সিল্ক-রুট সরগরম ৬
সিল্ক-রুট সরগরম ৬


জিষ্ণু খুব আপসেট্। রোজ কিছু না কিছু হচ্ছে এখানে। কেউ যেন ওর শুটিং বন্ধ করতে চায় যে কোনো উপায়ে। মহরতের পূজাটা ঠিকঠাক হয় নি মনে হয় মাঝেমাঝে।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শুটিং শুরু হল । কিন্তু দিনের আলো কমে আসছিল। ওয়েদার খারাপ হয়ে গেল একটু পরেই। আসলে এই উচ্চতায় বেলা বাড়ার সাথে সাথেই ওয়েদার খারাপ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও মাত্র দুটো শট্ নেওয়া গেল। প্রবল তুষার পাতে সবাই গৃহবন্দি। কাচের বড় ডাইনিং এ বসে পপকর্ন আর কফি খেতে খেতে সবাই গল্প করছিল। কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। সবাই একটু চুপচাপ। আসলে সবাই ভাবছে জারিনাকে নিয়ে।
রাত দশটা মানে নাথাংএ মাঝ রাত।তুষার পাত বন্ধ হয়ে গেছিল আটটা নাগাদ। ঝকঝকে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। বরফের চাদরে মোড়া নাথাংভ্যালী সেই আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে। কে বলবে একটু আগেও এখানে কি বাজে ওয়েদার ছিল। জিষ্ণু হাসি মুখে শট্ রেডি করতে ব্যস্ত। বেশ ভালো ভাবে কাজ শুরু হল রাতে।
দিঠি আর অয়ন রাত একটার পর শুতে চলে গেলো। এত ঠান্ডায় এ ভাবে রাতে বাইরে থেকে দুজনেরই মাথা ধরে গেছিল। অক্সিজেনের অভাবে সবার মাথা ধরে যাচ্ছে। দৌড়াদৌড়ি করলেই বুকে চাপ পড়ছে।
দিঠি শুয়ে শুয়ে ভাবছিল সিনেমা তৈরি হলে লোকে নায়ক নায়িকা ডিরেক্টর আর বিশেষ চরিত্র কে মনে রাখে। অথচ একটা সিনেমা বানাতে পর্দার পিছনে যে এতগুলো লোকের অক্লান্ত পরিশ্রম তাদের কেউ চিনবেও না। এই যে ইউনিটের এতো গুলো ছেলেমেয়ে এই ঠান্ডায় রাত জেগে এই বরফে ঘেরা পাহাড়ের মাথায় এত কষ্ট করছে কেউ জানবে না। পর্দায় এদের নাম কেউ পড়েও দেখে না। নায়ক নায়িকার অভিনয় দিয়ে সিনেমাটার বিচার হবে ভাল কি খারাপ। এ ভাবে ঘুরতে না এলে দিঠিও এতো কিছু জানতে পারতো না।
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। ভোর রাতে সবার দৌড়াদৌড়ি চ্যাঁচামেচিতে ওর ঘুম ভাঙ্গে। তাড়াতাড়ি জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বাইরে এসে যা শুনতে পায় ও আশা করে নি। প্যাসেজের শেষ মাথায় উল্টে পড়ে রয়েছে প্রকাশজির দেহ। কাল প্রকাশজি তাড়াতাড়ি শুতে এসেছিল। সবাই শুটিং এ ব্যস্ত ছিল। জিষ্ণু গায়ে হাত দিয়ে দেখে সব শেষ। ঠোটের কষ বেয়ে নেমেছে রক্তের ধারা। অয়ন ভাল করে দেখে বলে যে সেই একই বিষ মনে হচ্ছে। কাল কেউ না থাকায় ও কাউকে ডাকতেও পারেনি। সারা রাত শুটিং করে ভোর চারটায় জৈন আর বিষ্ণু ঘরে ফিরে দেখে এ অবস্থা। অন্ধকার প্যাসেজটা এ মাথায় এসে এল শেপে ঘুরে গেছে। তাই আগে কারো চোখে পড়েনি। জিষ্ণুরা এক ই ঘরে ছিল। তাই ঘরে ফিরতে গিয়ে ওরা দেখতে পায়।
পুলিশে খবর দিতে দেরি হচ্ছিল,কারণ রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। মিলিটারি ক্যাম্পে খবর করা হয়েছিল। ওরা চেষ্টা করছিল থানায় জানাতে।
অয়ন সবাইকে বলে, পুলিশ না আসা অবধি কেউ যেন আর বডিতে হাত না দেয়। জিষ্ণুদের ঘরে ঢুকতে বারণ করে। ওদের ঘরে বসতে বলে জৈন আর জিষ্ণুকে। অবশ্য অতবড় শরীর ডিঙ্গিয়ে কেউ ঢুকতেও পারবে না। এমন ভাবে পড়েছে প্রকাশজির বডি। দিঠি ঐ ঘরে উঁকি মেরে দেখতে যায় কিন্তু কিছু দেখা যায় না।
জিষ্ণু এদিকে ভেঙ্গে পড়েছে। বলছে-"আর এখানে শুটিং করা যাবে না। পঁচাত্তর ভাগ হয়ে গেছিল। এখন প্রকাশজি না থাকায় এবার সব শেষ হয়ে গেলো। কে দেবে বাকি খরচা ?"
জৈন খুব আপসেট্, এই ঠাণ্ডাতেও দরদর করে ঘামছে। বলছে কলকাতা ফিরে যাবে। ওর কাজ আছে কি সব। নায়ক নায়িকা হতভম্ব। সবাই ফিরতে চাইছে।
কিছুক্ষণ পরে পুলিশ এলো। এক এক করে সবার বয়ান নিলো। অয়ন মিডিয়া লাইনে আছে জেনে বহুক্ষণ আলোচনা করলো। অয়ন বলেছিল, বিষ খেয়েছে মনে হচ্ছে দেখে। দিঠির হাসি পাচ্ছিল পুলিশরা অয়নকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছিল তা দেখে। বডি পোষ্টমর্টমে গেলো। ওদিকে জারিনা সুস্থ, খবর এসেছে।পরদিন ওর ছুটি হলে জিষ্ণুর আ্যসিস্টেন্ট রোহিত ওকে নিয়ে নাথাং এ আসবে বাকি কাজ শেষ করতে। ওরা তখনো জানে না প্রকাশ-জির খবর। পুলিশ কে জারিনা কারো নাম বা কিছুই বলে নি।
পুলিশের রুটিন তদন্ত দেখে দিঠি বুঝতে পেরেছিল ওরা বেশ দিশাহারা এ সব দেখে। সবাইকে জেরা করছিল পুলিশ অফিসার । তবে দিঠি ও অয়নের সাথে অফিসারের ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। কারণ কমিশনার অয়নের বন্ধু , সে ফোন করে দিয়েছিল। সিকিমের পুলিশ এমনিতে খুব ভাল। আসলে সিকিমে ক্রাইম হয় না বললেই চলে।
প্রকাশজির ঘরে একটা হুইস্কির বোতল খোলা ছিল, বোধহয় একাই খাচ্ছিল। ডাইরেক্ট,'র',কারণ গ্লাস নেই কোথাও। ওকে আগের দিন রাতেও 'র' খেতে দেখেছিল দিঠি।
দিঠির কল্পনাপ্রবণ মন ডানা মেলেছিল । ও সবাইকে সন্দেহ করতে শুরু করে দিয়েছিল। বিশেষ করে অঙ্কনাকে। কিন্তু অঙ্কনাকে সন্দেহ করার কোনো ক্লু নেই। অয়ন একাই বসে ছিল ডাইনিং এ। ল্যাপটপে ফটো লোড করছিল ক্যামেরা থেকে। হঠাৎ একটা ফটোতে ওর চোখ আটকে যায়। ঠোটের কোনে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
সকাল থেকে এককাপ কফি খেয়েছে ওরা। হোম-স্টের মালিক খুব চিন্তিত। ওর এখানে খুন হয়েছে বলে নাকি আত্মা এখানেই থেকে যাবে, আর কেউ এখানে থাকতে চাইবে না। আশে পাশের হোম-স্টেতে যারা আছে তারাও ভেঙ্গে পড়েছিল। একটা খুনি এ ভাবে সবার মাঝে লুকিয়ে আছে ভেবে সবাই সবাইকে সন্দেহ করছিল। কেউ মন খুলে কথা বলছিল না।
দিঠি নিজের ডাইরিটা বের করতেই অয়ন ল্যাপটপ নিয়ে এসে বসল। বলল -" কি ভাবছ ? কে করছে এসব বুঝলে কিছু? "
-" আমার প্রথম প্রশ্ন মৌ কি দেখে ভয় পেয়েছিল?ওর হাতের 'আর্' টা কে? কে ওকে ডেকেছিল?"
দিঠির প্রশ্ন শুনে অয়ন বলল-"মৌ কি দেখে ভয় পেয়েছিল জেনেছি, তবে ভয় কে দেখাল, আর কেন এগুলোর উত্তর মৌ এর কাছেই আছে। ওকে চেপে ধরতে হবে।"
দিঠি একটু অবাক হতেই অয়ন ওকে জুম করে একটা ফটো দেখায়। দিঠি ভাল করে লক্ষ্য করে হেসে ফেলে।
-"এরপর , জারিনাকে কে বিষ দিলো আর কেন?"
-"এর উত্তর নানা রকম হতে পারে। ওকে এই ইউনিটে অনেকেই পছন্দ করে না। রাগের থেকে দিতে পারে। বিষটা মনে হয় লোকাল, জারিনার সাথে আসলে কথা বলতে হবে।"
-"প্রকাশজিকে মেরে কার লাভ হল? কে মারল?"
-" লাভ ক্ষতি জানি না। মদের বোতলে বিষ পাওয়া যাবে জানি। তবে ও মরে সবার ক্ষতি হল। সিনেমা শেষ হতে দেরি হবে। সবার টাকা পেতে দেরি হবে।"
অয়ন জানালা দিয়ে দেখছিল শালু এই হোটেলের মালিক মালকিন কে কি যেন বোঝাচ্ছে, মাঝে মাঝে মালকিন কে জড়িয়ে ধরছে। সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে কাছাকাছি গিয়ে বুঝল সিকিমিজ্ ভাষায় কিছু বলছে ও।
একটু পরে মালকিনকে একা পেয়ে অয়ন হিন্দিতে বলল-"শালু কাঁহা গ্যয়া?"
উনি বলেন বাইরে কোথাও হবে। ডেকে দেবে কিনা। অয়ন বলে -" থোরা দের পহেলে আপকো কুছ বোল রহা থা। উপর সে দেখা......."
ওরা বলল যে ও সান্ত্বনা দিচ্ছিল যে টুরিস্ট আসবে। এসব নিয়ে ভাবতে না বেশি। ও টুরিস্ট আনবে সব সময়। আসলে ও সবাইকে খুব ভালবাসে।
অয়ন হিন্দিতে বলে-" এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।"
-"বাবু, হামলোগ সিধা আদমি হ্যায়। ইয়ে ফিল্মিলোগ বহত্ গন্ধা হোতা হ্যায়। যবভি আতা হ্যায় বরবাদি কা বুলাৰা সাথ লাতা হ্যায়। কোই উনহে্ ঘর নেহি দেতা হ্যায়।" সিনেমা ওয়ালাদের বিশ্বাস করে না ওরা বুঝিয়ে দিলো।
দিঠির খুব কৌতূহল হয়। বলে যে এর আগেও এমন হয়েছে নাকি।
মহিলা একটু তাকিয়ে থেকে যা বলে তা এই যে, এরা এলেই এলাকার উঠতি বয়সী মেয়েদের ক্ষতি হয়। এরা মেয়েদের ফাঁসায়,পরে ভোগ করা হলে ছেড়ে দেয়।(চলবে)