STORYMIRROR

Nityananda Banerjee

Classics Inspirational Others

4  

Nityananda Banerjee

Classics Inspirational Others

সংশপ্তক ( ধারাবাহিক ২)

সংশপ্তক ( ধারাবাহিক ২)

5 mins
324

চেম্বার থেকে নতমুখে বেরিয়ে এল সপ্তর্ষি আর তার ছোটো কাকা নীলেশবাবু ।

কারও মুখে কোন কথা নেই। শুধু বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নীলেশবাবুর । ঘনঘন মনে পড়ে তিনটে মুখ - সপ্তর্ষি, শ্রাবণী আর তাদের ছয়মাসের শিশুসন্তান আকাশের । এই তো দুটো বছর কাটল অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিন ! আবাল্য পিতৃহীন সপ্তর্ষিকে যে তিনি কোলে পিঠে করে বড় করেছেন। নিজের পছন্দ করা মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়েছেন। নাতির মুখ দেখে বৌঠান তো সব জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে গেছেন। তাঁর নিকট কোনমুখে বলবেন সপ্তর্ষি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ! তার প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হবে - ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আর সপ্তর্ষি ?

চেম্বার থেকে বেরিয়েই নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়ে গিয়েছে।

নাহ ! শক্ত হতে হবে। সপ্তর্ষির ভাবনায় দৃঢ় হল কথাটি। আগেভাগেই হেরে গেলে চলবে না। কোমর বেঁধে মোকাবিলা করতেই হবে। বিধির বিধানে জীবনের যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত হয়েছে ঠিকই; তথাপি যে কয়টা দিন থাকব কিছু একটা করে যেতেই হবে ।

নীলেশবাবু হিসেব কষছেন। জোড়বাংলোর জমিটা কম করেও বিঘে পাঁচেক তো হবেই। ইস্টার্ন কোলফিল্ডসের নোটিশটাও পকেটেই রয়েছে। কম করেও লাখ পঁচিশেক টাকা তো দেবেই ; সঙ্গে একটা চাকরিও দেবে বলেছে। ধানী জমি। সম্বছরের ফসল জোগায় । তা ' হোক । এই বিপদকে মোকাবিলা করতে এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর নেই। তিনি ঠিক করে ফেললেন জমিটা ই সি এলে দিয়ে দেবেন। ওদের বাড়িতে চাকরি নেবার মত উপযুক্ত কেউ নেই। চাকরিটাও বরঞ্চ বিক্রি করে দিলে আরও কয়েক লাখ আসবে। মোটের উপর চিকিৎসার খরচ বেরিয়ে যেতে পারে।

নীলেশবাবু মানে নীলেশ রঞ্জন বাপুলী মহাশয় । সপ্তর্ষির পিতার অকালপ্রয়াণে প্রায় সমবয়সী বৌঠান ও সদ্যোজাত সপ্তর্ষির প্রতি দায়বদ্ধতাবশতঃ নিজে বিবাহ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।

নীলেশবাবু একটা প্রাইভেট ফার্মের হিসাব নিরীক্ষক ছিলেন । মোটা রকমের উপরি পাওনা পেতেন। তাতে করেই ছোট্ট সংসার চলে যেত আর বেতনের টাকায় সপ্তর্ষির পড়াশোনা বা আনুষঙ্গিক খাইখরচ চলে যেত।

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর সপ্তর্ষি ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি জোগাড় করে নেয়। যথাসময়ে রূপসার সঙ্গে তার বিবাহ হয় এবং এখন একটি সন্তানের জনক।

এই প্রসঙ্গে নীলেশরঞ্জনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে একটু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।

নীলেশবাবু উচ্চশিক্ষিত নন। কিন্তু মানুষ হিসাবে অনেক উঁচু দরের । যেদিন তাঁর দাদা গত হন; তখন সপ্তর্ষির বয়স মাত্র পঁচিশ দিন । বৌঠানের আছাড়িপিছাড়ি কান্না সহ্য করতে না পেরে সেদিনই শপথ নিয়েছিলেন তিনি নিজেকে বৌঠান এবং একমাত্র ভাইপোর জন্য উৎসর্গ করবেন। সেহেতু তাঁর নিজের সংসার বলতে শুধু ওই দু'জন। গ্রামের লোকজন তাঁকে অনেক অনুরোধ করেছিল ঐন্দ্রিলাকে ( তাঁর বৌঠান ) তিনি যেন বিবাহ করেন।

এক হাত জিভ বের করে করজোড়ে বলেছিলেন - এ' কথা শোনাও পাপ। আমি তো প্রতিজ্ঞা করেছি নিজে কোনরূপ বিবাহ করব না এবং বৌঠানের সংসারে নিজেকে একজন সক্রিয় কর্মী বলেই ভাবব।

গ্রামের লোকেরা হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কি্কান্তু সকলে তো সমান নয়। অনেকে এ নিয়ে কুৎসাও রটিয়েছিল।

এক ছাদের তলায় থেকে দুটি যুবক যুবতী কি ভাবে দিন রাত থাকে ? নিশ্চয় এর মধ্যে কিছু চালাকি রয়েছে।

আগুনের নিকট ঘি গলবে না এ আবার হয় নাকি !

তোয়াক্কা করেন নি নীলেশবাবু। পাত্তা দেননি বৌঠানও। ঐন্দ্রিলা দেবীর বাপের বাড়ির সকলে নীলেশবাবুর এই আত্মোৎসর্গের জন্য ধন্য ধন্য করেছিল।

এ হেন নীলেশরঞ্জন আপন ভাতিজার মারণ রোগে আক্রান্ত হওয়া যে তাঁকে বিশেষ ভাবে বিচলিত করবে তাতে কোন সন্দেহ।

ভাইপো জনে গেছে ; তিনিও জেনেছেন ; মুশকিল হল বৌঠানকে কি বলবেন এবং সপ্তর্ষির পত্নী রূপসার নিকট কেমনে মুখ দেখাবেন ।

কিন্তু রোগ তো আর আবেগ অনুভূতির বশীভূত নয়। সুতরাং তিনি পড়লেন মহা বিপদে।

ঔষধপত্র কিনে তাঁরা যখন বাড়ি ফিরলেন তখন রাত এগারোটা- বারোটা হবে।

শিশুটি নিদ্রামগ্ন। জেগে বসে আছেন মা ঐন্দ্রিলা আর স্ত্রী রূপসা। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন কবে তাঁরা আসেন।

এমন সময় দরজায় খটখট আওয়াজ হতেই রূপসা দৌড়ে যায় দরজার দিকে। শাশুড়ি মা বললেন - দাঁড়াও বৌমা; হুট করে দরজা খুলো না। আগে জিজ্ঞেস করে নাও কে ?

রূপসা পিছিয়ে গিয়ে বলল - মা আপনি বলুন।

ঐন্দ্রিলা দেবী এগিয়ে গেলেন। মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন - ঠাকুরপো এয়েচ ?

- হাঁ মা। সপ্তর্ষি বলল - আমরা এসে গেছি, দরজা খোলো।

তখন রূপসা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল । উদ্বিগ্ন ঐন্দ্রিলা দেবী কিছু বলার আগে নীলেশবাবু বললেন - বৌঠান! সব ঠিক আছে। দীপুর ( সপ্তর্ষির) সব কিছু ঠিক আছে। শুধু চিকিৎসা করালেই ও ঠিক হয়ে যাবে।

ডাক্তারবাবু বলেছেন কোন ভয় নেই।

একটি সাদা মিথ্যেকথা বলে নীলেশবাবু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। তাঁর আলজিভ দাঁতের চাপে একটু গেল। তা কেউ জানতেও পারল না। শুধু সপ্তর্ষি মাকে এবং রূপসাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠল - মা তোমাদের ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না। আর কাকাবাবু আজ যা করেছেন তাতে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করতে পারব না।

- কেন ? এমন বলছিস কেন ? ওরে কাকু যে তোর বাপের সমান। ও আছে বলেই তো আমরা ঠিক আছি।

নীলেশবাবুকে ঐন্দ্রিলা দেবী বললেন - কি রোগ ঠাকুরপো ?

নীলেশ বাবু এবার একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললেন - রোগ মানে তেমন কিছু না তবে সেরে উঠতে একটু সময় লাগবে।

মুখ ফুটে ব্লাড ক্যান্সার উচ্চারণ করতে পারলেন না । কানের কাছে মুখ এনে বললেন - বৌঠান পরে বলছি। এখন হাত পা ধুয়ে আসি।

- না ঠাকুরপো, আপনাকে বলতেই হবে। আমি যে কি অসহায় হয়ে পড়েছি, কি বলব ?

- বৌঠান সব কথাই বলব। আগে একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।

পথ আগলে দাঁড়ালেন ঐন্দ্রিলা দেবী।

- আগে বলুন। দীপু, তুই বল না। চুপ করে আছিস কেন ?

- মা ! মা ! অত অধৈর্য্য হয়ো না। বলছি।

ওনাদের কথাবার্তায় রূপসার ভেতর যে কি চলছিল আমাদের পক্ষে তা' টের পাওয়া সম্ভব নয় । সে এদেক সেদিক চাইছিল। আর অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে লাগল।

তখন সপ্তর্ষি রূপসাকে জড়িয়ে ধরে বলল - কিছুই করতে পারলাম না, রূপু । আমার লিউকোমিয়া হয়েছে।

নীলেশবাবু ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন । ঐন্দ্রিলা দেবী কঁকিয়ে কেঁদে উঠলেন। - সে আবার কি রোগ ?

নীলেশবাবু ধড়মড় করে উঠে বললেন - সে আছে বৌঠান, এক ধরণের রক্তের দোষ। ওর শরীরে রক্ত কমে যাচ্ছে।

- সেরে যাবে তো ?

- অবশ্যই। ডাক্তারবাবু তো বলেই দিলেন তেমন কিছু নয়। চিকিৎসা করলে পুরোপুরি সেরে যাবে ।

রূপসা বলল - কোথায় শুনেছি যেন। লি-উ-কো-মি-য়া-

বলে ভেতরে চলে গেল মোবাইল খুঁজতে।

নীলেশবাবুর চোখ সবদিকে। আজকালকার মেয়ে। ইন্টারনেট ঘেঁটে সব ঠিক বের করে নেবে।

পিছু ধাওয়া করে ধরে ফেললেন রূপসাকে। পথ আটকে বললেন - খেতে দিবি নে মা ? বড্ড খিদে পেয়েছে যে !

ঐন্দ্রিলা দেবী আসন পেতে খেতে দিলেন। আর রূপসা সেই সুযোগে মোবাইলে গুগল সার্চ করে জেনে নিল what is Leaukomia.

সপ্তর্ষি চোখে অন্ধকার দেখল। ঐন্দ্রিলা দেবী খাবার দিতে দিতে শুনতে পেলেন রূপসা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

( ক্রমশ )



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics