সংশপ্তক ( একাদশ অধ্যায়)
সংশপ্তক ( একাদশ অধ্যায়)
একাদশ অধ্যায়
নীলেশবাবু ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছেন । সে ত্রিশ লাখেই রাজী হয়ে যাওয়ায় তিনি বেশ বিস্মিত হলেন। -ত্রিশ লাখ টাকা খরচ করে কত টাকা মাইনের চাকরি পেতে পারো ?
- আজ্ঞে আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার।
নীলেশবাবু আরও বেশী অবাক হলেন । পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার ছেলে সে কি না চাকরি কিনতে চায়! বললেন - তুমি চাকরি পাওনি ? শুনেছি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলে চাকরির অভাব হয় না।
- ঠিকই শুনেছেন। কিন্তু নাম অনুসারে ক'জনই বা ভালো চাকরি পায় ! আমিও বেশ কয়েকটাই পেয়েছিলাম । কোনটায় মাইনে দশ হাজার, বারো হাজার , বড়জোর পনের হাজার। একটা কোম্পানি তো বলেছিল চার হাজার। ভাবতে পারেন ইঞ্জিনিয়ারদের দশা !
- সে কি বলছ হে ছোকরা। আমাদের দীপুই তো ষাট হাজার পায়। সেও তো ইঞ্জিনিয়ার।
- ওই যে বললাম ক'জনই বা পায়। দীপুবাবুর ভাগ্য ভালো মোটামুটি ঠিক পেয়েছেন।
- ই সি এলে ঢুকে কত মাইনে পাবে ? বড় জোর ত্রিশ হাজার।
ছেলেটি একটু হাসল ।
- তাই সই। ত্রিশ হাজারই সই। তবু তো সরকারি কোম্পানীর চাকরি। খাটা-খাটনি খুব একটা নেই। তা- ছাড়া আমদানিও বেশ হয়।
- কি রকম ?
- সে আপনারা বুঝবেন না। ও অনেক ব্যাপার আছে। অম্বরীশ স্যারের অফিসেই ভ্যাকেন্সি আছে। আর ওনার সঙ্গে আমার টার্মস খুব ভালো।
- বেশ বেশ । তা অম্বরীশ তোমার কাছে কত চেয়েছে?
- আজ্ঞে !
ছেলেটি একটু সঙ্কুচিত হল যেন ।
নীলেশ বাবু বললেন - আমি এমনি জিজ্ঞেস করছি। তোমাকে নিয়ে এত তদ্বির করছে বলেই...
- আজ্ঞে বিশ লাখ। কাউকে বলবেন না প্লীজ। স্যারকে তো নয়ই ।
- না না , আমি এমনি জিজ্ঞেস করলাম। তো তোমার তাহলে সাকুল্যে খরচ পঞ্চাশ লাখ।
- আজ্ঞে হ্যাঁ।
- বেশ পয়সাওয়ালার ছেলে তুমি। বাবা কি করেন ?
- অডিট এণ্ড একাউন্টস সার্ভিসের ই সি এল ডিভিসনে আছেন ।
- ও তাই বলো। সোনায় সোহাগা।
ছেলেটি হেসে ফেলল। নীলেশবাবু তখনকার মত ছেলেটিকে বিদায় দিলেন।
এদিকে অম্বরীশ রূপসার সঙ্গে গল্পে মশগুল। বিরক্ত হচ্ছেন ঐন্দ্রিলাদেবী; দীপুও। রূপসাকে ডেকে দীপু বলল - এত হা হা হি হি করার মত কি হয়েছে ? জানো না মা এগুলো পছন্দ করেন না ?
রূপসা থম মেরে গেল । অম্বরীশকে তার ভীষণ ভালো লেগেছে। বেশ চনমনে তরতাজা। আর কথায় যেন খই ফোটে। কিন্তু ধমক খেয়ে চুপ করে চলে গেল বাচ্চাকে নিয়ে। ঐন্দ্রিলাদেবী বললেন - ওই দেখ অম্বরীশ ! তোকে ডাকছে। চাকরিপ্রার্থী ছেলেটি অপেক্ষা করছিল । অম্বরীশ দেখতে পেয়ে বলল - কথা হয়ে গেল ?
ছেলেটি বলল - হাঁ। হয়ে গেছে। এবার চলুন স্যার, আমরা যাই।
অম্বরীশ বেরিয়ে গেল ।
মনে মনে ক্ষুব্ধ হল রূপসা। এতদিন পর প্রাণ খুলে হেসেছে। সে তো অম্বরীশের জন্য । তাও এদের সহ্য হয় না। মন খারাপের সময় যদি কেউ দু'টো মজার কথা বলে- আর তার জন্য হাসি পেলে দোষ কোথায় ? বুঝতে পারে না রূপসা। ভাবে শ্বশুরবাড়ির এটাই হয়তো রীতি। বউ মানুষ - বউয়ের মত থাকো ।
নীলেশবাবু বললেন - এক কাপ চা অর তো বৌমা। ছেলেটা এসে মাথা গুলিয়ে দিয়েছে।
রূপসা ভাবল কাকাবাবুও হয়তো অম্বরীশের কথা বলেছেন। এত ভালো মানুষ হয়ে তিনিও কি তার এই হাসিটা সহ্য করতে পারেন নি !
মনে ক্ষোভ ভরে এক কাপ চা দিয়ে এল রূপসা।
- একটু বোসো বৌমা। কথা আছে।
রূপসা দাঁড়িয়ে পড়ল । নীলেশবাবু বললেন - এখানটিতে বোসো। অনেকদিন পর তোমার হাসির আওয়াজ পেলাম । কি ভালোই না লাগল। যাক মেয়ে আমার সামলে নিয়েছে। মাথা থেকে অন্তত এই দুর্ভাবনাটা গেল ।
- কাকাবাবু, চায়ে বোধ করি চিনি দিতে ভুলে গেছি। দেখুন তো ! আমি এক চামচ চিনি নিয়ে আসি।
রুপসা চিনি এনে দিতে যাবে - নীলেশবাবু বললেন -
চিনি দেওয়া আছে মা। আর লাগবে না।
অম্বরীশ ও সেই ছেলেটি চলে যেতেই দীপু গিয়ে মেনগেটে তালা লাগিয়ে পায়চারি করছিল লনে। তার মনে হল রূপসাকে অমন করে কথা না শোনালেই ভালো হোতো। এরপর ওর যদি দুঃখ হয় ! নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। এদিকে অম্বরীশের প্রতি বিতৃষ্ণা বেড়েই যাচ্ছিল । যেটুকু বুঝেছে তাতে তার মনে হয়েছে অম্বরীশের উদ্দেশ্র ভালো নয়। তাইতো সে রূপসাকে কথাগুলো শুনিয়েছিল । বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখে রূপসা ছেলে কোলে বারান্দায় ঘুরছে। বিমলামাসী রান্নাঘরে বাঁটনা বাঁটছে । দীপু বলল - রাগ করেছ রূপু !
রূপসা বলল - আমার শরীরে রাগ অভিমান নেই। বুকটা আমার অত ঠুনকো নয় - তোমার মত।
- যাক বাবা, বাঁচা গেল। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম তুমি ক্ষুব্ধ হয়েছ। আসলে কি জানো, অম্বরীশের চালচলন আমাদের ভালো ঠেকে না। মাকে শুধিয়ে নিতে পার - কাকাবাবুকেও। পয়সাওয়ালা হলে যা হয় আর কি ? তুমি কি জানো ও পার্টিতে যায়, মদ খায়, বৌকেও খাওয়ায় আর ---
- আর পার্টিতে নাচানাচিও করে - এই তো ?
দীপু বলল - ওই পর্য্যন্ত থাকলে তো কোন সমস্যা ছিল না। তার বাইরেও অনেকদূর গড়িয়েছে।
- কি রকম ?
- শুনেছি সাহেব সুবোদের সঙ্গেও নাকি রাত কাটায়।
রূপসার হাত পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে এল। মনে হল আকাশটা মাথায় ভেঙে পড়েছে।
বলল - ও মাগো ! আর কখনোই সামনে যাব না।
- সামনে যেতেই পারো, দু'চারটে কথাও বলতে পারো। কিন্তু হেসে গড়িয়ে পড় না। অম্বরীশের মাথায় বিভিন্ন মতলব থাকে।
- আমাকে নিয়ে কি করবে ? আমি তো ওর সাথে যাব না ?
- কিছু না করুক, বেশী মিশে কুৎসা রটিয়ে দিবে। একে তো আমরা গাঁয়ে থাকি । তায় আবার কাটাবাবুকে নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। তুমিও তো জানো !
দীপু ইচ্ছে করেই কাকাবাবুর সাথে মায়ের ব্যাপার নিয়ে কিছু বলল না।
রূপসা বলল - একটা কথা বলি, কিছু মনে করবে না তো !
- বল।
- প্রথমদিকে যখন ওগুলো শুনতাম ; আমার মনেও একটা ভুল ধারণা জন্মেছিল । বয়সে পূর্ণ যুবক হওয়া সত্ত্বেও কাকাবাবু বিয়ে করেননি কেন !
- থাক সে সব কথা। এখন তো মনে কোন খটকা নেই ?
- একদমই না । কাকাবাবুকে আমি খুব ভালো ভাবে চিনে গেছি। ওনার মত দেবতূল্য লোক ভূ-ভারতে দুটি নেই। আমি আর একটি কথা বলব ?
- কি কথা ?
- তুমিও যেদিন প্রথম শুনেছিলে তোমার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি ?
- আমি তো জন্মাবধি শুনে আসছি কথাগুলো। সেজন্য মনে কোন দাগ কাটে নি কখনও।
ঐন্দ্রিলাদেবী বারান্দায় এসে বললেন - সন্ধ্যে হয়ে গেছে মা! বাচ্চাকে বাইরে রেখ না। ভেতরে গিয়ে কথা বল ।
দীপু রূপু দুজনই ভেতরে চলে গেল ।
নীলেশবাবুর মোবাইলে একটা মিসড কল এল । মনে হয় ওই ছেলেটির নাম্বার । ঘুরিয়ে ফোন করলেন তিনি। সত্যিই ওই ছেলেটিই। বলল
- তাহলে মেসোমশায় ! ডিল ফাইনাল তো ?
- পরে জানাব। আগে বাড়িতে আলোচনা করে দেখি। বৌঠান, দীপু, দীপুর বৌ যদি রাজী হয়ে যায় তাহলে আমারও কোন আপত্তি থাকবে না।
- যা করবেন মেসোমশাই আজ রাতের মধ্যেই সেরে ফেলুন। আগামীকাল বেলা এগারোটা নাগাদ জেনে নেব তবে ?
- আচ্ছা, ঠিক আছে। বলে ফোন কেটে দিলেন নীলেশবাবু।
তখন সবে রাত হয়েছে। বিমলা মাসী রান্নাবান্না সেরে চলে গেছে। নীলেশবাবু বৌঠান দীপু রূপসাকে ডেকে বললেন - আমার কিছু আলোচনা করার আছে । ওই চাকরির ব্যাপার নিয়ে। বৌমা! তুমি কি চাকরিটা নেবে ?
রূপসা মাথা নীচু করে রইল । ওর মনে পড়ে গেল অম্বরীশের পত্নীর কথা। সভয়ে উত্তর দিল - না কাকাবাবু। আমি চাকরি করব না।
( ক্রমশ )
