সিল্ক-রুট সরগরম(প্রথম পর্ব)
সিল্ক-রুট সরগরম(প্রথম পর্ব)
নিউ মাল জংশন ষ্টেশনে নেমেই মনটা খুশি হয়ে গেলো দিঠির । এতো সুন্দর একটা ষ্টেশন, চারদিকে চা বাগান, দূরে সবজে নীল পাহাড় ধাপে ধাপে উঠে গেছে। নীল আকাশের গায়ে ঝকঝক করছে বরফের মুকুট পরা কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাতাসে নাম না জানা ফুলের গন্ধ, সবুজ সতেজ গাছপালায় ঘেরা পরিষ্কার ষ্টেশন চত্বর। কোনো হকার বা দোকানের ভিড় নেই। বাইরে আসতেই চোখে পড়লো প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ড্রাইভার। গিয়ে পরিচয় দিতেই সুটকেস দুটো টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিল।
অয়ন ফটো তুলতেই ব্যস্ত। দিঠি ওর বন্ধু জিষ্ণুকে ফোনে জানিয়ে দিল যে ওরা ঠিকঠাক পৌঁছে গেছে। জিষ্ণু সেন, সফল ফিল্ম ডিরেক্টর, দিঠির ছোটবেলার বন্ধু। দিঠির একটা গল্পের উপর এখন এদিকে একটা সিনেমার শুটিং করছে জিষ্ণু, তার অনুরোধেই দিঠিরা এসেছে এই পাহাড়ের টানে। আজ তাদের গন্তব্য ঋষি-খোলা। সিকিম আর বাংলার বর্ডারে এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্ৰাম। গাড়ি ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে চা বাগানের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে। এই অপরূপ প্রকৃতির মাঝে এসে দিঠির খুব ভাল লাগছিল। গাঢ় সবুজের ঢেউ খেলানো চা গাছের গালিচা চারপাশে। একটু পরেই শুরু হল শাল বন। গাড়িতে নেপালি গান চলছিল, বেশ লাগছে গানের সুরটা। আস্তে আস্তে গাড়ি পাহাড়ে উঠছে ঘুরে ঘুরে। ড্রাইভারের বয়স বেশি নয়, নাম শালু। বেশ ভাল হাত। খুব মিশুকে, দিঠির প্রশ্নেের উত্তরে জানায় পাঁচ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছে পাহাড়ে। বাবা মা নেই, মাসীর কাছে মানুষ। এখন বয়স একুশ। বাড়ি জুলুখে।
গরু-বাথান বাজারে মোমো আর কফি দিয়ে জলযোগ সেরে ওরা এগিয়ে চলে। সামনেই একটা বেশ বড় ঝরণা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নিচে চেল নদীতে গিয়ে মিশেছে। রাস্তার পাশেই এক বিশাল বড় পাথর। আজ জিষ্ণুর একটা নাচের দৃশ্যের শুটিং চলছে এখানে।
শুটিং ইউনিটের অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। দিঠিরা দাঁড়াতেই জিষ্ণু এগিয়ে এলো হাসি মুখে। বলল -" অবশেষে এলি, আয় সবার সাথে আলাপ করাই।"
দিঠি আর অয়ন জিষ্ণুর সাথে এগিয়ে যায়। নাম করা নায়ক নায়িকা নিয়েই সিনেমাটা হচ্ছে। গল্পটা দিঠি লিখলেও বাণিজ্যিক মুভির স্বার্থে কয়েকটা নাচ গান ঢোকানো হয়েছে। গল্পর কয়েকটা জায়গায় বদল হয়েছে সিনেমার স্বার্থে।
নায়িকা অঙ্কনা আর নায়ক রায়ান। দুজনের সাথেই পরিচয় হল।
এছাড়া ডান্স ডিরেক্টর মিস রেহানা এসেছেন মুম্বাই থেকে। প্রযোজক এক বড় ব্যাবসায়ী সমর জৈন। উনি নিজেও সিনেমায় একটা ছোট রোলে আছেন। আসলে কোনো এক সময় সিনেমায় নামার ইচ্ছা ছিল জৈনের। কিন্তু তেমন সুযোগ পান নি। দু একটা বই করেছিলেন, চলেনি। আজকাল বয়স হয়ে গেছে তবু শখটা বেঁচে আছে। কম গুরুত্বের ছোট কোন চরিত্রে মুখ দেখাতে ভালবাসেন। বেশ মজার মানুষ। লোকাল কিছু মেয়েদের নিয়ে নাচের দৃশ্যর ছবি তোলা হচ্ছে ঝরণায়। বারবার রি-টেক হচ্ছিল একই দৃশ্য।
জিষ্ণু বলল -" তোরা বোর হয়ে যাবি। এখন এগিয়ে যা। সামনেই লাভা, আমার নায়ক নায়িকা আজ ওখানে ফরেস্টে থাকবে। কাল আমাদের ঋষিখোলায় শুটিং। আমি বিকেলেই পৌঁছে যাবো জৈনকে নিয়ে। তোরা ফ্রেশ হয়ে ঘুরে দেখ। "
অয়নের হবি ফটো তোলা, ও প্রকৃতির ফটো ফ্রেমে বন্দি করতেই ব্যস্ত। পেশায় অয়ন জার্নালিষ্ট, এক বহুল প্রচলিত ইংরাজি দৈনিকের পশ্চিমবঙ্গ ও উওর পূর্ব ভারতের খবর করা ওর কাজ । কাজের বাইরে এই ঘুরতে এসে ও প্রকৃতিকে নিজের ক্যামেরায় ধরে রাখতেই ব্যস্ত।
একটা ছেলে ওদের জন্য কফি নিয়ে হাজির। জিষ্ণু দিঠিদের বলে -" এ হল মদন, আমার ইউনিটের ম্যানেজার বললে কম বলা হবে। ও এখানে আমাদের অল ইন অল। গ্যাংটকের ছেলে। এদিকে যারা শুটিং করে ও তাদের সব রকম সাহায্য করে, আউটডোর ম্যানেজার। আমি যবে থেকে স্পট দেখতে এসেছি আমার সাথে লেগে রয়েছে। ওকে নিয়েই সব ব্যবস্থা করেছি। বিদেশ বিভুঁয়ে এই মদনের মতো ছেলে আছে বলেই এতো সুন্দর ভাবে সব এ্যারেঞ্জ করে কাজ করতে পারছি। " ছেলেটা লাজুক হাসি হেসে চলে গেলো।
আ্যসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের ডাকে জিষ্ণু এগিয়ে গেল। শট রেডি। দিঠি কফি খেতে খেতে শুটিং দেখছিল , কতো দিক থেকে ক্যামেরা ফোকাস করেছে। মাত্র দু লাইন গানের দৃশ্য তোলা হল। আবার নায়িকা ওবি ভ্যানে ঢুকে গেল। ড্রেস বদলাবে। দিঠিরা গাড়িতে উঠতে যাবে হঠাৎ একটা হৈ হৈ গুঞ্জন কানে আসায় সবাই এগিয়ে যায়।
নায়কের বন্ধুর রোলে যে সহ শিল্পী ছিল সে নাকি একটা পাথরে বসে ছিল। জৈনের সাথে কিছু আলোচনা করছিল । কি ভাবে একটা বড় পাথর গড়িয়ে আসে উপর থেকে। জৈনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলেও ঐ রকি ছেলেটা নিজের পায়ে চোট পেয়েছে।
সবাই দৌড়ে আসে। ওকে ধরাধরি করে এনে বসানো হয়। ও কিছু বুঝতেই পারে নি। হঠাৎ এভাবে পাথর গড়িয়ে আসায় সবাই অবাক।ফেব্রয়ারীর শেষ সপ্তাহ, বর্ষা আসতে বহু দেরি। এ সময় পাথর এ ভাবে পড়েনা সাধারণত। বর্ষার জলের তোড়ে এসব হয়। সবাই এটা নিয়ে চিন্তিত।
পলাশ বলে এক ক্যামেরাম্যান বলল যে ক্যামেরা বসানোর জন্য ওরা কিছু পাথর সরিয়ে ছিল। তাই কিছু পাথর নড়ে গেছিল। সেই সব পাথরের কোনোটা গড়িয়ে এসেছে হয়তো। তবে আউটডোরে এমন খুচখাচ দুর্ঘটনা ঘটে অনেক সময়।
দিঠি যেহেতু লেখিকা ওর মন কল্পনাপ্রবণ। ও অনেক কিছু ভাবছিল । অন্য দিকে অয়ন জার্নালিষ্ট হলেও যেহেতু ছুটিতে রয়েছে তাই সব ব্যাপারেই উদাসীন। নিজের মনেই হেসে ওঠে দিঠি, একটা সাধারণ ঘটনাকে নিয়ে সে কতদূর ভেবে ফেলেছে। একটা গাড়িতে রকিকে নিয়ে দুজন চলে যায় মালবাজারে ডাক্তার দেখাতে।
দিঠিদের গাড়িও লাভার দিকে এগিয়ে চলল।
পেডং থেকেই বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। সাইড ব্যাগ থেকে একটা শাল নিয়ে গায়ে জড়ায় দিঠি। একটা হাফ সোয়েটার এগিয়ে দেয় অয়নকে।
দূরের পাহাড়ের মাথায় শ্বেত শুভ্র বরফ আর চারপাশে নাম না জানা ফুলের মেলা, মন উড়ে চলে রূপকথার পথ ধরে। পথে ছোট ছোট গ্ৰাম,আর সহজ সরল গ্ৰাম্য লোকজন, কোথাও লাল ফুটিফাটা গালের পাহাড়ি শিশু,সবাইকে দেখেই মন খুশি হয়।
সামনেই দুটো ছোট পাহাড়ি ঝোরা এসে মিলেছে, সিকিমের চেকপোস্ট। আই কার্ড দেখাতে হয় ওদের। ড্রাইভার শালু জানায় এর পর কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে ঐ নদীপথে ওপারে যেতে হবে। একটা লোকাল ছেলে পিঠে ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল । শালুর সাথে কথা বলে ওদের সুটকেস দুটো আর সাইড ব্যাগটা ঝুড়িতে তুলে পাহাড়ি হাঁটা পথে নদীতে নামতে শুরু করলো। শালু বলে দিল ওর সাথে যেতে, দিঠিদের থাকার ব্যবস্থা নদীর ওপারে। এই ছোট্ট ঝোরার নাম ঋষিখোলা। এপারটা সিকিম ও পারে পশ্চিমবঙ্গ। দিঠি আর অয়ন চলল নদী পথে, পাথরে পা রেখে এগিয়ে চলে ঐ ছেলেটিকে লক্ষ্য করে। নদীর মুল ধারার উপর বাঁশের সাঁকো। পার হতেই ওপারে গহীন বন। দিনের বেলায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর ইতস্তত উড়ে আসা পাখীর ডাককে সঙ্গী করে ওরা পা চালায় আদিম অরণ্য পথে। মাঝে মাঝে জঙ্গলের মধ্যে একটা দুটো রিসর্ট চোখে পড়ে। নাম না জানা ফুলের সমারোহ আর মিষ্টি বুনো ফুলের মাতাল করা গন্ধ পথের সাথী। আঁকা বাঁকা বন্ধুর পথে নদীর পাশে চলতে চলতে পৌঁছে যায় একটা সুন্দর রিসর্টে। জিষ্ণু এতো সুন্দর জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেছে দেখে দিঠি মনে মনে ওকে তক্ষুনি একটা ধন্যবাদ দিয়ে ফেলে। নদীর ধারে টিলার উপর ছোট্ট কাঠের কটেজে থাকার ব্যবস্থা। নীচে বয়ে চলেছে সবজে রং এর ঋষি নদী। পাথরে ধাক্কা খেয়ে কোথাও আবার জলের রঙ শুভ্র সাদা, পরিষ্কার জলের নিচের রঙিন পাথর কুচি দেখা যায় স্পষ্ট।
খাওয়ার জায়গা কাঠের একটা দোতলায়, চারদিক খোলা, অয়নের ভীষণ পছন্দ হয়েছে জায়গাটা। ফার্মা কোম্পানিতে রিসার্চ করতে করতে সারাক্ষণ ঐ রাসায়নিকের গন্ধ শুঁকে জীবনের রসকষ গুলো হারিয়ে গেছিল। এই খোলা হাওয়ায় প্রকৃতির মাঝে এসে মন মাতাল হয়ে উঠেছিল তার।
বিকেলে দুজনেই নদীর বুকে নেমে পড়ল। দূরের পাহাড় থেকে বরফ গলা জল বয়ে আনছে ঋষি নদী। কনকনে ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে এক অন্য রকম শিরশিরানি, এক অন্য স্বাদের ভালো লাগা অনুভব করে দিঠি।
সূর্যের শেষ রশ্মিজালের ফাঁকে নাম না জানা পাখীর কলকাকলিতে আদিম অরণ্য যখন মুখরিত,একে একে ইউনিটের গাড়ি গুলো পাহাড়ি পথে এক কাঁচা রাস্তায় নেমে এসে নদীর ওপারে এসে দাঁড়ায়। বাঁশের আর কাঠের নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে সবাই একে একে এদিকে আসে।
রাতে চাঁদের আলোয় নদীর চরে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে বনমোরগ ঝলসে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা। সাথে কিছু গরম পানীয়। শীতের একটা হালকা আমেজ রয়েছে। উত্তরে হাওয়ায় বেশ ঠাণ্ডা লাগে। দিঠি একটা ছোট ভদকা নিয়েছে। অয়ন জৈন আর জিষ্ণুর হাতে হুইস্কি, ওরা নানারকম গল্পে মশগুল।
জৈন অবশ্য কিছুক্ষণ থেকেই নিজের ঘরে ফিরে যায়। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ আছে কিছু। ওর আ্যসিস্টেন্ট অভীক সরকার ওকে কিছু খবর দিচ্ছিল ব্যবসা সংক্রান্ত।
(চলবে)