অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভা
অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভা
হাজারখানেক সম্বন্ধ খারিজ করে,আরো কয়েক হাজার প্রেমপ্রস্তাব নাকচ করে,সুপুরুষ পাত্রদের ডেটে রিজেক্ট করে,ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটের পাত্রদের নাক সিঁটকিয়েও, সে আজও প্রেম এবং বিয়ে উভয় বিষয়েই সমান বিশ্বাস রেখে চলেছে। অথচ পছন্দের পাত্র জোটাতে, তার নিজের বাড়ির লোকেদের পছন্দের প্রতি, তার না আছে আস্থা,আবার তেমনি নিজের পছন্দের প্রতিও নিজের নেই তেমন কোনও ভরসা।তাহলে প্রশ্ন, মনমতো পাত্র জোটে কি করে ?এবং তার সাথে বিয়ে হয়ই বা কেমন করে?বাড়ির বড়োরা পড়ে গেল চিন্তায়।অবশেষে মুশকিল আসান করল পরিবারের কোনও একজন গুরুজন।তার মাথায় জ্বলে গেল বুদ্ধির বাতি।বৃদ্ধ বুদ্ধিটা দিয়ে বাতলে দিল এক সহজ পথ।তার কথায়-সম্বন্ধ,প্রেমপ্রস্তাব,ডেট,ম্যাট্রিমনি,ঘটকালি সবই তো দেখা হ'ল,তাহলে একবার কেননা শেষবারের মতন সেই প্রাচীন রীতিই নাহ'ক অনুসরণ করা যাক্।দেখাই যাক্ না কি আছে কপালে?
সবাই একটু ধন্দে পড়ে গেল।এ ওর মুখের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগল।
তখন সেই গুরুজন বাকিদের উপর খানিক বিরক্ত হয়েই বলে উঠল,"সব একেকটা হোপলেস।ওই আমতা-আমতাই করতে থাকো সব।হাঁ করলে কোথায় হাওড়া বুঝবে তা নয়,সবকিছু আমায় ঝোড়া-কোদাল নিয়ে বোঝাতে হবে দেখছি।আরে বাবা আমি স্বয়ম্বর সভার কথা বলছিলাম।আগেকার দিনের রাজকুমারীরা যেভাবে বর নির্বাচন করত।আমি তাই বলছিলাম কী সবই তো দেখা হ'ল,এবার শেষবারের মতন এটায় একবার ট্রাই মেরে দেখলে হ'ত না?"
"হোয়াট অ্যান আইডিয়া গুরুজি।"মিচকে হেসে বলে উঠল বাড়ির ফচকে।
"ফাজলামি নয়,ব্যাপারটা সিরিয়াস।সবাই মিলে ভালো করে ভেবে নিয়ে আমাদের রাণীকে জানাও।"গুরুগম্ভীর মুখে সেই গুরুজন জানাল।
সবাই তো যাকে বলে এককথায় রাজি।কিন্তু পাত্রী রাজি হবে তো? সবার ওই একই চিন্তা।আর তাকে একথা বলবেটাই বা কে?মানে গিয়ে, কে বাঁধবে বেড়ালের গলায় ঘন্টা?ও যা মেয়ে।ওকে তো বাড়ির বড়োরাও ভয় করে।রেগে গেলেই মুণ্ডুটা তিনশ ষাট্ ডিগ্রি ঘুরিয়ে রাগ জাহির করে।একবার বাড়ির ওই মিচকে পটাশ ফচকে তার ওই মুণ্ডু ঘোরানোর বিশেষত্ব পেঁচার সাথে তুলনা করে তাকে পেঁচানি বলায়, সে ক্ষেপে গিয়ে যা কাণ্ড বাধিয়েছিল,সেকথা মনে পড়লে এখনও সবার হাড় হিম হয়ে যায়।
সেই মিচকে পটাশ ফচকেই বলল দায়িত্ব সহকারে,"আমিই অ্যানাদিদিকে বলব।"
কথা শেষ হতে না হতেই সেই বয়সের গাছপাথরহীন গুরুজন দাদু বলে উঠল,"থাক্ বাছা তোমাকে আর খামোকা কষ্ট করতে হবে না।যা বলার আমিই বলব।আমার ওপর সে কখখোনো রাগ করে না।তাহলে ওই কথাই রইল, মেয়ে রাজি থাকলে স্বয়ম্বর সভা হচ্ছে।"
অন্যদিকে অ্যানাবেলকে স্বয়ম্বর সভার কথা বলতেই সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল।যাকে বলে মেয়ে যেন এক পায়ে খাড়া!এতটাও কেউ আশা করেনি যে,অ্যানাবেল এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে।অ্যানাবেলের তো এসব নিয়ে কোনও চিন্তাই নেই।সে এই ব্যাপারটায় ভারী খোরাক পেয়েছে।তা সে বাড়ির লোক যতই তার বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা করুক।একেই বলে বোধহয়, 'যার বিয়ে তার হুঁশ নেই,পাড়া-পড়শির ঘুম নেই।'
সেই ছোটবেলায় বেঁচে থাকতে অ্যানাবেল বইতে পড়েছিল রাজকন্যাদের স্বয়ম্বরের কথা।টিভির পর্দাতেও দেখেছিল নকল স্বয়ম্বর। কিন্তু মরার পর স্বয়ং তারই হবে কিনা আসল স্বয়ম্বর সভা!বাহ্ বাহ্ কেয়া বাত।অ্যানাবেল তার বিয়ে নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয়।আসলে সে মনে মনে ভাবল বিয়ে হোক্ বা ছাই না হোক্,কিছু ছেলে তো দেখা যাবে।পাত্র পছন্দ হোক্ বা না হোক্, কিছু ঝাড়ি তো মারা যাবে।মনে-মনে খানিক কল্পনা করে নিল সে-সভার মাঝে সে মধ্যমণি হয়ে সিংহাসনে বসে,আর সামনে দুধারে সারি বদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দাসেদের থুড়ি ছেলেদের দল।আইব্বাস,সিন্ পুরো জমে ক্ষীর।
কথামতো অ্যানাবেলের সম্মতিতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল স্বয়ম্বরের। এখন তো আর ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বা চিঠি পাঠিয়ে আর আমন্ত্রণ জানানো হয় না।বরং তার জায়গা নিয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। তাই স্পুকবুক,স্পুকঅ্যাপের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের, নানা প্রান্তের সর্বগুণ সম্পন্ন অবিবাহিত অশরীরি পুরুষদেরকে অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানান হ'ল।সবাইকে পাঠানো হ'ল স্পুকি মেইল।ভারতবর্ষ থেকেও নিমন্ত্রিত ভূতেরা রওনা দিল অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভায়।কিছুজন তো দেখামাত্রই রিজেক্ট হয়ে গেল।যেমন-মেছোভূত,রোগাভূত-মোটাভূত।আর হবে নাই বা কেন?সব সোশ্যাল সাইটে ছবি দেয় নানারকম রঙ চড়িয়ে,এডিট করে,সব যেন একেকটা জ্যান্ত রাজপুত্তুর।আর কাছে আসতে চাক্ষুস করতেই ধরা পড়ল এদের ভাঁওতাবাজি।বুঝবে কি করে অ্যানাবেলের বাড়ির লোকজন, যে মেছোভূতের গা থেকে এখনও মেছো-মেছো গন্ধ ছড়ায়,কিংবা মোটাভূতের আদৌ কোনও সিক্সপ্যাক নেই,আর রোগাভূতকে তো একটা ফুঁ মারলেই উড়ে যাবে,যেমন ঝড়ে খড়কুটো উড়ে যায় তেমনটা আর কী।যাইহোক,এরা তো এক দেখাতেই বাতিল।তবে অন্যদিকে এই বাতিল ব্যাপারটা ভালোভাবে মেনে নেয়নি 'অশরীরি ভারতীয় মোর্চা সমিতি'।তাদের বক্তব্য-মেছোভূত বর্ণবৈষম্যের শিকার।মোটাভূত আর রোগাভূত বডি শেমিং-এর শিকার।লোক দেখাতে তাদের নিমন্ত্রণ করা হ'লেও,আগে থেকেই সব ঠিক ছিল যে তাদের বাতিল করা হবে।যাকে বলে,টোটাল ফিক্সিং কেস্।তাই 'অশরীরি ভারতীয় মোর্চা সমিতি'র পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদে তাদের প্রতিনিধিরা রওনা দিচ্ছে অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভায়,সেখানে ধর্না দেবে বলে।কিন্তু এসব ধর্না-টর্নার ঘোষণায় পাশ্চাত্য ভূত সমাজে কিসসু এসে যায়নি।তাদের বক্তব্য-যত্ত সব বাড়াবাড়ি।কেউ আবার মজা করে বলে উঠল-ভারতীয়রা খালি ছুঁতো খোঁজে ধর্নায় বসার। না হ'লে শুধু তারা বাতিল ভারতীয় ভূতগুলোকেই দেখল।ক্রিজে তো এখনও বেশ কিছু ভারতীয় ভূত দিব্যি ব্যাটিং চালিয়ে যাচ্ছে।আর তার মধ্যে সবথেকে এগিয়ে এবং অ্যানাবেলের স্বয়ং নেকনজরে আছে যে ভূত,সে আর কেউ নয়-আমাদের অতি পরিচিত স্কন্ধকাটা।অ্যানাবেলের মুণ্ডুটা যেমন তিনশ ষাট্ ডিগ্রি ঘোরে,ঠিক এর বিপরীত হ'ল স্কন্ধকাটা,মুণ্ডুই নেই।আর স্কন্ধকাটার এই ব্যাপারটাই অ্যানাবেলের সবথেকে ইউনিক্ লেগেছে বাকি ভূতেদের থেকে।তাই তো বাকি ভূতেদের থেকে স্কন্ধকাটা সবথেকে এগিয়ে,আর অ্যানাবেলের সুনজরের ফলে স্কন্ধকাটার মুণ্ডুহীন ব্যাপারটাই এখন ওর ইউ.এস.পি বা অ্যালমা মিটার হয়ে দাঁড়িয়েছে।অন্যদিকে স্কন্ধকাটার সাথে জোর টক্কর না দিলেও অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভায় টিকে আছে আরো এক ভারতীয় ভূত-যার নাম ব্রহ্মদৈত্য।তবে ব্রহ্মদৈত্যর ওই গুরুগম্ভীর বুড়োটে বুড়োটে মার্কা নামটা ছাড়া নাকি অ্যানাবেল আর কিছুই বিশেষ খুঁজে পায়নি বৈহ্মদৈত্যর মধ্যে।স্বয়ম্বর সভায় এখনও সে টিকে থাকলেও,তার জেতার আশা খুবই ক্ষীণ। অ্যানাবেল তো আর পাত্তাই মারছে না ব্রহ্মদৈত্যকে।এই এবার সে আউট হ'ল বলে।এই একটু আগেই যেমন আউট হ'ল আরেক ভারতীয় ভূত।মেছোভূত বা মোটাভূত-রোগাভূতের মতন প্রথম পর্বে আউট না হ'লেও,তার নামের গেরোয় তাকে দ্বিতীয় পর্বে আউট হতে হ'ল।অ্যানাবেলের তার নামটা একেবারেই পছন্দ হয়নি,তাই সে নাক সিঁটকে নাকচ করে দিয়েছে তাকে।প্রত্যেকবার এই হয়,মেয়েরা ওর নাম শুনলেই হাসি-ঠাট্টা জুড়ে দেয়।তাতে ও বেচারার কি দোষ?পিতৃদত্ত নাম ওটা,নিজে তো আর রাখেনি।নাহ্ এবার সে ঠিকই করে নিয়েছে 'স্পুকি কোর্ট'-এ গিয়ে নামটা এফিডেফিট করে তবেই ছাড়বে।নাহ্ আর পারা যায় না।নামের জন্য বারবার অপমান আর বরদাস্ত হয় না।শুধু মেয়েরা কেন ছোট্ট-ছোট্ট বিচ্ছু বিটকেল বাচ্চাগুলো পর্যন্ত, রাস্তা দিয়ে গেলেই আড়ালে-আবডালে টিটকিরি মারে,"মামদো,যেন একটা হুমদো।"এইসব উল্টো-পাল্টা বলে তাকে ক্ষেপায়।সেদিন তো এইকথা শুনে শ্যাওড়া পেত্নির শ্যাওড়া গাছে পা দুলিয়ে দুলিয়ে খ্যানখ্যানে গলায় সে কী হাসি!সে হাসি আর থামে না।যা অপদস্থ হতে হয়েছিল সেদিন।এবারে বাড়ি ঢোকার আগে কোর্টে গিয়ে নামটা বদলে তবেই সে বাড়ি ঢুকবে,এমনই প্রতিজ্ঞা করল মামদো ভূত।তবে এরা ছাড়াও অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভায় হাজির আরেক ভারতীয় ভূত।যদিও সভা কর্তৃপক্ষ রেকর্ড চেক করতে ব্যস্ত যে,একে আদৌ নেমন্তন্ন করা হয়েছিল কিনা,নাকি এ নিজে থেকেই হ্যাংলা-হাভাতের মতো বিনা নিমন্ত্রণে সভায় এসে জুটেছে।কারণ অ্যানাবেলের পছন্দের কথা মাথায় রেখে বলা যায় যে,এ পাত্র তার একেবারেই রুচবে না।
সভার ঘোষক তো বলেই ফেলল,"নবতিপর লোলচর্মসার ঘাটের মরা শ্মশানের দিকে মুখ করে বসে থাকা দাদু তুমি কে?তোমার পরিচয়ই বা কী?সভা ওয়ান্টস্ টু নো।"
"আই অবজেক্টস্।"বলে উঠল দাদু ভূত,তারপর আরো বলল,"হরবর-হরবর করে চাট্টি বানানো মিথ্যে কথা বললেই হ'ল।আমি মোটেও ওরকম বুড়ো থুরথুরো নই।"
তারপর খানিক দম নিয়ে আরো সংযোজন করল,"সে টি.ভি সিরিয়ালে সাদা লম্বাচুলো,রাজার ঘাড়ে দেখালে আমি কী করব।জানো আমি কত বুদ্ধিমান, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী।দেখবে দেখবে,এই কেমন আমি বুড়ো থেকে ছুড়ো আবার ছুড়ো থেকে বুড়ো হতে পারি।"
"থাক্ দাদু তোমায় আর ভেল্কি দেখাতে হবে না।"বাধা দিয়ে বলে উঠল সভার সেই ঘোষক।তারপর আরো বলল,"বলি তুমি আবহাওয়া নাকি,যে প্রত্যেক ঋতুতে বদলে যাও ,নাকি তুমি গিরগিটি যে রঙ বদলাও।"
"কি আমি বদলে যাই,আমি গিরগিটি, আমি ভেল্কি দেখাই। যা নয় তাই বলে যাচ্ছ ।জান আমি কে?"উত্তেজিত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকে সেই ভূত।
ঘোষক কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সে ঘোষণা করল নিজের নাম,"আমি বেতাল।"
ঘোষক কিছুমাত্র অবাক না হয়েই স্বাভাবিক স্বরে বলল,"সে তুমি বেতাল হও বা বেতালা।আমাদের ম্যাডামের তোমাকে চলবে না।তাই মানে মানে তুমি কেটে পড়ো তো বাপু।"বেতালকে আর কিছুমাত্র সুযোগ না দিয়েই ঘোষক একপ্রকার তাকে সভা থেকে যাকে বলে খেদিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল কে একজন লুকিয়ে লুকিয়ে সুড়সুড় সুড়সুড় করে সভায় প্রবেশ করছে।কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতেই চিনতে পারল সভার সেই ঘোষক।
"তুমি তো মাইরি হেব্বি নির্লজ্জ হে দাদু।অমনভাবে খ্যাদানোর পর আবারো সভায় সেঁধিয়ে মরছ।মরণ!"ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে ঘোষক।
"আরে আরে তুমি যাকে ভাবছ আমি সে নই।আমি ইয়ে মানে তার যমজ ভাই।আমি হ'লাম গিয়ে বেতালের যমজ ভাই তাল।আসলে ও টি.ভি সিরিয়ালের দৌলতে পপুলারিটি পেয়েছে,আর আমাকে কেউ চেনেই না।"খানিক উদাস হয়ে কথাগুলো বলল তাল।ঘোষক খানিক পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে মেপে নিল।তারপর শ্যেন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,"গল্প বানাচ্ছ না তো দাদু?"
"আরে না বাবা,ভূতের রাজার দিব্যি।"বলে ওঠে তাল।
ভূতের রাজার নামে দিব্যি কাটতে খানিক আশ্বস্ত হ'ল ঘোষক ভূত।তারপর বলল,"সে তুমি তাল ,বেল যেই হও না কেন,মোদ্দাকথা তোমার ওই বুড়োটে ভামমার্কা থোবড়া আমাদের ম্যাডামের রুচবে না।তাই তুমি রাস্তা মাপো তো বাপু।"তারপর একরাশ বিরক্তি উগড়ে দিয়ে সে তালকে বলল,"দেখতেই পেলে তোমার ওই যমজ ভাই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়েও বাতিল হ'ল আর তুমি এরপরও এখনও নিজের আশা রাখ?সত্যিই, ধন্যি তুমি দাদু নাম্বার টু।ওই দিকে দরজাটা ।"
এইভাবে বেতালের মতো তালও স্বয়ম্বর সভা থেকে ছাঁটাই হ'ল।প্রথমদিকে অ্যানাবেলের বেশ ভালোই লাগছিল।কিন্তু এখন স্বয়ং তারই উৎসাহ কেমন যেন নিভু নিভু।তার আর ভালো লাগছে না ,কেমন যেন সব একঘেয়ে লাগছে ।ভূতগুলোও কেমন যেন সেই বস্তাপচা,মার্কা মারা, বোরিং।স্কন্ধকাটাকে ভালো লাগলেও,অ্যানাবেলের তার প্রতি কিছুতেই 'হান্ড্রেট পার্সেন্ট লাভ' জেগে উঠছে না।কী যেন একটা কিছু কম আছে তার মধ্যে।দেখলেই যাকে কিছুতেই ফেরানো যাবে না এরকম উদ্দীপনা,এই নিমন্ত্রিত ভূতগুলোর কোনও একটাকে দেখেও কিছুতেই জেগে উঠছে না অ্যানাবেলের মধ্যে। স্কন্ধকাটার মধ্যে সব গুণ থাকলেও এক্স ফ্যাক্টর একেবারেই নেই।হ্যাঁ এই এক্স ফ্যাক্টর নেই বলেই স্কন্ধকাটার সাথে অ্যানাবেলের কিছুতেই রাজযোটক হচ্ছে না।শুধু নব্বই শতাংশে আটকে আছে।
অ্যানাবেল আনমনে এইসব ভাবছে,এমন সময় সভার মধ্যে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল এক বৃদ্ধ। আর সেই বৃদ্ধ তার ডানহাত দিয়ে ধরে রেখেছে এক তরুণকে।দুই অনাহুতের এরকম করে সভামধ্যে প্রবেশ খুব স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে হতবাক করল ।সভার রক্ষী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার আগেই সেই বৃদ্ধ বলে উঠল,"ইয়ে আজ্ঞে একটু আসতে দেরি হয়ে গেল।আমরাও নিমন্ত্রিত।তবে পাত্র আমি নই।পাত্র হ'ল এই যে "একথা বলে সে তার সাথে আগত তরুণটির হাত ধরে একটু টান মারল।
তরুণটির পরিচয় দেওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক ওই বৃদ্ধের পরিচয়।বৃদ্ধ একটি মর্গে কাজ করত এবং বৃদ্ধ ছিল কাউন্ট ড্রাকুলার একান্ত নিষ্ঠাবান ভক্ত।হামেশাই টাটকা-তাজা বেওয়ারিশ লাশ সে কাউন্ট ড্রাকুলার চরণে সেবা দিত ।ভক্তের ভক্তিতে খুশি হয়ে কাউন্ট ড্রাকুলা যেই না তাকে দর্শন দিয়েছে,আর সে সেই খুশি সহ্য করতে না পেরে পটল তুলতে তুলতে সোজা নরকে।একদিন কফিনে সে ঘুমের মধ্যে শুনতে পেল বাইরে কে যেন কাঁদছে।বাইরে বেরিয়ে সে দেখতে পেল তার খুব পরিচিত এই তরুণটিকে। তখন সে রীতিমত বিধ্বস্ত, চুল উস্কোখুস্কো,জামা-কাপড় এলোমেলো।তার এই অবস্থার কারণ জানতে চাইলে সে যা বৃত্তান্ত দিল,তা হ'ল এইরকম-মৃত প্রেমিকার জন্য দিনের পর দিন সে লোকের ঘাড় ফুঁটো করে রক্ত জমা করেছে। অথচ সেই প্রেমিকা,তারই পাশে শায়িত পাঁচহাজার বছরের কোনও এক ফারাও মমির প্রেমে পাগল হয়ে, নিবেদিত প্রাণ প্রেমিককে ভুলে তার সাথে সোজা ইজিপ্ট পগাড়পার ।বেচারা প্রেমিক,আগে যদি বুঝত!কে আর কষ্ট করে যোগাড় করত গামলা গামলা রক্ত।যে প্রেমিকার ডুবে ডুবে রক্ত খাওয়া উচিৎ ছিল,সেই প্রেমিকা শেষে কিনা বালিতে মজল!এমনিতে সে তার প্রেমিকের উপস্থিতিতে তার সাথে কী ভালোমানুষিটাই না করত।কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে, ফারাও মমির সাথে তার সে কী বেলি ডান্স। আর এসব পিঠে ছুরি মারা ব্যাপার-স্যাপার, নিরীহ প্রেমিকবর ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ।যখন টের পেল তখন পাখি ফুরুৎ।তারপর থেকে তার এই দশা। হায় রে ভূতনি ,শেষে ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি!
সব শুনে-টুনে বৃদ্ধ বলল,"যা হয় মঙ্গলের জন্য হয়,শোনোনি কথাটা।আরে কোথায় তুমি আর কোথায় সেই মেয়ে । আরে তুমি হ'লে স্বয়ং ভূতাধিরাজ।সব ভূত-পেত্নি-পিশাচ তোমার নামে ভিরমি খায় ।মেয়েরা সব তোমার পায়ে আছাড় খেয়ে পরবে।শাঁখচুন্নিরা সব তোমার দাসী হবে ।আরে তোমার জন্য সব মেয়েদের লাইন লেগে যাবে ।"
এতকিছু বলার পরেও তরুণটিকে সেই থম্ মেরে থাকতে দেখে সেই বৃদ্ধই তখন তার হাতদুটোকে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তাকে নিয়ে উপস্থিত হয় অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভায়।কারণ বলাই বাহুল্য এমনতর ভূতাধিরাজ ভূত অ্যানাবেলের স্বয়ম্বর সভায় অবশ্যই আমন্ত্রিত।
বৃদ্ধ এবার খুব গর্বের সঙ্গে জোর গলায় সেই তরুণের পরিচয় দিল,"যার নামই যথেষ্ট, আলাদা পরিচিতি দিতে লাগে না,স্বয়ং আমি যার অন্ধ ভক্ত,সভামধ্যে উপস্থিত এখন, এক এবং অদ্বিতীয় স্বয়ং ভূত সম্রাট কাউন্ট ড্রাকুলা।"
যেই বলা সেই কাজ।সবার বিস্ফারিত চক্ষু এখন শুধুই কাউন্ট ড্রাকুলার দিকে।কতজন তো এমনিই অজ্ঞান হয়ে গেল।সবাই তার কাছে ছুটে এল, তাকে শুধু একঝলক দেখবে বলে।একজন তো রীতিমত নিজে থেকেই কাউন্ট ড্রাকুলার একটা হাত ধরে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলেই ফেলল,"আপনার নাম অনেক শুনেছি,চাক্ষুস হ'ল আজ।আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল স্যার,ভাগ্যিস আজ এখানে এসেছিলাম।নাহ'লে হয়ত দেখাই হ'ত না।"
সভারক্ষীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত ভীড় সামলাতে সামলাতে।
এদিকে বাকিদের মতন অ্যানাবেলেরও মনের অবস্থা কাউন্ট ড্রাকুলা দর্শন হেতু,যাকে বলে উথাল-পাথাল।তবে অ্যানাবেলের চিত্ত উচাটনটা বাকিদের থেকে একটু বেশিই।হাজার হোক্ এ স্বয়ম্বর সভার সে মধ্যমণি কিনা।অ্যানাবেল মুগ্ধ দর্শকের মতো অপলক দৃষ্টিতে কাউন্ট ড্রাকুলার দিকে তাকিয়ে রইল।হঠাৎ করে তার চোখ গেল কাউন্ট ড্রাকুলার দুদিকের দুই তীক্ষ্ণ দাঁতের দিকে,যা দিয়ে সে লোকের ঘাড়ে ছুঁচের মতো ফুটিয়ে রক্তপান করে।
অ্যানাবেল মনে মনে বলল,"হাউ রোমান্টিক।"
তারপর ভাবল,ভালোবেসে,আদর করে ঘাড়ের কাছে লাভ বাইট স্বরূপ দাঁত ফুটিয়ে যখন রক্ত চুষবে............উফ্ অ্যানাবেল আর কিচ্ছু ভাবতে পারল না। আনন্দে,উত্তেজনায় শুধু চোখদুটো বন্ধ করে নিয়ে দৃশ্যটা কল্পনা করে খানিক শিহরিত করে নিল নিজেকে।
তারপর তার মনে পড়ল, আরে এই তো সেই এক্স ফ্যাক্টর যা সে এতক্ষণ ধরে খুঁজছিল।শুধু তাই নয়, যে যে গুণ এতক্ষণ ধরে সে তার মনের মানুষের মধ্যে খুঁজছিল,কাউন্ট ড্রাকুলার মধ্যে তার সবকটিই বিদ্যমান,বরং তারও বেশিকিছু বিদ্যমান রয়েছে তার মধ্যে। সত্যি শুধু সে কেন, যে কেউই ওর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবে।ভূত শ্রেষ্ঠ বলে কথা।সদবংশজাত।কে ফেরাবে তাকে?পরিবার ,পাত্রী সবাই রাজি হতে বাধ্য। সভার মেয়েগুলো তো যেন হামলে পড়ছে।নাহ্ আর থাকা যায় না।মেয়েগুলো বাড়াবাড়ি করার আগেই সে থালায় সাজিয়ে রাখা নরমুণ্ডের মালাটা কাউন্ট ড্রাকুলার গলায় পড়িয়ে দিল।আর কি 'শুভস্য শীঘ্রম্', বিয়ের আসর বসল।গেটে লাগান হ'ল মনুষ্য হাড় নির্মিত দুজনের নামের ফলক-'অ্যানাবেল ওয়েডস কাউন্ট ড্রাকুলা'।রক্তের ফোয়ারা বসানো হ'ল।ডাইনিরা নাঁকি গলায় নহবত উপস্থাপন করল।কেঁচোর নুডল,সাপের স্যূপ,খুলির স্যান্ডউইচ,আরশোলার চাটনি সহ নানারকম ননভেজ ভূতুরে পদ পরিবেশিত হ'ল। সে এক জম্পেশ, জমজমাট বিয়ের রাত,যা ভূত সমাজ এই প্রথম দেখল।রেকর্ড বলছে, ভূতেদের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত এরকম বর্ণাঢ্য বিয়ের আয়োজন এই প্রথম। বিয়ে মিটল বেশ ভালোভাবেই। অ্যানাবেল এখন ফোনে স্পুক সার্চের মাধ্যমে তাদের হানিমুন ডেস্টিনেশন বাছতে ব্যস্ত।আর প্রাথমিকভাবে তার রাজস্থানের কুলধারা এবং ভানগড় ফোর্ট পছন্দ হয়েছে হানিমুনের জন্য।
‐----------------------------------------------------------------
