Drishan Banerjee

Thriller Crime

3  

Drishan Banerjee

Thriller Crime

সিল্ক-রুট সরগরম ৫

সিল্ক-রুট সরগরম ৫

6 mins
7.1K


পরদিন সকালে জারিনার শুট্ ছিল। বেশ ভালো ভাবেই ওকে ঢুকিয়েছে ঋতেশ বাবু ,জিষ্ণুর স্ক্রিপ্ট রাইটার। জারিনা আজ হিরোর সাথে নাচবে। এই ঠাণ্ডায় এতো অল্প পোশাকে ওকে কেমন লাগছিল দিঠির। শট্ শেষ হলেই ওকে কম্বলে মুড়ে দেওয়া হচ্ছিল। নাচের দৃশ্যের পর ও ফিরে গেলো ওর রিসর্টে। জৈন ওর সঙ্গে গেল। প্রকাশজি আজ অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল।

অঙ্কনার কিছু শুট্ ছিল। এরপর ভিলেন নায়িকাকে নিয়ে পালাচ্ছে জিগজ‍্যাগ্ রোডে, হিরো বাইকে তাড়া করছে। বেশ ভালোই চলছিল। লাস্টে হিরো বাইক নিয়ে পড়ে যাবে। সেই সময় হল বিপত্তি। রায়ানের ড‍ামি করছিল একটা লোকাল ষ্টান্টম্যান।সে বাইক নিয়ে গিয়ে পড়লো একটা বড় পাথরে। আর পাথরটা গড়িয়ে গেল নিচে। রাস্তা এমন জিগজ‍্যাগ্ যে নিচের প্রতিটা রাস্তা ছুঁয়ে সেই বড় পাথরটা নিচে নামতে লাগল। সবাই ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করছিল,নিচ থেকে উঠে আসা কোনো গাড়িতে আঘাত লাগলেই বিপদ। জারিনাদের গাড়িটা বহু নিচে দেখা যাচ্ছিল। সবার হার্ট-বিট বেড়ে গেছিল। কিন্তু তেমন কিছু হল না।

 হঠাৎ ঝিরঝির করে বরফ পড়তে শুরু করলো। ইউনিটের সবাই খুব খুশি। দারুণ লাগছিল। যদিও জিষ্ণুর মুখ ভার। বরফ পড়া বন্ধ না হলে বাকি শুটিংটা হবে না। মদন ওকে গাড়িতে বসতে বলল,এমন বরফ পড়া নাকি সাময়িক। একটু পরেই বন্ধ হয়ে যাবে। কুয়াশায় নিচের রাস্তাগুলো ঢেকে যাচ্ছে। জিষ্ণু,রায়ান,দিঠি আর অয়ন একটা গাড়িতে উঠে বসেছিল। অঙ্কনা ফিরে যেতে চাইছিল। ওর শট্ শেষ সেদিনের মতো। মদন সবাইকে গরম গরম কফি খাওয়াচ্ছিল। রাস্তা বরফে ঢেকে যাচ্ছে, ক্যামেরাম্যান সে সব তুলতেই ব্যস্ত। হঠাৎ দিঠির খেয়াল হল জারিনা আগেই ফিরেছে। অঙ্কনা ওর বন্ধুর সাথে একা ফিরে গেল যদি কিছু হয়!! দিঠি জানে এখন ও যতক্ষণ না ফিরে নিজে চোখে সব দেখবে,শান্তি পাবে না। ও তাড়াতাড়ি অয়নকে বলে -" আমার মাথাটা ব্যথা করছে। আমি ফিরে যেতে চাই" ।

জিষ্ণু বলে -"অঙ্কনা তো যাচ্ছে, ওর সাথে চলে যা তাহলে। অয়ন ক্যামেরা ম্যানের থেকে কি শিখবে বলছিল।"

দিঠি এটাই চাইছিল। জিষ্ণু ওকে গাড়িতে তুলে দিলো। তুষারপাত্ বন্ধ হলেও নেমে এসেছে মেঘের মতো সাদা কুয়াশা। কিন্তু এই কুয়াশায় এক হাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছেনা। আর পথ বরফে ঢাকা। ড্রাইভার বলল ওয়েদার পরিষ্কার না হলে এই পথে গাড়ি চালানো যাবে না। অগত্যা ওরা গাড়িতেই বসে থাকলো। দিঠির সাথে অঙ্কনার পরিচয় প্রথম দিন হলেও বাংলা ছবির এই নায়িকা খুব অহংকারী ও গম্ভীর। কথাই বলেনা প্রয়োজন ছাড়া। দিঠি আবার চুপচাপ থাকতে পারেনা। একটু পরেই দিঠি বলল -" বেশ ভালো লাগছে এভাবে স্নোফল দেখতে, তাই না?"

অঙ্কনা একটু হেসে একটা ম্যাগাজিন টেনে নেয়। ওর সাথে যে মেয়েটি থাকে সে ওকে আরেকটা পেপারের মাঝের বিনোদনের পাতা এগিয়ে দেয়। বলে-"এটা কাল পেয়েছি। পড়ে দেখো ।"

দিঠি নামটা দেখে। উত্তর বঙ্গের একটা দৈনিক। হেডিংটাও চোখে পড়ে, "নতুন ছবিতে একসাথে দুবোন।" পাশে বড় করে জারিনার ছবি,আর ছোট করে অঙ্কনার। অঙ্কনা হেডিং দেখে পেপারটা ছুঁড়ে দেয়। বলে-" জিষ্ণুকে আগেই বলেছিলাম আমি,ও থাকলে কাজ করবো না। ও বলেছিল একটা ছোট্ট রোলে নিয়েছে। আর এখন রোজ গল্প বদল হতে হতে ওকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এবার আমিও দেখাবো আমি কি করতে পারি। বইটাই নষ্ট করে দেবো।" রাগে ওর মুখটা থমথম করছে।

দিঠি জানতো না ওরা দু বোন। পেপারটা তুলে খবরটা পড়ে। লিখেছে ওদের বাবা এক,মা আলাদা।বাবা ছিলেন সিনেমার সহকারী পরিচালক। প্রথম বৌকে ছেড়ে একটা উঠতি সাইড এ্যাকট্রেসের সাথে থাকতো। বিয়ে হয় নি, তাদের মেয়ে জারিনা। অঙ্কনার দু বছরের ছোট জারিনা। এখন ওদের বাবা নেই। পেপারে এই সিনেমাটার কথাই লিখেছে যে,রেশম পথে শুটিং চলছে জিষ্ণু সেনের নতুন ছবির। নাম দেয় নি।

 দিঠি এবার সাহস করে বলে,-"আমার গল্পটা পড়েছিলেন। ওখানে ঐ অন্য মেয়েটার চরিত্রকে ওভাবে দেখাই নি। ও শুধু মিমির কল্পনাতেই ছিল। এরা সিনেমার স্বার্থে এসব বদলাচ্ছে।"

-" লোকেশনটাও তো বদলাল। আগে জানতাম সিমলায় হবে, এখন এখানে। এই পাহাড়ে নাকি বরফ পাবে বেশি!!"

দিঠি বলে-" গল্পটা সিমলাকে ঘিরে লিখেছিলাম। ওদিকে টুরিস্ট বেশি, তাই শুটিং এর প্রবলেম্। আর এই সিল্ক-রুটে শুটিং কম হয়। খরচও কম।তাই ওরা এদিকেই এলো।"

এমন টুকটাক কথার পর হঠাৎ ড্রাইভার বলল যে সবাইকে নামতে হবে। চেন জড়াতে হবে চাকায়। রাস্তায় যা বরফ গাড়ি স্কিড্ করতে পারে। এ এক অন্য রকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ওরা নেমে দেখে কুয়াশাও কেটে গেছে, আকাশ পরিষ্কার। কিন্তু রাস্তায় প্রচুর বরফ।

কিছুক্ষণ পর চাকায় চেন লাগিয়ে গাড়িটা নামতে শুরু করলো।

উপরে আবার শুটিং শুরু হয়ে গেছে।

বিকেলে জিষ্ণু ফিরে বলল -"কাল সকাল থেকে নাথাং এ শুটিং, সবাইকে যেতে হবে। রাতে একটা মোটামুটি থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। নায়ক নায়িকার চাঁদনী রাতে বরফের দৃশ্য আছে। পরদিন ফুলমুন নাইট। যদি বরফ না পড়ে সারা রাত শুটিং হবে। মিলিটারিরাও হেল্প করবে বলেছে। সব ব্যবস্থা রেডি।"

 রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি মিটিয়ে সবাই শুয়ে পড়েছিল। ঘুম নেই দিঠির চোখে। কি যেন একটা সন্দেহ ওকে কুরে-কুরে খাচ্ছিল সারাক্ষণ।

কিন্তু পরদিন সকালে নতুন বিপত্তি শুরু হল। মাঝরাত থেকে জারিনার বুকে ব্যথা আর শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। ওর রুমে আর কেউ ছিল না, পাশের ঘরে ড্যান্স ডিরেক্টর মিস রেহানা ছিল। তাকে ডাকতে এসে ও অজ্ঞান হয়ে যায়।

সবাই প্রথমে ভেবেছিল উচ্চতাজনিত কারণে অসুস্থতা,কিন্তু কটেজের মালিক কোনো রিস্ক না নিয়ে ওকে মিলিটারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে ও রক্তবমি করতে শুরু করে। সারারাত ওকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি চলে, ভোরের দিকে ওকে নিচে রোংলি পাঠানো হয়। ডাক্তার বলেছিল ওর খাবারে বিষ ছিল। কোনো লোকাল বিষ।

দিঠি ভাবছিল ডিনারে সবাই একসাথে খোলা জায়গায় খেয়েছে। একমাত্র অঙ্কনা আর জৈন ঘরে খেয়েছে। তাহলে জারিনার খাবারে কে কি মেশাল!! আর কিভাবে এতো লোকের মাঝে বিষ মেশাল?

চোখ বন্ধ করে দিঠি ভাবতে থাকে, তিনটে হোম-স্টের মাঝের ফাঁকা জায়গায় বড় করে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে ঘিরে খাবার ব্যবস্থা ছিল, কাল রাতে ছিল সুপ, রুটি মাংস, পনীর,পাস্তা আর স্যালাড্। ডেজার্টে ছিল কাষ্টার্ড। জারিনাকে শুধু পাস্তা আর স্যাালাড্ খেতে দেখেছিল যতদূর মনে পড়ে। তবে ড্রিঙ্ক করেছিল একটু। কিন্তু কে ওকে বিষ দিল আর কেন?

দিঠি জানতো অঙ্কনা ও জারিনা দুজন দুজনকে দেখতে পারে না। অঙ্কনা আর ওর বান্ধবী কেকা ঘর থেকে বের হয়নি।ওদের খাবার ঘরে দিয়ে আসা হয়েছিল। জৈনের খাবার নিয়ে গেছিল শালু। বাকিরা সবাই নিজের খাবার নিজেই নিয়ে খেয়েছিল। তবে কে ওর খাবারে বিষ দিলো?

সব ঝামেলা মিটিয়ে ওরা দুপুরে রওনা দিলো আবার সেই জুলুখের প্যাঁচালো জিলিপি রাস্তা ধরে, সব গাড়ি লাইন দিয়ে চলল নাথাং ভ‍্যালির পথে।প্রকাশের ইচ্ছা ছিল জারিনার সাথে থাকার। কিন্তু পুলিশের জেরার ভয়ে চলে এসেছে। মদন একজন কে রেখে এসেছে সব সামলানোর জন্য। ইউনিটের একজন আর জিষ্ণুর অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে গেছে ওর কাছে। ওকে দু-এক দিনের মধ্যে ছেড়ে দেবে হাসপাতাল। ও আর শুটিং এ আসবে কিনা এই নিয়ে সবাই চিন্তিত। ওর অল্প কাজ এখনো বাকি। এদিকে প্রকাশজি বলেছেন সুস্থ হলেই ওকে পাঠানো হবে কলকাতা।

দিঠির খুব ইচ্ছা ছিল ওর সাথে কথা বলার। সুযোগ হয় নি। সিকিম পুলিশের সাথে জিষ্ণুর রিলেশন ভাল। তাই ওদের এগিয়ে এসে শুটিং করতে দিয়েছে পুলিশ । অয়ন এ ব‍্যপারে হেল্প করেছিল। ওর সিকিমের উপরমহলে ভালই পরিচিতি।তবে ইউনিটের কেউ সিকিমের বাইরে কোথাও যাবে না বলে দিয়েছে পুলিশ। জারিনার ঘর সার্চ করেছিল পুলিশ। একটা জলের বোতল,একটা ভদকা আর একটা কফ্ সিরাপের শিশি ফরেন্সিকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যেটা দিঠিকে অবাক করেছে ঘরের মধ্যে ভোজালিটা পুলিশ পায় নি। ওর ব্যাগ তল্লাশি হয়েছিল দিঠির সামনেই। দিঠি ভাবে,তবে কি ও ওটা কাউকে দিয়ে দিয়েছে?দিঠি ভেবেছিল প্রকাশজিকে একবার জিজ্ঞেস করবে সুযোগ পেলে।

 

বরফে মোড়া ছোট্ট গ্ৰাম নাথাং, উচ্চতা প্রায় চোদ্দ-হাজার ফিট, একটা মিলিটারি  ক্যাম্পকে ঘিরে গোটা পঞ্চাশেক বাড়ি। সব বাড়ির চাল বরফে মোড়া। সারা রাত তুষারপাতের পর সকালে তাপমাত্রা মাত্র চার। রাতে নাকি মাইনাস দশ হয়ে যায়।

 

বেশির ভাগ বাড়িতেই হোম স্টে বা গেস্টহাউস রয়েছে। দিঠিদের একটা কাঠের দোতলা বাড়ির উপর তলায় জায়গা হল। ঘরের একটা দিকে বড় কাচের জানালা। প্রচুর বরফ চারদিকে। ভ্যালিতে বরফের ফাঁকে ফাঁকে আলু চাষ হয়েছে। কোথাও সবুজ কিছু চোখেই পড়েনা। গাছপালা নেই বললেই চলে। পাহাড়ের মাথাগুলোয় বাঙ্কার। এসব জায়গায় শুটিং করতে সেনাবাহিনীর অনুমতি লাগে, যা জিষ্ণুর ঝুলিতে রয়েছে। অয়ন খবর করতে এর আগে এদিকে এসেছে। ওরও ভালই পরিচিতি। দিঠির ঠিক পাশের ঘরে অঙ্কনা ও কেকা থাকবে ঠিক হল। ওধারের ঘরে মৌ-রা তিনজন। শেষ ঘরে জৈন,জিষ্ণু আর প্রকাশজি। বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশেপাশের বাড়িতে।(চলবে)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller