সমস্তিপুরের আতঙ্ক
সমস্তিপুরের আতঙ্ক


ঘটনাটা ঘটেছিল বিহারের সমস্তিপুরে অনেক দিন আগে। বিকাশ চৌধুরী রেলওয়ে সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে , সমস্তিপুর স্টেশনে স্টেশন মাষ্টার হয়ে এসেছে।
বিকাশ তখনও বিয়ে করেনি। বড়জোর ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়স হবে। কলকাতার ভবানিপুরে নিজেদের বাড়ি। তার বাবা রেলওয়ের একজন বড় অফিসার ছিলেন, এখন অবসর নিয়েছেন।
মেজভাই সুকেশ সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। বিকাশের খুব ইচ্ছা তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর। সেইজন্য সায়েন্স পড়বার জন্য কলেজে ভর্তি করবার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিকাশের খুব ইচ্ছা ভাইকে বি – এস – সি পড়িয়ে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করানোর।
বাবা নিরঞ্জন বাবু বিকাশ কে বললেন, “ বাবা বিকাশ বলছিলাম যে, যদি সুকেশ কে কমার্স পরানো যায়, তাহলে খুব ভালো হয়”। কিন্তু বিকাশ প্রতিবাদ করে বলে যে , “ না বাবা সুকেশের মাথা সায়েন্সে ভালো, ওকে বরং ইঞ্জিনিয়ারিং পরানোই উচিত” ।
ছেলের কথা শুনে নিরঞ্জন বাবু আর কোন প্রতিবাদ করেননি, শুধু বলেছিলেন , “ বেশ যা ভালো বুঝিস তাই কর”।
২
অতএব মেজো ভাইকে সায়েন্স পড়ানোর জন্যই ভর্তি করা হোল কলেজে। ছোটভাই নরেশ অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।
বিকাশের পরেই একটি বোন লীলা। তার দুটি ভাই সুকেশ ও নরেশ।
লীলার বয়স প্রায় একুশ বছর। বি-এ পাশ করেছে । বিয়ে দেওয়ার জন্য নিরঞ্জন বাবু ও সুমিতা দেবী খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন। পাত্রের সন্ধানও চলছে।
এর আগে বিকাশের জন্যও বিয়ের একটি সম্বন্ধ এসেছিল। নিরঞ্জন বাবু ও সুমিতা দেবীর খুব ইচ্ছা ছিল বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বিকাশ রাজি হয় নি, বলেছিল – না, আগে চাকরীতে বহাল হয়ে রোজগার করি, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। বিশেষ করে আগে লীলার বিয়ে টা হয়ে যাক, তারপর দেখা যাবে।
৩
ছেলের উত্তর শুনে নিরঞ্জন বাবু আর সুমিতা দেবী আর বিশেষ কোন অনুরোধ করেনি বিকাশকে বিয়ে করার জন্য।
এক সময় তার চাকরী হোল রেলে ।
প্রথমে হাওড়ায় কিছুদিন। তারপর সেখান থেকে দু এক জায়গায় ঘুরে বিহারের সমস্তিপুরে স্টেশন মাস্টার হয়ে এসেছে, জায়গাটা বেশ ভালোই লাগে বিকাশের।
বেশ খোলামেলা জায়গা । স্টেশনের কিছু দূরে শালবন । রাস্তাঘাট পাথরে ভর্তি। বৃষ্টি হলে রাস্তায় কাঁদা হয় না।
কোনদিকে অসুবিধা নেই, শুধুমাত্র জলের কষ্ট।
আমাদের দেশের মতো এত পুকুর নেই। টিউবওয়েল তো একেবারেই নেই। আছে শুধু পাতকুয়ো। সেই পাতকুয়ার জলেই স্নান আর খাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
পাতকুয়াও কিন্তু আমাদের দেশের মতই মতো নয়, যে কাছাকাছি জল থাকবে । আমাদের দেশের চেয়ে বড় পাতকুয়ো গুলো, কিন্তু জল থাকে একদম তলায়।
কুয়োর মুখে কাঠের সঙ্গে কপিকল লাগানো। তাতে খুব লম্বা দড়ি লাগানো আছে। সেই দড়িতে বালতি বেঁধে জল তুলতে হয়। তবে জল খুব পরিস্কার আর জলে পাথরের পরিমান বেশি থাকার জন্য জলটাও ভীষণ হজমিকারক।
৪
ও দেশের মেয়েরা টপাটপ জল তুলে কলসি ভর্তি করে একসঙ্গে মাথায় দু তিনটি কলসি বসিয়ে বেশ আরামে চলে যায়। একটুও জল পড়েনা কলসি থেকে ।
বর্তমানে যারা সমস্তিপুরে গেছেন বা যান , নিওনের আলোয় তাঁদের চোখ ঝলসে যায়। চারিদিকে লোকজন, যাত্রী হকার আর কুলীদের হাঁক ডাকে কানে তালা লেগে যায়।
কিন্তু এতো লোকজনও ছিল না, আর ছিল না এত নিয়ন লাইটের চোখ ধাঁধানো ঝলসানি।
আলোও ছিল খুব কম। তাও আবার এত উজ্জল নয়, টিম টিম করে জ্বলতো । স্টেশনের উপর ছিল একটা চায়ের দোকান। সন্ধ্যার পর আর দোকানদার দোকানে আর থাকত না।
কুলিও ছিল , তবে খুব কম। মাঝে মাঝে তাদের দেখা যেত খৈনি টিপতে আর তুলসিদাসের রামায়ণ পড়তে।
ট্রেনের সংখ্যাও ছিল কম আর যাত্রীদের ওঠানামাও খুব কম। কাজে কুলিরা থেকে কি করবে । যেদিন ওয়াগনে মাল বোঝাই হত বা নামানো হত সেই দিনই কুলিরা পেতো পয়সা। তবে সেটা সবদিন নয়।
খুবই কষ্টে ও দুঃখে এবং দারিদ্র্যের মধ্যে তাদের দিন কাটাতো।
৪
স্টেশনে ছিল স্টেশন মাষ্টারের অফিস তার উল্টো দিকে ছিল টিকিট ঘর, মাঝখানে ছিল রাস্তা। যাত্রীদের টিকিট কেটে এই রাস্তায় প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়াতো ট্রেনের অপেক্ষায় ।
প্ল্যাটফর্মের উপর ছিল যাত্রীদের জন্য একটা টিনের চালা। চালাটা অবশ্য বেশ বড় রকমের । বসার জন্য গোটা চারেক লোহার বেঞ্চও ছিল প্ল্যাটফর্মের উপরে। এছাড়া একটা সুলভ শৌচালয় ছিল। আর ছিল পানি পাঁড়ে ।
পানি পাঁড়ে হোল রেলওয়ের নিযুক্ত করা একজন জল দেওয়ার লোক। একটা তিন চাকাওয়ালা ছোট্ট ঠেলা গাড়িতে লোহার একটা জলের ট্রাঙ্ক বোঝাই জল নিয়ে সে স্টেশনের ওদিক এদিক ঘুরতো।
কেউ জল চাইলে সে জল দিত, তবে মাটির ভাঁড়ে । স্টেশনের একটু দুরেই ছিল রেলের কর্মচারীদের থাকবার জায়গা , এখানে পাতকুয়া নয় টিউবওয়েল , বাথরুম পায়খানা এবং লাইটের ব্যাবস্থা সব ছিল।
৫
এইসব ছিল উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের জন্য, কিন্তু কুলি বা অন্যান্য নিন্ম পদস্থ কর্মচারীদের কোয়াটারে আলোর ব্যাবস্থাও ছিল না, পায়খানা বাথরুম বলতে ছিল জেনারেল। আর তার সঙ্গে ছিল ইটের কয়েকটা ঘর, আর তার উপর ছাপরার ছাউনি।
নিন্ম শ্রেণীর কর্মচারী আর কুলিরা ছিল স্থানীয় লোক। স্টেশনের কাছাকাছি ছিল তাদের ঘর। কাজেই রাত নটার পর তারা যে যার ঘরে ফিরে যেত। কোয়াটারের চারদিকে কতগুলো শুয়োর কাদা মাটি মেখে ঘুরে বেড়াত। এগুলো পুষত ভাঙিয়া অর্থাৎ মেথররা।
প্রথমদিকে বিকাশের বিকাশের ভালো লাগছিল না। কারন এখানে বিহারিদের সংখ্যাই অত্তন্ত্য বেশী।
অবশ্য সমস্তিপুর শহরে অবশ্য কিছু কিছু বাঙালীও ছিল। কিন্তু ষ্টেশন থেকে বেশ কিছু দুরেই তারা থাকত। যার ফলে বিকাশের কথা বলার কেউ ছিল না। একদিন সেখান কার জুনিয়র স্টেশনমাস্টার বিকাশ কে বলল, “ স্যার যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলব”। বিকাশ বলল, “ বল সুকুমার কি বলবে”। সুকুমার বলল, “ যদি আপনি আমার ওখানে দুইবেলা ডাল ভাত খান, তাহলে খুব ভালো হয়,”। তার কথা শুনে বিকাশ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। একে তো তার রান্না করার অভ্যাস নেই, তার উপর বাসনপত্রও নেই। কাজেই সে খুশি হয়ে বলল, “ বেশ তাই হবে সুকুমার”।
সেদিন থেকে বিকাশ সুকুমারের কোয়াটারেই খেতে লাগল। যা খরচ হয়, তার অর্ধেক দিতে লাগল।
সারাদিন মাত্র আপ ডাউন মিলে আটটা ট্রেন যাতায়াত করে, তারপর স্টেশন ফাঁকা। কোনও কাজকর্ম নেই।
কোনদিন বিকাশ আর সুকুমার চলে যায় শহরে। আবার কোনদিন রেল লাইন ধরে সোজা চলে যায় আউট সিগন্যালের কাছে গিয়ে পাথরের উপর বসে বসে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে আর গল্প করে। তারপর কোয়াটারে এসে দুজনে খেয়ে দেয়ে যে যার নিজের কোয়াটারে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
আর যাই হোক জায়গাটা বেশ ফাঁকা । দূরে শাল গাছের জঙ্গল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে মহুয়া গাছের সারি, রেল লাইনের ধারেও বড় বড় নানা রকম গাছ। খেজুর আর বাবলা গাছ তো আছেই, আর তার সঙ্গে আছে নাম না জানা বুনো গাছের ঝোপঝাড় । কোথাও কোথাও আবার উঁচু উঁচু গাছপালা হীন টিলা দেখা যায়। লাইনের উল্টো দিকে পোড় প্রান্তর। সেখানে কিছু কিছু ঘাস দেখা যায়। মোষের পাল নিয়ে স্থানীয় ছেলেরা এখানে ঘুরে বেড়ায়।
এখানে গরুর গাড়ি নেই বললেই চলে। মোষের গাড়িতেই মালপত্র বোঝাই করে শহরে আনা হয় আর শহর থেকে মালপত্র নিয়ে যাওয়া হয়। এ ছাড়া লরীও যাতায়াত করে বড় রাস্তার উপর দিয়ে। যখন ট্রেন আসে যায়, তখন দু একটা বাসও আসে স্টেশনের সামনে। আর ট্রেন চলে গেলেই সব ফাঁকা।
দেখতে দেখতে কেটে গেল একমাস।
বিকাশ খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে লাগল, আর কোন সমস্যা হলে সুকুমার তাকে সাহায্য করত। আবার সুকুমারের কোন সমস্যা হলে বিকাশ সাহায্য করত। সেদিন সুকুমার হঠাৎ বিকাশ কে বলল, “ স্যার আপনি একা একা শাল এর জঙ্গলে বা মহুয়ার জঙ্গলে যাবেন না, এখানে ভীষণ বাঘ আর ভাল্লুকের উৎপাত, তাছাড়া বুনো দাঁতাল শুয়োরও আছে, এবং বিভিন্ন বিষধর সাপও আছে,”।
একদিন বিকাশ অফিসে বসে কাজ করছে, এমন সময় সুকুমার এসে বলল, “ স্যার আমার বদলির অর্ডার এসেছে, তবে আমার জায়গায় সুখেন্দু বলে একজন আসবে, ওর বাড়ি উত্তর চব্বিশ পরগণার হাবড়ায়, এবার থেকে ওই আপনার সঙ্গে থাকবে”। বলে সুকুমার চলে গেল।
আর কয়েকদিন পর সত্যিই সুখেন্দু বলে একজন এল। একদিন কথায় কথায় বিকাশ সুখেন্দু কে বলল স্থানীয় যে জঙ্গল আছে, সেখানে যেতে ইচ্ছা করছে। “ সুখেন্দু বলল, “ বেশ তো চলুন একদিন বেরিয়ে আসা যাক”। ওরা রামবিলাস নামে একজন কে ঠিক করল, আর তার সঙ্গে গেল জঙ্গলে। রামবিলাসের স্বাস্থ্য বেশ মজবুত। লম্বা চওড়া দেহ,যেন পাথরে খোদাই করা একটি মূর্তি।
লোকটির স্বভাবও খুব ভালো। সকলের সঙ্গেই সে ভালো ব্যাবহার করে। আর যখন রেলের রেড সিগন্যাল জ্বলে, তখন সে লেবেল ক্রসিং এর গেট বন্ধ করে দেয়।আর সারাদিন খাটিয়ায় বসে খৈনি খায়।
বহুদিন সে কলকাতায় ছিল। যার ফলে সে ভালোই বাংলা বলতে পারতো। তবে মাঝে মাঝে বিহারের টান এসে যেত।
বিকাশ আর সুখেন্দুর কথা শুনে সে রাজি হলো না, সে বলল, “ মাপ করবেন বাবুজি, “ ওই জঙ্গলের ধারে একটা কুটির আছে , লোকে বলে সেখানে না কি এক পেরেত থাকে”। সুখেন্দু জিজ্ঞেস করল, “ পেরেত মানে কি”? “ রামবিলাস বলল, “ বাবুজি যাকে আপনারা ভূত বলেন, এছাড়া আরও ভয়ানক জন্তু আছে, তার নাম হেরোল”।
৬
হেরোঁলের কথা শুনে বিকাশ আর শুখেন্দু পরস্পরের মুখের দিকে চাইলো। অবাক হয়ে তারা ভাবতে লাগল, সেটা আবার কি জন্তু। রামবিলাস বলল, “ ইয়ে জন্তু শিয়াল কি মাফিক বড়া ওর ইনসান কো মারকে উসকি মাস ভি খাতা হে, তবে বাহার সে জিতনা চাহে দেখলো, অন্দর সে মত দেখনা”।
শাল মহুয়ার জঙ্গল দেখার জন্য একে তো তারা খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল, তাই তারা একদিন সকাল বেলায় রওনা দিল, আর বেলা থাকতে থাকতে জঙ্গলে পৌঁছাল। পৌঁছে দেখে যে, জঙ্গলের মধ্যে একটা টিলা। তারা যেই সেই টিলায় উঠতে যাবে, অমনি গর গর করে একটা আওয়াজ শুনতে পেল, সুখেন্দুর হাতে ছিল একটা টর্চ, সে সেইব টর্চ জ্বালাতেই দেখল একটা ভয়ংকর দেখে কুকুর তাদের উপর প্রায় ঝাপিয়ে পড়ার উপক্রম করছিল। আর ঠিক সেই সময় কোথা থেকে একটা বাদুর এসে ওদের মাথার উপর পাঁক খেতে লাগল। ওরা দিগবিদিক শুন্য হয়ে সাইকেল ছোটাতে লাগল, আর ওদের গায়ে বড় বড় পাথর যেন কে ছুড়ে মারতে লাগল।
হঠাৎ তাদের পিছনে হুড়মুড় করে একটা ভয়ংকর শব্দ হোলো, শব্দ শুনে মনে হলো যেন টিলার ওপর থেকে মস্ত বড় একটা পাথর গড়িয়ে পড়লো, ওরা চমকে উঠে পিছন ফিরে চাইল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। নিরুপায় হয়ে তারা তখন সাইকেল নিয়ে ছুটতে লাগল, আর পিছনে যেন কার অট্টহাসি শুনতে পেল। চমকে উঠল ওরা । তাকিয়ে দেখল একটা বিশাল বড় নর কংকাল তাদের দিকে তেরে আসছে। সেটা দেখতে না পেরে দুজনেই অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর যখন জ্ঞ্যান ফিরল, দেখল দুজন কে ঘিরে সব দাড়িয়ে আছে। রামবিলাস জিজ্ঞেস করল, “ বাবু আপনারা ঠিক আছেন তো”। ওরা দুজনেই মাথা নাড়ল।
তারপর একদিন রামবিলাস কে জিজ্ঞেস করতে রামবিলাস তার কাহিনী শুরু করল। “ সাব আপনারা পরেছিলেন বিশে ডাকাতের ভূতের পাল্লায়,”। বিশে দাকাত ছিল একসময়ের চলমান আতঙ্ক। তখন এখানে সবেমাত্র স্টেশন হয়। একদিন বিশে তার দলবল নিয়ে ষ্টেশন মাস্টারের ঘরে ডাকাতি করতে যায়, কিন্তু স্টেশন মাস্টার তাকে গুলি করে মেরে দেয়। সেইথেকেই এই জঙ্গলে বিশের আত্মা আজও ঘুরে বেরায়। বিকাশ বলল, “ কিন্তু তুমি এইসব কি করে জানলে”? রামবিলাস বলল, “ ওই বিশে ডাকাতের একমাত্র হতভাগ্য ছেলে হলাম আমি”। এই বলে রামবিলাস ওখান থেকে চলে গেল।