সিল্ক-রুট সরগরম ৮
সিল্ক-রুট সরগরম ৮


জিষ্ণু বলে -"ঐ ঝরনায় শুটিং করার কথা আছে। আজ আর যাবো না। এখন ফিরে যাবো।"
অবশেষে বরফের উপর দিয়ে গাড়ি চলল ফিরে আবার নাথাংএ। ছোট ছোট জলাশয় জমে বরফ হয়ে আছে। সেই বরফ সরিয়ে কোথাও জুম চাষ হচ্ছে।
কিন্তু নাথাং এ যে ওদের জন্য আরো খারাপ খবর ছিল ওরা ভাবতেই পারে নি। বাবা মন্দিরের বাবাও ওদের ওপর রেগে আছে মনে হল।
প্রবল তুষার পাত মাথায় করে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ওদের গেস্ট হাউসে ফিরে ওরা শুনল সবার খাওয়া হয়ে গেছে। জৈন খেতে আসে নি। ঘরে খাবার চেয়ে নিয়েছিল। জিষ্ণুরা লাঞ্চ করে যখন ঘরে ফিরল বিকেল চারটা।
জিষ্ণু ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে উঠেছিল। যা শুনে দিঠি আর অয়ন গিয়ে দেখে জৈন মেঝেতে পড়ে রয়েছে চিৎ হয়ে।রক্তের ধারায় নীল কার্পেট কালো হয়ে গেছে। বুকের বা দিকে আমূলে বসানো এক কারুকার্য করা ভোজালি । দিঠি ভোজালিটা দেখেই চমকে উঠল। পাশে খাবারের প্লেট। খাওয়া শুরুও করে নি।
জিষ্ণু কথা হারিয়ে ফেলেছিল। ওর স্বপ্নের সিনেমার এই পরিণতি কখনো ভাবে নি ও। চিৎকারে বাকি যারা এই গেস্ট হাউসে ছিল সবাই এসে গেছে। বীভৎস দৃশ্য দেখে অঙ্কনা আর্তনাদ করে রায়ানের বুকে মুখ লুকালো। সবাই হতভম্ব। কি হবে এবার কেউ জানে না।
দিঠিদের ঘরে জিষ্ণুকে বসানো হল। ওর শরীর খারাপ করেছে। মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট এ একজন ডাক্তার ছিল, তাকেই সবাই খবর দিয়ে আনল। পুলিশ আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে। সবাই একসাথে থাকতে চাইছে, কেউ কাউকে ছাড়ছে না। অঙ্কনার শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। পুবালি বলে একটা মেয়েও অসুস্থ হয়ে গেছিল। ঋতেশের এ সব দেখে বুকে ব্যথা করছিল। একে প্রায় চোদ্দ-হাজার ফিট উচ্চতা, তাতে এমন প্রবল মানসিক চাপ কেউ আর নিতে পারছিল না। গেস্ট হাউসের মালকিন কেঁদেই চলেছে। আর ব্যবসা করতে পারবে না এখানে।
দিঠি কাঁচে ঘেরা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মরা জ্যোৎস্নার হলদেটে আলোয় বরফে মোড়া শ্মশান ভূমি মনে হচ্ছে এই নাথাংভ্যালীকে। এত নিস্তব্ধতা কবরের ভেতরকেও হার মানায়। তার লেখা গল্পের ওপর এমন অভিশাপ নেমে আসবে কখনো ভাবে নি। ঘুরতে এসে এই সিকিমের প্রেমে পড়ে গেছিল। আর এখন এই বাতাস কে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে এরপর কার পালা। বহুদিন আগে এমন একটা সিনেমা দেখেছিল। বরফের রাজ্যে এক এক করে সবাই মারা যাচ্ছে। আগাথা ক্রিস্টির একটা গল্প মনে পড়ছিল। এখন প্রথম কাজ সবাইকে নিয়ে সুস্থ ভাবে গ্যাংটক পৌঁছানো। প্রয়োজনে মিলিটারি সাহায্য নিতে হবে। আর একটা প্রাণও যাতে অকালে না ঝরে যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। দিঠি অয়ন কে বলে -"সবাইকে ডাইনিং এ আসতে বল। পুলিশ না আসা অবধি কেউ কোথাও যাবে না। তিনটে গেস্ট হাউসের সবাই এক জায়গায় থাকবো আজ। একজনকেও একা রাখা বিপদ।"
সবাই দিঠির কথা মেনে নেয়। অবশিষ্ট বত্রিশজন ডাইনিংএ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে মেঝেতে। চেয়ার টেবিল বের করে দেওয়া হয়।
পুলিশ এসে সব দেখে বলে পরদিন কমিশনার ও গোয়েন্দা বিভাগের লোক আসবে। বেঙ্গল পুলিশকেও ডাকা হয়েছে। সবাইকে পরের দিন গ্যাংটকে নিয়ে যাওয়া হবে। এবার কেস গুরুতর।
বাথরুমেও কেউ একা যেতে চাইছে না। অঙ্কনা,কেকা,,মৌ,পুবালি,জারিনা আর রেহানা একসাথে সামনের ঘরটায় গিয়ে বসে। ওরা সবাই কম বেশি অসুস্থ। বাকিরা ভাবছে এই অভিশপ্ত রাত কখন শেষ হবে। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়া হবে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। জিষ্ণুর চোখ আজ তরল না খেয়েই লাল। কেউ কিছু খেতেও ভয় পাচ্ছে এবার।
মদন অপরাধীর মতো মুখ করে বসে আছে। ও লোকেশন আর হোটেল ঠিক করেছিল। বাইরে আবার তুষার পাত শুরু হয়েছে।
হঠাৎ অয়ন বলে-" এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে সবার মানসিক চাপ বাড়বে। তার চেয়ে আমরা সবাই মিলে একটা খেলা খেলি। সবাই নিজেদের সম্পর্কে কিছু বলবো। এবং অন্য একজনকে নমিনেট করবো কিছু বলার জন্য। প্রত্যেকেই বলবে কিছু না কিছু।"
_"ভাল লাগছে না অয়ন। আমি চাপ নিতে পারছি না আর"বলে জিষ্ণু।
-"চাপ কমাবার জন্য এই খেলা। যারা অপরাধী নয় তারা হালকা হবে। আবার যে অপরাধী সে চাপে থাকবে। রাতটাও কেটে যাবে।"দিঠি বলে।
ঋতেশ বলে -"তার চেয়ে নম্বর চিট তৈরি করি, যে যা নম্বর পাবে পরপর বলবে। সময় তিন মিনিট থেকে পাঁচ মিনিট"
সবাই বলে সেই ভালো।ঋতেষ বলে বাকিদের ডেকে আনতে।রকি উঠে যায় ডাকতে।
অবশেষে খেলা শুরু হয়। প্রথম নম্বর ওঠে ফাইট ডিরেক্টর রেডির। ও ওর সিনেমা জীবনে আসার গল্প, কি ভাবে কোলকাতা এলো এসব বলে। জৈন ওকে প্রথম সুযোগ দিয়েছিল এটাও বলে।
পরেরটা মিস রেহানার। ও নিজের ক্যারিয়ার স্ট্রাগলিং এসব নিয়ে বলে। বাংলা বইতে এটাই ওর প্রথম কাজ।
তিন নম্বর ওঠে অয়নের, ও দিঠির সাথে ওর প্রেমের গল্প বলে। এরপর ওঠে মদনের। ও যে খুব গরীবঘর থেকে যুদ্ধ করে এপথে এসেছে তা বলে। ওর বাবা মা ওর এই সিনেমা জগতের সঙ্গে কাজ ভালবাসেনা তাও বলে।
এভাবেই কয়েক জন পর আসে জিষ্ণুর চান্স। ও ওর ক্যারিয়ার আর ফিল্মলাইন নিয়ে বলছিল। কিন্তু ও এক মিনিটেই হাফিয়ে যায়। ক্ষমা চেয়ে বলে ও পারছে না আর কিছু বলতে।
এরপর আরো দু জন জানায় নিজেদের কথা।
ঋতেশ হঠাৎ বলে -"অঙ্কনাদিদের সাড়া নেই । একবার দেখে আসবো নাকি?"
রোহিত বলে -"বেশ জমে গেছে। ওদের ডেকে আনি বেশ হবে।" দুজনেই উঠে যায় বাইরে।ওদের ডেকে আনে।
নেক্সট্ হোটেলের মালকিন। তার এই ভালো ব্যবসা সিনেমার চক্করে বন্ধ হবে তাই নিয়ে বকে চলে। তাদের পরিবারে নাকি এই সব সিনেমায় নামা খারাপ চোখে দেখা হয়। এই লাইনে গেলে সবাই ভেসে যায় এ সব বলে। মদন ওনার দাদার ছেলে বলে উনি রাজি হয়েছিলেন এই ইউনিটকে রাখতে। এমন আরো অনেক কিছু।
এরপর ঋতেশ, ও নিজের জীবনের গল্প করে। লেখক হতে চেয়েছিল, সিনেমার ডায়লগ্ লিখতে গিয়ে নিজের লেখা হারিয়ে গেছে।আরকজন ক্যামেরা ম্যানও গল্প লেখে, সে বলে তার গল্পের কয়েকটা চরিত্রের কথা।
এদিকে কুড়ি নম্বরে আসে শালু। ওর মা বাবা নেই। ও মাসির কাছে জুলুখে মানুষ। এখন গাড়ি চালায় বলে সারা সিকিম হাতের মতো চেনে এমন অনেক জায়গা জানে যেখানে সবাই যেতে পারেনা এসব বলে।
জারিনা বলে প্রকাশজি তাকে এ লাইনে এনেছিল। আজ সে নেই জারিনা মানতে পারছে না। প্রকাশজি তাকে বিষ দিতেই পারে না। এখানে তার একজনই শত্রু। অবশ্য নাম বলে না। কিন্তু অনেকেই দেখে অঙ্কনার চোখ দুটো জ্বলে উঠলো।
অঙ্কনা বলে নিজের ক্যারিয়ারের কথা। রায়ান তার ভালো বন্ধু, কেকা কিভাবে তার জীবনে এলো এসব বলে।
এভাবেই দেখতে দেখতে ভোর হয়। আবার একটা নতুন দিন। সবাই রেডি এই অভিশপ্ত জায়গা ছেড়ে যাওয়ার জন্য। দিঠির মাথায় একটা প্রশ্ন বার বার ঘুরে আসে। সকালে গ্যাংটক থেকে দুগাড়ি পুলিশ আসে। সিকিম শান্তিপ্রিয় লোকেদের জায়গা। চুরি ছিনতাই খুন জখম খুব কম হয় এখানে।
কিন্তু প্রকাশ আর জৈন দুজনেই ক্ষমতাবান। অর্থ প্রচুর এদের। তাই ওপর থেকে চাপ এসেছে এই সব খুনের কিনারা করতেই হবে। হেলিকপ্টারে বেঙ্গল পুলিশের দুই অফিসার এসেছে । সিকিম পুলিশ নাকি ওদের সাহায্য চেয়েছে। তারা সব খুঁটিয়ে দেখল। সবার বয়ান নিলো। এরপর দিঠি ,অয়ন আর জিষ্ণু আলাদা করে বসলো ওদের সাথে। অনেকক্ষণ আলোচনার পর আবার সবাইকে ডাইনিংএ ডাকা হল। সবাইকে গ্যাংটক নেওয়া হবে শুনে সবাই খুব খুশি।(চলবে)