সংশপ্তক ( দ্বাদশ অধ্যায় )
সংশপ্তক ( দ্বাদশ অধ্যায় )
দ্বাদশ অধ্যায়
খোলামেলা আলোচনা চলছিল । রূপসা না বলে দিতেই নীলেশবাবু খুশি হলেন ঠিকই ; একটা চিন্তা থেকেই গেল । ঐন্দ্রিলাদেবী উত্তর - ঠাকুরপো, আমাদের পরিবারে যখন চাকরি নেবার লোক নেই তখন --
- কি বলছেন বৌঠান ? অম্বরীশের হাতে ছেড়ে দেব ?
- আমি কি তাই বলেছি ?
বৌঠান বললেন - আমি বলতে চাইছি; নেবার লোক যখন নেই তখন কোম্পানিকেই বল না ওর পরিবর্তে কিছু টাকা দিতে ?
- কোম্পানির এরকম কোন নিয়ম আছে বলে মনে হয় না। হয় চাকরি নিন অথবা forego করে দিন।
- ও তাই বুঝি ! তাহলে কি হবে ?
- সেই জন্য তো আলোচনা করছি। বৌমা তোমার বাপের বাড়ির কেউ আছে ?
ঐন্দ্রিলাদেবী বললেন - ভালো প্রস্তাব । রূপু মা বল ।
রূপসা আমতা আমতা করতে লাগল । ওর ছোট ভাই তো বেকার। চাকরিটা পেলে খুব ভালো হয়। কিন্তু ওদের তো টাকা দিয়ে চাকরি কেনার সাধ্য নেই। তবু বলতে গিয়েও কথা জড়িয়ে যায়। - ভা---ই ।
নীলেশবাবু চট করে কথাটা ধরে নিলেন ।
- বেশ তবে তোমার ভাইকে ডেকে পাঠাও।
- কিন্তু কাকাবাবু !
- বুঝেছি। তুমি কেন কিন্তু কিন্তু করছ ! মা গো, আমরা ব্যবসায়ী নই। আর তুমি যে আমাদের কি; এ কথা কি মুখ ফুটে বলতে হবে ?
- না , তা বলছি না। তবু --
ঐন্দ্রিলাদেবী ধরে ফেলেছেন রূপুম'র ভাবনাটা।
- আরে বাবা, এর চেয়ে মহৎ কাজ আর হয় না। বৌমা ! তুমি আজই সমরকে ডাকো। কাল বিকেল নাগাদ ঠিক এসে পড়বে।
- না মা, আমি বলতে চাইছি আমাদের তো টাকা পয়সা তেমন নেই !
ধমক দিয়ে নীলেশবাবু বললেন - আমরা কি টাকাকড়ি দাবী করছি না কি করব ? মাগো, বৌঠান তো বলেই দিয়েছেন বরং কোম্পানিকে ফেরৎ দিয়ে দেব তবু অম্বরীশের মত ছেলের হাতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার তুলে দিতে পারব না। আমি ছেলেটিকে বলেছি আলোচনা করে আগামীকাল ফয়সালা জানিয়ে দেব। তুমি ফোন কর , তোমার ভাইকে ডেকে আনো। বৌঠান বলে দিয়েছেন - that's final.
রূপসা তবু কিন্তু কিন্তু করে।
- চিটিৎসার জন্য বিশাল অঙ্কের টাকার প্রয়োজন। এখন এভাবে হাতের লক্ষ্মী ছেড়ে দেওয়া কি উচিত হবে ?
ঐন্দ্রিলাদেবী প্রশ্ন করলেন - তোমাকে ও কথা ভাবতে হবে কেন ? ও ভাবনা আমাদের। ডাক্তারবাবু তো বলেছেন তেমন কিছু বাড়াবাড়ি হয়নি। তাহলে ?
ধমক খেয়ে রূপসা চুপ করে যায় । দীপু বলে - আমি ফোন লাগিয়ে দিয়েছি; এই নাও কথা বল ।
ও প্রান্ত থেকে সমরের গলা ভেসে আসে - দিদি, তোরা কেমধ আছিস? দীপুদা কেমন আছে এখন ? আমরা ভেবে অস্থির । তোকে ফোন করতে সাহস পাই না।সব ঠিক তো ?
- হ্যাঁ ভাই, এখানে আমরা সবাই ঠিক আছি। এই শোন সমু ! কাল একবার আসতে পারবি ?
- কেন দিদি ?
- আরে দরকার আছে তাই ডাকছি। কাল বিকেলের মধ্যে যে কোন উপায়ে চলে আয় !
- দিদি , ঠিক করে বল তো ! সব ঠিক আছে কি না ?
- হ্যা রে ভাই। বলছি তো সব ঠিক আছে। এই দেখ মা, কাকাবাবু, তোর জামাইবাবু আমরা সবাই তোর কথা শুনছি।
ঐন্দ্রিলাদেবী রূপসার হাত থেকে ফোন নিয়ে বলেন - সমর, আমি জেঠিমা বলছি। কোন চিন্তা কর না বাবু। তোমার সঙ্গে ভীষণ দরকার আছে। কাল তুমি অবশ্যই এসো। নেমন্তন্ন করলাম জেঠিমা হয়ে।
জিভ কেটে সমর বলল - অমন বল না জেঠিমা। আমি দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাব। মা কান্নাকাটি করছে।
- মাকে দাও তো ফোনটা।
সমর তার মাকে ফোন দেয়। ঐন্দ্রিলা দেবী বলেন - বেয়ান , আপনারা ভালো আছেন ? আমরা সবাই খুব ভালো আছি। আসলে সমরকে আমরা একটা সারপ্রাইজ দেব বলে হঠাৎ করে ফোন করেছি। আচ্ছা বেয়াধ, কাল সমরের সঙ্গে আপনিও আসুন না। খুব ভালো লাগবে আমাদের ।
ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল সমরের সঙ্গে সমরের মা-ও আসছেন ।
খুশির বাঁধ ভেঙে পড়ল যেন । নীলেশবাবু বললেন - বৌঠান কি যুক্তিপূর্ণ কথাটাই না বলেথেন ! সমরকে একটা সারপ্রাইজ দেব । এত বড় কথা অতি সহজে আপনি ছাড়া আর কে বলবে !
দীপু এবং রূপসা ঐন্দ্রিলাদেবীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল । নীলেশবাবু এই সুখের মুহূর্তটুকু মোবাইলে তুলে রাখলেন । বললেন - নে ছাড় এবার দীপু ! মাকে আর এত আদর করতে হবে না। সকাল সকাল উঠতে হবে।
দীপু বলল- কেন ? সকাল সকাল উঠতে হবে কেন ?
ঐন্দ্রিলাদেবী বললেন - ভালো ভালো বাজার আনতে হবে না ? ঠাকুরপো একলা কতদিকে সামলাবে ?
রাত দশটা । নীলেশবাবুর মনে হল চাকরিপ্রার্থী যুবককে রাতেই ডিসিশন জানিয়ে দেওয়া ভালো। যেই ভাবা তেমন কাজ।
ফোন করলেন ছেলেটিকে । বললেন - very sorry to inform . চাকরিটা দেওয়া যাচ্ছে না। আমাদের এক নিকাত্মীয় - ওটা নেবে। আর তোমার চেয়েও ওর প্রয়োজন বেশী।
ছেলেটি আর কি বলে ? টুক করে ফোন কেটে দেয়। নীলেশবাবুর মাথা থেকে বোঝাও নেমে যায় নিমেষে ।
তারপর বৌঠানকে বলেন সে কথা। বৌঠানও খুশি হন । রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে দীপুকে নিয়ে আলোচনা করেন তাঁর সাথে।
দীপুর রিপোর্ট এখন মোটামুটি ঠিক । ভালোও আছে। মনে মনে ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ জানায় । ভাগ্যিস সেদিন ওই ডাক্তারবাবুকে পেয়েছিলাম । চোখ থেকে অন্ধকার তো উনিই দূর করছেন।
এমন সময় ফোন এল নীলেশবাবুর কাছে।
- কাজটা কিন্তু ভালো করলেন না পিসাবাবু। অতগুলো টাকা হাতছাড়া করলেন।
নীলেশবাবু বললেন - তোমারও তো অনেকগুলো টাকা হাতছাড়া হয়ে গেল, তাই না ?
- আমার আর কি গেল ? দশ লাখ তো ! আমি চুটকি মেরে কামিয়ে নেব।
- শুধু কি দশ লাখ বাবা ? আর ছেলেটির কাছে যে বিশ লাখ পেতে ? সেটা গেল না ?
- কি আজেবাজে কথা বলছেন পিসাবাবু ! নেক্সট উইকে আপনাদের ওখানে যাব। লস সিটটা দেখিয়ে দেব ।
- কোন প্রয়োজন নেই বাবা । আমাদের যা পাবার পেয়ে গেছি ।
- চাকরির বদলে অত টাকা তো পাবেন না। যাকে দিচ্ছেন সে আর কত দেবে ! খুব বেশি হলে পাঁচ সাত লাখ।
- তাও দিচ্ছে না বাপ। একটি পয়সাও দেবে না বলেছে।
- সে কি ?
- হুমম্ । আসলে কি জানো, টাকাটাই তো শেষ কথা নয়। এর বাইরেও অনেক সুন্দর সুন্দর কথা আছে। যেগুলো তোমার মত লোকের জন্য নয়।
- দেখুন পিসাবাবু, আমি আবারও বলছি - ভেবে দেখুন। এখনও সময় আছে।
- যা ভাবার ভেবে নিয়েছি বাবা। বেশি ভাবলে চোখ থেকে ঘুম ছেড়ে যাবে । তুমি তোমাকে নিয়ে থাকো, আমাদেরকেও আমাদের মতই থাকতে দাও। রাখি ?
গুড নাইট।
- কাজটা ভালো করলেন না। এর ফল ভুগতে হবে বলে দিলাম । তখন যেন বলবেন না ফ্যামিলি থেকেই বিপদ বাড়িয়ে দিল !
- কার ফ্যামিলী ? কিসের ফ্যামিলি ? আমার ফ্যামিলি সব বিপদের মোকাবিলা করতে জানে । তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি ভবিষ্যতে কোনদিন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না। নইলে জানো না - এই নীলেশ রঞ্জন বাপুলি কি করতে পারে ?
বলে ফোনটা নিজেই কেটে দিলেন । ঐন্দ্রিলাদেবী জিজ্ঞেস করলেন - কার সাথে কথা বলছিলে ঠাকুরপো । এমন তিরিক্ষি মেজাজ তোমার কখনও তো দেখিনি ?
- আর বলেন না বৌঠান । বলতেও খারাপ লাগে। না বলেও থাকতে পারি না। অম্বরীশ ফোন করেছিল । খুব রাগ দেখাল । যেন আমরা ওর উপরই নির্ভরশীল।
- কেন , কি বলল ?
- বলে কি না ' কাজটা মোটেও ভালো করলেন না পিসাবাবু !
কথা নকল করে বললেন ।
ঐন্দ্রিলাদেবী বললেন - তাহলে ঠিকই বলেছ। য্যায়সা কো ত্যায়সা। কোন সম্পর্ক রাখব না ওদের সঙ্গে ।
পরদিন সকালবেলায় দীপু ঘুম থেকে উঠে কাকাবাবুর সঙ্গে বাজার আনতে গেল । রূপসাও খুব ভোরবেলায় উঠে পড়ল । মা ভাই আসছে ; আনন্দ তো হবেই। তার উপর আবার মানবজীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি - চাকরি - যা একজন বেকার যুবকের কাছে স্বপ্ন তাই দিতে চলেছে ভাইকে। ঈশ্বর কত মঙ্গলময়। যা করেন সবই ভালোর জন্যই করেন । দেওয়ালে টাঙ্গানো শিবের ফটোতে চেয়ে মাথা নোয়ায় । শাশুড়ি মা ঘুমোচ্ছেন। রূপসা চায় না ; তিনি সাত সকালে বিছানা ছেড়ে উঠুন।
( ক্রমশ )
