সংশপ্তক ( নবম অধ্যায় )
সংশপ্তক ( নবম অধ্যায় )
নবম অধ্যায়
অম্বরীশের এই বেলেল্লা
পনা ঐন্দ্রিলাদেবী ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বললেন - দ্বিতীয় উদ্দেশ্য কি ? মানে আমি ধান্দার কথা জানতে চাইছি। দেখ বাপু দীপুটার আমার শরীর ভালো নেই। এখন এসব ধান্দাবাজী মোটেও ভালো নয়। এতদিন তো কোন খবর রাখিসনি। ভায়েদের বলেছিলাম দীপুর শরীর খারাপের কথা। ওরা তো বলে দিয়েছিল ব্যাপারটা নিজেরা সামলে নে। এখন আবার খবরদারি করতে এসেছিস কেন ?
- খবরদারি নয় পিসি। তোমাদেরই উপকার করতে এসেছি। দেখ পিসি, বাড়ির বৌ চাকরি করলে একসাথে এতগুলো টাকা তো পাবে না। নতুন চাকরিতে কতই আর মাইনে পাবে ? বড়জোর পনের ষোলো হাজার ! তার চেয়ে যদি বিক্রির টাকাটা ফিক্সড করে দাও তবে মাইনের চেয়ে অনেক বেশি সুদ পাবে মান্থলি; তাও আবার বাড়ি বসেই।
- দেখ অম্বরীশ ! আমাদের ব্যাপারটা আমাদেরই বুঝে নিতে দে। আমরা কি করব না করব তাতে তোদের এত মাথাব্যথা কেন ?
- পিসি ! তুমি একটু বেশিই কথা বলছ । জানো, আমি সি এম ডির খাস লোক। তাঁর পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারি।
- ভয় দেখাবি না। এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যা। তোদের মুখ দেখতে পারছি না।
ঐন্দ্রিলাদেবী রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন । আসরে নামতে হল নীলেশবাবুকে । একরকম টানতে টানতে অম্বরীশকে নিয়ে বারান্দায় এলেন ।
- শুধু শুধু রাগ করো না অম্বরীশ । দীপুর জন্য বৌঠানের মেজাজটা চড়া হয়ে গেছে। সেটাই স্বাভাবিক। তোমার যা বলার আমাকে বল। আমি তোমার কথা শুনতে চাই।
অম্বরীশ তখন চাকরি নিয়ে যাবতীয় কথা বলল। নীলেশবাবু বললেন - ঠিক আছে, ক্যাণ্ডিডেটকে নিয়ে এস ; কথাটথা বলি!
অম্বরীশ বলল - আমার সাথে কথা হয়ে গেছে। আপনি শুধু এমাউন্টটা বলে দিন। মানে আপনারা কত নেবেন।
- এ ভাবে তো দুম করে কিছু বলা যায় না বাবা ! তার জন্য সময় চাই। তা ছেলেটির কি নাম ? কোথায় থাকে?
- দেখুন ছোট পিসেমশাই, আপনারা বিক্রেতা । চাকরিটা বিক্রি করছেন। যৌতুক দিচ্ছেন না। অতশত জানবার কোন প্রয়োজন আছে ?
ঠাণ্ডা মাথায় নীলেশবাবু বললেন - আছে বাবা। বিক্রি করছি মানে ওটাতো অপাত্রে দিতে পারি না। তা-ছাড়া ছেলেটি কেমন, তার চরিত্র কেমন - এগুলো জানতে হবে না ? যদি গুণ্ডা বদমাশ হয় ?
- আমাকে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না " পিসে ?
- দেখ বাবা, বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। ছেলেটিকে জানি না, চিনি না - তাকে কি করে চাকরিটা দেই বল! নিয়ম অনুসারে তো ওকে আমাদেরই কেউ বলে সার্টিফিকেট দিতে হবে। নইলে কোম্পানি মানবে কেন ?
- আমি তো আপনাদের আত্মীয় ! আমার উপর ভরসা রাখতে পারবেন না ?
- জানো অম্বরীশ ! সেদিনের কথা আমি জীবনে কোনদিনও ভুলব না । সেই দিন - যেদিন বৌঠানকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলাম । তখন তুমি খুবই ছোটো । ওসব কথা মনে রাখার বয়সও ছিল না। দাদা সদ্য গত হয়েছেন । বাড়িতে অর্থাভাব প্রচণ্ড রকমের । জমানো রাশি সব শেষ হয়ে গেছে দাদার চিকিৎসায়। বড় আশা নিয়ে তোমাদের বাড়ি গেছলাম। তোমার বাবা কাকারা কুকুরের মত দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল । হয়তো ভেবেছিল আমাদের পরিবারটি তাদের ঘাড়ে চাপতে চলেছে। ভাবতে পারো কি অবস্থা হয়েছিল আমাদের ? একটা দুধের শিশুকে নিয়ে কপর্দকশুন্য অবস্থায় অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছি। দোষের মধ্যে কিছু সাহায্য চেয়েছিলাম - এই যা।
অম্বরীশ শুনল কিন্তু কোন পাত্তা দিল না। শুধু বলল - সেইজন্যই তো আজ আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি।
- আর কারুর কোন সাহায্য আমাদের লাগবে না বাবা। ভগবান বাঁকা চোখে হলেও একটু সুদৃষ্টি দিয়েছেন । অবশ্য ভাগ্যদোষে দীপু অসুস্থ হয়ে পড়েছে - তাও ঠিক।
- এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন পিসে ?
- কোন উপায় নেই বাবা । বৌঠান যখন একবার না বলে দিয়েছেন তখন তার কোন অন্যথা হবে না । এটাই এই সংসারের নিয়ম ।
দীপু আর কিছু বলল না । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু বলল - ভেবেছিলাম কয়টা দিন থেকে যাবো। বৌদিদির সঙ্গে তো আলাপই হল না ! যাক গে সে না হয় পরে একদিন করে নেব। এখন তাহলে আসি ?
- এসো বাবা। সাবধানে যেও।
অম্বরীশ চলে গেল। নীলেশবাবুর মনে পড়ল সেই পিওনের কথাটি । ওই সাহেব বড় ধুরন্ধর । ফাইল হাপিস করেও দিতে পারে।
ভীষণ চিন্তিত লাগছিল ওকে। কি হবে এবার !
ঐন্দ্রিলাদেবী হাঁক পাড়লেন - গ্রহ বিদেয় হয়েছে ঠাকুরপো ?
- হ্যাঁ বৌঠান । বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু কপালে কি আছে ঈশ্বরই জানেন !
দীপু উঠে এসে বলল - কিচ্ছুটি হবে না কাকাবাবু। দেখে নিও যত গর্জায় তত বর্ষায় না । ও কিছুই করতে পারবে না। হকের ধন যাবে কোথায় ?
- অত নিশ্চিন্ত হোসনি দীপু । সেদিন পিওন লোকটা এই কথাটাই আমাকে বোঝাতে চেয়েছিল । দেখি একবার ওকে ফোন করে।
- ছাড়ো তো ! যা হবার হবে। সে নিয়ে এখন থেকে ভেবে কি লাভ ! বেশ কয়েকবার যাওয়া আসা করতে হবে হয়তো।
- সে বড় কথা নয়। আমি ভাবছি অম্বরীশ যদি ফাইল লোপাট করে দেয় !
- কি করে ? ওইই তো বলে গেল নোটিশ সার্ভ হয়ে গেছে - অন দ্য ওয়ে । একবার হাতে পাই, তারপর না হয় উকিলবাবুকে ডেকে একটা বিহিত করে নেব।
নীলেশবাবু আর ভাবতে পারছেন না । তীরে এসে বুঝি তরী ডুবে যায় !
এভাবে দুদিন কেটে গেল । ইতিমধ্যে সেই পিওন একবার ফোন করে জেনে নিল সাহেব বেরিয়েছেন কি না। আর বলল, কি করবেন কিছু ভেবেছেন কি ?
- দেখি নোটিশটা আসুক। অম্বরীশ তো বলে গেল ওটা বেরিয়ে গেছে।
- বেরিয়ে গেছে ! কই না তো? এই তো দেখে এলাম বড় সাহেবের টেবিলেই রয়েছে।
- সে কি ? তবে ও কি মিথ্যে বলে গেল ?
- ওনার কোন কথা সত্যি হয় না। আপনাকে বলেছিলাম - কিছু তো করলেন না। এবার ভুগুন।
নীলেশবাবু আবেগের তাড়নায় বলে দিলেন - আপনার পাওনা মিটিয়ে দিলে কি কোন গ্যারাণ্টি আছে ওটা হাতে পাব ?
লোকটা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।
- বলছি তো বাঁ হাতে নেব ডান হাতে দেব। এর চেয়ে বড় কথা আর কি বলব ?
- ঠিক আছে ,কাল তো কলকাতা যাচ্ছি, রাতে ফিরব। তাহলে পরশু যেয়ে দেখা করব ! ঠিক আছে ?
- ওকে ওকে।
ফোন কেটে দিল লোকটা। নীলেশবাবুর চিন্তায় সাময়িক ছেদ পড়ল ।
