Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Inspirational Children

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Inspirational Children

সিঙ্গারার জীবনকথা

সিঙ্গারার জীবনকথা

4 mins
312


চায়ের সঙ্গে গরম গরম সামুসা আবার সঙ্গে তেঁতুল বা টমেটোর চাটনি না হলে আমাদের বাঙালিদের পাচাটা ঠিক জমে ওঠে না সেই সামোসার উৎপত্তিস্থল নিয়েতো কখন ও ভাবা হয়নি। 


সিঙ্গারার ইতিহাস অনেক পুরনো। 


ঠাণ্ডা লুচি বারংবার ফেরত পাঠানোয় রাজবাড়ির হালুইকর অনুমতি চেয়েছিলেন রাজসভায় মিষ্টান্ন পাঠাতে। রাজচিকিৎসকের পরামর্শে মধুমেহ রোগাক্রান্ত রাজা অগ্নিশর্মা হয়ে শূলে চড়ানোর হুকুম দিয়েছিলেন হালুইকরকে। অনেক অনুনয় বিনয় করে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছেন হালুইকর। রাজা আদেশ দিয়েছেন - হালুইকরকে তিনরাত্রের মধ্যে দেশত্যাগ করতে। 


দ্বিতীয় রাত্রে হালুইকরের স্ত্রী ঠিক করেছে দেশত্যাগের আগে একবার দেখা করবে রাজার সাথে। সেইমতো তৃতীয়দিন সকাল বেলা রাজদরবারে এসে প্রণাম জানালো স্বয়ং রাজামশাইকে। রাজসভায় আসার কারণ জিজ্ঞেস করায়, রাজাকে জানায় - সে নাকি এমনভাবে লুচি তরকারি করতে পারে, যা রাজা আধঘন্টা বাদে খেলেও গরম পাবেন। এজাতীয় লুচি এবং তরকারি নাকি কিছুক্ষণ বাদে খাওয়াই দস্তুর। 


সন্দিহান রাজা কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে হালুইকরের স্ত্রীকে পাঠালেন পাকশালে। জানিয়ে দিলেন যখন রাজসভা থেকে খবর যাবে তৎক্ষণাৎ পাকশাল থেকে খাবার পৌঁছনো চাই। হালুইকরের স্ত্রী মৃদু হেসে মহারাজকে জানিয়েছিলো - খাদ্যদ্রব্য রাজসভায় তৎক্ষণাৎই পৌঁছবে, কিন্তু অনুগ্রহ করে তিনি যেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খান - অন্যথায় মহামান্য রাজকীয় জিহ্বা পুড়ে যেতে পারে। বিস্মিত মহারাজের সামনে দিয়ে হাস্যমুখে হালুইকরের স্ত্রী চলে গেল পাকশালে। 


রাজ-পাচক আলুর তরকারি তৈরি করে পাকশালে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন, হুকুম এলেই লুচি ভাজতে হবে। ময়দার তাল মাখা রয়েছে হাতের সামনে। হালুইকরের স্ত্রী পাচককে কটাক্ষ করে বসলো ময়দার তাল নিয়ে। লেচি কেটে লুচি বেলে, কাঁচা ময়দার ভেতর লুচির জন্য তৈরি সাধারণ তরকারি ভরে দিয়ে, সমভুজাকৃতি ত্রিভুজের গড়ন বানিয়ে আড়ষ্ঠ রাজ পাচকের সামনে নিজের আঁচল সামলে শুরু করলো চটুল গল্প। 


রাজাজ্ঞা আসতেই তরকারির পুর ভর্তি দশটি ত্রিভুজাকৃতির লুচির ময়দা ফুটন্ত ঘি ভর্তি কড়ায় ফেলে দিয়ে, নিমেষের মধ্যে সোনালী রঙের ত্রিভুজগুলি তুলে নিয়ে স্বর্ণথালায় সাজিয়ে নিজেই চললো রাজসভায়। 


মহারাজ এরূপ অদ্ভুত দর্শন খাদ্যবস্তু দেখে স্তম্ভিত। হালুইকরের স্ত্রী অত্যন্ত বিনীতভাবে জানালো - খাদ্যদ্রব্যটির নাম সমভুজা। মহারাজ যেন সম্পূর্ণ বস্তুটি মুখে না ঢুকিয়ে একটি কামড় দিয়ে দেখেন - ঠাণ্ডা না গরম এবং অনুগ্রহ করে স্বাদটি জানান। 


মহারাজ স্বাদ জানাননি। তিনি তিনছড়া মুক্তো মালা খুলে হালুইকরের স্ত্রীয়ের হাতে দিয়েছিলেন। রাজবাড়ির হালুইকরের দণ্ডাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিলেন। প্রায় ছ'মাস পর হেসে উঠেছিলেন মহারাজ, শান্তি পেয়েছিলো তামাম প্রজাকুল। 


মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার রাজ-হালুইকর, কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠপুত্র গিরীধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী আবিষ্কার করেছিলেন সিঙ্গাড়া। 


শাক্ত সাধক, পরবর্তিকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রামপ্রসাদ, স্বয়ং সন্ধ্যাহ্নিক সেরে প্রতিসন্ধ্যায় বসতেন একথালা সিঙ্গাড়া নিয়ে। 


দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দরবার থেকে বাইশটি সুসজ্জিত হস্তী ভেট নিয়ে গিয়েছিলো উমিচাঁদের কাছে - বাইশটি স্বর্ণথালা ভর্তি বাইশশোটি সিঙ্গাড়া। 


ভারতীয় খাদ্য হিসেবে সিঙ্গাড়ার সাথে রবার্ট ক্লাইভের প্রথম সাক্ষাৎ হয়, এই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রেরই সৌজন্যে। 


সিঙ্গাড়ার জন্য ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে। নাম ভুলে গেছে তাঁর প্রধান হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী বেহারার। 


ইংরিজিতে বলে, কমন সেন্স মেকস্ আ ম্যান আনকমন। ধরিত্রীদেবী সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ খাদ্যদ্রব্যটির, যেটি সেই ১৭৬৬ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা তথা সারা ভারতে। 


ঐতিহাসিকদের মতে, এর বহু আগে, নবম শতাব্দীতে পারস্যের অধিবাসীরা যব এবং ময়দার তালের সঙ্গে গাজর কড়াইশুঁটি রসুন ও মাংস মেখে সেঁকে খেতো, যাকে বর্তমান সিঙ্গাড়ার জনক হিসাবে ধরা হলেও, সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেও তাঁরা ময়দার তালে মাংসের কুঁচি ঢুকিয়ে সেঁকেই খেতেন। এরও বহুপরে তাঁরা ভারতবর্ষের উত্তরপূর্ব উপকূলে বিভিন্ন মশলা সহযোগে তৈরি আলুর তরকারি, ময়দার ভেতর ঢুকিয়ে ঘিয়ে ভাজার পদ্ধতিতে চমৎকৃত হ'ন। বলা হয়, ফার্সি শব্দ ‘সংবোসাগ’ থেকেই এই সিঙারা শব্দের উৎপত্তি।সমোসা/সামুচা/সামুসা/সিঙারা এর উৎপত্তি মধ্য প্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়াতে এরপরে এটি আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সামোসা শব্দ এবং এর রূপগুলি উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা থেকে পশ্চিম চীন পর্যন্ত জনপ্রিয় প্যাস্ট্রি এবং ডাম্পলিংয়ের পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই অঞ্চলে মধ্য এশীয় তুর্কি রাজবংশের আগ্রাসনের পরে সামোসা ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতে ২ হাজার বছর আগে সিঙ্গারার আবির্ভাব।পারস্যের কবি ইসহাক আল-মাওসিলির নবম শতাব্দীর একটি কবিতায় সমোসার প্রশংসনীয় পাওয়া যায়। আমির খুসরো (১২৫৩-১৩২৫), একজন আলেম এবং দিল্লি সুলতানিয়ের রাজকবি,প্রায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে লিখেছিলেন যে -রাজকুমারগণ ও আভিজাত্যরা "মাংস, ঘি, পেঁয়াজ ইত্যাদিতে প্রস্তুত সামোসা উপভোগ করেন।"


ডায়বেটিক পেশেন্টদের ঘন ঘন খিদে পায়। চিকিৎসাবিজ্ঞান উন্নত হয়েছে। ডাক্তাররা বলছেন, অনেকক্ষণ অন্তর একসাথে প্রচুর পরিমানে না খেয়ে, ক্যালোরি মেপে কিছুক্ষণ অন্তর অল্পসল্প খাবার খেতে। কিন্তু সেযুগে ডাক্তারবাবুদের হৃদয় ছিলো বিশাল। মধুমেহ রোগীরা তখন তেল ঘি মশলা, ভাজা খেলেও তাঁরা রাগ করতেন না। নিশ্চিতভাবেই আজকের যুগে ডাক্তার বাবুরা আঁতকে উঠবেন যদি দেখেন কোনো ডায়াবেটিক পেশেন্ট প্রতিঘন্টায় সিঙ্গাড়া ওড়াচ্ছেন, তবু, আঁটকানো যায়নি সিঙ্গাড়াকে। 


শহুরে অভিজাত পরিবারের বৈঠকখানায় মোটা গদির সোফায় বসা অতিথির থালাই হোক বা প্রত্যন্ত গ্রামের জরাজীর্ণ চায়ের দোকানের সামনে নড়বড়ে বাঁশের বেঞ্চে রাখা তেলচিটে কালো ভাঙ্গা বেতের চুবড়ি - বিকেল সাড়ে চারটেই হোক বা সকাল পৌনে দশটা, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রধান হালুইকরের স্ত্রীর উদ্ভাবনটি সর্বত্র সর্বদা সর্বগামী। 


যা রাজসভায় রাজ-সম্মুখে পরিবেশিত হয়, তার কৌলীন্য প্রশ্নাতীত হবে - এই তো স্বাভাবিক। 


ভাষাবিদদের মতে, সমভুজা--> সম্ভোজা--> সাম্ভোসা--> সামোসা।

মতান্তরে, সমভুজা--> সম্ভোজা--> সিভুসা--> সিঁঙুরা(নদীয়ার কথ্যভাষার প্রভাবে)--> সিঙ্গাড়া।




এর জন্মস্থান কিন্তু বাংলাদেশ কিংবা ভারত নয়। তবে বর্তমানে সিঙারা ভারত,বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের খুবই জনপ্রিয় নাস্তা।বিশেষ করে বাঙালিদের কাছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract