সময় প্রদত্ত শিক্ষাটি:-
সময় প্রদত্ত শিক্ষাটি:-


পত্রিকাটা নিয়ে বসেছিলাম। শীতের মিঠা রোদ গায়ে লাগিয়ে আয়েশে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকাতে চোখ বুলাচ্ছি, ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটার মতন হচ্ছে প্রায়। তখুনি দেখলাম বাবা ফোন করছেন। ফোনটা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে মায়ের সাথ সারা সকালের রোজনামচা বাতলাচ্ছি। তখুনি ডোর বেলের আওয়াজ পেয়ে একটু হতচকিত হয়ে গেলাম যে এই ভরদুপুরে আবার কে এলো! মাকে কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন করছি বলে তরিঘড়ি ফোন কেটে দরজার পানে ছুটলাম। কুরিয়ার ছিল, পার্সেল নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পরলাম যে পুনরায় মাকে ফোন করার কথা বেমালুম ভুলে গেছি।
রাত তখন প্রায় ৭ টা, ভাবলাম দুপুরে ভুলে গেছিলাম এখন না হয় ফোন করি, কিন্তু করবো করবো করেও করা হয়ে ওঠেনি। খুব যে জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিলাম তা নয়, ওই ফোনটা হাতে নিলাম মাকে ফোন করবো বলে, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন নোটিফিকেশনের বেড়া জালে পরে তখন আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি। রাত্রিকালীন ভোজন সমাধা হলে কন্যা রত্নটিকে ঘুম পাড়িয়ে যখন মোবাইলটা হাতে নিলাম মায়ের সাথে কথা বলবো বলে, তখন দেখি ১১টা বেজে গেছে ইতিমধ্যে। এই গহন শীতের রাতে বাড়িতে ফোন করে তাদেরকে আর যন্ত্রণা দিতে মন চাইলো না। করলাম না আর ফোন মাকে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো মায়ের ফোনেই। সাত সকালে মায়ের ফোন! নানা কুচিন্তা এক নিমেষে মাথায় ঘুরপাক খেলো, মুহূর্ত সময় দেরি না করে ফোনটা নিলাম। ভয় জড়ানো গলায় বললাম, "মা! এত সকাল সকাল ফোন...সব ঠিক আছে তো? বাবার শরীর ভালো তো? বোনু ঠিক আছে তো? তুমি ঠিক আছো তো?" এক নিঃশ্বাসে জিজ্ঞেস করলাম মাকে কথাগুলো, অজানা ভয়ে পেয়ে বসেছে আমায় ততক্ষণে।
আমায় শান্ত হতে বলে মা বললেন, "তুই শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছিস, আমরা সবাই ঠিক আছি। আমি তো নিজে চিন্তা করছিলাম যে কাল তুই বললি কেউ এসেছিল তখন আমাদের কথা চলাকালীন, তুই পরে আবার ফোন করবি, কিন্তু করলি না তো! অপেক্ষায় ছিলাম তোর ফোনের। রাতেও বড় অসহজ লাগছিল আমার, তোর বাবা যদিও বলছিলেন যে এত চিন্তা কেন করছি? মিতি ঠিক আছে, সেরকম চিন্তার কিছুই হয় নি। কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ত, তাই আর পুনরায় ফোন করে উঠতে পারে নি। শুয়ে পরো, শুয়ে পরো সকালে নিজেই ফোন করে নিও না হয়। তোর বাবা এই বলে সান্ত্বনা দিয়ে তো নিজে ঘুমিয়ে পড়লেন, কিন্তু আমি যে মা, ভেতরে ভেতরে খুব উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা হচ্ছিল রে সোনা তোর জন্যে। তুই ঠিক আছিস শুনে এখন বেশ শান্তি লাগছে..."। মা এই বলে থামলেন।
কিন্তু আমার মাথায় তখন ঘুরছে কেন ফোন করে নিলাম না তখন, মা বসে ছিল আমার ফোনের অপেক্ষায়। মায়ের সাথে কথা বলে রান্নাঘরে কাজ করতে করতেও আনমনা হয়ে পড়ি আমি! ভাবছি এই তো বেশ কিছুদিন আগে আমার কর্তা অফিসের কাজে বাইরে গেছিলেন, নেটওয়ার্কের নিদারুণ সমস্যায় ওর সাথে ঠিক ভাবে কথাই হলো না ২ দিন, কি দুঃসহ ছিল সেই সময়টা আমার জন্য। যতই মুখে বলি না কেন নিজের মন-মস্তিষ্কে শুধু সুচিন্তা ভাবনার বিচার বিবেচনা যেন আমরা করি, কিন্তু নিজের প্রিয়জন কারোর সাথে যখন আমরা যোগাযোগ করতে অসমর্থ হই, তখন মাথায় কুচিন্তাগুলোই ভনভন করে বেশি। গতকাল মায়ের সাথেও এমনটাই হলো। সত্যি একমাত্র আপনজনেরাই আছেন যারা সময়ে সময়ে আমাদের খোঁজখবর রাখেন। সকালবেলা মায়ের সাথে কথা বলার সময় এই জিনিসটাই অনুভব করলাম যে প্রিয়জনের চিন্তায় আমরা কি রকম অস্থির আর ব্যাকুল হয়ে পড়ি। কথায় আছে মায়ের স্নেহ নাকি মাপা যায় না, আজকে উপলব্ধি করতে পারলাম। ওই সময়টা আমায় শিখিয়ে দিল শত কাজকর্মের মাঝেও নিজের আপনজনের সঙ্গে সময় ব্যতীত করা বা কথা বলা খুব প্রয়োজন।
সত্যি, তোমায় ভুলবো না সময়, তুমি আজ আমায় জীবনের একটা গুঢ় পাঠ পড়ালে, তুমি আজ আবার শেখালে প্রিয়জনের গুরুত্ব আমাদের জীবনে।
আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই বা অবহেলা করি নিজেদের আপনজনের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে, আমি শিক্ষা পেয়েছি আজ। নিজের এই অভিজ্ঞতাটা থেকেই বলছি প্রিয়জনকে শুধু প্রয়োজনের সময় মনে করবেন না, তারা অপেক্ষারত থাকে আমাদের সাথে সময় কাটানোর জন্যে। নিদেনপক্ষে একটা ফোন অবশ্যই করা যায়, সর্বোপরি আমরাই তো ওদের যক্ষের ধন।