Riya Bhattacharya

Horror Romance Classics

2.6  

Riya Bhattacharya

Horror Romance Classics

সখী

সখী

7 mins
1.2K



" ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো....

তোমার মনের মন্দিরে -----" 


দূর থেকে ভেসে আসছে মননস্পর্শী সংগীত, আকাশ - বাতাস মন্থন করে যেন তুলে আনছে অমৃতকুম্ভ। 


আজ প্রায় সাতদিন হলো এসেছি বালিডাঙা। দূরসম্পর্কের এক মাসীর বাড়িতে। আসলে দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এরচেয়ে বেশিদূর ভ্রমণে সম্মতি দেন নি পিতৃদেব, নয়ত আজ কোনো পাহাড়িয়া গ্রামে একান্তে বসে শীতল জ্যোৎস্না উপভোগ করতুম। 


এখানে আসা ইস্তক দিন যে খুব খারাপ কাটছে এটা বলতে পারি না। মাসী, মেসোমশাইয়ের যত্নের ঠ্যালায় মাঝেমধ্যেই হৃদকম্প উপস্থিত হচ্ছে। আর মাসতুতো বোনটিও ভারী মিষ্টি, সারাদিন কলকল ঝর্ণার উচ্ছ্বলতায় মাতিয়ে রাখছে পরিবেশ। মাসীদের যৌথপরিবার, ঘর সর্বদা ভরভরন্ত আত্মীয়ভীড়ে, নিজের জন্য সময় খুঁজে পাওয়া শুধু মুশকিল নয়, অসম্ভবও বটে। পিতৃদেবের কথায়, আমার এখন এমন পরিবেশই প্রয়োজন, আত্মীয়তা ব্যথাতুর মনে শান্তির প্রলেপ দেয়, স্থির হতে সহায়তা করে।


কিন্তু স্থির হতে পারছি কই। কি একটা অপ্রাপ্তির কাঁটা সর্বদা খচখচ করে মননে। কি নেই.....কি যেন থেকেও নেই..... এই অস্থিরতায় রোজ ছিঁড়েখুঁড়ে যায় আমার আজন্মলালিত একাকীত্ব, তারপরে পাগলা হাওয়ার ন্যায় অসীম মায়াবী সুরতরঙ্গ..... বেতসলতার ন্যায় কাঁপন ধরায় প্রাণে। 


প্রতিসন্ধ্যায় শুনতে পাই এই সুর, ঠিক যখন গ্রাম্যবালিকার আঁচলতলে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, কালচে মেঘের গায়ে ফুটে ওঠে সন্ধ্যাতারার বুটি.....তুলসীতলায় জ্বলে ওঠা লক্ষ দীপমালাকে যেন অজান্তেই পবিত্র করে তোলে সে। 


দু একবার মনে হয় ছাদে গিয়ে দেখি, কে সেই অসামান্য গায়ক, যার সুর সকল ভ্রান্তিবিলাস ভেদ করে ধাক্কা দেয় বুকে.... মজানো খালে অতর্কিতেই বান ডাকে.... কান্না পায় তখন.....বড্ড কান্না পায়...


কিন্তু মাসীর সাফ আদেশ, " মেয়েদের সন্ধ্যার পরে ছাদে উঠতে নেই৷ " আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পুরাতন সংস্কারের অচলায়তন যে কতটা দৃঢ় ও গম্ভীর হতে পারে তা এখানে না এলে বুঝতে পারতামই না। আমাদের শহুরে আদবকায়দার কাছে এ গ্রাম যেন রূপকথার সেই দৈত্যপুরী, যেখানে রাজকন্যাকে রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে কেবল ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় ; রাজপুত্র যেন কোনোমতেই তার সন্ধান না পেতে পারে।


আমার আবার নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি টান বরাবরই প্রবলভাবে বেশি। মৃত্যুকে ভালোবেসে দুটো মিষ্টি কথা কইতে গিয়ে আজ জীবন - মৃত্যুর মাঝে আটকে গেছি ; কেউই আমায় আপনজন বলে মনে করতে রাজী নয়....তবে দাবীদাওয়া আছে দুজনেরই। 


আজ যেভাবেই হোক ছাদে উঠে দেখব---


জেদটা চেপে বসেছে মাথায়, সেইসঙ্গে আকুল বসন্তবাতাস মেখে অক্লান্ত সুর হাতছানি দিয়ে ডাকছে.....আজ হয়ত উপেক্ষা করার সাধ্য নেই আমার। 


আত্মীয়স্বজনের ভিড় এড়িয়ে ছাদে উঠতে কালঘাম ছুটে গেল, ন্যাড়া ছাদে থইথই করছে অন্ধকার। ঠান্ডা বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ চাপা দিতে চাইছে চৈতন্যকে, অলিক ঘুমঘুম মায়ায় ভারী হয়ে আসছে চোখের পাতা....


কোনোক্রমে পা টিপে টিপে অন্ধকারের সমুদ্র ঠেলে এগিয়ে গেলাম পশ্চিম দিকে। এদিকটায় কিছু বাঁশঝাড় থাকার কারণে দিনেরবেলাতেই ছায়া ঘনিয়ে থাকে, সন্ধ্যাদেবীর কি অবস্থা হয় তা বলাই বাহুল্য। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যাই সেদিকে, ভুলে যাই আত্মীয় - পরিজন, মাসীর চোখরাঙানি, মেসোর বারণ....মাসতুতো বোনের হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত ব্যথার আঁচড়.... সবকিছু!


ছাদের কোনের আলসেতে পিঠ দিয়ে বসে আছে এক তরুণ অবয়ব, মরা চাঁদের আলো কুয়াশা হয়ে যেন ঢেকে রেখেছে তাকে। অজস্র মালিন্যের অন্তরাল থেকে যেন জেগে উঠেছে একটুকরো চাঁদ.... শবে আর শিবে বিভেদ করতে শেখেনি সে। 


আকাশের দিকে চেয়ে আনমনে গেয়ে চলেছে সে, বাতাসে ভেসে চলেছে অন্তহীন সুরের লহরী। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি৷ মনে করার চেষ্টা করি কখনো কি দেখেছি তাকে! এত আত্মীয়ের মাঝে তবে কি অলক্ষ্যে থেকে গেছে এই মুখ! নয়ত ভরসন্ধ্যায় এবাড়ির ছাদে এলো কিকরে! 


ধৈর্যটা কম বলে পিতৃদেবের কাছে বরাবরই গঞ্জনা শুনে থাকি আমি। এত বকাবকি করেও থামাতে পারেননি আমায়। তাই যখন সুরলহরী উত্যুঙ্গ আবেগে ঝড় তুলছে প্রাণে, 


ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে

আমার মুখর পাখি ---

তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে। 


তেড়িয়ার মত প্রশ্ন করলাম, 


" ভরসন্ধ্যায় ছাদে বসে গান গাইলে মাসী ঠ্যাঙায় না!" 


থেমে গেল সুর, আচমকাই যেন থমথমে হয়ে এলো পরিবেশ। ঝিঁঝিঁপোকার ডাকে ভেসে এলো আর্ত বিপদসংকেত, কোথাও " ট্রি....ট্রি..." শব্দে ডেকে উঠলো ভয়ার্ত রাতপাখি। 


একজোড়া গভীর চোখ ঘুরে গেল আমার দিকে, শূন্যদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উদাস গলায় বলে উঠলো,

" আজকাল মা আর আমায় কিছুই বলে না!" 


ধাক্কা খেলাম। মা! মাসীর যে মেয়ে ছাড়া ছেলেও আছে এমনটা আজ পর্যন্ত শুনিনি তো! এমনিতেই প্রায় বছর বারো পরে আমার এই গ্রামে আসা, তবে ছেলে থাকলে অন্তত শুনতে তো পেতুম! মাসতুতো বোনটিও তেমন কিছুই বলেনি তো! 


" মাসী আপনার মানে তোমার মা! কই বলেননি তো কখনো যে ওনার কোনো ছেলে আছে!" অবাক হয়ে ধপ করে বসে পড়ে বললুম আমি।


" বলবে কেন! সন্তানকে যখন পরিচয় দিতে লজ্জা করে তার অস্তিত্ব তখন স্বীকার করেনা কেউই। " ব্যথায় বুজে আসা চোখ উত্তর দিলো।


মনখারাপ হয়ে গেল বড্ড৷ এত সুন্দর গানের গলার মালিককে কেউ সন্তান হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়! আমি জানতাম মেসোমশাই বড্ড কঠোর মানুষ, তা বলে মাসীও! কেন এমন করলেন তাঁরা! আজ সাতদিন এসেও এই মুখাবয়ব একদিনও আমার চোখে পড়েনি কেন ঘরে!


পেটের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠছে হাজার জিজ্ঞাসা, বুকে তিরতির করে বইছে সমব্যথা। আমার মত মায়াদয়াহীন মেয়েও যে কারো জন্য ব্যথা অনুভব করতে পারে আজ জানছি৷ বদলে যাচ্ছে হিসেবনিকেশ, হ্যাঁ - না এর গল্পগুলো। 


" আচ্ছা, আমি যতদূর শুনেছি এ বাড়িতে গান গাওয়া নিষেধ, তবুও তুমি রোজ সন্ধ্যায় এই গানটা গাও! ক্ষমা করো, তোমাদের বাড়ি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানিনা আমি, প্রায় বারো বছর পরে এলাম গ্রামে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে সবকিছু, এই পরিবেশ....এখানকার লোকজন....!" 


" আর আমি! আমি অদ্ভুত লাগিনা!" এক অপূর্ব মায়াজড়ানো স্বরে প্রশ্ন করলো সে। 


" আসলে সেভাবে ভাবিইনি কখনো। তুমি বড্ড ভালো গাও, যখনই এই গানটা গাও, কেমন যেন উদাস হয়ে যাই....গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কেন জানিনা....!"


" এই গানটাকে বড্ড আপন মনে হয়! মনে হয় আগেও শুনেছো বহুবার....হয়ত এই এক জায়গায় বসে....একই মানুষের কাছে!" 


" হ্যাঁ, কিন্তু....! বিগত বারো বছর এই গ্রামে আসিনি আমি। এবারও প্রায় বাধ্য হয়ে আসা, লকডাউন না হলে কবেই পালাতুম! তাহলে এই গান আগে শুনবো কিকরে তোমার কাছে! যেখানে আজকের আগে জানতামই না যে মাসীর কোনো ছেলে আছে! " বিহ্বলস্বরে জবাব দিলাম আমি। 


" বারবার পালানো যায়না যে নিজের অতীতের থেকে, যতই মিথ্যার বেসাতি হোক পর্দা সরিয়ে সত্য একদিন উঁকি দেয় ঠিকই। এই গান তোমার হৃদয়ে আঁকা আত্রেয়ী, কিকরে অস্বীকার করবে তুমি তাকে! কিকরে অস্বীকার করবে আমাকে!" 


চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক খেলেও বোধহয় এতটা চমকাতাম না যতটা এই তরুণের মুখে নিজের নাম শুনে চমকেছি। একে আমি চিনি! আগে থেকেই চিনি! তাহলে মনে করতে পারছি না কেন! কেন ধোঁয়াশা হয়ে আছে অতীতের বারোটা বছর! পিতৃদেব বলেছিলেন, পথ দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়েছিলাম মাথায়..... তাই হয়ত ধূসর হয়ে গেছে অতীতের যাবতীয় স্মৃতি।


ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাসের আঁচড়ে শিউরে উঠলাম। সেই তরুণ যে কখন এত কাছে সরে এসেছে বুঝতে পারিনি, তার নিঃশ্বাস উথালপাথাল ঢেউ তুলছে বুকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলছে সে,


" মাত্র তিনবছর পিছিয়ে যাও আত্রেয়ী, বেশিদূর যেও না যেন! এই গান, এই আমি যে তোমার বড্ড চেনা! মনে করো আত্রেয়ী, মনে করো! সবাই অস্বীকার করেছে আমায়, তুমি কোরো না যেন! " 


বাতাস বড্ড গুমোট হয়ে উঠেছে....হলকা উঠছে যেন বুভুক্ষু কালসাপের নিঃশ্বাসে। দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার, স্মৃতিতে আলোড়ন তুলছে খুবচেনা ঘামের গন্ধ.... ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ..... আকাশের তারারা আলোর ফুটকি হয়ে জ্বলছে নিভছে....তারমাঝে খেলা করছে এক কিশোর ও এক সদ্যযুবতী, খেলায় খেলায় কিশোর সিন্দুররেখা এঁকে দিচ্ছে সদ্যযুবতীর ললাটে,


" আমার স্মরণ শুভ - সিন্দুরে

একটি বিন্দু এঁকো --

তোমার ললাটচন্দনে।"


ঘুম পাচ্ছে আমার....বড্ড ঘুম পাচ্ছে....।


*      *     * 


" কতবার বলেছিলাম এ মেয়েকে এখানে এনো না! কেন শোনোনি তুমি! কুপুত্র জন্ম দিয়েছিলে, সেতো গেছে! এখন এর যদি কিছু হয় কি জবাব দেব আমি এর বাবাকে!" 


আবছায়া অন্ধকার ঠেলে ভেসে এলো মাসীর কান্নার শব্দ, 


" চুপ করো তুমি! ছেলেটা নেই আর, আজও ক্ষমা করতে পারোনি না তুমি তাকে! সমাজ না মেনে ভালোবেসেছিল, এটাই কি তার দোষ!" 


" অবশ্যই, পাপ পূণ্য বলে কিছু নেই এই দুনিয়াতে! ছিঃ ছিঃ! মাসতুতো বোন, তায় বয়োঃজ্যেষ্ঠ ; তাকে নাকি ভালোবাসা! মেয়েটাকে কম ভুগিয়েছে তোমার কুপুত্তুর! কথায় কথায় হুমকি - জেদ! কুঁকড়ে থাকতো মেয়েটা! সব জানাজানি হতে যখন ত্যাজ্যপুত্র করলাম! ছাদ থেকে লাফিয়ে কি প্রমাণ করলেন তিনি! ভালোবাসা! " 


" উফফ! তোমার কি একটুও মায়াদয়া নেই গো! ছেলেটা আমাদের মরে গেছে গো! বাপ হয়ে প্রাণটা কাঁদেনা তোমার! সব দোষ কি তারই ছিল! এ মেয়ের ছিল না! এতো বড় বয়সে, বোঝাতে পারতোনা! সময়ে এসে বেঁকে বসলেন, এখন নাকি অতীতের বারোবছর কিচ্ছু মনে নেই তার! হয়, পয়সাওয়ালা বাপের মেয়ে হলে এমন অনেককিছু হয়! আর বাপের কাছে দেনাগ্রস্থ তুমি এই মেয়েকে জামাই আদর করো, নিজের ছেলেটা কি দোষ করলো তবে!" মুখে আঁচলচাপা দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলেন মাসী। 


" থামো! যা জানো না তা নিয়ে বোলোনা। এ মেয়ের কোনো দোষ নেই এতে, নিজে শিক্ষা দিয়ে ছেলে মানুষ করতে পারোনি তার দায় কারো ওপরে চাপিও না। জেগে উঠলেই খবর দিও, ভালোয় ভালোয় গাড়িতে তুলে দিতে পারলেই বাঁচি!" 


আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। মাথাটা বড্ড ভারী হয়ে আছে৷ বুকের খাঁজে চিনচিনে ব্যথা, ঝিমঝিম করছে অনুভূতি। মাথার পাশেই বসে ছিল সদাহাস্যময় মাসতুতো বোনটা, আজ দেখলাম তার চোখের কোনে জল। আমায় উঠতে দেখে কোনোক্রমে টেনে হাসলো সে, তারপরেই ছুটে গেল মাসী - মেসোকে ডাকতে অফুরন্ত ব্যস্ততায়। 


" আমি বাড়ি যেতে চাই, সম্ভব হলে এখনই। জানি লকডাউন আছে, তবুও..... জানিনা কিভাবে...তবু যাবো, এখনই। " কেটে কেটে কথাকটি বললাম আমি। 


" জানি, গাড়ি অপেক্ষা করছে বাইরে, তৈরী হয়ে এসো। " ভাবলেশহীনভাবে উচ্চারণ করলেন মেসোমশাই। এত স্নেহময় একজন মানুষের আচমকা ভাবান্তরে আশ্চর্য লাগলেও কিচ্ছু বললামনা। বড্ড অসুস্থ লাগছে, বেরোতে হবে এখান থেকে শিগগিরই। 


গাড়ি চলতে শুরু করেছে, থমথমে জনমনুষ্যহীন রাস্তায় ইতিউতি শুয়ে আছে কয়েকটা পথকুকুর। আমার ডানপাশ ঘেঁষে বসে আছে হিমশীতল এক অস্পষ্ট অবয়ব..... কখনো ছেড়ে না যাওয়ার কথা রাখতে ফিরে এসেছে অরিণ ; মরণের ওপার থেকে।


"আমার আকুল জীবনমরণ

টুটিয়া লুটিয়া নিও --

তোমার অতুল গৌরবে।।"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror