবো।"
" ধুর পাগলি। আমি তো যাবো মিটিংয়ে। তোর তো প্রথম দিন নতুন ক্লাসে। যাবো না বললে হয় নাকি।"
অগত্যা রানী দুধের গ্লাসটা খালি করে পিঠে ব্যাগ আর জলের বোতল ঝুলিয়ে গাল ফুলিয়ে মামবাপীর হাত ধরে রওয়ানা দিল স্কুলের পথে। সে আজ থেকে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী। কিন্ডারগার্টেন থেকে প্রাইমারীতে উঠেছে সে। স্কুলের নতুন বিল্ডিংএ তাই তাদের এবার থেকে পড়াশোনা হবে।
প্রাইমারি সেকশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতী অশোকা সেন আজ মাদার টিচার মিটিং ডেকেছেন। তবে এটাও বলেছেন নোটিশে, যে যদি কারুর মা না আসতে পারেন তবে বাবা বা অন্য কোন অভিভাবক এলেও চলবে। মূলত তিনি আলাপ পরিচয় সারবেন বলেই ডেকেছেন মিটিংটা।
রাণীকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে বিরূপাক্ষ রায় বাড়ি এসে বাজার সেরে নিজের ব্রেকফাস্ট রেডি করে নিলেন। ততক্ষনে বিন্তি এসে মুছে দিয়ে গেলো ঘরদোর। তারপর ল্যাপটপ খুলে অফিসের কাজ কিছু সেরে নিয়ে তিনি নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লেন রানীর স্কুলের উদ্দেশ্যে।
মিটিং হলে প্রায় সকলেরই মায়েরা এসেছে। তিনি ছাড়া আর সাকুল্যে হয়ত দু তিন জন পুরুষ মানুষ চোখে পড়লো তার। সকলেই নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয় সারছেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন - "আপনি? "
-" নমস্কার, আমি রানীর অভিবাবক। আপনি?"
-"নমস্কার, আমি অহনার মা। রানীর মা আজ এলেন না যে ?"
-" আছেন তো। "
-"কোথায়?'
-" এই ,এখানেই। "
এর মধ্যেই একজন অহনার মায়ের সঙ্গে আলাপ জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিরূপাক্ষ "আচ্ছা, আসছি "বলে এগিয়ে গেলেন মিটিং হলের পেছনে রাখা ফাঁকা চেয়ারগুলোর দিকে।
দশটায় মিটিং শুরু হবার কথা ছিল। ঠিক দশটা বেজে দুই মিনিটে এলেন প্রধান শিক্ষিকা। মনে মনে বিরূপাক্ষ ভদ্রমহিলার সময়জ্ঞানের তারিফ না করে পারলেন না। ততক্ষনে ঘরে উপস্থিত সকল অভিভাবকই রেজিস্টার খাতায় নাম, ধাম , সম্পর্ক ইত্যাদি নথিভুক্ত করে ফেলেছেন। মিসেস সেন সকলকে নমস্কার জানিয়ে বলা শুরু করলেন - "প্রথমেই এখানে উপস্থিত সকল মাকে জানাই শুভ মাতৃ দিবসের শুভেচ্ছা। মূলত আপনাদের সাথে পরিচিত হব বলেই এখানে আপনাদের আজ আসতে বলেছি। লিটল হার্টসের বৃহত্তর পরিবারে আপনাদের সকলকে স্বাগত।" এই বলে তিনি ডেকে নিলেন আরেকজন ম্যাডামকে। তারপর সকলের দিকে ফিরে বললেন - "ইনি শর্মিলা দত্ত। ক্লাস ওয়ানের শ্রেণী শিক্ষিকা। বাকি মিটিং পরিচালনার দায়িত্ব আমি ওঁর হাতেই তুলে দিলাম।"
মিসেস দত্ত এবার মৃদু হেসে সকলের দিকে ফিরে বললেন - "আমি মিটিংএ আসার আগে আপনাদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গেই ক্লাস করে এলাম। প্রত্যেকেই খুব সপ্রতিভ এবং বাধ্য। আশা করি ওরা সকলেই আপনাদের এবং এই স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে।" তারপর একটু থেমে বললেন - "এখানে মায়েরা ছাড়াও চারজন পুরুষ অভিভাবককে দেখতে পাচ্ছি। আগে ওনাদের সাথে কথা বলে তারপর আপনাদের কাছে আসছি। "
বিরূপাক্ষ ছাড়া একে একে তিনজন অভিভাবকই নিজেদের কথা, ছেলে মেয়েদের কথা গুছিয়ে বললেন। তিনজনের মধ্যে একজন বললেন তাঁর স্ত্রী অসুস্থ, তাই আসতে পারেননি। একজন জানালেন তাঁর স্ত্রী অফিসের কাজে বাইরে থাকায় আসতে পারেননি। মিস্টার সমাদ্দার বললেন তার স্ত্রী গত বছরই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গত হয়েছেন। তাই তিনিই এসেছেন তার ছেলে অয়নের বাবা হিসেবে। মিস্টার সমাদ্দারকে মিসেস সেন এবং মিসেস দত্ত উভয়েই সমবেদনা জানালেন।
এরপর মিসেস দত্ত বিরূপাক্ষ রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন - "আপনি বুঝি রানীর বাবা?" বিরূপাক্ষ একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন - "শুধু বাবা নই, মাও। "
-" আমরা খুবই দুঃখিত মিস্টার রয়। রানীর মা কি নেই?"
বিরূপাক্ষ এবার বেশ হেসে উঠে বললেন - "না, না থাকবে না কেনো। বিলক্ষণ আছে। আপনার সামনেই সশরীরে দাঁড়িয়ে আছে।" কথাটা বলেই বিরূপাক্ষ বুঝতে পারলেন সকলের দৃষ্টিই এখন থমকে আছে তাঁর দিকে। ঘরের মধ্যে অস্পষ্ট ভাবে হালকা গুজগুজ ফুসফুসও শুরু হয়েছে। মিসেস দত্তের চোখে মুখেও বেশ অপ্রস্তুত ভাব। তাও আমতা আমতা করে বললেন -" না মানে। আপনি কি সিংগেল ফাদার? আরেকটু যদি খুলে বলা সম্ভব হয় , তাহলে সুবিধা হয় বুঝতে। "
-"আমি যখন রাণীকে এই স্কুলে ভর্তি করাতে এসেছিলাম তখন সব খুলেই বলেছিলাম। কিন্তু সেই প্যানেলে আপনারা ছিলেন না। তাই না জানাই স্বাভাবিক। " তারপর সময় নিয়ে একটু থেমে বললেন - "এখানে আপনাদের না বোঝার দুটো কারণ আছে - এক আমার সম্পর্কে তথ্যের অভাব। আর দুই আর আমার মতে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেটি হল সমাজের চাপিয়ে দেওয়া কিছু প্রথাগত ধারণা। দুটো বিষয়েই সংক্ষেপে আমি বলতে চাই আপনাদের, যদি আপনাদের শুনতে সমস্যা না থাকে।"
মিসেস দত্ত এবার তাকালেন মিসেস সেনের দিকে। মিসেস সেন এবার বিরুপাক্ষর দিকে তাকিয়ে বললেন - "বলুন আপনি। তবে বুঝতেই তো পারছেন সময় অল্প। তাই একটু দ্রুত বললে সুবিধা হয় আর কি।"
-" এ ব্যপারে আমি সম্পূর্ণ সহমত আপনার সাথে। তাই বেশি সময় নেবো না । আগে এক নম্বর বিষয়টা স্পষ্ট করি। রানীর বায়োলজিকাল প্যারেন্টস জীবিত নেই কেউ। রানীর জন্মদাতা যিনি সেই ধ্রুব দাস আমার প্রিয় বন্ধু ছিলেন। যেদিন রানীর জন্ম হবার কথা সেদিন ধ্রুব তাঁর স্ত্রী তৃনাকে নিয়ে হসপিটালে যাবার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। তৃনাকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন এবং পুলিশ মিলে স্থানীয় একটি নার্সিং হমে নিয়ে এলে রাণীকে ডাক্তাররা সুস্থ অবস্থায় জন্ম দিতে সক্ষম হন। কিন্তু তৃণা আর তার মেয়েকে দেখতে পায়নি কোনোদিন। সে অপারেশন বেডেই ঘুমিয়ে পড়ে চিরকালের জন্য। এই অবস্থায় রানীর দায়ভার তৃণা বা ধ্রুবর তরফে কেউই নিতে এগিয়ে আসে নি। আমি ছিলাম ঘটনাস্থলে। আমি তখন এগিয়ে যাই। ওই ফুটফুটে এক রত্তি দেবশিশুকে সন্তান হিসেবে কাছে পেতে আমিও তখন মরিয়া। আমার মাথায় তখন একবারের জন্যও আসেনি আমি বিবাহিত না অবিবাহিত বা ভবিষ্যতে পরিবার মেনে নেবে কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন। সেগুলো সবই তখন আমার কাছে অবান্তর বা অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল। এখনো তাই মনে হয়। যাই হোক, তারপর খুব শিগগির সমস্ত আইনগত বাঁধা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত সে আমার হয়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আমি অবিবাহিত ছিলাম তখন এবং এখনও তাই।
এবার আসি দ্বিতীয় কারণে। আর সামান্যই কথা। রাণীকে যখন হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসি তখন রানীর দিন সাতেক বয়স। রানীকে কাছে পেতে আবেদন করেছি মাত্র। তখনও সে আইনত আমার হয়নি। সেই দিনই আমি অফিসে গোটা বিষয় জানিয়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের আবেদন করি। সেটা তখন কিছুদিনের জন্য গ্রাহ্যও হয়। আমার টিমের লোকজন এবং ম্যানেজার সকলেই খুব সহৃদয় ব্যাক্তি ছিলেন।
প্রথম তিনমাস আমি এভাবেই রানীর সব কিছু নিজের হাতে সামলাই। রাণীকে বোতলে দুধ খাওয়ানো, স্নান করানো, পটি করানো সব একাই করতাম। মা সেই সময় কিছুদিনের জন্য কোচবিহারে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। তারপর একদিন সময় সুযোগ বুঝে মাকেও নিয়ে এলাম আমার কাছে। মা প্রথমে রাণীকে মেনে নিতে পারেননি। আমার ভবিষ্যৎ নিয়েও যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনেই দুজনের মধ্যে একটা খুব স্ট্রং কেমিস্ট্রি তৈরি হয়, জানেন! আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে সপ্তাহে দুদিন ,তিনদিন করে অফিস যেতে শুরু করি। এই করেই দিব্যি কাটছিল দিনগুলো। রানীও একটু একটু করে আমাদের স্নেহে আদরে বড় হয়ে উঠছিল।
এরই মধ্যে হঠাৎই ঘটে ছন্দপতন । গত বছর পুজোর সময় রানীর দিদা বলতে গেলে একেবারে বিনা নোটিশে, অল্প কদিনের জ্বরে ভুগে তারাদের দেশে পাড়ি দেন। তারপর থেকে আবার আমি একা হাতে সব শুরু করি। রানীকে সময়ের অভাবে ডে বোর্ডিংয়ে রাখতে বাধ্য হই। সেটুকু ছাড়া আর যদিও এখন তেমন সমস্যা নেই।
আর যদি বলেন, মা বাবার অভাব? না, সেটা ও পায়নি। কিভাবে পাবে? ওর সে অভাব কোনোদিনই ছিল না। জন্মদাত্রী ছাড়াও যে মা হওয়া যায় সে শিক্ষা তো শ্রীকৃষ্ণই দিয়ে গেছেন। আর যে সোশ্যাল ট্যাব্যুগুলো রয়েছে সেগুলোও এখন আমাদের আস্তে আস্তে ভেঙে ফেলা উচিৎ।"
-" যেমন ?"
-" যেমন, মা মানেই তাকে বিবাহিত হতে হবে আর তার থেকেও বড় কথা, তাকে একজন নারী হতে হবে, এর কোনো যুক্তি নেই। আপনারাই ভেবে বলুন না সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এই সব যোগ্যতা একটা বাচ্চার ভালো থাকার ক্ষেত্রে কি আদৌ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে? আমার উত্তরটা সব সময় 'না'-ই মনে হয়েছে। আমি রাণীকে অন্য যে কোনো মায়ের থেকে কম আদরে বা যত্নে বড় করিনি। এটুকুই আমার বলার ছিল। বাকি আপনাদের বিচার্য।" এটুকু বলে থামলেন বিরূপাক্ষ।
সারা ঘরে তখন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে।
প্রথম সারিতে বসে থাকা অহনার মা-ই প্রথম উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে হাততালি দিয়ে বললেন -" হ্যাপি মাদার্স ডে, মিস্টার রয়।"
বিরূপাক্ষ প্রতি নমস্কার জানিয়ে বললেন - "সেম টু ইউ।"
(৪)
-"দাদা, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? উঠুন, এসে গেছি।"
-"উম, হ্যাঁ। থামাও। আর ইয়ে ভাড়াটা তোমাকে অনলাইন পে করে দিয়েছি।"
গাড়ি থেকে নেমে আস্তে আস্তে পা বাড়ালেন বিরূপাক্ষ রায় । আজ তিনি অনেক নিশ্চিন্ত। তিনি জানেন ধ্রুব বা তৃণা যেখানেই থাকুক তারাও নিশ্চয়ই মনে মনে খুব খুশি । একদিন সব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে তুলে নিয়েছিলেন সন্তান পালনের দায়িত্ব। সেদিন থেকে নিজের মনের জোরে আর ভালোবাসায় রাণীকে একা হাতে গড়ে পিঠে তুলেছেন। তাঁর সন্তান হিসেবে রানীও হতাশ করেনি তাঁকে। সে গবেষণা এবং উচ্চশিক্ষার জন্য আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পা রাখতে চলছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে, সেই সুদূর মার্কিন মুলুকে। তিনি সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে যেন অনুভব করছেন মা বাবা হিসেবে তাঁর গৌরব, তাঁর সাফল্য। সকল কষ্টের মধ্যেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি যেনো ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাকে।