সংশপ্তক ( ধারাবাহিক)
সংশপ্তক ( ধারাবাহিক)
সংশপ্তক পর্ব এক
চেম্বারে বসে আছেন ডক্টর গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য্য স্যার। এডভান্স মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা সক্ষেপে আমরি হাসপাতালের ঢাকুরিয়াস্থিত অ্যানেক্স বিল্ডিং এর তিনতলায় ১০৮ নং রুমে।
এই অ্যানেক্স বিল্ডিংটি ক্যান্সার পেশেন্টদের জন্য সংরক্ষিত। অবশ্য মেন বিল্ডিংয়ে বাকি পেশেন্টদের চিকিৎসা চলে।
যাই হোক, ডক্টর ভট্টাচারিয়া এখান ডক্টর জি এস নামেই প্রসিদ্ধ । তিনি হেমাটো- অঙ্কোলজিস্ট । বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারী হসপিটাল এবং ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাথে যুক্ত। এন আর এস, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজের কোনটায় ডিন, কোনটিতে প্রফেসর আর আমরিতে হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট । ডিগ্রীর অন্ত নেই। সবই ক্যান্সার সম্বন্ধিত।
ফর্সা ধবধবে চেহারা। ভারিক্কি গড়ন । মুখশ্রী অতি সুন্দর। আর দাঁতগুলো যেন মুক্তোর মত । এমনিতে ভীষণ রাশভারী। কিন্তু যখন হাসেন দেখলে মনে হয় ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্যক্তিত্ব ।
হাসপাতালে অন্তত দু'ডজন ক্যান্সার চিকিৎসক আছেন যারা স্ব স্ব বিভাগে খ্যাতনামা।
জি এস ডাক্তার হিসাবে পারফেক্ট। ডায়গ্নোসিস থেকে ট্রিটমেন্ট এক্কেবারে নিখুঁত।কথায় বলে না - গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারি কি হয়েছে ? ঠিক তেমনই।
কথা খুব বেশী বলেন না। আবার গল্প জুড়লে শেষ হয় না। এমন ভক্টরের একটাই বদরোগ - খরচের বাপান্ত করে ফেলেন। অবশ্য যে বিষয়টিতে তিনি প্রশিক্ষিত সেখানে কম খরচের ট্রিটমেন্ট আশা করাই উচিত নয় । তথাপি তাঁর বিভিন্ন রকম পরীক্ষা- নিরীক্ষার প্রতি বিশেষ ঝোঁক আছে। লোকে বলে তিনি ধনীদের ডাক্তার। তাঁর নিকট চিকিৎসা করানোৎসাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত।
বয়স মোটামুটি ষাটের কোঠায় । বিয়ে থা' করেছিলেন। কিন্তু অপুত্রক। শোনা গেছে তাঁর ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর স্ত্রী নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন। কেউ কেউ বলে ওঁকে নাকি খুন করা হয়েছিল । সেইজন্য থানা পুলিশ অনেক কিছুই হয়েছিল । যেহেতু তিনি ছিলেন বেশ প্রভাবশালী সেজন্য ওঁর আইনগত দিক থেকে কোন সাজা হয়নি। আবার এও হতে পারে পুলিশ প্রভাবিত হয়ে বা কোন চাপে বা প্রমাণের অভাবে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ।
তিনি হাসপাতালে ঢুকলে সকলেই তটস্থ হয়ে থাকত। প্রাইভেট হসপিটাল - এমনিতেই বেধ পরিচ্ছন্ন। তথাপি নিয়ম করে তিনি যখনতখন যেখানে সেখানে হাজির হতেন । এমনকি বিভিন্ন প্যাথলজি সেন্টারগুলো যেমন VIMTA, RANBUXY, SRL , LAL PATH LAB - এদের কোন ত্রুটি পেলে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছাড়তেন ।
দু'একটা ঘটনা শুনেছি । একবার জনৈক রোগী আউটডোরের সামনে বমি করেছে । মেয়েকর্মীটি খুব গালাগালি করেছিল । কর্মীটির দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটনাটি তাঁর গোচরে এলে কর্মীটিকে বরখাস্ত করে দিয়েছিলেন ।
আর দ্বিতীয় ঘটনাটি হল একবার এক রোগীর রক্তপরীক্ষার প্রয়োজন হলে হাসপাতাল থেকে স্যাম্পল কালেক্ট করে মুম্বাই পাঠানো হয়েছিল। যে পরীক্ষার জন্য রক্ত দেওয়া হল তাতে পনের থেকে ষোলো দিনের মধ্যে রিপোর্ট আসার কথা। কিন্তু একমাস পেরিয়ে যাবার পরও যখন সেই রিপোর্ট আসেনি; রোগীকে রুঢ় ভাষায় বললেন - যে টেস্টটা দিয়েছিলাম কেন করাননি। যান আপনাকে আর দেখব না।
রোগী অনুনয় বিনয় করতে লাগল ।
- স্যার , রক্ত যথাসময়ে দিয়েছি। এই দেখুন তার প্রমাণ এই রসিদ।
ডাক্তারবাবু তখন যে স্যাম্পল কালেকশন করেছিল তাকে ডেকে পাঠালেন ।
কর্মচারীটি এসে বলল - স্যার, ব্লাড ট্রানজিট লস্ট হয়ে গিয়েছে। আবার রক্ত দিলে বিনা খরচে পাঠিয়ে দেব।
সাদা ধবধবে মুখ ক্রোধে লাল হয়ে গেল। যৎপরোনাস্তি অপমান করেও ছাড়লেন না।
-রোগীকে সঠিক সময়ে খবর না দিয়ে এখন এই মুহূর্তে বলে দোষ কাটানোর চেষ্টা ?
ধরলেন স্যাম্পল কালেকশন ম্যানেজারকে।
- বলুন, কাকে ছুটি করে দেব ? আপনাকে নাকি এই কর্মীকে ? নাকি দুজনকেই।
সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। ডাক্তারবাবুর চিৎকারে সব ডাক্তারেরা এসে ভীড় করেছেন।
কি হল কি হল করে যখন কেউ তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারলেন না; হসপিটালের ডিন ডক্টর শুভঙ্কর দেব এসে বললেন - জি এস ! জি এস ! প্লীজ বি কাম( calm) ইউ হ্যাভ হার্ট প্রব্লেম। প্লীজ লেট মি সি।
সিনিয়র ডাক্তারের প্রতি সম্মানবোধই হোক বা হার্টের কথা বিবেচনা করেই হোক তিনি চুপ করলেন এবং নির্দেশ দিলেন বিনা খরচে রক্তপরীক্ষাসহ রোগীর পুনরাগমনের খরচবাবদ অর্থ ম্যানেজার এবং কর্মীটিকে দিতে হবে। নচেৎ দুজনেরই চাকরি যাবে।
তখনকার মত ব্যাপার মিটল । কিন্তু রোগীটির প্রতি তাঁর এক বিশেষ সহমর্মিতা গড়ে উঠল। কিছু ওষুধপত্র দিয়ে তিনি রোগীকে পুনরায় বিশ দিন পর আসতে বললেন।
ঠিক বিশতম দিনে রোগী আবার এল। ডাক্তারবাবু ব্লাড রিপোর্ট পরীক্ষা করলেন । কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট রিপোর্ট।
এতে দেখা গেল রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা 9 mg/dl অর্থাৎ প্রতি ডেসিলিটারে 9 মি.গ্রা । নরমাল 12 - 17 mg/dl.
W.B.C. ( White Blood Corpuscle) 175000 নর্ম্যালি যা 4000-11000 থাকার কথা।
আর Platelet 60000 ( Normal 150000 -400000)
তিনটে ইস্যুতেই লাল দাগ দিলেন এবং মাথা নেড়ে আপন মনে কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন।
রিপোর্টের একেবারে নীচের দিকে লেখা রয়েছে -
Impression :- Chronic Myloyed Leaukomia in Chronic Phase.
ডাক্তারবাবুর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বেশ বোঝা গেল।
কিন্তু মুখে হাসি টেনে বললেন - চলুন শুয়ে পড়ুন।
রোগী প্রথমে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল । পেট ভালো করে চেক করলেন। তারপর এপাশ ও পাশ ফিরিয়ে দেখলেন। বুকের পাঁজর গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। যেন চামড়া দিয়ে ঢাকা কঙ্কাল । মুখ একপাশে কাত হয়ে গেছে। স্প্লীন ( প্লীহা ) অস্বাভাবিক বেড়েছে। ওজন মাত্র ৫০ কিলো।
তারপর মুখে হাসি এনে বললেন -
এ তেমন কিছু না। এটা কোন কেসই নয় !
রোগীর সহযোগী প্রধ্ন করল - স্যার, কেসটা কি ?
- তার আগে বলুন তো এই লক্ষণগুলো কবে থেকে বুঝতে পেরেছিলেন ?
- তা অন্তত সাত আট মাস আগে। একদিন লক্ষ্য করলাম পেটটা অদ্ভুত রকম আন্দোলিত হচ্ছে। সব সময় না। শুধু রাতে শোয়ার সময়। যে পাশে ফিরে শুই পেট সেদিকে নেমে যায়। প্রথমে ধীরে ধীরে ওজন কমতে শুরু করল। ভাবলাম শরীরে এখন আর মেদ নেই। আগে তো ওজন ছিল প্রায় ৭০ কেজির মত। আর একটা কথা ; গোটা শরীর জুড়ে ছোট ডড় নানা আকারের লাল লাল তিল বেরিয়েছে।
- কোন ডাক্তার দেখাননি ?
- অনেকবার দেখিয়েছি। ডাক্তারবাবু বললেন পিলেটা বড় হয়েছে । তেমন কিছু দেখলে কেটে দেব।
- ননসেন্স !
রোগীর সহযোগী বলল - কে স্যার ? আমরা না ওই ডাক্তারবাবু ?
- তারপর বলুন আর কি উপসর্গ ছিল ?
- মহাষ্টমীর দুপুরবেলা হঠাৎ দাঁত দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে। বিকেলে ডেনটিস্ট দেখাই । তিনি বললেন প্রেসার চেক করিয়ে আনতে। আবার এক ফিজিশিয়ানের নিকট প্রেসার চেক করাতে উনি বলেন একটু হাই আছে। রোগীর বয়স ৩২। প্রেসার ছিল ১৬০/৯০ । আবার বলেন কি অসুবিধা ? বলি দাঁত থেকে রক্ত পড়ছে। আর পিলেটা বেড়েছে।
- প্লীহা বেড়েছে ? ওটা তো ভালো না। আপনি কোন হেমাটোলজিস্টের এডভাইস নিন।
যাই হোক দাঁতের ডাক্তার মাড়ি সেলাই করলেন, ওষুধ দিলেন । তাতেও কিছু হল না নীচের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হল । শেষে ভয়ে এখানে এসে ডক্টর মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য্যকে বুক করলাম । কিন্তু তিনি রাতে আসেন বলে ডক্টরস লিস্ট দেখে আপনার নাম পেলাম ।
- আপনারা জানেন কি ওর কি হয়েছে ?
- না স্যার । আমরা কি করে জানব?
- তবে শুনুন ওর লিউকোমিয়া হয়েছে। যাকে বলে ব্লাড ক্যান্সার । Cancer of bone marrow.
সিনেমায় নিশ্চয় এই রোগের নাম শুনে থাকবেন। তবে মোটামুটি যথেষ্ট ঠিক সময়েই এসেছেন। এখনও হেসে খেলে কমপক্ষে ১৫-২০ বছর টিকে যাবেন। আর একটা কথা, চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারবেন তো ?
- সে স্যার ঘটি বাটি বেচেও চিকিৎসা করাব। নইলে তিন তিনটে প্রাণ ভেসে যাবে।
এবার ডাক্তার রোগীকে বলেন - আপনি কি করেন ?
- স্যার, চাকরি করি।
- সরকারি না বেসরকারি ?
-- সরকারি।
- বেশ তো, কোম্পানী খরচ দেবে তো ?
- জানি না স্যার !
- মেডিক্লেম আছে ?
- না স্যার।
- দেখুন রোগটা ঘটি বাটি বেচার রোগ নয় ; সর্বস্বান্ত করে দিতে যথেষ্ট। তবে চেষ্টা করব কতটা কমে হয়।
এই ওষুধগুলো লিখেছি।
Hydrea ( Hydroxy Urea ) - দুটো ক্যাপসুল একসাথে একগ্লাস জল সমেত দৈনিক পাঁচবার মানে মোট দশটা ক্যাপসুল পাঁচ দিন খাবেন।
একটা ক্যাপসুল ৫০০০ শ্বেতকণিকা কমায় । মানে দৈনিক ৪০০০০ হাজার করে পাঁচদিনের দু'লাখ কমে যাবে।
-zyloric 100 mg - ডেলি একটা। ইউরিক এসিড কমানোর জন্য।
পাঁচ দিন পর আসবেন।
আর ব্লাড দিয়ে যান এই টেস্টগুলো করিয়ে নিন।
RT-PCR ( Both qualitative & quantitative )
CBC
LFT
KFT
HbA1c.
( ক্রমশ )
**********************************************************
বি.দ্র - পাঠকদের নিকট সবিনয় নিবেদন আপনারা এই ওষুধগুলো নিয়ে কোনরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা বা কাউকে খাবার উপদেশ দেবেন না। মারণ ঔষধ । এমনকি বাচ্চাদের দৃষ্টির বাইরে রাখা ঔষধ ।
উপন্যাসের প্রয়োজনে এগুলির উল্লেখ করা হল । কোনরকম বিপদাপদের জন্য লেখক বিন্দুমাত্র দায়ী নন
*******"****************************************************
