STORYMIRROR

সাইনি রায়

Comedy Horror

4  

সাইনি রায়

Comedy Horror

শ্যাওড়া সুন্দরীর বিয়ে

শ্যাওড়া সুন্দরীর বিয়ে

6 mins
666

"দ্যাখ ও পাড়ার পুঁটু ডাইনিরও বিয়ে হয়ে গেল আর তুই শুধু একটার পর একটা ছেলে নাকচ করে যা।"

"ওর তো লাভ ম্যারেজ মা।"

"তা তোকে কে করতে বারণ করেছে? না নিজে করছিস আর আমার আনা সম্বন্ধগুলো শুধু খারিজ করছিস। "

কি ভাবছেন?বিয়ে নিয়ে অভিভাবক সন্তানের এই দড়ি টানাটানি শুধু মনুষ্য সমাজেই প্রচলিত? আজ্ঞে না এটা ভূতেদের সমাজেও সমানভাবে প্রসিদ্ধ। অবশ্য মানুষ মরলে তবেই তো ভূত হয়, তাই নিয়ম খুব একটা আলাদা হওয়া উচিৎ নয়। 

"তোর তো কাউকেই পছন্দ হয় না।কিছু না কিছু খুঁত বার করবিই তুই।আরে সবার সবটা থাকেনা।"

"দ্যাখো মা,আমি সুন্দরীর সুন্দরী শ্রেষ্ঠ শ্যাওড়া সুন্দরী। সবাই আমায় এমনিই রানী নাম দেয়নি। আমি যা তা কাউকে বিয়ে করি কি করে?"

"তুই ওই নিয়েই থাক।মামদোকে তোর পছন্দ হল না।"

"ধুর নামটাই তো কেমন হুমদো হুমদো মার্কা।বিয়ে করলে সবাই যখন বলবে-কিরে মামদোর বউ?ইস্ ছিঃছিঃ ভাবা যায় না। "

"উফ্ নামে কি আসে যায়?আচ্ছা বেশ,না হয় মেনে নিলাম।কিন্তু বেহ্মদত্যি?সে তো বাউন ছিল।"

"হ্যাঁ আর সে বাউন প্রেমিকার কাছ থেকে দাগা খেয়ে সিলিং ফ্যানে গিয়ে ঝুলল।হাসতে দেখেছো ব্যাটাকে?দাঁতের আগে জিভ বেরিয়ে পড়ে।চলবে না। "

"তোকে নিয়ে আর পারা গেল না।দ্যাখ আবারও বলছি।আচ্ছা বেশ,এদের কথা বাদ দে।কিন্তু এই যে ছেলেটার সম্বন্ধ এসেছে,এ সত্যিই ভালো। মরার আগেও যেমন মরার পরেও তেমন।আর দ্যাখ একা থাকে তোকে কোনও ঝঞ্ঝাটই নিতে হবে না।শুধু দুজনে থাকবি।"

"আমি কি দায়িত্ব নিতে ভয় পাই না কি?আমার কথা হল যার মাথাই নেই তার গলায় মালা দেব কি করে?"

এবার আসা যাক পাত্রের কথায়।

পাত্রীর মায়ের কথা অনুযায়ী পাত্র শুধু মরার পরে নয় জীবিতাবস্থাতেও যথেষ্ট ভালো ছিল।ভূতটাকে একটু তলিয়ে দেখা যাক।পাত্রের নাম-ভূতনাথ। একটা বেসরকারী স্কুলের শিক্ষক ছিল।খুব পরোপকারী ছেলে ছিল।লোকজনের পাশে সবসময় দাঁড়াতো।জাতী-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত।তাছাড়া নানারকম সামাজিক কাজকর্মের সাথেও যুক্ত ছিল।রক্তদান শিবির থেকে শুরু করে কোনও গরীবকে প্রয়োজনমতো সাহায্য করা,সবকিছুতেই সে ছিল সিদ্ধহস্ত ।চোলাই মদের দোকান বন্ধ করা হোক বা রাস্তায় কোন মেয়েকে উত্যক্ত করলে তার প্রতিবাদ করা,এসব কিছুতে ভূতনাথই একমাত্র ভরসা ছিল।

একবার পথচলতি এক তরুণীকে কয়েকটি ছেলে কটূক্তি করায় তাদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে ভূতনাথ।এক শীতের সন্ধ্যায় সুনসান ফাঁকা রাস্তা ধরে একা ফিরছিল সে।ছেলেগুলো তক্কেতক্কে ছিল।প্রথমে পিছন দিক থেকে মুখে গামছা বেঁধে তুলে নিয়ে যায়।তারপর ওই অবস্থায় হাত-পা বেঁধে বেধড়ক মেরে আধমরা করে রেললাইনে ফেলে দিয়ে আসে।বেচারা সাহায্যটুকু চাইবার সময় পর্যন্ত পায়নি। ছুটে আসে এক্সপ্রেস ট্রেন। পঁয়ত্রিশ বছরের তরতাজা প্রাণটা দেখতে দেখতে শেষ। আজও ভূতনাথ তার মাথাটা খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু পায়নি। পাত্র জাতে স্কন্ধকাটা। যদিও অশুভ শক্তির কল্যাণে সে কথা বলতে পারে।তবুও গোল থামছে না। পাত্রীর শুধু একটাই বক্তব্য, যার মাথা নেই তার সাথে মালাবদলই কি করে হবে আর শুভদৃষ্টিই বা কি করে হবে?তাই পাত্রীর মায়ের হাজার বোঝানো ধোপে টিকছেনা।একমাত্র ভগবান ইয়ে মানে ভূতের রাজাই ভরসা। তিনিই যদি কোনওরকম ব্যবস্থা করতে পারেন।আজ্ঞে হ্যাঁ ইনিই সেই ভূতের রাজা আর ইনিই ভূতেদের ভগবান। যার হাতে ভূতেদের ইহকাল পরকাল সবকিছু নির্ভর করছে। ভাগ্যিস রায় মশাই ছিলেন নাহলে ভূতেদের এমন দিলদরিয়া রাজার কথা কে-ই আর জানত!পাত্রীর মায়ের এহেন কাতর প্রার্থনা ভূতেদের ভগবান শুনেছিলেন কিনা কে জানে?কিন্তু পাত্রী তো স্কন্ধকাটাকে বাতিল করে দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছে। 

         প্রত্যেকবারের মতো এবারেও ভূতমহল বেশ আনন্দের সাথেই ভূতচতুর্দশী উদযাপন করল।এইসময় যে যে ভূতেরা বাইরের বড় শহরে থাকে তারা বছরের এই একটা দিন অন্তত দেশের বাড়িতে ফিরে এসে আনন্দ উল্লাস করে।যেমন,রোগাভূত-মোটাভূত দুই ভাই।বহুবছর এরা কর্মসূত্রে বাইরে থাকে।প্রত্যেক বছরের মতো এবারেও ওরা ভূতচতুর্দশীতে সামিল হতে দেশের বাড়িতে এসেছে। শ্যাওড়া সুন্দরী একমাত্র সন্তান। ছোটবেলা থেকেই এই দুই ভাইকে সে নিজের দাদা বলে মানে।ওরাও ছোট বোনের মতোই তাকে স্নেহ করে।ভূতচতুর্দশীতে এই তিনজন অন্যবারের মতো এবারেও প্রচুর আনন্দ করেছে।কয়েকদিন পরেই ভাইফোঁটা।তাই শ্যাওড়া সুন্দরী গিয়েছিল রোগাভূত-মোটাভূতের বাড়ি ওদের নেমন্তন্ন করতে।গল্প-গুজব করতে করতে ফিরতে একটু রাত্তিরই হয়ে গেল।পুকুর পাড়ের কাছে সবে এসেছে এমন সময় রাস্তা ঘিরে দাঁড়ায় মেছোভূত।আগেও অবশ্য সে শ্যাওড়া সুন্দরীকে একটু-আধটু বিরক্ত করেছে কিন্তু সে সব পাত্তা দেয়নি সে।আজ এক্কেবারে সোজা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আহা শখ কত!ওকে নাকি বে করতে হবে।নিজেকে দেখেছে কোনদিন ঠিক করে?ছেলেরাই ওর ছিরি দেখলে পালিয়ে যাবে আর মেয়ে তো মেয়ে। বেঁশো কাঠ একটা।গা থেকে শুঁটকি মাছের গন্ধ ছাড়ে।

"পথ ছাড়" বিরক্ত হয়ে বলল শ্যাওড়া সুন্দরী। 
"ছারবুনি আগে বল বে করবি?" গায়ের গন্ধ ছড়িয়ে প্রশ্ন করে মেছোভূত।
"তোকে বিয়ে করতে বয়ে গেছে।" দাপটের সাথে বলে ওঠে শ্যাওড়া সুন্দরী। 
"আমায় বে না করলে ভালো হবেনি।" মেছোভূত নাকি গলায় বলে ওঠে।
শ্যাওড়া সুন্দরী কোনওদিন কাউকে ভয় করেনি।কিন্তু আজ মেছোভূতের এমনতর কথা শুনে শ্যাওড়া সুন্দরীর কঙ্কালটা কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠল।
এমনসময় ভেসে এল একটা কড়া ভারি গলার ধমক,"পথ ছাড়,ওকে যেতে দে।"
মেছোভূতও তার নাকি গলাটা আরো কাঁপিয়ে বলে উঠল,"কে বে?খুব তো আড়াল থেকে বসে বাতেলা মারছিস,হিম্মত থাকলে সামনে আয়।আমিও তো দেখি কেমন ভূতের ব্যাটা!"
এমন সময় প্রকট হল সে।সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এক বলবান ভূত।কিন্তু একি!মাথা কই?কাছে আসতেই সব্বার আগে ভিরমি খেল মেছোভূত। তারপর শ্যাওড়া সুন্দরীও।মেছোভূত ওইখানেই পড়ে রইল।স্কন্ধকাটা মনে মনে ভাবল,"ব্যাটা পড়ে থাকুক।পরে ওর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।আগে মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করা যাক।"
এই ভেবে সে পরম মমতায় শ্যাওড়া সুন্দরীকে কোলে তুলে নিল।তখনও অবশ্য জানেনা যে এই সেই পাত্রী যার সাথে বিয়ের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল। খুঁজে খুঁজে বার করে শ্যাওড়া সুন্দরীর বাড়ি।সে এক হুলুস্থুলু কাণ্ড। পাড়াশুদ্ধু লোক ঝেঁটিয়ে দেখতে এসেছে।তাদের ভারে তো শ্যাওড়া গাছ পুরো রাস্তায় নুইয়ে পড়েছে। ওদিকে পথচলতি মানুষ এটা ভাবতে ব্যস্ত যে আজ শ্যাওড়া গাছটার হলো কি!অমন মাটিতে ঝুঁকে পড়েছে কেন?
ভুতুড়ে ডাক্তার এল।শ্যাওড়া সুন্দরীকে পরীক্ষা করে বলল,"চিন্তার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।আসলে আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গেছে।আর এত ভিড় কিসের?ঘর ফাঁকা করুন। শ্যাওড়া গাছে বাতাস লাগতে দিন।"
ডাক্তারবাবু বড়ো ভালো।গ্রামের একমাত্র বিলেতে পাশ করা ডাক্তার। সারাজীবন গ্রামের মানুষের সেবায় গ্রামেতেই রয়ে গেলো। মরার পর আজও শহর থেকে কত ডাক আসে যে শহরে গিয়ে চিকিৎসা করলে অনেক লাভ।ওখানে ভালো পসারও জমবে।কিন্তু ডাক্তারবাবু তার এই জন্মভূমি ছেড়ে যেতে নারাজ। 
আস্তে আস্তে শ্যাওড়া সুন্দরীর জ্ঞান ফিরতে থাকে।ঝাপসা চোখে প্রথমটা স্কন্ধকাটাকে দেখে শ্যাওড়া সুন্দরী ভাবে ভুল দেখছে কিন্তু পরে ভালোভাবে জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারে যে সে ঠিকই দেখেছে।টেঁপি পেত্নি পা দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগল,"সেবারে জানো কালোভূত আর বেঁটেভূত ওরকম আমারও রাস্তা ঘিরে ছিল। স্কন্ধদাই তো আমায় বাঁচিয়েছিল।সেই থেকে যাই বল আমি তো বাবা স্কন্ধদার ফ্যান হয়ে গেছি।মাথা নেই তো কি হয়েছে?সে নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।"
সত্যি ভূতেদের শরীর দিয়ে বিচার করে হবেটাই বা কি?এখানে তো সবাই অশরীরী!ভূতেদের সমাজে তারই কদর বেশী যাকে শুধু মনুষ্য সমাজই নয় অন্য ভূতেরাও ভয় করে।আর এ ব্যাপারে স্কন্ধকাটা সব থেকে এগিয়ে। তার উপরে আবার পরোপকারী। তার এই পরোপকারী ভাবমূর্তিই শ্যাওড়া সুন্দরীকে মত বদল করতে বাধ্য করল।নাই বা হল চোখে চোখ মিলিয়ে মালাবদল তবু চারহাত এক হতে সময় লাগল না। এক অশুভ রাতে খুলিকে সাক্ষী রেখে পাকে পাকে বাঁধা পড়ল ওরা।কঙ্কাল মশাইয়ের ভৌতিক মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে অশুভ পরিণয় সম্পন্ন হলো। স্কন্ধকাটা যেমন শ্যাওড়া সুন্দরীর ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিয়েছে তেমনি শ্যাওড়া সুন্দরীও আজ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিল-শুধু স্কন্ধকাটা একা নয়,এবার থেকে সে-ও তার স্বামীর সাথে তার মাথাটা খুঁজতে সাহায্য করবে।হাজার হোক অর্ধাঙ্গিনীরও একটা কর্তব্য আছে।
বছর ঘুরতেই শ্যাওড়া সুন্দরী এক ফুটফুটে সন্তানের জন্ম দিল।সে এক কাণ্ড!শ্যাওড়া সুন্দরী যবে থেকে জানতে পারে যে সে মা হতে চলেছে তবে থেকে সে এক মানসিক উত্তেজনার মধ্যে ভুগতে শুরু করে।দিন-রাত প্রার্থনা করত ছেলে হোক বা মেয়ে,সন্তান যেন বাপের মতো মুণ্ডুহীন না হয়। আজও স্কন্ধকাটার মুণ্ডুটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।কে জানে আর পাওয়া যাবে কিনা?কিন্তু অবশেষে মুণ্ডুযুক্ত সন্তানেরই জন্ম দিল শ্যাওড়া সুন্দরী। ছেলের মুন্ডু দেখে মায়ের ধড়ে প্রাণ ফিরে এল না বটে বা স্বস্তির নিঃশ্বাসও পড়েনি যদিও তবে শ্যাওড়া সুন্দরী চাপমুক্ত হলো। 
-----------------------------------------------------------------



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy