মহুল আর মহুলের স্যার
মহুল আর মহুলের স্যার
অজিত বসু।পেশায় সরকারি স্কুলের শিক্ষক। বয়স পঁয়ত্রিশ, সুদর্শন, সুপুরুষ। বাড়ি গ্রামাঞ্চলে হলেও,কর্মস্থান খাস কোলকাতায় হওয়ার দরুণ, গ্রামের বাড়িতে তালা দিয়ে এখন সে এই শহরে ফ্ল্যাটবাসী হয়েছে। অবশ্য প্রতি শনি-রবিবার নিয়ম করে অজিত গ্রামের বাড়িতে যায় বটে।সংসারে সে একা।কোনও দায়ভার নেই।বাবা বাল্যাবস্থাতেই গত হয়েছেন আর মা কয়েক বছর আগেই মারা গিয়েছেন।
এ পাড়ায় অজিত নতুন অতিথি। পড়শিদের সাথে আলাপের সেরকম সুযোগ হয়ে ওঠেনি এখনও। সামনে দুর্গাপুজো। তাই কার্যত এখন চাঁদা তোলার খুব ধুম।অজিত তার ফ্ল্যাটের পাশের ঘরের বাসিন্দার কাছ থেকে জেনেছে যে,ক্লাবের সেক্রেটারি সহ পুজো কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দরা তার ঘরের দোরগোড়ায় চাঁদার জন্য এসে ফিরে গেছেন,সে ঘরে ছিল না বলে।আর এরকমটা দু-তিনবার হয়েছে। অজিত তাই ভাবল চাঁদাটা সে নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে ক্লাবে। তাই পাশের ঘরের প্রতিবেশী বিজয়ের কাছে জানতে চাইল সে,"আচ্ছা ক্লাবটা কোথায়?আমি তো ঠিক জানিনা। বারবার ওনারা এসে ফিরে যাচ্ছেন, সেটা ভালো দেখায় না। তাই ভাবছি আমিই গিয়ে চাঁদাটা দিয়ে আসব।"
বিজয়ও তৎক্ষণাৎ অজিতকে ক্লাবের ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিল আর সাথে বলল,"সে ক্লাবে যেতে চাইছ যাও,ক্ষতি নেই,কিন্তু আমাদের ফ্ল্যাটের পরের ফ্ল্যাটটার পাশে যে দোতলা গোলাপি বাড়িটা আছে,ওটাই আমাদর সেক্রেটারি মহাশয় যতীনবাবুর বাড়ি।ওখানে গিয়ে চাঁদাটা দিলেও হবে।আর তাছাড়া কাছেও হবে।একদমই তো পাশে।এখন তোমার যা ইচ্ছা। "
"ওহ্ তাই নাকি?তাহলে তো ওখানে গেলেই হয়।বাহ্ ভালো বলেছ।ধন্যবাদ। আমি বরং ওনার বাড়িতেই যাই।"অজিত বিজয়ের কথায় সহমত পোষণ করে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে রওনা দিল যতীনবাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বাড়ির কলিংবেলটা বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন বছর সত্তরের এক প্রবীণা মহিলা।ইনি যতীনবাবুর স্ত্রী শ্রীমতি কমলাদেবী।
অজিত সঙ্গে সঙ্গে কমলাদেবীকে সৌজন্যমূলক নমস্কার জানিয়ে বলতে থাকে সে কে এবং কেন ওনাদের বাড়িতে এসেছে, "নমস্কার, আমার নাম অজিত।এ পাড়াতে এই নতুন এসেছি।কাউকে বিশেষ চিনিও না।আসলে যতীনবাবুরা পুজোর চাঁদা আনতে গিয়ে দুদিন আমার ফ্ল্যাট থেকে ফিরে এসেছেন আমি আসলে আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম তো।তাই ভাবলাম ওনারা এতবার ফিরে গিয়েছেন যখন আমিই বরং চাঁদাটা গিয়ে দিয়ে আসি ।তাই এলাম।"
কমলাদেবী দরজা খুলে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক তরুণের কাছ থেকে তাদের বাড়িতে তার আগমনের কারণ জানতে পেরে আশ্বস্ত হয়ে তাকে বাড়ির ভিতর স্বাগত জানালেন।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই ভেসে এল যতীনবাবুর কন্ঠস্বর, "কে এসেছে কমলা?"
কমলাদেবী অজিতকে যতীনবাবুর ঘরে নিয়ে গেলেন।একটা চেয়ার টেনে বসতে দিলেন অজিতকে।তারপর অজিতের সম্বন্ধে এবং অজিত কেন এসেছে তাঁদের বাড়িতে সে ব্যাপারে অজিত যেমন যেমন কমলাদেবীকে বলেছিল কমলাদেবীও হুবহু সেই কথাই জানালেন তাঁর স্বামীকে।
এরকম রোদ ঝলমলে সকালবেলায় আধশোয়া যতীনবাবুকে গায়ে চাদর দিয়ে বিছানায় দেখে অজিত সহজেই অনুমান করে নিল যে,ভদ্রলোকের শারীরিক অবস্থা বোধহয় ভালো নয়।তাই ভদ্রলোকের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখিয়েই অজিত প্রশ্ন করল,"আপনার শরীরটা কি ভালো নেই?না মানে এমন সময় গায়ে চাদর দিয়ে, তাই প্রশ্নটা করলাম।"
"না,না সেরকম কিছু নয়। ওই একটু জ্বর হয়েছে আরকি।ও প্রত্যেকবার সিজ্ন চেঞ্জের সময় আমার জ্বর হবেই হবে।ও আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।এ হল আমার সিজ্ন চেঞ্জের সঙ্গিনী। আমার স্ত্রীকে তো তাই বলি,সিজ্ন চেঞ্জ হতে চলেছে,তোমার সতীন আসলো বলে।"জ্বরকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে যতীনবাবু অজিতের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলেন।
কিন্তু যতীনবাবুর জ্বর হয়েছে শুনে অজিত ব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল,"একি!আপনার তো তাহলে রেস্টের প্রয়োজন।আমি বরং আজ যাই।ভুল দিনে এসে আপনার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটালাম দেখছি।আমি বরং অন্য আরেকদিন আসব।"
"আরে আরে যাচ্ছ কোথায়?বোসো বোসো।তুমি যেমনটা ভাবছ সেরকম গুরুতর কিছু নয়।তাই যদি হোতো তাহলে আমার সহধর্মিণী মহাশয়া কি তোমায় এত খাতির যত্ন করে আমার শোয়ার ঘরে এনে বসাতো?প্রথম দিন আমাদের বাড়িতে এসেছ।একটু বোসো,গল্পগুজব করি,চা-মিষ্টি খাও-টাও।"অজিতের ফিরে আসার পথে প্রবল বাধা দিয়ে কথাগুলো বলে উঠলেন যতীনবাবু।
"গল্পগুজব না হয় ঠিক আছে।আবার চা-মিষ্টি কেন?"অজিত একটু লজ্জা পেয়েই কথাগুলো বলে যতীনবাবুর উদ্দেশ্যে।
"কেন নয়?প্রথম দিন আমাদের বাড়িতে এসেছ।তোমায় শুকনো মুখে যেতে দেওয়া হবে কেন?যেখানে আমরা অতিথিকে নারায়ণ মানি।আর তাছাড়া আমি তোমায় ছেড়ে দিলেও আমার স্ত্রী কিন্তু তোমায় ছেড়ে দেবে না।ওই সে আসল বলে জল-মিষ্টি নিয়ে। "যতীনবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই সত্যিই কমলাদেবী ঘরে প্রবেশ করলেন এক হাতে মিষ্টির প্লেট আর আরেক হাতে গ্লাসে জল নিয়ে।
"আবার ওসব কেন?"কমলাদেবীর হাতে মিষ্টির প্লেট দেখে একটু আমতা-আমতা করেই অজিত কথাগুলো বলে ওঠে কমলাদেবীর উদ্দেশ্যে।
"তা বললে কি হয়?এই প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এলে।নাও-নাও আর লজ্জা পেতে হবে না।আমি চায়ের জল বসিয়ে এসেছি।এই সামান্য কটা মিষ্টি আগে একটু মুখে দাও তারপর চা আনছি।"এই বলে কমলাদেবী রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে পুনরায় ফিরে এলেন আর অজিতকে জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা ভালো কথা,যেটা জিজ্ঞেস করব বলে ভুলে চলে যাচ্ছিলাম।তুমি কি চা খাও?লিকার না দুধ চা?চিনি দেওয়া না চিনি ছাড়া?আজকাল তো কমবয়সীরাও দেখি চিনি ছাড়া, দুধ ছাড়া চা খায়।তাই ভাবলাম জিজ্ঞেস করে নেওয়াই ভালো। আমার অবশ্য দুধ ছাড়া, চিনি ছাড়া চা এক্কেবারে চলে না।সুগার আছে তাই নকল চিনি মানে সুগার ফ্রি।আমি নকল চিনি বলি,তাই দিয়েই চা বানাই।তোমারটা কি বানাব?"
"ভালো বললেন তো!নকল চিনি।যা ইচ্ছে, আমার চায়ে কোনও বাধ-বিচার নেই।সব চলে।আমি সর্বভূক।হাসতে হাসতে কথাগুলো কমলাদেবীকে বলে অজিত।এরপর চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে অজিত খোশমেজাজে গল্প শুরু করে দেয় যতীনবাবু আর কমলাদেবীর সাথে।"আমি তো তাই ওনাকে বলছিলাম,ওনার রেস্টের সময় এসে আমি ওনাকে ডিস্টার্ব করলাম।"কমলাদেবীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে অজিত।
কমলাদেবী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন,"আরে ধুর,ধুর।আমি ওকে কত বলেছি এর আগে।আমার কথা শুনলে তবে তো!ওই জ্বর গায়েই সবার সাথে আড্ডা দেয়, ক্লাবের কাজ নিয়ে মেতে থাকে।হাজারবার বলেছি,শোনেনা,তাই এখন আর বলি না। তাই তো তোমায় ওর ঘরে নিয়ে এসে বসালাম।"
মুখমিষ্টির পর চায়ের কাপে সুখটান শেষ হতেই অজিত চাঁদাটা তুলে দেয় যতীনবাবুর হাতে।যতীনবাবু চাঁদা নিয়ে বিল কেটে অজিতের হাতে দিতেই অজিত তা পকটস্থ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ঘরে ফিরবে বলে।ফেরবার আগে গৃহকর্তা আর গৃহকর্ত্রীকে প্রণাম জানিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে অজিত জানায়, "বেশ ভালো লাগল আপনাদের সাথে আলাপ হয়ে।"
"তাহলে আরকদিন এসো,আরেকদিনই বা কেন,মাঝেমধ্যে তো আসতেই পারো।এই তো তোমার ফ্ল্যাটের পাশেই থাকি।যখন স্কুলের কোনও কাজ থাকবেনা,চলে এসো।বেশ জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।"প্রসন্নচিত্তে অজিতের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে চললেন যতীনবাবু তারপর পুনরায় সংযোজন করলেন,"তোমার যখন ইচ্ছা তখন আসতে পারো।বিশাল দুতলা বাড়িটা দেখছ বটে।কিন্তু সংসারে আমরা শুধু এই তিনটে প্রাণী।আমরা বুড়ো-বুড়ি আর আমাদের মেয়ে অন্নপূর্ণা।"
যতীনবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই এক তরুণী পরনে লং স্কার্ট আর কালো-হলুদ ডোরাকাটা গেঞ্জি পরে যতীনবাবুর ঘরের সামনেটা এসে দাঁড়াল।যতীনবাবু তরুণীটির দিকে উদ্দেশ্য করে অজিতকে দেখিয়ে বললেন,"এই হচ্ছে আমাদের একমাত্র সম্পদ, এই বুড়ো-বুড়ির স্নেহের ধন,যার ভালো নাম অন্নপূর্ণা। অবশ্য ভালো নামটার বদলে ওর খারাপ নাম মহুল নামেই সবাই ওকে বেশি চেনে।আমাদের কন্যা। "
"ভালো নামের থেকে খারাপ নামটাই কিন্তু শুনতে বেশি ভালো লাগছে। আর আমরা বাঙালি,ভালো নাম যাই থাকুক না কেন,ওই খেঁদি-পেঁচি,বাবলু-পল্টু নামেই আমাদের বেশি পরিচিতি। "অজিত যতীনবাবুকে প্রত্যুত্তরে জানাল।
"তোমার কিন্তু বেশ ভালো রসবোধ আছে এটা মানতেই হবে। "বলেই হো হো করে হাসতে শুরু করলেন যতীনবাবু।
অজিতের মহুলকে দেখে কেন জানিনা মনে হল মেয়েটির মধ্যে যেন কোনও অস্বাভাবিকতা রয়েছে। পরে ভাবল,না ও হয়ত ভুল ভাবছে।মেয়েটি এমনিই হয়ত ওদের কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে না।অজিত তার স্বভাববশতঃ মহুলকেও নমস্কার জানাল। কিন্তু মহুলের তরফ থেকে কোনও প্রতিনমস্কার না পেয়ে পরিবর্তে মহুলকে বাঁ হাতে স্কার্ট ধরে ডানহাতের আঙুলের নখ খেতে দেখে এবার অজিত একটু অবাকই হল। ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেন কমলাদেবী। তিনিই তখন বললেন,"ওর আবার নমস্কার, ও এসব কিছু বোঝে নাকি?তুমি কিছু মনে কোরোনা বাবা।মেয়ে আমাদের এরকমই।ওর বয়েসটাই যা তিরিশ,ভিতর থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চা .........."
স্ত্রীকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই মাঝপথ থেকে যতীনবাবু বাধা দিয়ে বলে উঠলেন,"তুমি আবার সেই শুরু করলে?"
কিন্তু কমলাদেবী থামলেন না,বরং স্বামীর কথার উপর পুনরায় কথা বলতে শুরু করে দিলেন।"এতে শুরু করার কি আছে?যা সত্যি তাই বলছি। আজ নয়তো কাল ও ঠিকই জানতে পারবে যে আমাদের মেয়ে অ্যাবনর্মাল।"
"কতবার বলেছি না তোমায় বারবার মেয়েটাকে অ্যাবনর্মাল অ্যাবনর্মাল বলবে না"স্ত্রীর উপর রেগে গিয়ে কথাগুলো বলেন যতীনবাবু।
"না বলবে না।তুমি-আমি না বললে যেন সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে?আর কাকেই বা বলা?যাকে নিয়ে বলছি তার কি কোনও তাপ-উত্তাপ আছে?"কথাগুলো বলতে বলতে কমলাদেবীর গলা যেন দলা পাকিয়ে আসতে থাকে,চোখ ছলছল করে ওঠে।আর যাকে নিয়ে এত কথা সে বেচারি এসব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। সে এখন তার দুহাত দিয়ে তার স্কার্টের দুদিকটা ধরে একবার এ ঘর আরেকবার ও ঘর তো কখনও দালানময় ছুটে বেড়াচ্ছে। এটাই তার আজকের এবেলার খেলা।
মেয়ের সম্পর্কে অজিতকে ভারি গলায় বলতে শুরু করলেন কমলাদেবী, "বিয়ের বহুবছর পরও আমাদের কোনও ছেলে-পুলে হচ্ছিল না। কত ডাক্তার-টাক্তার দেখালাম,কত ওষুধ-পত্তর খেলাম।কিছুতেই কিছু হল না।মন্দির-মসজিদ,জলপোড়া কিছুই বাদ দিলাম না।তবু কোনও লাভ হল না। একসময় সন্তান লাভের আশাই প্রায় ছেড়ে দিলাম আর ঠিক সেই সময় কোল আলো করে ঘরে এল অন্নপূর্ণা। খুশির কোনও সীমা ছিল না সেদিন। প্রথমে সবকিছু ঠিকই ছিল।কিন্তু মেয়ে যত বড় হতে লাগল ততই ওর শরীরে নানারকম জটিলতা ধরা পড়তে লাগল।শহরের কোনও নামকরা ডাক্তারকে দেখাতে বাকি রাখিনি।কিন্তু সব ডাক্তারই এক এক করে জবাব দিয়ে দিল।সবার একই বক্তব্য-কিছু করার নেই। এটাই ওর ভবিতব্য আর এটাই আমাদের মেনে নিতে হবে।আমার শূণ্য কোল ভরে উঠেছিল ও আসার পর।আজ ওর ভবিষ্যৎ দেখে ভাবি,এর চেয়ে আমার শূণ্য কোলই ভালো ছিল।"বলতে বলতে চোখে জল চলে আসে কমলাদেবীর। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে,ফোঁটা দুই জল শাড়ির আঁচলের কোণায় মুছে নিলেন তিনি।
"আর কি করবে বলো?ভাগ্যের পরিহাস বলো বা অন্যকিছু।ভাগ্যকে কে কবে অস্বীকার করতে পেরেছে বলো?আমাদেরও মেনে নিতে হবে যা আছে ভাগ্যে। তা সে যেমনই হোক না কেন।"স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে কথাগুলো বললেন যতীনবাবু।
সবকিছু শুনে অজিতের সেখানে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় ছিল না।অজিত মনে মনে ভাবতে থাকে ,এই সদাহাস্য দম্পতির বুকে কি কঠিন পীড়াই না বিরাজ করছে অথচ বাইরে দিয়ে দেখলে বোঝাই যায় না।এরপর সে ঘরে কিছুক্ষণের জন্য যেন স্তব্ধতা বয়ে গেল।ঘরে উপস্থিত তিনজনই ভিষণরকম চুপচাপ হয়ে পড়ল।এতক্ষণের খুশির পরিবেশ যেন মুহূর্তের মধ্যে এক অপ্রত্যাশিত অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যতায় পরিবর্তিত হয়ে গেল।এই পরিস্থিতিতে কি করণীয়, অজিত কিছুতেই কিছু খুঁজে পেল না।অবশেষে খুব জোরে একটা দম নিয়ে,মনোবল বাড়িয়ে, ঘরের নিরবতা কাটিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন কমলাদেবী,"এই আর কি আমাদের কথা।জানি পাল্টাবে না, তাই মেনে নিয়েছি।শুধু একটাই ভয়,আমরা চোখ বুজলে ওর কি হবে?তাই তো আমাদের অবর্তমানে ওর দেখভালের জন্য একটা জায়গা ঠিকও করেছিলাম।টাকাটা একটু বেশি লাগত, কিন্তু আমরা যখন থাকব না তখন ওকে তো ওরা দেখত!খুব সুন্দর পরিবেশ,সবকিছুর বেশ ভালো ব্যবস্থা আছে এমনকি ওদের জন্য পড়াশোনারও ব্যবস্থা আছে।মেয়েকে নিয়ে আমরা গেলাম। মেয়ে কি বুঝল কে জানে?হয়তো কিছু আঁচ করতে পেরেছিল কিংবা ভেবেছিল যে ওকে হয়তো ওখানে আমরা বরাবরের জন্য রেখে আসতে গেছি।সে কি কান্না। ওর বাবা বোঝায় একবার,আমি বোঝাই,কোনও লাভ হল না। আর কি করার।আমি তাও শক্ত ছিলাম।বলো না ওর ভালোর জন্যই তো এসব করা।কে দেখবে বলো তো ভবিষ্যতে ওকে?তাই মনকে শক্ত করে ওকে ওই অবস্থাতেই একটু-আধটু বকাবকিও করি।কিন্তু ওর বাবা,মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল।ব্যস্ শেষমেশ বহু কান্নাকাটির পর আবার তিনজনে বাড়ি ফিরে এলাম।এমন জানো।"খানিক বিরতি নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন কমলাদেবী, "কি আর বলব তোমায় এই বাবা-মেয়ের কথা।সে বার একটা আয়া রাখলাম ওর দেখাশোনার জন্য। তো আমি আর ওর বাবা একদিন বেরিয়েছি ওকে আয়ার কাছে রেখে।ঘরে ফিরে দেখি মেয়ের মুখ গোমড়া। বাবাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করে দিল।আর বাবা তো মেয়ে বলতে অজ্ঞান। মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি আয়া নাকি ওকে বকেছে।ব্যস্ ওর বাবার তো আয়াকে সে কি বকাবকি।আয়ারও প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আরে সেরকম কিছুই না।ফ্রিজ খুলে ঘনঘন ঠান্ডা জল খাচ্ছিল বলে মেয়েকে প্রথমে ভালোভাবেই বারণ করে আয়া,শোনেনি বলে একটু কড়া করেই ওকে বলেছে।সে যত ওর বাবাকে বোঝায় ওর বাবা বুঝবে না।শেষমেশ জানো কি করেছে ওর বাবা?থানা-পুলিশ পর্যন্ত করেছে।আয়া তো হাতে-পায়ে ধরে কিন্তু ওর বাবা শুনলে তো?তারপর আমি অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওর বাবাকে ঠান্ডা করে ব্যাপারটা শেষমেশ মেটাই।সেই থেকে আর আয়া রাখা হয় না এ বাড়িতে।বুঝলে?এরা বাপ-বেটি এমন। অগত্যা আমাকেই মেয়ের সবকিছু দেখতে হয়।কি করব?আরে আমারও তো বয়েস হয়েছে। বলোনা আমি আর এখন এতসব করতে পারি কখনো?"
"আমার গিন্নি মনে হয় তোমার দেরি করিয়ে দিচ্ছে তাই না অজিত?তোমার হয়তো তাড়া আছে।"স্ত্রীর কথার মাঝেই কথাগুলো বললেন যতীনবাবু।
"না না এক্কেবারেই না।আমার তো বেশ ভালোই লাগছে আপনাদের বাবা-মেয়ের বাৎসল্য রসের কাহিনী শুনতে।তাড়া কিসের?আজ তো ছুটির দিন আর তাছাড়া আজ আমার দেশের বাড়িতেও যাওয়ার নেই। "স্মিত হাসি হেসে যতীনবাবুকে জানাল অজিত।
"তাহলে বলছ তাড়া নেই?আরেকটু বসা যাবে? তাহলে আরেকটু চা হোক।কই গিন্নি চা বসাও।"যতীনবাবু বেশ গদগদ হয়ে কথাগুলো বললেন।
"তা বসতে অসুবিধে নেই।কিন্তু আবার ওনাকে চায়ের জন্য কষ্ট দেওয়া কেন। এই তো একটু আগেই চা খেলাম। "আবার চা প্রসঙ্গ শুনে এবার একটু ইতস্তত করেই কথাগুলো বলে অজিত।
কিন্তু কমলাদেবী কিছুমাত্র বিরক্ত না হয়ে অজিতকে বললেন,"তোমার দ্বিতীয়বার চা খেতে আপত্তি আছে কি?"
"না"অজিত একটু লজ্জা পেয়েই জানাল।
"তাহলে আমারও বানাতে কোনও অসুবিধা নেই। আরে বাবা তুমি খেলে আমরাও তো একটু খাব ।এটা বুঝতে পারছ না?আর তোমাকে লজ্জা পেতে হবে না।"এই বলে কমলাদেবী দ্বিতীয়বারের জন্য চা বানাতে গেলেন।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কমলাদেবী আবার বলতে শুরু করলন,"হ্যাঁ তা যা বলছিলাম এই বাপ-বেটির ব্যাপারে। বাবা তো মেয়েকে ঘরের বাইরে বের করে না বললেই চলে।আগে অবশ্য আমাদের সঙ্গে বেরোত । একদিন বাবা-মেয়ে বেরিয়েছে তো কে কি বলেছে আর সেটা শুনে মেয়েকে আর বাড়ির বাইরেই বের করেনা।আমি কত করে বোঝাই, যে যাই বলুক বাদ দাও।মেয়েটার শরীর-স্বাস্থ্যটা আগে।বাইরে না বেরোলে শারীরিক দিক থেকেও ভেঙে পড়বে আর মানসিক অবস্থাও আরো খারাপ হয়ে যাবে।দ্যাখো না বাইরে না বেরিয়ে বেরিয়ে মেয়েটা যেন কেমন জবুথবু হয়ে যাচ্ছে। "
"সে তো হবেই। সবসময় বাড়িতে থাকলে বাইরের জগৎটাই ভুলে যাবে একদিন। আরে লোকজন তো হয়ই খারাপ বলার জন্য। আপনি খারাপ কিছু না করলেও লোক জোর করে আপনাকে খারাপ বানাবে।আপনি হাজারটা ভালো কাজ করুন কিন্তু লোকে ঠিক খুঁজে খুঁজে আপনার খুঁতটাই বার করবে "সবকিছু শুনে-টুনে অজিত মন্তব্য করে।
"যা বলেছো তুমি।তাই তো বলি মেয়েটাকে বাড়ির বাইরে বের করো।বাইরের হাওয়া-বাতাস লাগাটাও তো জরুরি ওর শরীরের জন্য ।শুধু বলবে ছাদে গিয়ে হাঁটা-হাঁটি করুক তাহলেই হবে।বলো তো কোথায় রাস্তা আর কোথায় বাড়ির ছাদ!তাছাড়া লোকজনের সাথে মেশাটাও তো জরুরি। লোকজনের সাথে না মিশে মিশে ওর এমন অবস্থা হয়েছে যে বেশি লোকজন বা ভিড় ওর আর ভালো লাগে না ,অচেনা লোক দেখলে ঘাবড়ে যায়।"অনেকদিন পর কমলাদেবী মনের মতো মানুষের কাছে তাঁর মনের দুটো কথা বলতে পেরে যেন স্বস্তি পেলেন।তাই সহজে থামবার বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত না দিয়ে আবারও বলতে লাগলেন,"মা-বাবা ছাড়া ওর পরিচিতের জগতের মধ্যে আছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকজন। এই যেমন ধরো কিছু আত্মীয়-স্বজন,বিশেষ করে ওর পিসতুতো দাদা সৃজন।যে নিয়ম করে প্রতিবছর আমার মেয়ের হাতের রাখি আর ভাইফোঁটা নিতে ভোলেনা।আর আছে বাড়িতে আসা কিছু পাড়া-প্রতিবেশী।আর হ্যাঁ আমার দুজন প্রধান সাহায্যকারী।কাজের লোক বলতে যেন কেমন একটা লাগে।একজন রাঁধুনি আর একজন তোলা কাজ করে।দুজনে প্রায় এ বাড়িতে বিশ বছর কাজ করছে।ওরা দুজন আমার মেয়ের খুব প্রিয়। এই ওর পরিচিতজনের লিস্ট। "কথা শেষ হতে না হতেই অন্নপূর্ণা হাতে দুটো বই নিয়ে তার খামখেয়ালিপনায় হাজির হল তার বাবার ঘরের সামনে। "ওই যে,বাবার জ্বর হয়েছে বলে বাবা দুদিন পড়াতে পারেনি বলে ঘুরঘুর ঘুরঘুর করছে।এমন মেয়ে,আমার কাছেও পড়বে না। "
অজিত এবার সস্নেহে অন্নপূর্ণা ওরফে মহুলের উদ্দেশ্যে বলল,"কই দেখি কি বই পড়েন আপনি?"
"এই দাঁড়াও দাঁড়াও, কাকে আপনি-আজ্ঞে করছ?ও এসব বোঝে-টোঝে না।বললাম না বয়েসটাই যা ওর তিরিশ,ভিতর থকে এক্কেবারে বাচ্চা। "অজিতকে শুধরে দিয়ে কমলাদেবী কথাগুলো বললেন।
"ওর কিন্তু তুই-এর দোষ আছে বাবা।"যতীনবাবু হাসতে হাসতে যোগ করলেন।
"হ্যাঁ আর বলো কেন?দুনিয়ার লোককে তুই।সেই প্রথম থেকে।কতবার বলেছি আমাদের বলছিস বল,বাইরের লোককে আপনি না হোক তুমি বলিস।কে শোনে কার কথা?সেই তুই।আর লোকজনও তেমন।ও এরকম বলে সহানুভূতি দেখিয়ে ওর তুইটাই সবাই সাদরে গ্রহণ করেছে।আমাদের সংশোধনটা কোনও কাজে দেয়নি। তাই তুমিও দয়া করে ওকে আপনি-আজ্ঞে না বলে তুমিই বোলো চাইলে তুই-ও বলতে পারো।"কমলাদেবী অজিতকে বললেন।
"তা অবশ্য আমি ওনাকে, সরি ওকে তুমি বা তুই বলতেই পারি কারণ ও আমার থেকে ছোট।আমি বরং তুমিই বলি।যদিও আমি বিশ্বাস করি এই তুই-তুমি-আপনির মধ্যে তুই হল সবচেয়ে কাছের সম্বোধন, তুমিটা একটু দুরের আর আপনি হল বহু যোজন দুরের ।"অজিত মন্তব্য করল।
"কথাটা মন্দ বলোনি।"যতীনবাবু অজিতের কথা সমর্থন করলেন।
এইবার অজিত মহুলের হাতে থাকা বইগুলোর উদ্দেশ্যে বলল,"আমায় বইগুলো দেখাবে?আমার কাছেও এরকম অনেক বই আছে।আর আমার অনেক ছোট ছোট বন্ধু আছে,তাদের পড়াই সেই বইগুলো। "
মহুল খুব সহজেই অজিতের কথায় তার বইগুলো দিয়ে দিল।আর তার এই ব্যবহারে ভারি অবাক হলেন মহুলের মা-বাবা।
কমলাদেবী তো সরাসরি বলেই দিলেন,"বাঃ বাঃ তোমাকে তো বেশ তাড়াতাড়ি বইগুলো দিয়ে দিল।আসলে অচেনা মানুষদের সাথে ও বড় একটা মিশতে চায় না তো তাই একটু অবাকই হলাম,তোমার প্রতি ওর ব্যবহারে।"
অজিত বইগুলো হাতে নিয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখল এক্কেবারে বাচ্চাদের বই।বর্ণপরিচয়, ইংরাজি বর্ণমালা, সংখ্যা, চিহ্ন এসবের বই।
বইগুলো অজিতের হাতে তুলে দিয়ে সরল বালিকার মতো প্রশ্ন করে মহুল, "তুই আমায় পড়াবি?"
মহুলের এ ধরনের প্রশ্নে অজিত ভারি অবাক হয়ে গেল।কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।কমলাদেবী-যতীনবাবুও একরকম হতবাক্ হয়ে গেলেন।
কমলাদেবী গালে হাত দিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,"সে কি রে!তুই তো অবাক করে দিলি।জানো এমন পাজি মেয়ে, আমি পড়ালে বলবে-তুই বাজে পড়াস্।আর সেখানে তোমাকে চেনে না জানে না কেমন বইগুলো দিয়ে দিল,আর এখন আবার তোমার কাছে পড়তেও চায়। না-না মহুল ওকে ছেড়ে দে।ও ব্যস্ত মানুষ। এমনিতেই ওর অনেক দেরি করিয়ে দিয়েছি আমি।"
কিন্তু অজিত কিছুমাত্র বিরক্তিবোধ প্রকাশ না করেই বলল,"আমার কোনও অসুবিধা নেই। ছাত্রী যখন পড়তে রাজি আছে এই স্যারও তখন পড়াতে রাজি আছে "
অজিতের কথায় যতীনবাবু-কমলাদেবী না হেসে পারলেন না।তারপর বেশ কিছুক্ষণ চলল ছাত্রী-মাস্টারমশাইয়ের জ্ঞান আদান-প্রদান পালা।পড়াশোনা শেষে মহুল বেশ খুশি হয়েই তার আঁকার খাতাগুলো আনতে গেল মাস্টারমশাইকে দেখাবে বলে।
"বাঃ বাঃ তোমার সাথে তো বেশ তাড়াতাড়ি ভাব জমিয়ে ফেলেছে।এত তাড়াতাড়ি তো ও কারোর সাথে ভাব করেনা।জানো ওর আঁকা খুব প্রিয়। "মেয়ের কাণ্ডকারখানায় একপ্রকার বিস্মিত হয়েই অজিতকে কথাগুলো বললেন কমলাদেবী।
মহুলের আঁকাগুলো সস্নেহে দেখে,তার আঁকার খুব প্রশংসা করে এবার অজিত সত্যি-সত্যিই প্রস্তুত হল তার ঘরে ফেরবার উদ্দেশ্যে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই সরলা তরুণীর জিজ্ঞাস্য,"কাল আবার পড়াবি তো স্যার?"
মহুলের এহেন আবদারে তিনজনেই হতবাক্। তবে অজিত অবাক হলো ওর মতো তরুণীর মুখে 'স্যার' শব্দটা শুনে।
তাই একটু আশ্চর্যচকিৎ হয়েই মহুলকে প্রশ্নটা করল অজিত,"তুমি কি করে জানলে আমি তোমার স্যার হই?"
যতীনবাবুই অজিতকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন,"আরে গত পরশু আমরা বাপ-বেটি মিলে একটা সিনেমা দেখছিলাম। যাতে ছিল স্কুলের একটা সিন্।সেখানে এই তোমার মতো একজন টিচার ক্লাসে বেশ কিছু কচি-কাঁচাকে পড়াচ্ছিল।ওই সিনেমার হিরো।তবে হিরোর অভিনয়টা যে করছিল তাকে চিনি না, সাউথের কোনও হিরো-টিরো হবে।ওই যেমন আজকাল চ্যানেলগুলোয় সাউথের সিনেমাগুলোকে হিন্দিতে ডাবিং করে দেখায়,সেরকমই একটা সিনেমা দেখছিলাম আর কি। তখন আমিই মেয়েকে বুঝিয়ে বলি-যিনি পড়াচ্ছেন তিনি হচ্ছেন স্যার আর যারা পড়ছে তারা হল স্টুডেন্টস্।তাই ও তোমায় স্যার বলেছে।"
"ও তাই বুঝি?তা ভালো ভালো। "একটু অবাক হয়ে অজিত প্রতিক্রিয়া জানায়।তারপর আরো বলে,"ভালো বুদ্ধি আছে তো,পরশু দেখা সিনেমা অনুযায়ী আজ আন্দাজ করে নিল যে আমি ওর স্যার হই!এ কিন্তু আপনার ভারি অন্যায়, মেয়েকে এভাবে ঘরে পুরে রাখছেন। আমি তো দেখতে পাচ্ছি ও রীতিমতো বেশ বুদ্ধিমতী।"
যতীনবাবু একটু মুচকি হেসে বললেন, "কি আর করার আছে বলো?সে তো ওর ভালোর জন্যই ওকে ঘরে আটকে রাখি,বাইরে মিশতে দিই না।সে যাক্ গে।কিন্তু মেয়ে আমার দারুণ ফাঁসিয়ে দিয়েছে তোমায় ওর কথায় কিছু মনে কোরোনা। ওকে আমি পরে বুঝিয়ে বলব।তোমাকে আর ওকে জোর করে পড়াতে আসতে হবে না "
"না না জোর করার কি আছে?আমার তো বেশ ভালোই লাগল।আমার পড়াতে কোনও অসুবিধা নেই ওকে।তবে দিনে তো আমার স্কুল থাকে তাই আমি পড়ালে সন্ধ্যেতে পড়াতে আসব,অবশ্যই আপনাদের যদি কোনও অসুবিধা না থাকে।"অজিত যতীনবাবুকে জানায়।
"আমাদের কেন অসুবিধা হবে?আমরা তো সারাদিন এই বাড়িতেই থাকি।তোমার অসুবিধা না হলে আমাদের আর কি?" যতীনবাবু খুশি খুশি মনে কথাগুলো অজিতকে বললেন।
"তাহলে ওই কথাই রইল স্যার আমি কাল ওই সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ পড়াতে আসব। "যতীনবাবুকে জানাল অজিত।
যতীনবাবু একটু অবাক হয়ে পিছনে চারিদিকে তাকিয়ে কাকে যেন খোঁজার ভান করলেন। তারপর অজিতের উদ্দেশ্যে বললেন,"স্যার?কাকে বলছ আমাকে?"
"হ্যাঁ, এখানে তো আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। " অজিতও যতীনবাবুকে উত্তরে জানায়।
"আমি আবার কবে তোমাকে পড়ালাম?মনে পড়ছে না তো?" যতীনবাবু মুচকি হেসে স্মৃতিভ্রংশের ভান করলেন অজিতের কাছে।অজিতও বিষয়টা বুঝতে পেরে একটু হেসে বলল,"না মানে আপনাকে কিছু তো একটা বলে সম্বোধন করতে হবে,কতক্ষণ আর উহ্য রেখে আপনি-আজ্ঞে করে চালাব।তাই আর কি.............."
অজিতকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই যতীনবাবু বললেন,"তোমরা এই আজকালকার দিনের ছেলেপুলেরা কথাবার্তায় আদব-কায়দায় এত বেশি পাশ্চাত্যধর্মী যে,বেশি আদব-কায়দা দেখাতে গিয়ে আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির আত্মিক যোগাযোগটাই ভুলতে বসেছ।তা বলি কাকু বলে ডাকতে কি তোমার সন্মানে বাধবে?"
অজিতও লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে জানাল, "না না তা কেন?ঠিক আছে তাহলে আজ থেকে আমি আপনাকে কাকু বলেই ডাকব।তাহলে আজ আসি কাকু।কাল আমি সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ আসছি মহুলকে পড়াতে।"এই বলে অজিত সেদিনকার মতো বিদায় নিল যতীনবাবুদের বাড়ি থেকে।
কিন্তু যতীনবাবু বা ওনার স্ত্রী কমলাদেবী মোটেও আশা করেননি যে অজিত সত্যি সত্যিই কথা রাখবে।তাঁরা একপ্রকার ভুলেই গেলেন অজিতের মহুলকে পড়ানোর বিষয়টা।তাই পরদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়ির বেলটা বেজে উঠতে ওনারা একেবারেই আশা করননি যে অজিত আসতে পারে বলে।দরজা খুলে অজিতকে দেখে তাই অবাকই হলেন যতীনবাবু,আবার ভালোও লাগল তাঁর,অজিত তার কথা রেখেছে বলে।বিষয়টা খানিক আঁচ করতে পারল অজিত তাই সে যতীনবাবুকে বলল,"ভাবতে পারেননি না যে আমি সত্যিই মহুলকে পড়াতে আসব?"
"কি করে ভাবব বলো যে আমার অমন সোনার টুকরো মেয়েটার কথা তুমি সত্যি সত্যিই ভেবেছ ।ওর মন রাখতে তুমি আজ আমাদের বাড়িতে এসেছ।আর সবাই তো ওকে পাগল-ছাগলই ভাবে।"যতীনবাবুর কথায় কেমন যেন যন্ত্রণার সুর বেজে উঠল তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।সমস্ত যন্ত্রণাকে আপাতত দুরে সরিয়ে রেখে যতীনবাবু অজিতের সাথে খোশমেজাজে জমজমাটি গল্প শুরু করে দিলেন।আর তাতে যোগ দিলেন কমলাদেবী। একপ্রস্থ গল্পের পালা শেষ হওয়ার পর মহুলকে পড়াতে বসল অজিত।মহুলও বেশ বাধ্য ছাত্রীর মতো অজিতের কাছে পড়াশোনা করল।এর আগে সে কখনোই কোনও অপরিচিত ব্যক্তির কাছে এরকম বাধ্য হয়ে তাকে আপন মনে করে তার কাছে পর্যন্ত যায়নি,তার কাছে লেখাপড়া করা তো দুরস্ত।যা দেখে তার মা-বাবা কম অবাক হননি।অজিত তার পরের দিনও পড়াতে এল।এইভাবে গোটা পাঁচদিন কেটে গেল।অবশেষে একদিন বলতে বাধ্য হলেন কমলাদেবী।
"দ্যাখো বাবা, তোমার কাকুকে বলতে বলেছিলাম।কিন্তু ও ইতস্তত বোধ করছেন।তাই অগত্যা আমিই বলতে বাধ্য হচ্ছি............."
কমলাদেবীকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই খানিক ঘাবড়ে গিয়ে অজিত মাঝপথ থেকে বলে ওঠে,"কেন কি হয়েছে?মহুল কি আর আমার কাছে পড়তে চায় না?ওর কি আমার পড়ানোটা পছন্দ হচ্ছে না?"
"আরে ধুর ধুর,তা না।তোমার পড়ানো নিয়ে মহুলের কোনও আপত্তি নেই।সে তো এই ক'দিনে দেখছি তোমার জন্য সন্ধ্যেবেলা রীতিমতো অপেক্ষা করে থাকে কখন তুমি আসবে বলে।আসলে পাঁচদিন হয়ে গেলো,তুমি আসছ,পড়াচ্ছো।আমরা চাই তুমি বরাবরই ওকে পড়াও,আমাদের কোনও অসুবিধা নেই।হ্যাঁ যদি তোমার কোনও অসুবিধা না থাকে।তাই বলছিলাম, মাইনে কত নেবে যদি বলতে?"কমলাদেবী অজিতকে সবিস্তারে বুঝিয়ে বললেন।
"ও এই ব্যাপার?"অজিত এতক্ষণ ভাবছিল কি না কি?কমলাদেবী সবটা বুঝিয়ে বলার পর অজিত আশ্বস্ত হয়ে বাকি কথাগুলো বলল,"দেখুন,ভগবানের কৃপায়,গুরুজনদের আশীর্বাদে আর নিজের মেহনতে আজ আমি একটা সরকারি স্কুলে পড়াই।মাইনে বেশ ভালোই। একা মানুষ আমার বেশ ভালোভাবেই চলে যায়। মহুলকে পড়াই আমার নিজের ইচ্ছায়। ওকে পড়িয়ে আপনাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার আমার কোনও প্রয়োজন বা ইচ্ছা নেই।কিন্তু হ্যাঁ,ও সবার থেকে আলাদা বলে ওকে কোনরকম দয়া দেখাচ্ছি,এটা ভাববেন না যেন।"
কথার মাঝে একটু বিরতি নিয়ে আবার বলতে শুরু করে অজিত,"আমি শনি-রবিবার দেশের বাড়ি যাই শুধু ওই ফাঁকা বাড়িটা দেখাশোনা করব বলে নয়।আরো একটা কারণ আছে।ওই দুদিন ওইখানকার অনেক বাচ্চা আমার কাছে পড়তে আসে।আমিও তাদেরই পড়াই যাদের আমাকে নূন্যতম পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা নেই।ওরা প্রত্যেকেই হতদরিদ্র ঘরের সন্তান। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ওদের পড়ানোর পাশাপাশি, ওদের বই-পত্তর কিনে দেওয়া,কারোর কোনও বিষয়ে অর্থ সাহায্যের প্রয়োজন হলে তাও দিয়ে থাকি।গর্ব করে বলছি না এসব কথা।আমার ভালো লাগে এসব করতে।এসব করে আমি আত্মার শান্তি পাই বা বলতে পারেন মানুষকে সাহায্য করা একধরনের আদর্শ আমার কাছে।"
"ওহ্, তুমি তাহলে সোশ্যাল ওয়ার্কও কর?"যতীনবাবু অজিতের এই নতুন দিকটা জানতে পেরে বিস্ময়াবিভূত হয়ে প্রশ্নটা করলেন।
"দেখুন সোশ্যাল ওয়ার্ক আর চ্যারিটি, এই দুটো কথাতেই আমার ঘোরতর আপত্তি। মানুষের প্রয়োজনে সামান্য সাহায্যের হাতটুকু বাড়িয়ে দেওয়া। তার জন্য এত বিশেষণ?দুনিয়ার সবথেকে বড় সোশ্যাল ওয়ার্কার কে জানেন?আমাদের মায়েরা।সারাদিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন,অথচ বিনিময়ে নূন্যতম স্বীকৃতিটুকু পান না।কেউ দাম দেয় না।আরে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া, চাকুরিজীবীদের তো তাও ছুটি হয়,কিন্তু মায়েদের তিনশো পঁয়ষট্টি দিন চব্বিশ ঘন্টাই অবিরাম কাজ করে যেতে হয়।কই তখন তো কেউ তাদের কথা ভাবে না।তাহলে আমি দুটো মানুষের পাশে দাঁড়ালে এতো ভারী ভারী সম্ভাষণ কেন?"
অজিতের এই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টায় এবং অজিতের কথাবার্তায় যতীনবাবু এবং কমলাদেবী দুজনেই বেশ অবাক হয়ে গেলেন এবং তাঁদের থেকে বয়সে অনেক ছোটো এই তরুণটির প্রতি দুজনেরই মন শ্রদ্ধায় পূর্ণ হয়ে উঠল।
অজিত বলে চলল,"সামান্য মানুষ আমি।সাধ্যের মধ্যে থেকে যতটুকু যা করতে পারি করি।যা করি স্বেচ্ছায়।আর এর পরিবর্তে কোনও আশা করি না।আমি এও আশা করি না এদের থেকে যে,আজ যাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি তারা ঘুরে কোনওদিন আমায় শুকনো ধন্যবাদটুকু দেবে।যা করি কোনও স্বার্থ না রেখে করি।স্বর্গ পাবো বা এসব করে পুণ্যি কামাবো,এরকম কোনও লোভ বা বাসনা আমার মধ্যে নেই।আপনারা বরং আমায় আশীর্বাদ করুন যাতে আমি আজীবন এভাবেই মানুষের প্রয়োজনে মানুষের কাছে আমার সাহায্যের হাতটুকু বাড়িয়ে দিতে পারি।"
যতীনবাবু-কমলাদেবী দুজনেরই চোখ ছলছল।কমলাদেবী বললেন,"তুমি আমাদের থেকে অনেক ছোটো বাবা।কিন্তু কাউকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে বয়েস দেখলে হয়না। মানুষ তার কর্মগুণে শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। তুমিও ঠিক তেমনি বাবা।আমরা অন্তর থেকে তোমায় আশীর্বাদ করছি,তোমার ভালা হোক।তোমার জীবন সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক। মানুষের জন্য আরও ভালো-ভালো কাজ করে যাও।তোমায় দেখে মানুষ কিছু শিখুক।আজকালকার দিনে মানুষ বড়ো তার নিজের স্বার্থ নিয়েই চলে।তোমাদের মতো মানুষ এখনকার দিনে বিরল।তোমার থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ যেন তোমার মতো হতে পারে।"
তারপর থেকে প্রায় একটা বছর কেটে গেছে,অজিত মহুলের স্যার। তবে অজিত যে শুধু ওকে পড়ায় তা কিন্তু নয়। অজিত মহুলকে পড়াশোনার পাশাপাশি ওকে রাস্তায় নিয়ে হাঁটাতে বেরোয়।হালকা ব্যায়াম করায়,খেলায়।পাড়ায় রীতিমতো জনপ্রিয় ওদের এই গুর-শিষ্যা জুটি। একদিন স্কুলে অজিতের ক্লাসের চাপটা একটু এসে পড়তে তাহলে যে কমই ছিল।দুপুরের পরে আর ক্লাস ছিল না।তাই অজিত দুপুর দুটোর মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসার সুযোগ পেয়ে গেল।ফ্ল্যাটের কাছাকাছি আসতেই অজিত অবাক হয়ে গেল রাস্তায় মহুলকে দেখতে পেয়ে, আরো দেখতে পেল,মহুলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারটে ছেলে,তার মধ্যে একটা ছেলে আবার মহুলের ডান হাতটা ধরে টানছে।সুনসান ফাঁকা রাস্তা, গ্রীষ্মের দুপুর, বাইরে কেউ কোত্থাও নেই।সেই সুযোগই নিয়েছে এইসব ছেলে-পুলেরা।ছেলেগুলো এপাড়ার নয়,অজিত দেখেই চিনেছে।এরা রাস্তার লোফারটাইপ ছেলে-ছোকরা। একলা মেয়ে দেখেছে কি সুযোগ নিতে এসেছে।অজিত আর একমুহূর্তও দেরি না করে ছুটে গেল ওদিকে।
"অ্যাই,অ্যাই তোরা কে রে?দাঁড়া দেখাচ্ছি তোদের।"
অজিতের ভারী কন্ঠস্বরের ধাতানি,আর ওর লম্বা-চওড়া,সুঠাম,পুরুষালি চেহারা নিয়ে মারমুখী হয়ে তেড়ে আসা দেখে ছেলেগুলো এক দৌড়ে পালালো।অজিতও ওদের পিছু পিছু ধাওয়া করতে লাগল,যদি অন্তত একটাকেও ধরা যায়। অন্যদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ভীত হয়ে মহুল রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। মহুলের কান্নাযুক্ত আর্তনাদে অজিত ওদের পিছু ছেড়ে মহুলের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হল।অজিত মহুলের কাছে যেতেই মহুল ভয়ে অজিতকে জড়িয়ে ধরল।অজিতও মহুলকে সান্ত্বনা দিতে দিতে তাকে নিয়ে চলল তাদের বাড়ি।বাড়ির দরজাটা খোলাই ছিল।অজিতের ডাকাডাকিতে যতীনবাবু আর কমলাদেবী দুজনেই দুজনের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কমলাদেবী এইমাত্র টের পেলেন যে মহুল আসে-পাশে কোথাও নেই।উপরন্তু মহুলকে অজিতের সাথে বাইরে থেকে আসতে দেখে বেশ অবাকই হয়ে গেলেন।পরে দুপক্ষের কথাবার্তায় পুরো বিষয়টা পরিস্কার হল।আসলে দুপুরবেলা খাওয়া নিয়ে আজ মহুল একটু বেশিই বায়না করেছিল।তার ইচ্ছা ছিল মুরগির মাংস, কিন্তু বাড়িতে হয়েছিল মাছ।খাবার নিয়ে জেদাজেদি করায় তাই কমলাদেবী মেয়েকে একটু বকাবকি করেন।ঠোঁট ফুলিয়ে তখনকার মতো চুপচাপ খাবারটা খেয়ে নিলেও ভিতরে ভিতরে রাগটা পুষে রেখেছিল।তাই দুপুরবেলা বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়ার পর কখন যে সে মায়ের পাশ থেকে উঠে,আসতে আসতে দরজাটা খুলে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে গেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি কমলাদেবী। কমলাদেবী তো মেয়েকে এই মারেন তো সেই মারেন।কমলাদেবীকে শান্ত করতে আর মহুলকে তার মায়ের মারের হাত থেকে বাঁচাতে অজিত মা আর মেয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। মহুল তো ভয়ে অজিতের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল।
"জন্ম থেকে জ্বালাচ্ছে।এমন ইচ্ছা করছে যেন ধরে দিই দুটো।"রাগের মাথায় কথাগুলো বলতে বলতে থাপ্পড় মারার ভঙ্গিমায় কমলাদেবী মহুলের দিকে তেড়ে যেতেই ,অজিত রুখে দাঁড়ালো।
"আরে আরে করছেন কি?ও কি জেনে-বুঝে এসব করেছে নাকি?ও কি বোঝে বাইরের জগৎ সম্বন্ধে?"অজিত কমলাদেবীকে মারধরের হাত থেকে বিরত করতে করতে কথাগুলো বলল।
"না ও এসব বোঝেনা।এদিকে খাবার নিয়ে মায়ের সাথে ঝামেলা করে রাগ দেখিয়ে চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে জানে। পাপ পাপ বুঝলে পাপ।গত জন্মে নিশ্চয়ই কোনও পাপ করেছিলাম, নাহলে অমন সন্তানকে কি কখনও পেটে ধরি?আগে যদি জানতাম পেটে অমন একটা কাল আসছে তাহলে ওটাকে পেটেই নষ্ট করে দিতাম।ইচ্ছা করে ওটার গলা টিপে নিজে আত্মহত্যা করে মরি।মর মর।"আরো রেগেমেগে কথাগুলো বললেন কমলাদেবী।
অজিত কিছু বলতে যাওয়ার আগেই যতীনবাবু রীতিমতো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন,"অনেকক্ষণ ধরে বাজে বকে যাচ্ছ।আমি কিছু বলছি না বলে তাই না?ও কেন মরবে?মরতে হলে তুমি মরো।না যদি পোষায় তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।ওর আমি একাই দেখাশোনা করব।কেমন মা তুমি মা হয়ে মেয়েকে মরার কথা বলো।খালি ওকে বকাবকি করার তাল,সুযোগ পেলেই হলো। তুমি কেন খেয়াল রাখনি মা হয়ে?বেশ তো পড়ে পড়ে ভাত ঘুম দিচ্ছিলে।অত বড় মেয়েটা পাশ থেকে উঠে চলে গেল আর তুমি কোনও টেরই পেলে না?নাক ডাকতে এত ব্যস্ত?"
"কি আমি নাক ডাকতে ব্যস্ত ছিলাম?আমি ওর খেয়াল রাখি না?সারাদিন ওর যা কাজ,তা কে করে তুমি করো না আমি?আমায় বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা না?বেশ চলে যাব।চাই না আমার এ সংসার। থাকো তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে।"যতীনবাবুর কথায় কমলাদেবী অভিমানে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন।
অবস্থা প্রায় এমন হয়ে দাঁড়ালো যে দুজনে হাতাহাতি করতে উদ্যত হলেন।
অজিতই দুজনকে ঠান্ডা করল,"আহ্ করছেন কি?ভদ্রঘরের লোকজনেরা এসব করে কখনো?"বলে দুজনকে দুটো চেয়ারে বসাল সে।স্বামী-স্ত্রী দুজনেই থম মেরে চেয়ারে বসে পড়লেন। এদিকে মহুল ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে।সে তার মা-বাবার এমন রুদ্ররূপ এর আগে কখনো দেখেনি। দুজনে কিছুটা শান্ত হওয়ার পর অজিত কমলাদেবীকে বলল,"কাকিমা আপনি মহুলকে ঘরে নিয়ে যান।ও একটু ঘুমাক্।বেচারি বড্ড ভয় পেয়ে গেছে।ওর এ আতঙ্ক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাটে ততোই ভালো।"
কমলাদেবী অজিতের কথামতো মহুলকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য মহুলের দিকে এগোতেই মহুল আবারও ভয়ে অজিতের পিছনে গিয়ে আশ্রয় নিল।
অজিতও পিছন ফিরে মহুলের মাথায় সস্নেহে হাত রেখে তার ভয় কাটাতে উদ্যোগী হল,"কোনও ভয় নেই মহুল।মা তোমাকে আর বকবে না।আমি বারণ করে দিয়েছি।এখন মায়ের সাথে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো কেমন। আর হ্যাঁ আমাকে প্রমিস করো আর কখনো একা একা এরকম বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাবে না।মায়ের ওপর রাগ করবে না।আর বায়না করবে না।লক্ষী হয়ে থাকবে।প্রমিস?"
মহুল মাথাটা নিচু করে কাঁপা কাঁপা গলায় তার স্যারকে বলল,"প্রমিস। "
কমলাদেবীও তাঁর রাগকে শান্ত করে মহুলকে নিয়ে ঘরে গেলেন।
যতীনবাবুকে চেয়ারে একভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে অজিত বলল,"আপনি ঠিক আছেন তো কাকু?একটু কি জল খাবেন?"
অজিতের কথায় যতীনবাবু যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন।তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই অজিতের হাতদুটো ধরে কৃতজ্ঞতার সুরে বললেন,"কি করে যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছিনা বাবা। আজ তুমি যদি না ঠিক সময়েকি কেলেঙ্কারি হতো কে জানে?কি করে যে তোমার ঋণ শোধ করব?তোমার কাছে আজ এক বাবা চির কৃতজ্ঞ হয়ে থাকল।"
যতীনবাবু আরো কিছু কৃতজ্ঞতাসূচক বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে ওনার হাতদুটোকে ধরে অজিত বলতে লাগল, "ছিঃ ছিঃ কাকু,এসব কি বলছেন?ঋণ!সে আবার কি কথা?আমি তুচ্ছ একজন মানুষ। আজও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভুলিনি।চোখের সামনে খারাপ কিছু দেখলেই প্রতিবাদ করি।বিপদে সাহায্য করি।আপনাদের সাথে আমার সম্পর্ক পরিবারের মতো।মহুল যতটা আপনাদের ততোটা আমারও। ওর কিছু খারাপ হতে দিই কি করে?"
"তবু বাবা,সবাই তোমার মতো নয়।সবাই সুযোগ সন্ধানী, তার ওপর মহুল মা আমার ওইরকম।আজ যা বিপদ ঘটতে পারত,তুমি যা ক্ষতির হাত থেকে আজ আমাদের বাঁচালে,ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।তোমার কখনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমায় বোলো,এই বুড়ো কাকু তোমায় সাধ্যমতো সাহায্য করবে।জানি আমার সাহায্যের তোমার কোনও প্রয়োজন নেই,কারণ তুমিই সবার পাশে দাঁড়াও,তবু বোলো বাবা চেষ্টা করে দেখব।"যতীনবাবুর গলায় উৎকন্ঠা স্পষ্ট। আরো কি সব বিড়বিড় করতে করতে ভদ্রলোক আবার চেয়ারে বসে পড়লেন।
পাশের ফাঁকা চেয়ারটায় অজিত গিয়ে বসল।তারপর বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। নিস্তব্ধতা ভাঙালো অজিত।বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সে হাতদুটো কচলাচ্ছে।কিছু যেন বলতে চায় সে কিন্তু বলতে পারছে না। সাতপাঁচ ভেবে তারপর অজিত বলেই ফেলল কথাগুলো, "কাকু অনেকদিন ধরেই একটা কথা বলব বলব করে বলতে পারছিনা। আজ মনে হয় কথাগুলো বলার সঠিক সময় এসে গেছে,তাই বলছি।বাড়িতে বড়ো কেউ থাকলে তারাই কথাগুলো আপনাকে বলত,কিন্তু আপনি তো জানেন,আমার মা-বাবা দুজনেই নেই।তাই আমিই বলছি।"
অজিতকে এভাবে আমতা আমতা করে কথা বলতে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই একটু অবাকই হয়ে গেলেন যতীনবাবু।তারপর একরাশ কৌতুহল নিয়ে অজিতকে প্রশ্ন করলেন,"কি ব্যাপার বলো তো অজিত,আমি তো বাবা কিছুই বুঝতে পারছি না। "
অজিত মাথাটা নিচু করে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে, তারপর সটান যতীনবাবুর চোখে চোখ রেখে সাহস করে বলেই ফেলল,"আমি মহুলকে বিয়ে করতে চাই।"
যতীনবাবুর মনে হল,তিনি বুঝি ভুল শুনেছেন,তাই নিজের ভুল শোধরাতে তিনি অজিতকে প্রশ্ন করলেন,"অ্যাঁ,কি বললে?আরেকবার বলো।"
এবার অজিত কথাগুলো একটু জোরেই বলল, "হ্যাঁ কাকু আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমি মহুলকে সত্যিই বিয়ে করতে চাই।আপনি প্লিজ না করবেন না। "
অবিশ্বাস্য এ কথার জবাবে যতীনবাবু কি প্রতিক্রিয়া জানাবেন সেটাই তিনি যেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। নিজের কানকে যেন তিনি বিশ্বাসই করাতে পারছিলেন না।
"কাকু কিছু তো বলুন।"অজিতের কথায় ভয়ের ভাব স্পষ্ট।
যতীনবাবু এবার কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন,"তুমি কি আমার সাথে মজা করছ?যদি এটা মজা হয়ে থাকে তাহলে বলব এটা মজা করার সময় নয়।আর যদি কথাটা সত্যি হিসাবে ধরি তাহলে বলব তুমি পাগল হয়ে গেছ।প্রকৃতস্থ নও তুমি।"
"কাকু আমি শুধু মহুলকে ভালোবেসে বিয়ে করে ওকে সুখী রাখতে চাই।"অজিত বিনয়ের সাথে বলল।
"কি আল-ফাল বকছ তুমি। যা নয় তাই।তোমায় বিশ্বাস করার এই প্রতিদান দিলে শেষে?"আশাভঙ্গের সুর যতীনবাবুর গলায় স্পষ্ট শোনাল।
"আমি তো কোনও বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করিনি কাকু। আমি তো শুধু মহুলকে ভালোবেসেছি মাত্র। "আরো নরম হয়ে কথাগুলো বলল অজিত।
যতীনবাবু তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই চেয়ারটা যতীনবাবুর পিছনদিকে উল্টে পড়ে গেল।এরপর যতীনবাবু জোরে জোরে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলে চললেন, "এ যে অসম্ভব, এ কিছুতেই হতে পারেনা।"
"কেন অসম্ভব কাকু?"অজিতের গলায় স্পষ্ট মহুলকে হারানোর ভয়।
"কেন অসম্ভব বোঝো না তুমি?বোধ-বুদ্ধি তো বলি আছে।নির্বোধ তো নও।একটা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ তুমি আর মহুল মা আমার.............ওইরকম।এরপরও বলছ তুমি কিসের অসম্ভব?আমাদের দুর্বলতা নিয়ে ছেলেখেলা করতে তোমার লজ্জা করছে না?"অজিতের উপর গর্জে উঠে বললেন যতীনবাবু।
যতীনবাবুর এরকম তর্জন-গর্জনে এবার একটু যেন ভয়ই পেল অজিত, তবু সাহস করে আবারও বলল,"শুনুন কাকু.........."
কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই যতীনবাবু অজিতকে দাবড়ে দিয়ে বললেন,"বন্ধ করো তোমার এ নাটক। ছিঃ ছিঃ ছিঃ অজিত আমি ভাবতে পারিনি।শেষে আমাদের মান-সম্মান নিয়ে তুমি এভাবে ছিনিমিনি খেললে?আমাদের ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলে?এই তোমার মানসিকতা?তোমার সাথে তাহলে ওই বাইরের লোকেদের তফাৎ কি রয়ে গেল?"
কমলাদেবী এতক্ষণ মহুলকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন।মহুল ঘুমিয়ে পড়তেই তিনি ঘর থেকে দালানের দিকে আসতেই যতীনবাবু আর অজিতের যাবতীয় কথোপকথন শুনতে পেলেন।
কমলাদেবীকে দেখতে পেয়েই যতীনবাবু তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "এই যে তুমি এসেছ,শুনেছ সব অজিত কি বলছে?"
কমলাদেবী গম্ভীর হয়ে বললেন, "হুম্ শুনেছি। "
"তুমি কিছু বলবে না?"স্ত্রীকে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন যতীনবাবু।
এরপর স্থির হয়ে পরবর্তী কথাগুলো অজিতকে বললেন কমলাদেবী, "হাতজোড় করে তোমায় অনুরোধ করছি বাবা,কাল থেকে আর তুমি এ বাড়িতে এসো না।বিষয়টা যতটা যা এগিয়েছে এখানেই থামানো উচিৎ।হাজার হোক তুমি একজন জোয়ান পুরুষমানুষ তাই নিজেকে আটকাতে পারোনি।তাই মহুলকে ওভাবে ভেবেছ ,কিন্তু মহুল তো ওরকম নয় যে তোমায় স্ত্রীর সুখ দিতে পারবে।তাই মহুলকে ভুলে যাওয়াটাই তোমার পক্ষে ভালো হবে।কম বয়েস ওরকম একটু-আধটু হতেই পারে।কিচ্ছু মনে করিনি তাতে।তুমি বরং একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও।"
সেদিনের মতো অজিত মহুলদের বাড়ি থেকে চলে এলেও সারারাত ঘুমোতে পারেনি।পরের দিন আর ওদের বাড়িতে যাওয়ার সাহস হলো না অজিতের। তার পরের দিনও স্কুল যাওয়ার পথে, স্কুল থেকে ফেরার পথে এমনকি দোকানে যাওয়ার ছুতো-না তা করে অজিত বহুবার মহুলদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেও ভিতরে ঢোকার হিম্মত করতে পারেনি।মহুলকে দেখার আকুতি অজিতকে ওদের বাড়ির দরজার সামনে নিয়ে গেলেও কোনও এক অজানা ভয় আবার ওকে ঘরমুখী করে ফিরিয়ে এনেছে।অন্যদিকে মহুলও পরপর দুদিন তার প্রিয় স্যারের দেখা না পেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। রীতিমতো বায়না জুড়ে দিয়েছে স্যারকে দেখবে বলে।কমলাদেবী আবার মেয়েকে বকবকি শুরু করে দিলেন।এবার আর যতীনবাবু স্ত্রীকে বাধা দিলেন না।কিন্তু বিপত্তি বাধল অন্য জায়গায়। মহুল তার স্যারকে দেখতে না পেয়ে এবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিল।হাজার বোঝানো,বকাবকি কোনও কাজে দিল না। অগত্যা আর কি করার,মেয়ের আবদার মেটাতে যতীনবাবু অজিতকে ডেকে পাঠালেন।
অজিতকে দেখেই মহুল আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
"অসভ্য, বেহায়া মেয়ে কোথাকার। "বলে কমলাদেবী একটানে মহুলকে অজিতের কাছ থেকে ঠেলে দুরে সরিয়ে দিলেন।
"আহা হা ,একি করছেন?ওকে কিছু বলবেন না।ও নিষ্পাপ। ও কি বোঝে এসবের?ভুল যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে সেটা আমার তরফ থেকে হয়েছে, ওর তরফ থেকে না।ও বেচারি তো নির্দোষ। "মহুলের প্রতি সহানুভূতি রেখে কথাগুলো বলল অজিত।
এরপর মহুলকে খাবার টেবিলে বসাতেই মহুলের নতুন বায়না, "স্যার তুইও আমার সাথে খা।"
"না মহুল তুমি খাও।"অজিতও সস্নেহে মহুলের প্রস্তাব নাকচ করে দিল।
"তাহলে আমিও খাবো না।"মহুল গোঁসা করে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল।
"মহুল এরকম করে না।"অজিত মহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল।কিন্তু মহুল তার জেদে অনড়।
মহুলের জেদ আর পীড়াপীড়ি দেখে যতীনবাবুও বললেন,"ও যখন এত করে বলছে তখন আজকে না হয় আমাদের বাড়িতেই খেলে।ও নাহলে খাবে না। তোমার কি কোনও অসুবিধা আছে?"
অজিত পড়ে গেল ফাঁপরে। অগত্যা ইচ্ছা না থাকলেও মহুলের মন রাখতে তাকে ওদের বাড়ির ভাত গলাধঃকরণ করতেই হল।খাওয়া শেষে মহুলকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেলেন কমলাদেবী। ঘুমাতে যাওয়ার আগে মহুল অজিতকে বলে গেল,"তুই কিন্তু চলে যাস্ না স্যার। "
স্মিত হাসি হেসে অজিত মহুলকে বলে,"ঠিক আছে তুমি এখন ঘুমাও।"
অজিতের কথায় আশ্বস্ত হয়ে মহুল গেল ঘুমাতে। যতীনবাবু অজিতকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন।
"কি করেছ দেখতে পাচ্ছ তো?মেয়ে আমার তোমাকে ছাড়া একদম থাকতে পারছে না।"উদ্বিগ্ন কন্ঠে যতীনবাবু অজিতকে কথাগুলো বললেন।
"সেই জন্যই তো বলছি কাকু ওকে একমাত্র আমিই ভালো রাখতে পারব।আপনাদের অবর্তমানে ওর তো কাউকে দরকার আর সেটা আমি।"অজিত জোর দিয়ে কথাগুলো যতীনবাবুকে বলে।
"আমাদের অবর্তমানে ওর জন্য অন্য ব্যবস্থা করে যাব।তোমার কোনও প্রয়োজন নেই।"বেশ রূঢ় ভাবেই অজিতকে কথাগুলো শোনালেন যতীনবাবু। "ওহ্!ওকে আবার সেই জায়গাতেই পাঠাবেন,যেখানে একটা দিনও ও টিকতে না পেরে কান্নাকাটি করে ফিরে এসেছিল। "অজিতের কথার জবাবে যতীনবাবুকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার অজিতই বলল,"আশ্চর্য, মেয়ে কষ্ট পেয়ে মরে যাবে সে ভালো,তবু আপনি আমার সাথে ওকে সুখে থাকতে দেবেন না।"
"তোমার সাথে ও কিছুতেই সুখে থাকতে পারবে না।তুমি কেন বুঝতে পারছ না?দ্যাখো অজিত, আজ যদি মহুল আর পাঁচটা মেয়ের মতো সুস্থ-স্বাভাবিক হতো তাহলে আমি তোমার প্রস্তাবে খুশি খুশি রাজি হয়ে যেতাম।দেখিয়ে দিতাম মেয়ের বিয়ে দেওয়া কাকে বলে!কিন্তু ও যে...........না না লোভে পড়ে ওর বিয়ে তোমার সাথে দিয়ে আমি ওকে জলে ভাসিয়ে দিতে পারি না।এতে ওরও ক্ষতি তোমারও ক্ষতি।তুমি সুস্থ-সবল মানুষ তুমি হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিন্তু মহুলের কি হবে একবার ভেবে দেখেছো?আবেগের বশে এসব সিদ্ধান্ত নিও না।তোমার কাকীমার কথা শোনো।একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও। তোমার একজন জীবনসাথীর প্রয়োজন আছে।আমি অপারগ বাবা,নাহলে তোমার মতো পাত্রকে কেউ নাকচ করে কখনও?"যতীনবাবু সুর নরম করে অজিতকে বোঝালেন।
"বিয়ে যদি করি তাহলে একমাত্র মহুলকেই করব।নাহলে নয়।"দৃঢ়তার সাথে অজিত বলে উঠল।
"ওহ্,আবার সেই এক পাগলামি।তোমায় এত করে বোঝাচ্ছি আর তুমি সেই একই জেদ ধরে বসে আছ।আরে কেন তুমি বুঝঝ না বলো তো?বেশ বিয়ে যদি হয়েও যায় তারপর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তোমাদের জীবন একবার ভেবে দেখেছ?আরে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তোমাদের মধ্যে কোনদিনই হওয়া সম্ভব নয়। আর কিভাবে বোঝাবো তোমায়?মেয়েটা তোমায় মানসিক.......... শারীরিক কোনও সুখই দিতে পারবে না।এটা কি তুমি বুঝতে পারছ না?"যতীনবাবু আবারও বোঝালেন অজিতকে।
"আমার দরকার নেই তো।আমি চাই না ওসব।আমি শুধু এটুকুই চাই যে ও আমার সাথে থাকুক।"অজিতও যতীনবাবুকে জবাব দিল।
"চাই না বললে তো হবে না অজিত।তুমি চাওয়ার কেউ নও।তোমার শরীর চাইবে।তোমার মন বিষিয়ে উঠবে এই সম্পর্কে। তখন?"যুক্তি দিয়ে অজিতকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যতীনবাবু। অজিতেরও পাল্টা যুক্তি, "আমার মন অত সস্তা নয়। আমি খুব শক্ত মনের মানুষ। আমি কোনও কিছু আশা না রেখে,সব জেন-বুঝেই ওকে বিয়ে করতে রাজি আছি।"
"উফ্ তুমি কেন বুঝতে চাইছ না বলো তো?আরে তুমি একজন সুস্থ-সবল পুরুষ মানুষ। তোমার চাহিদা কোনও অন্যায় নয়।শুধু মহুল ওটা তোমায় দিতে পারবে না আর কিভাবে তোমায় বলি?বেশ ছোটো হয়ে যখন আমার মুখ থেকে এসব কথা শুনতেই চাইছ তখন আমিও খোলাখুলি বলি,যদি তুমি বোঝো।আরে যে মনের কথা তুমি বলছ না সে মন একদিন হাঁপিয়ে উঠবে,হতাশ হয়ে যাবে না পেয়ে পেয়ে। কারণ হরমোন মন বোঝে না,হরমোন শুধু শরীর বোঝে।আর কিছু বোঝাতে বাকি আছে?"যতীনবাবু খোলাখুলি সবকিছু বোঝালেন অজিতকে।
"বুঝলাম,কিন্তু আপনি আমায় বুঝতে পারেননি কাকু।আমার মন ছাপিয়ে শরীর কোনওদিনই জিততে পারবে না।"অজিতও মনের জোরে কথাগুলো বলল।
এরপর বহুদিন কেটে গেল। অজিত তার সিদ্ধান্তে অনড়। যতবার যতীনবাবু তাকে বোঝাতে গেছেন ততবার তার সেই একই মন্তব্য। অগত্যা অজিতের অদম্য মনোভাবের কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন যতীনবাবু। অজিতের সাথে মহুলের বিয়ের সম্মতি জানানোর পর অজিতই প্রস্তাব দিল তার মা-বাবার কাছে যে,মাঝে-মধ্যে যেন মহুলকে তার ফ্ল্যাটবাড়িতে আনা হয়, যাতে ভবিষ্যতে তার এখানে মানিয়ে নিতে কোনও অসুবিধা না হয়। তার সাথে অজিত এও প্রস্তাব দেয়, মহুলের সুবিধার জন্য মহুলের মা-বাবা যেন অজিতের ফ্ল্যাট বাড়িতেই থাকেন।তাহলে মা-বাবাকে ছেড়ে থাকার কষ্টটা মহুলকে ভোগ করতে হবেনা।
অজিতের এ প্রস্তাবে যতীনবাবু শুধু একটু মৃদু হাসলেন,আর বললেন, "সত্যিই তুমি মহুলকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসো।"
মহুলের অবশ্য বেশ ভালোই হয়েছে।এখন সে প্রায়-প্রায়ই তার স্যারের বাড়িতে যায়। সেখানে স্যার তার জন্য কত খেলনা,চকোলেট, আইসক্রিম কিনে রাখে।মহুলের তো দারুণ মজা। এখন মহুল রোজ নিজে থেকেই তার মা-বাবার কাছে আবদার করে তার স্যারের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।যদিও এর আগেও সে তার স্যারের বাড়িতে গেছে তবে এত ঘনঘন নয়।মহুল এই বিয়ের ব্যাপারটা জানেনা।কারণ স্বাভাবিক ভাবেই মহুলের বিয়ের সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই তাই। মহুলের মা চেষ্টা করেছিলেন মেয়েকে বোঝাবার কিন্তু মহুল বুঝতে পারেনি। পরে অজিত মহুলকে বোঝায় যে আসলে এটা একটা খেলা।তাই মহুলের কাছে এই বিয়ে একটা খেলা। যেটা তার জীবনেও হবে বাইশে মার্চ।এই খেলা শেষে মহুল জিতে যাবে আর সে স্যারের বাড়িতে গিয়ে থাকবে।মহুল এখন শুধু সে দিনের অপেক্ষায় ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাচ্ছে।যে ক্যালেন্ডারে অজিত লাল কালি দিয়ে সেই বিশেষ দিনটাকে গোল দাগ পাকিয়ে দিয়ে গেছে ।মহুল আর অজিতের বিয়েটা যতদিন জানাজানি হয়নি ততদিন সব ঠিকঠাকই ছিল।কিন্তু খবর একটু চাউর হতেই আবার লোকের ঠাট্টা,কটাক্ষ,বিদ্রূপ,হাসাহাসি পরোক্ষে শুরু হলো। সামনাসামনি দেখা হলে তারা শুভেচ্ছা দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু পিছন ফিরলেই সেই ফিসফাস শুরু করে দেয়।
এতে ভারি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন মহুলের বাবা।তিনি আবারও অজিতকে বললেন,"এখনও সময় আছে বাবা।ভালো করে ভেবে নাও।এখনও চাইলে সব থামিয়ে দেওয়া যাবে।কারণ এখনও কিছুই হয়নি। কিন্তু বিয়ের পর তুমি যদি আমার মেয়ের হাতটা ছেড়ে দাও তাহলে ও বাবা জলে পড়ে যাবে।তাই বলছি বাবা আরো একবার ভেবে নাও। লোকজনদের তো দেখছ,তোমাদের টিকতে দেবে না। "
"ওই রাস্তার কতগুলো লোকের জন্য আপনি আমার ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছেন?"অজিতের প্রশ্ন তার হবু শশুর মশাইয়ের প্রতি।
"এটা তোমার প্রতি বিশ্বাস হারানো নয় বাবা।আমার মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। "যতীনবাবু চিন্তিত হয়ে কথাগুলো বললেন অজিতকে।
অজিতও যতীনবাবুকে আশ্বস্ত করে বলল,"অকারণ চিন্তা করবেন না। আমি মহুলের পাশে চিরকাল থাকব।"
তবু যেন যতীনবাবুর শঙ্কা কাটলনা।"তুমি কি মহুলকে বিয়ে করে এখানেই থেকে যাবে না তোমার দেশের বাড়ি ফিরে যাবে?না মানে লোকজনকে তো দেখছ।অবশ্য কোথায়ই বা যাবে?যেখানেই যাবে লোকে এভাবেই উৎপাৎ করবে। তোমার চাকরিও অবশ্য এখানে।অবশ্য এখানে থাকবে বলেই তো আগে থেকে তোমার ফ্ল্যাটে মহুলকে অভ্যস্ত করাচ্ছ।কি যে বলছি আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারছিনা।মাথা কাজ করছে না এক্কেবারে। "
"মনে অযথা এত চাপের সৃষ্টি করবেন না। মনকে চাপমুক্ত করুন। পালিয়ে কি কোনও সমস্যার সমাধান হয়?আর কেনই বা অন্য কোথাও যাবো!আমি ওকে ভালোবেসেছি তাই বিয়ে করছি।এতে তো কোনও পাপ বা অপরাধ নেই।আমাদের উচিৎ সকলে মিলে মহুলকে সামলানো। এভাবে লোকের কথায় কান দিলে ওকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। "অজিত যতীনবাবুকে আবারও আশ্বস্ত করল।
এবার সত্যি সত্যিই যতীনবাবু আশ্বস্ত হয়ে খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করে দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও মানুষের মানসিকতার জন্য তা একেবারে ব্যক্তিগত পরিসরে বেঁধে দিলেন।
বিয়ের দিন যতীনবাবুকে বাকি কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাদের মতো ব্যস্ত-সাব্যস্ত, উদ্বিগ্ন দেখালেও তা আর চার-পাঁচজন বাবার মতো সাধারণ ছিল না ব্যাপারটা। স্বামীর মনের কথাটা আঁচ করতে পারলেন কমলাদেবী।যতীনবাবুর ডান কাঁধে নিজের ডান হাতটা রেখে বললেন,"তুমি অযথা চিন্তা করছ।অজিত সত্যিই খুব ভালো ছেলে।আমাদের অবর্তমানে ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আর ভাবতে হবেনা। "
"অজিত শুধু ভালো নয়, ও ভগবান। কিন্তু তবু কেন যে আমি আমার মনকে বোঝাতে পারছিনা কে জানে?"
কথাগুলো বলতে বলতে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়লেন যতীনবাবু।
এদিকে আবার অন্য বিপত্তি। পাড়ার কোনও ছেলে-পিলে মহুল আর অজিতের বিয়ে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করেছে।ব্যস্ হুহু করে তা ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের থেকেও দ্রুত। নেটাগরিকরা তা নিয়ে নানা মন্তব্যও শুরু করে দিয়েছেন;যার বেশিরভাগই অজিতের প্রশংসাসূচক। বিষয়টা দৃষ্টি এড়ায়নি বিভিন্ন সংবাদ-সংস্থারও। তাই বিয়ের দিন এক্কেবারে অযাচিত অতিথির মতো;বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিরা দলে দলে ভিড় জমাতে থাকে মহুল আর অজিতের বিবাহবাসরে।সবাই তো ভীষণ তাজ্জব বনে যায় এরকম ব্যাপার-স্যাপারে ।মহুল যেন এত বহিরাগতের ভিড়ে একটু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।সে তো অজিতের পিছনে দাঁড়িয়ে খালি মুখটুকু বার করে ভারী উৎসুক নয়নে এসব কাণ্ড দেখে যাচ্ছে। অজিতের এসব এক্কেবারে নাপসন্দ।তাই সে হাতজোড় করে সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে,"দেখুন আপনারা আমাদের বিয়েতে এসেছেন, খুব আনন্দের ব্যাপার। দয়া করে বিয়ের ভোজ খেয়ে তবেই যাবেন।কিন্তু অনুরোধ করছি,দয়া করে কেউ ছবি তুলবেন না বা এ নিয়ে কোনও লেখালেখি করবেন না।প্লিজ্।এটা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। "
0);">অজিতের অনুরোধ তার বিবাহবাসরে উপস্থিত সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিরা মেনে নিলেও, সামাজিক মাধ্যমে ততক্ষণে হুহু করে ছড়িয়ে পড়েছে অজিত আর মহুলের শুভ পরিণয়ের খবর আর অজিতের মহত্ত্ব। অজিত এখন সবার চোখে রীতিমতো ভগবান। আর এসব বাড়াবাড়ি অজিতের কাছে একেবারেই অপছন্দের।যদিও যতীনবাবু আর ওনার স্ত্রী কমলাদেবীর আদৌ এটা কোনও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে না।তাঁদের মতে যা সত্যি তাই লেখা হয়েছে এবং তা পড়ে সবার অজিতকে ভগবান বলে মনে করাটা কোনও অস্বাভাবিক কিছু নয়।বরং সেটাই ঠিক।যতীনবাবু এবং কমলাদেবী বরং এ বিষয়ে বেশ খুশিই।তাঁরা বেশ গর্বিত বোধ করেন অজিতের মতো জামাই পেয়ে।
আজ অজিত-মহুলের ফুলশয্যা। অজিত নিজে হাতে ওদের ফুলশয্যার ঘরটা সাজিয়েছে,তবে একটু অন্যভাবে। সারা ঘরটা গোলাপি বেলুন দিয়ে সাজানো। কারণ গোলাপি মহুলের প্রিয় রং।আর ঘর ভর্তি নানারকম ছোটো-বড় পুতুল আর খেলনায় ঠাসা।ঘরের কোণের টেবিলটা সাজিয়েছে অজিত নানারকম আঁকার সরঞ্জাম দিয়ে কারণ মহুলের আঁকতে খুব ভালো লাগে আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে নানারকম রূপকথার গল্পের বই।মহুল তো সে ঘরে ঢুকে এক্কেবারে আনন্দে আত্মহারা। কি করবে ভেবে উঠতে পারছেনা।একবার বেলুনগুলো ধরে টানছে, একবার খেলনা নিয়ে খেলছে।অজিত শুধু ঘরের কোণটায় দাঁড়িয়ে মহুলের এহেন কাণ্ডকারখানা দেখে মিটিমিটি হাসছে।একপ্রস্থ আঁকাআঁকির পর অবশেষে মহুল ক্লান্ত হয়ে তার 'স্যার'কে ধরে আনে।'বর' বলতে মহুল যেমন বোঝে না তেমন সে তার স্যারকে হঠাৎ করে অন্য কোনও নামে ডাকতে,ভীষণ আপত্তি জানিয়েছে।মা-বাবা তাকে অনেক চেষ্টা করে বুঝিয়েও শেষে ক্ষান্ত দিয়ে হার মেনেছে।আর অজিতেরও মহুলের অন্য কোনও সম্বোধনের চেয়ে 'স্যার' সম্বোধনটাই বেশি ভালো লাগে।তাই অজিতের মহুলের স্যার বলাতে কোনও আপত্তি নেই। তাই আজও সে মহুলের 'স্যার'।আর স্যার এখন তাকে সিন্ড্রেলার কাহিনী পড়ে শোনাবে।সিন্ড্রেলার কাহিনী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে মহুল। মহুল ঘুমিয়ে পড়লে বইটা পাশে সরিয়ে রেখে ঘরের লাইটটা বন্ধ করে অজিতও ঘুমিয়ে পড়ে।
দেখতে দেখতে অনেকগুলো মাস কেটে গেল।সেরকম কোনও অসুবিধাই হয়নি মহুল বা অজিতের। শুরুর দিকে মহুলের তার মা-বাবা ছেড়ে এ বাড়িতে থাকতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল বটে।তাই কখনও কমলাদেবী অজিতের ফ্ল্যাটে এসে থাকতেন বা মহুল আবার কখনও তার মা-বাবার কাছে গিয়ে থাকত।জামাইয়ের তরফ থেকে বরাবর মহুলের মা-বাবার জামাইবাড়িতে থেকে যাওয়ার প্রস্তাবটা গ্রহণ করেননি।তাই আপাতত এইভাবে মেয়েকে সঙ্গ দেওয়ার ব্যবস্থা। তবে এখন আর এই অসুবিধাটা নেই।শুধু অজিত যখন স্কুলে যায় তখন সে মহুলকে তার বাপের বাড়িতে দিয়ে আসে বা কখনও কখনও তার মা ওই সময়টুকুর জন্য অজিতের ফ্ল্যাটে এসে থাকেন।অজিত অবশ্য মহুলকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য একজন আয়ার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। কিন্তু কমলাদেবী আপত্তি জানান।আপত্তির কারণ আসলে আর কিছুই না এতদিন ধরে মেয়েকে সঙ্গ দেওয়ার অভ্যাস তিনি ছাড়তে চান না।মেয়ে যেখানে তাঁর এত কাছেই থাকে।তাই যতদিন তাঁর শরীরে কুলোচ্ছে ততদিন তিনি এইভাবেই মেয়ের কাছে কাছে থাকতে চান।জামাইয়ের কাছে তার শাশুড়ি মায়ের এ একপ্রকার আবদারই বলা চলে,যা জামাই মহাশয় সাদরে গ্রহণ করেছে।তাই সকালবেলা রাঁধুনি আর তোলা কাজের লোক তাদের কাজ করে চলে যাওয়ার পর অজিত আর মহুল তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। মহুলকে তার বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সে রওনা দেয় তার স্কুলের পথে।আবার ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার পথে সে মহুলকে তার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। মাঝে সময় পেলে অজিত স্কুল থেকে মহুলকে ফোন বা ভিডিওকলও করে নেয়। বিকেল হলেই মহুল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে কখন তার স্যার তাকে ফেরত নিয়ে যাবে।সে রোজ তার বাপের বাড়িতে আসলেও মনটা তার পড়ে থাকে তার স্যারের কাছে।স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক,প্রেম এসব মহুল বোঝে না বটে কিন্তু এও তো একধরনের ভালবাসা। ভালবাসার সংজ্ঞা তো কেবল একতরফা হতে পারেনা। মহুলের এরকম পরিবর্তনে মহুলের মা-বাবা দুজনেই খুশি।তাঁরা এসব একেবারেই আশা করেননি মহুলের কাছ থেকে।স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এরকম আচরণ স্বাভাবিক হলেও মহুল তো আর চার-পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক নয়।তাই এরকম পরিবর্তন তাঁরা তার কাছ থেকে আশা করেন কি করে?কিন্তু এখন মহুলের আচার-ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে সে তার জীবনের যাবতীয় অস্বাভাবিকতা কাটিয়ে যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।তার এই পরিবর্তনে তার মা-বাবা যতটা অবাক আবার ঠিক ততটাই আনন্দিত। বিয়ের আগে মহুলের একটা বাঁধা-ধরা জগৎ ছিল যাতে কিছু মুষ্টিমেয় পরিচিত মানুষের বসবাস ছিল,যাদের সাথে সে অভ্যস্ত ছিল কিন্তু এখন মহুল অচেনা-অপরিচিত লোকজনের সাথেও সহজে মিশে যেতে পারে।বাড়িতে কেউ গেলে অভ্যর্থনা জানাতে ভোলেনা।যতীনবাবু একদিন জামাইবাড়ি গিয়ে রীতিমতো অবাক।মহুল তাঁকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে বলেছিল,নিজে হাতে বোতল থেকে গ্লাসে জল ঢেলে বাবাকে এগিয়ে দিয়েছিল।মহুল এখন নিজে হাতেই খাবার খায়।নিজে নিজে সে স্নানও করতে পারে।আর এসব তাকে শিখিয়েছে অজিত।সত্যি ছেলেটা করে দেখাল।মা-বাবা হয়ে তাঁরা যেটা করতে পারেননি সেটা স্বামী হয়ে অজিত করে দেখাল।আসলে অজিত বলে,"ও ওর বয়েসী মেয়েদের মতো সবকিছু করতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু একটা সুস্থ-স্বাভাবিক বাচ্চার বুদ্ধিমত্তায় যতটুকু যা আসে,ও সেটুকু তো করতে পারবে।"
সত্যি একথা তো কোনওদিন ভেবে দেখেননি যতীনবাবু বা ওনার স্ত্রী। মেয়ের অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে তাকে বহু যত্ন করে তোলা তোলা করে রেখে বরং আরো অসুস্থ করে তুলেছেন। অন্যদিকে ক'দিনেরই বা পরিচয় অজিতের সাথে। অথচ ওর সংস্পর্শে থেকে থেকে মেয়েটা কেমন আস্তে আস্তে পরিণীতা হয়ে উঠেছে।
সময় আরেকটু এগিয়ে গেল।বেশ ভালোই চলছে অজিত-মহুলের সংসার। সেদিন ছিল রবিবার। আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে সে কি বৃষ্টি!একেই বলে খিচুড়ি খাওয়ার দিন।অজিত-মহুল দুজনেই খিচুড়ি খেতে খুব ভালোবাসে।সাথে ডিমভাজা,আলুভাজা,বেগুনভাজা। অজিতই আজ রান্না করেছে।অজিত প্রায়শই ছুটির দিনগুলোতে মহুলের প্রিয় খাবার পদ রান্না করে থাকে।আজকেও এর অন্যথা হলনা।তার উপরে আবার এরকম আবহাওয়া। বিকেলের দিকে আবার অজিত কফি আর পকোড়া বানালো।মহুল সেই পকোড়া আশ মিটিয়ে শুধু নিজে খেয়েছে তাই নয় তার সমস্ত ছেলে-মেয়ে মানে পুতুলগুলোকেও খাইয়েছে। বৃষ্টি সেই সকাল থেকে একনাগাড়ে হয়েই চলেছে।কোনও বিরাম নেই। ভ্যাপসা গরমটা অবশ্য কেটেছে।অজিত মনে মনে ভাবছে,আজ রাতে আরাম করে ঘুমানো যাবে।তবে মহুলের এই মুহুর্তে ঘুমোনোর কোনও ইচ্ছা নেই। তাকে এখন খেলায় পেয়েছে।ঘরের যত ছাতা ছিল সেসবগুলোকে খুলে তার নিচে অন্তত গোটা দশেক পুতুলকে সে জড়ো করেছে।অজিত বেশ কয়েকবার মহুলকে ঘুমানোর জন্য বললেও মহুল সেদিকে কর্ণপাত করেনি।অজিত মহুলকে আরেকটু সময় দিল আর ভাবল,এরপরেও যদি মহুল তার কথা না শোনে তাহলে মহুলকে জোড় করেই ঘুম পাড়াবার ব্যবস্থা করতে হবে।প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মহুলের অজিতের কাছ থেকে নানারকম গল্প,ঘুমপাড়ানি গান বা ছড়া শোনাটা একরকম আবশ্যিক হয়ে গেছে।এছাড়া মহুলের ঘুমই আসেনা।মহুল যাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে রাজি হয় সেজন্য অজিত মহুলকে নানারকম গল্প শোনাবারও প্রলোভন দেখালো,কিন্তু তাতে কোনও লাভ হল না। মহুল অজিতকে কোনওরকম পাত্তা না দিয়ে মন দিয়ে খেলেই চলেছে।অগত্যা অজিত আর কি করে,মহুলের অপেক্ষায় থেকে সে না নিজে পারছে ঘুমাতে যেতে আবার না পারছে মহুলকে বকতে।বকাবকি তার ধাতে নেই।স্কুলের বাচ্চাদেরও আজ পর্যন্ত সে কোনওদিন বকাবকি করেনি,ভারি শাস্তি দেওয়া তো দুরে থাক।গুরু হয়েও সবসময় বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছে,আর এইজন্যই সে স্কুলের বাচ্চাদের প্রিয় স্যার।অজিতের ক্লাস তারা ভুলেও কামাই করেনা তাই।আর এই বন্ধুত্ব সে সবার সাথে বজায় রাখে।বয়সে ছোটো,বড়ো, সমবয়সী সবার সাথে।মহুলের সাথেই বা এর ব্যতিক্রম হয় কি করে?শেষমেশ অজিত বারান্দায় গেলো।বর্ষাকাল তার বরাবর প্রিয়। একরকম রোমান্টিসিসম আছে এই বর্ষাঋতুর মধ্যে। অতি বড়ো পাষাণও প্রেমে পড়ে যেতে পারে এই বর্ষাঋতুর সান্নিধ্যে এলে।তবে অজিতের এসব মানায় না,অজিত এসব থেকে অনেক দুরে।তবু কেন কে জানে আজ অজিতের মনটা কিছুতেই বাগে আসছে না।যত সে মনটাকে বাঁধতে চাইছে,তত যেন মন তার সমস্ত আগল ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।এরকম তো ওর কোনওদিন হয় না।তবে আজ কেন এ ভরা বর্ষায় রাস্তায় কোনও বৃষ্টিভেজা যুগলকে দেখে অজিতের মনটা এত উচাটন?এ প্রশ্নের উত্তর অজিতের কাছে নেই।অথচ এই তো সেদিন, ফ্ল্যাটের ছাদে অজিত মহুলকে নিয়ে এরকমই এক বর্ষণক্লান্ত দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজেছিল।কই সেদিন তো এরকম কিছু মনে হয়নি। সেদিন সদ্য বিবাহিত অজিতের মধ্যে কোনওরকম শৃঙ্গার রসের উদ্রেক ঘটেনি বরং বাৎসল্য রসই ছিল তাতে।সেদিন মহুলের হাত ধরে অজিত ফিরে গিয়েছিল তার ছেলেবেলায়, যখন বৃষ্টির দিনে ইচ্ছা করে রাস্তার জমা জলে জুতো ভেজাত।ছাতা সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ছাতা ভুলে যাওয়ার বাহানা বানিয়ে ইচ্ছা করে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরত।কাগজের নৌকা ভাসাত বৃষ্টির জমা জলে।এরকম কত কি মনে পড়েছিল সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে।কিন্তু আজ যেন অজিতের মনের পালে অন্য হাওয়া লেগেছে।এরকমটা তো হওয়া উচিৎ নয়। নিঃশব্দে কখন প্রেমের বেনোজল অজিতের মনের মধ্যে প্রবেশ করেছে তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।অজিতের কাছে এসব ভারী অশোভন ঠেকল।তৎক্ষণাৎ সে মনটাকে আবার আগের জায়গায় ফেরাতে অন্য ভাবনা-চিন্তা করতে লাগল।একটা পরিকল্পনা অবশ্য সে মহুলকে নিয়ে দীর্ঘদিনই করে আসছে এবং খুব তাড়াতাড়ি সেটাকে সে বাস্তবে রূপায়িতও করতে চায়। আর সেটা হল,মহুলকে স্কুলে পাঠানো।কোলকাতা শহরে যত বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য স্কুল আছে,সে সবগুলো ইতিমধ্যেই দেখে এসেছে অজিত।সবদিক ভালোভাবে খতিয়ে দেখে একটি স্কুল অজিতের পছন্দও হয়েছে। এবার শুধু মহুলকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্কুলে পাঠানোর পালা।এসবই সে ভাবছিল,এমন সময় বৃষ্টিটা আরো জোরে এল,তার সাথে মাতাল করা হাওয়া।হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে অজিতের সাধের পাঞ্জাবিটা ভিজিয়ে দিল।অজিতের প্রিয় পোশাক পাঞ্জাবি। নানা রঙের,নানা ধরণের পাঞ্জাবি আছে অজিতের কাছে।পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য পোশাক অজিত খুব কমই পড়ে।পাঞ্জাবিটা আর পড়ে থাকা যাবেনা,বৃষ্টিতে বেশ ভালোই ভিজে গেছে।আর বেশিক্ষণ পড়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।তাই ভেজা পাঞ্জাবিটা বদলে অন্য পাঞ্জাবি পড়ে নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করল অজিত। তাই বারান্দা ছেড়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল সে।বেশ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, দুরে কোথাও একটা বাজ পড়ল।অজিত বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে দালানে এসে মহুলকে আরো একবার শুয়ে পড়ার জন্য অনুরোধ করল।কিন্তু সে অনুরোধ মহুলের কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।মহুল খেলায় মশগুল। অজিত ঘরে গিয়ে পাঞ্জাবিটা সবেমাত্র গা থেকে খুলেছে।সেইসময় পিছু পিছু মহুলও সেই ঘরে ঢুকল আরো কিছু পুতুল নেবে বলে।কি থেকে কি হলো বলা মুশকিল, তবে হাওয়ার বেগের সাথে বৃষ্টির পরিমাণও বেড়ে গেল।এই আবহাওয়াই কি তবে দায়ি অজিতের এতদিনকার পুঞ্জীভূত ইমান টলিয়ে দেওয়ার জন্য?নাকি তা নেহাৎই ছিল কোনও সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা?কোথায় গেল তবে অজিতের লৌহমানব ভীষ্মের মতন ভীষণ কঠিন প্রতিজ্ঞা?মহুলের নিষ্পাপ চাহনিতে সে রাতে অজিতের শয়তানের দৃষ্টি পড়েছিল। সুমতি হেরে গিয়ে সে রাতে অজিতের অন্তর্নিহিত কুমতিই জিতে গিয়েছিল। অজিতের এতদিনকার তৈরি করা আদর্শকে এক লহমায় ভেঙে,গুঁড়িয়ে, চুরমার করে দিয়ে জিতে গেল অজিতের আদিম রিপু।সে রাতে মহুল আর অজিতের মধ্যে যেটা হয়েছিল তার সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না মহুলের।মহুল শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিল,তার সাথে খুব খারাপ কিছু একটা করেছে তার স্যার। মহুল প্রাণপণে বাধা দিয়েছিল।কিন্তু পারেনি।যেমন ভীত-সন্ত্রস্ত হরিণী হার মানতে বাধ্য হয় শিকারী বাঘের থাবার কাছে।বাঘের গর্জনের নীচে যেমন ঢাকা পড়ে যায় আহত হরিণীর গোঙানির শব্দ;সে রাতে অতি সুকৌশলে বজ্রপাতের শব্দ ঢাকাচাপা দিয়েছিল মহুলের বাঁচতে চাওয়ার শেষ আর্তনাদটুকুকে।অজিত যখন সম্বিৎ ফিরে পায়, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।এতক্ষণে সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।ঘোর কাটতেই সে বুঝতে পারে যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে।পাশে শারীরিক-মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মহুল ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে।তাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না অজিত।নিজের প্রতি ঘেন্না হল অজিতের।আস্তে আস্তে আশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দেয় মহুলের দিকে।আহত,ক্রুদ্ধ মহুল নিজের শেষ শারীরিক ও মানসিক বলটুকু সম্বল করে ক্রমাগত হাত-পা ছুঁড়ে অবশিষ্ট প্রতিবাদটুকু করতে থাকে।অজিত কোনও রকম বাধা দিল না। সে জানত,এটুকু তো তার প্রাপ্য। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অজিত নিজেকে থাপ্পড় মারতে লাগল ততক্ষণ যতক্ষণ না তার হাতদুটো অবশ হয়ে এল।সারারাত মহুল কেঁদে গেল।যতবার অজিত ওর কাছে গিয়ে ওকে সামলাবার চেষ্টা করেছে,হাতের কাছে যা পেয়েছে মহুল ছুঁড়ে মেরেছে অজিতকে। মহুলের মতো আজ এই ঘরটাও যেন বিধ্বস্ত। শরীর মনে মহুল আজ যে আঘাত পেল,সেই দুঃখে আজ এই ঘরটাও যেন নীরবতা পালন করছে।ভারী গর্ব হতো এই ঘরের,এখানে এমন একজন স্বামী আছেন যে দুহাত বাড়িয়ে বুক দিয়ে সব ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে তার স্ত্রীকে রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু আজ সে স্বামীই সীমারেখার শৃঙ্খল ভেঙে রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে উঠল।কোনও প্রতিবাদ হল না। ঘরটা শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গেল।
ভোরের আলো ফুটতেই অজিত ফোন করে মহুলদের বাড়িতে।স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ভোরে ওঠা অভ্যাস।যেটা অভ্যেস নেই সেটা হল,এত ভোরে কারো ফোন ধরা।ফোনটা বাজতেই কমলাদেবীর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।এত ভোরে কার কি হলো?তবে কি মেয়েটার কিছু?ফোনটা যতীনবাবুই ধরলেন।যেই ভাবা সেই কাজ।মায়ের মন,ভুল বলে কি করে?ফোনটা ধরে 'হ্যালো' বলতেই ওপাশ থেকে অজিতের কাঁপা কন্ঠস্বরের আর্তি, "বাবা,মাকে নিয়ে এক্ষুণি একবার আমাদের ফ্ল্যাটে আসুন।"
যতীনবাবু সিঁদুরে মেঘ দেখলেন।উদ্বেগ জড়ানো কন্ঠে অজিতকে প্রশ্ন করলেন,"কি হয়েছে?মহুল মা আমার ঠিক আছে তো?"
অজিত শুধু বলল,"বাবা, ফোনে এসব বলা যাবেনা।আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।"
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পড়িমরি করে ছুটলেন অজিতের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে, একরাশ দুর্ভাবনা সঙ্গে করে নিয়ে।
সারারাত মহুলের সাথে সাথে অজিতও দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।বেচারি মহুল কেঁদে- কেঁদে চোখদুটো ফুলিয়ে ফেলেছে।বেলটা বাজতেই অজিত ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।দরজাটা খুলতেই মা-বাবার ব্যাকুল চিত্তের প্রশ্ন, "কি হয়েছে?কি হয়েছে মহুলের?"
যতীনবাবু-কমলাদেবী ঘরের ভিতরে ঢুকতেই, অজিত দরজাটা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেয়। তারপর হাতদুটো কচলিয়ে ,মুখ কাঁচুমাচু করে,মাথা নিচু করে খানিক ভয়ে খানিক তীব্র উত্তেজনায় ব্যাকুল হয়ে বলে,"মা আপনি মহুলের কাছে যান।বাবা আপনি একটু পাশের ঘরে আসুন আমার সাথে।আমি সব বুঝিয়ে বলছি।"
যতীনবাবু-রমাদেবী একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। তারপর অজিতের কথামতো রমাদেবী গেলেন মেয়ের কাছে আর যতীনবাবু গেলেন জামাইয়ের সঙ্গে। অজিত ভেবেছিল যে সে সবটা ধীরে ধীরে বলে উঠতে পারবে।কিন্তু অপরাধ প্রবণতায় ভোগা লজ্জিত অজিত একটা কথাও যতীনবাবুকে বলে উঠতে পারল না।অন্যদিকে মাকে কাছে পেয়ে মহুলের যন্ত্রণা যেন আরো তীব্র হয়ে উঠলো,সাথে তার কান্না তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠলো। অজিতকে বারে বারে নানা প্রশ্ন করেও কোনও উত্তর পেলেন না যতীনবাবু। অন্যদিকে পাশের ঘর থেকে তাঁর আদরের মহুলের কাতর কন্ঠের কান্না ক্রমাগত ভেসে আসতে থাকে।আর এক মুহূর্ত দেরি না করে যতীনবাবু বুকের হৃদস্পন্দনকে কোনওরকমে সামলে গেলেন মেয়ের কাছে।অজিত তখন কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে জানলার সামনে।পূর্বদিকের ঘর।তাই প্রতিদিন সূর্যওঠা দেখা অজিতের একরকম অভ্যাস হয়ে গেছে।প্রতিদন সে আর সূর্য সকালবেলা একে অপরকে অভিবাদন জানিয়ে দিন শুরু করে।আজ যেন অজিত অন্যদিনের তুলনায় সূর্যের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। সূর্য যেন আজ তাকে কটাক্ষ করছে।যেখানে স্বামী হয়ে স্ত্রীকে রক্ষা করা কর্তব্য সেখানে সে নিষ্পাপ স্ত্রীয়ের ফায়দা তুলেছে। এইরকম কত কি এই মুহুর্তে অজিত ভেবে চলেছে।সকাল যত হচ্ছে সূর্যের কটাক্ষ যেন আরো প্রকট হচ্ছে। এ কোন সকাল?এমন সকাল যে তার জীবনে কোনওদিন আসতে পারে তা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।বেশ কিছুক্ষণ পর যতীনবাবু পাশের ঘর থেকে ফিরে এলেন।অজিত তখনও জানলার ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে। আষাঢ়-শ্রাবণহীন অনুতাপের মেঘ,এ অসময়ে বৃষ্টি নামিয়েছে তার দুচোখে।পাপবোধের চোরাবালিতে ঘূর্ণি লাগতে শুরু করেছে।যতীনবাবু আস্তে আস্তে তাঁর হাতটা অজিতের কাঁধে রাখলেন।অজিত ভাবলেশহীনভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।কোনওদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই।
যতীনবাবু ক্ষীণকন্ঠে বললেন,"আমি তো বলেছিলাম বাবা,তুমি পারবেনা।"
যতীনবাবুর কন্ঠে 'পারবেনা'শব্দটা শুনে আর অজিত স্থির থাকতে পারল না।এবার বেসামাল হয়ে পড়ল।হাউহাউ করতে করতে মেঝেতে বসে পড়ল।দুহাত দিয়ে বুক চাপরাতে চাপরাতে চিৎকার করে উঠল অজিত,"পাপ করেছি পাপ আমি জানোয়ার, আমি ধর্ষক,আমায় জেলে দিন বাবা আমায় জেলে দিন।আমি স্বামীর অধিকার হারিয়েছি "
যতীনবাবু অজিতের মুখ চেপে ধরলেন,"চুপ করো,চুপ করো।শান্ত হও।কিচ্ছু হয়নি।তুমি কোনও অন্যায় করোনি,কোনও পাপ করোনি।আমরা কিচ্ছু মনে করিনি।"
অজিত অবাক হয়ে যতীনবাবুর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
যতীনবাবু আবার বললেন,"যা হয়েছে সেটা স্বাভাবিক,অস্বাভাবিক কিছু নয়। "
অজিত কিছুটা সামলে নিয়ে বিস্ময়ের সাথে যতীনবাবুকে প্রশ্ন করল,"কি বলছেন বাবা,কাল রাতে যা হয়েছে তা অস্বাভাবিক নয়?"
"না অস্বাভাবিক নয়। আর এটা তুমি তোমার মাথায় ঢুকিয়ে নাও।আর এ নিয়ে কোনও কথা নয়।বুঝলে?"অজিতের দু কাঁধ ধরে বেশ জোরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে কথাগুলো বললেন যতীনবাবু।
অজিত খানিক মাথা চুলকে নিয়ে নিচু স্বরে বলল,"অস্বাভাবিক নয়?"তারপর আবার জোর গলায় বলতে লাগল,"কি বলছেন বাবা,যে মেয়েটা আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক নয়,যে এসবের কিছুই বোঝেনা,তার সাথে এসব করাটা অস্বাভাবিক নয়?আপনি বাবা হয়ে এসব বলছেন কি করে?আরে,স্বাভাবিক তো তখন হবে যখন দুজনের সম্মতি থাকবে।জোর করাটা কোনও অর্থেই স্বাভাবিক নয় ।যে কোনও কাউকে তার মর্জির বিরুদ্ধে জোর করে কোনও কিছু করাটাই অন্যায়।আমার পছন্দই নয় জোর-জবরদস্তি করা। তবু আমি হেরে গেলাম আমার আদিম রিপুর কাছে।আর আপনি তাকে বাবা হয়ে প্রশ্রয় দিচ্ছেন?"
"হ্যাঁ প্রশ্রয় দিচ্ছি।তুমি যদি তাই মনে করো তো তাই।আমার মেয়ের কথা ভেবেই প্রশ্রয় দিচ্ছি। "উত্তেজিত হয়ে যতীনবাবু কথাগুলো বলেন অজিতকে। পরে একটু নরম সুরে বললেন,"এটা কোনও ব্যাপারই নয় অজিত।এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যেটা সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে।তুমি কোনও অন্যায় করোনি। আসলে মহুল তো এসব বোঝেনা।তাই ও এরকম করছে।আর তাই তোমার এরকম মনে হচ্ছে। দুঃখ কোরোনা। দুটো দিন যাক্ সব ঠিক হয়ে যাবে।"
"কিচ্ছু ঠিক হবেনা বাবা।আপনি যতই ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক বলে ধামাচাপা দিয়ে দিন না কেন।আমি জানি আমি কি করেছি।জ্ঞানত আমি নিজেকে কোনওদিনও ক্ষমা করতে পারব না।আমি আবারও বলছি। কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কিছু করা বা করানোটাই সম্পূর্ণ অন্যায়। আমি এতবড় মহাপুরুষ নই যে এরকম ঘৃণ্য নিন্দনীয় অপরাধের জন্য নিজেকে নিজে আইনের হাতে তুলে দেব।আসলে তো আমি একটা কাপুরুষ। বুকের পাটা বা মেরুদণ্ড কোনওটাই নেই।তবু যতটুকু বোধ-বুদ্ধি, বিবেক বেঁচে আছে তাতে করে আমি নিজেকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না।"উদাস কন্ঠে বলে ওঠে অজিত।এ যেন কোনও হতাশাগ্রস্ত,পাপবোধে লীন আসামির জবানবন্দী। যে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে অনুতাপের চাবুক মেরেই চলেছে।
"কি আজেবাজে বকছ?"যতীনবাবু অজিতকে এক ধমক দিলেন।
"আজেবাজে?..............."অজিতের কথার মাঝপথে কমলাদেবী সে ঘরে প্রবেশ করলেন।
অজিত তাঁকে দেখতে পেয়েই সটান প্রশ্ন করে,"মা আপনিও নিশ্চয়ই বলবেন আমি আজেবাজে বকছি।আর আমি কোনও অন্যায় করিনি। "
"এসব কথা আসছে কোত্থেকে?এসব কথা তখনই আসে যখন কেউ ভুল করে।আর তুমি তো কোনও ভুল করোনি।"কমলাদেবী খুব শান্তভাবেই কথাগুলো বললেন।
কমলাদেবীর কথা শুনে হাততালি দিতে দিতে অজিত কটাক্ষের সুরে বলে ওঠে,"বাহ্ অসাধারণ।আপনিও ঠিক বাবার মতোই কথাগুলো বললেন।আপনারা দুজনে কি শলাপরামর্শ করে ঠিক করেছেন যে,একই কথা ছাড়া কেউ আলাদা কথা বলবেন না?এবার বুঝছি বৈবাহিক ধর্ষণ বলে কেন কিছু সমাজে হয়না?পুরুষ তো তাই যা খুশি করার অধিকার আছে তার আর এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবার কথা না হয় ছেড়ে দিন।কিন্তু আপনি একজন মা,একজন নারী হয়ে কি করে আমাকে ক্ষমা করতে পারেন?অপরাধ করে আমার মনে আগুন জ্বলছে।আপনাদের আমাকে দেখে ঘেন্না হচ্ছে না?"
"না হচ্ছে না কারণ তুমি কোনও ভুল করোনি।আর এটা তুমি তোমার মাথায় বসিয়ে নাও আর নিজের মনকে বোঝাও,এতে তোমার আর মহুলের দুজনেরই মঙ্গল। আর শোনো,মহুল বাড়ি যাওয়ার জন্য খুব বায়না করছে।ওকে অনেক বুঝিয়েছি,ও কিছুতেই এখানে থাকতে রাজি হচ্ছে না খালি বাড়ি যাওয়ার জন্য জেদ করছে।ওকে তাই নিয়ে যাচ্ছি কেমন। কয়েকদিন ওখানে গিয়ে থাকুক ভালোভাবে বোঝাই সব। তারপর ও ঠান্ডা হলে ওকে আবার দিয়ে যাব।"কমলাদেবী অজিতকে বললেন।
মহুল বাপের বাড়ি যাবার জেদ ধরেছে শুনে অজিতের পায়ের তলার মাটি যেন সরে যায়। মাথায় যেন বাজ পড়ে তার।অস্ফুটে বলে ওঠে সে,"মহুল চলে যাবে?আমায় একলা ফেলে চলে যাবে?"
যতীনবাবু অজিতকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,"ও কি একেবারে যাচ্ছে বাবা।কয়েকদিন যাক্।আমাদের সাথে থাকুক।ওকে বোঝাই,ওর মন শান্ত হলে দেখবে যেমন আজ ও যাওয়ার জন্য জেদ করছে তেমন একদিন ও তোমার কাছে ফিরে আসার জন্য জেদ করবে।"
"তাই যেন হয় বাবা।তবে বাবা আমি কিন্তু রোজ ওকে দেখতে যাব।"কাঁদো কাঁদো সুরে অজিত যতীনবাবুকে অনুরোধ করল।
"এতে বলার কি আছে বাবা?তুমি ছাড়া আমাদের আর এত আপন কে আছে?নিশ্চয়ই যাবে।যখন ইচ্ছা তখন যাবে।আমাদের বাড়ির দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে।"যতীনবাবু অজিতকে পুনরায় সান্ত্বনা দিয়ে কথাগুলো বললেন।
মেয়ের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন কমলাদেবী।তাঁকে সাহায্য করল অজিত। কাল রাতের ঘটনার পর থেকে মা-বাবার সাথে বাড়ি যাওয়ার সময় পর্যন্ত মহুল আর একটা কথাও বলেনি তার 'প্রিয়' স্যারের সাথে।শুধু দরজার বাইরে পা দেওয়ার আগে একবার ঘুরে তাকিয়ে আহত,অভিমানী মহুল অজিতকে বলে গেল,"তুই খুব খারাপ, বাজে,দুষ্টু। তোর সাথে আড়ি,আড়ি,আড়ি।"
দরজাটা কোনওরকম
বন্ধ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে অজিত।একসময়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে অজিত মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ে কতক্ষণ ওইভবে মেঝেতে পড়েছিল অজিতের মনে নেই। পরের দিন নয়,এই সামান্য সময়ের ব্যবধানটুকুও যেন অজিতের কাছে অস্বস্তিকর ঠেকছে।তাই সে আর কালকের অপেক্ষা না করে বিকেলেই ছুটে গেল মহুলদের বাড়ি।মহুল অজিতকে দেখামাত্রই আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে।হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই অজিতকে ছুঁড়ে মেরেছে।মেয়েকে থামাতে গিয়ে যতীনবাবু,কমলাদেবী দুজনেই ব্যর্থ হন।এই প্রথম হল এমন,মহুল তার বাবার হাজার বোঝানো এবং মায়ের বকুনির এত অবাধ্য হল।সে তার মতো করে প্রতিবাদ করেই যাচ্ছে। কমলাদেবী মহুলকে বকাবকি করায় সহানুভূতির সুরে অজিত বলে ওঠে,"আহা হা,ওকে কিছু বলবেন না মা।ওহ্ কত কষ্ট পেয়েছে বলুন তো।ও তো সেটুকুও বুঝিয়ে বলতে পারছে না বেচারি।আমরা কি ওর মনের কথা বুঝছি কেউ?"
অজিত নিয়ম করে স্কুল থেকে ফোন করে ঠিকই কিন্তু মহুল কোনওরকম কথা বলতে নারাজ। ভিডিওকলে সে অজিতকে দেখতে পেলে, সেখান থেকে পালিয়ে যায়। অজিত অস্থির হয়ে ওঠে ভালোভাবে একঝলক মহুলকে দেখবে বলে।অবশেষে সে একটা উপায় বার করেছে। মহুল যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সে মহুলকে আশ মিটিয়ে দেখে আসে।মহুল জেগে পড়ার আগেই সে ফিরে আসে।কমলাদেবী যতীনবাবুকে একদিন বললেন,"অজিতের কাছে তুমিও মাঝে-মধ্যে গিয়ে খবর-টবর নাও বুঝলে।এখানে তো শুধু আসে মেয়েটাকে একঝলক দেখবে বলে ।তারপরই তড়িঘড়ি চলে যায়। বসে না পর্যন্ত। ভালোভাবে কথাও বলে না। হয়তো আমি আছি বলে বা মেয়েটা জেগে গিয়ে আবার রাগারাগি করবে বলে।এসব কথা শুধু ফোনে বোঝানোও সম্ভব নয়। বরং ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে ওর কাছে বসে,ওর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে ভালোভাবে বোঝাও।আমি ওকে যতটা বোঝাবার বুঝিয়েছি।এর থেকে বেশি বোঝালে ও হয়তো লজ্জা পেতে পারে।যতই হোক্ শাশুড়ি, একজন মহিলা।তুমি শশুর হলেও পুরুষমানুষ। তুমি বললে অতটা ওর খারাপ লাগবে না। কদিন ধরেই দেখছি বেচারিকে কেমন যেন মনমরা মনমরা।ছেলেটা বড্ড ভেঙে পড়েছে। "
"হুম্, তুমি ঠিকই বলেছো।আমি আজই বরং একবার যাই।ও স্কুল থেকে ফিরুক,তারপর সন্ধ্যের সময় করে আমি ওর কাছে যাব।"স্ত্রীকে জানালেন যতীনবাবু।
কথামতো সন্ধ্যেবেলা যতীনবাবু হাজির হলেন অজিতের ফ্ল্যাটে।অজিত একটু আগেই ফিরেছে।কলিং বেলটা বাজতেই অজিত তাড়াতাড়িতে টেবিলে রাখা ব্যাগটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে ফেলল।যতীনবাবু বসতে গেলে অজান্তে পা লাগে সেই ব্যাগটায়।কিসে পা লাগল দেখতে গিয়ে দেখেন একটা ব্যাগ।ব্যাগটা সরাতে গিয়ে দেখতে পেলেন ব্যাগে রাখা জিনিসগুলো। মদের বোতল,সিগারেটের প্যাকেট। একমুহূর্ত যতীনবাবু ভাবলেন যা দেখছেন বুঝি ভুল দেখছেন।স্তম্ভিত হয়ে অজিতকে প্রশ্ন করেন,"অজিত কি এসব?তোমার তো কোনওদিন এসবের অভ্যাস ছিল বলে তো মনে পড়ে না।"
মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে অজিত জানাল,"আমি শুনেছি,নেশা করলে নাকি কষ্ট ভোলা যায়!"
অজিতকে বুকে জড়িয়ে ধরেন যতীনবাবু। তারপর অজিতকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে যতীনবাবু শান্তস্বরে বললেন,"তুমি যদি এরকম করো,তাহলে আমরা মহুলকে সামলাবো কি করে?আমরা তো তোমার ভরসাতেই এতদিন নিশ্চিন্তে ছিলাম।"
"আর আমার ভরসা!"অজিত আনমনে বলে ওঠে।
"আমি তো বলছি বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে।তুমি এত চিন্তা কোরোনা। শুধু একটু সময় লাগবে।"যতীনবাবু আবারও অজিতকে বোঝালেন।
চেয়ার ছেড়ে অজিত দাঁড়িয়ে পড়ে।তারপর জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে থাকে,"আর কতো সময় লাগবে বাবা?আর কতো?হুঁহ্।আসলে কিছুই ঠিক হবেনা। যে ঠিক করার সে-ই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পারলে একমাত্র মহুলই পারে সবকিছু ঠিক করতে।আর সত্যিই তো ও কেনই বা এই অন্যায় মেনে নেবে?মহুল দেখিয়ে দিল বাবা,আপনি আমি শিক্ষিত,সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছি আর যাকে আমরা অসুস্থ বলে ভাবছি সে কিন্তু সমানে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। ও অসুস্থ হয়েও ঠিক আর আমরা সুস্থ হয়েও অন্যায় করছি।আমাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ।"
অজিতের কথা শুনে যতীনবাবু বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।তারপর আস্তে আস্তে বললেন,"দ্যাখো বাবা,দুর্ঘটনা বলো,ভুল বলো,আমাদের এটা মেনে নিয়েই চলতে হবে।আর এটা তো ঠিক যে তুমি মহুলকে ভালোবাসো আর তাই তুমি এত অনুতপ্ত।দুর্ঘটনা ঘটলে তো মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করে।কিন্তু তুমি এরকম নিজেকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিলে কি করে হবে বলো তো?তার থেকে একটু সবুর করো।আমরা তো ওকে বোঝাচ্ছি। দেখো তোমরা দুজন আবার ঠিক স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে।মনে রেখো অজিত,এখন মহুল কিন্তু আর আমাদের ভরসায় নেই।ও কিন্তু এখন তোমার ভরসায় আছে।মহুলকে যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকো তাহলে নিজেকে শক্ত করো,মন থেকে এসব মোছো।এতেই তোমাদের দুজনের মঙ্গল। "
যতীনবাবু অজিতকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরলেন।আর ফেরবার পথে সঙ্গে নিয়ে এলেন মদের বোতল আর সিগারেট ভর্তি ব্যাগটা।রাতের অন্ধকারে, চুপিসারে সবার অলক্ষ্যে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে তা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
মহুল বাড়িতে আসার পর আজকাল রোজই কমলাদেবী এটা-ওটা ভালো ভালো পদ রান্না করেন অজিতের জন্য, যা যতীনবাবু নিজে গিয়ে অজিতকে দিয়ে আসেন।এরকমটা যে এই প্রথম হচ্ছে এমনটা নয়। আগেও কমলাদেবী মেয়ে-জামাই-এর জন্য নানারকম রান্না করে পাঠিয়েছেন,তবে এখনকার মতো রোজ রোজ নয়।আসলে অজিতের মানসিক স্থিতির কথা বিচার করেই,ওর একটু মন ভালো করার ক্ষুদ্র প্রয়াস। বাড়িতে যে অজিতকে ডেকে খাওয়াবেন বা দুটো কথা বলবেন,সে উপায় নেই। কারণ মহুল সজ্ঞানে অজিতের মুখ দেখতেও নারাজ।অজিতকে দেখলেই কান্নাকাটি করে, চিৎকার ক'রে সারা বাড়ি মাথায় তুলে শেষে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাই একপ্রকার যেন অজিতের মহুলের মুখোমুখি হওয়াও যেন নিষেধ।যতীনবাবুই যতটা পারেন অজিতের কাছে যান আর অজিত তখনই মহুলদের বাড়িতে আসে যখন মহুল ঘুমিয়ে থাকে,চোরের মতো আসে আবার মহুল জেগে পড়লে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যায়।
দিন গড়িয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ গড়িয়ে মাস কেটে গেল।মহুলের এ বাড়িতে ফিরে আসার সম্ভাবনা যেন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতম হয়ে আসছে।চিন্তায় চিন্তায় রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনা অজিত।চুলগুলো উস্কোখুস্কো,দীর্ঘদিন দাড়ি কাটে না, চেহারাটাও ভেঙে গেছে।
চিন্তিত যতীনবাবু একদিন স্ত্রীকে বললেন,"বুঝলে,আমি ভাবছিলাম অজিতকে নিয়ে একবার ডাক্তারের কাছে যাবো। ওর ভাবগতিক ভালো ঠেকছেনা। কখন যে কি করে বসে!"
"ভালোই ভেবেছ।কিন্তু কোন্ ডাক্তার দেখাবে ঠিক করেছ কিছু?"কমলাদেবীর জিজ্ঞাস্য।
"সাইক্রেয়াটিস্ট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিজেকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যে এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে কি আমার কথায় আদৌ ডাক্তার দেখাতে যেতে রাজি হবে?মনে তো হয়না।কিন্তু তবু আমি ওকে বোঝাব।এটা আমার কর্তব্য। "যতীনবাবু স্ত্রীকে জানালেন।
যে অজিত ভোর হওয়ার সাথে সাথে এমনিই ঘুম থেকে জেগে পড়ত,সেই অজিতের এখন ঘুম থেকে উঠতে ফোনের অ্যালার্ম আর ঘড়ির অ্যালার্ম দুটোই একসাথে লাগে।ঘুম নামক বস্তুটাই যেন অজিতের জীবন থেকে বায়বীয় পদার্থের মতো উবে গেছে।কখন ঘুমায় কখন জাগে তার কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। সদাসর্বদা একটা আনমনা ভাব।স্কুলে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে স্পষ্টত এড়িয়ে যায় বিষয়টা। রাতে ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে কথা বলে।ঘুমাতে, জাগতে সবসময় একটা কথাই লেগে থাকে অজিতের মুখে এবং মনে 'পাপ পাপ,আমি পাপ করেছি।'রাতে নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে।তার বেশিরভাগটাই মহুলকে নিয়ে। এই যেমন গত ভোরে মহুলকে নিয়ে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখে অজিত।ধড়মড়িয়ে খাটে উঠে বসে পড়ে সে।ঢকঢক করে জগের সমস্ত জলটাই নিমেষে শেষ করে ফেলে।শরীরটা কেমন যেন আনচান-আনচান করে ওঠে অজিতের।ঘরে খানিক পায়চারি করে নেয়। 'ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়।'এইধরণের কুসংস্কারে অজিত কোনওদিনও বিশ্বাস করেনি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের মঙ্গলের জন্য বোধহয় কুসংস্কারও প্রশ্রয় পেয়ে যায়। তাই ভোরের এরকম অপয়া স্বপ্ন নিয়ে অজিত বেশ চিন্তিত। খাটে এসে বসে অজিত। বসে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখদুটো জুড়িয়ে যায় অজিতের। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে কলিং বেলের ক্রমাগত শব্দে।
দরজা খুলতেই দেখে যতীনবাবু দাঁড়িয়ে। গত ভোরের স্বপ্নের জেরে অজিত যতীনবাবুকে কিছু বলতে না দিয়েই উৎকন্ঠার বশে প্রশ্ন করে বসল,"কি হয়েছে মহুলের, মহুল ঠিক আছে তো?"
যতীনবাবু অজিতকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।তারপর দালানে পাশাপাশি দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে একটায় অজিতকে বসিয়ে নিজে তার পাশের চেয়ারটায় বসলেন।
"শোনো অজিত,তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে। আগে মাথা ঠান্ডা করে সবটা শোনো।" তারপর খানিক থেমে আবার বললেন,"তারপর যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেওয়া যাবে।"
'ব্যবস্থা' শব্দটা শুনে একটু অবাকই হয় অজিত।তাই প্রশ্ন করে, "ব্যবস্থা, কিসের ব্যবস্থা বাবা?"
যতীনবাবু খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।কি করে বলবেন কথাটা ঠিক করে উঠতে পারলেন না।একে মহুল তার উপরে আবার অজিতের এরকম মানসিক অবস্থা। তবু তো বলতেই হবে কথাটা।অজিত এ বিষয়ে যুক্ত না থাকলে যতীনবাবু কখনোই অজিতকে এ ব্যাপারে বিরক্ত করতেন না।মনে জোর এনে অবশেষে যতীনবাবু কথাটা বলেই ফেললেন অজিতকে, "বাবা অজিত, মহুল মা হতে চলেছে।"
কথাটা শুনেই অজিতের বুকের ভিতরটা কেমন যেন ধক্ করে ওঠে।কিছুক্ষণ বোকার মতন অজিত যতীনবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে,তারপর আবার লজ্জায় চোখদুটো সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে সে।
আবার যতীনবাবুই বলতে থাকেন,"ওর মা-ই প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারে।বাড়িতে যেভাবে পরীক্ষা করে জানা সম্ভব সেভাবেই আমরা জেনেছি।ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। ওকে দেখাতে নিয়ে যাব তাই ভাবলাম সবার আগে তোমাকে জানানো প্রয়োজন, হাজার হোক্ তুমি এ সন্তানের বাবা।তাই বাচ্চার ব্যাপারে যাই সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক্ না কেন তোমার অনুমতি ছাড়া তো কিছু করা সম্ভবপর নয়। তারপর ডাক্তারেরপরামর্শ নিয়ে যা ভাবার ভাবা যাবে।আবারও বলছি অজিত,তুমি কিন্তু কোনও ভুল করোনি।মনে কোনওরকম চাপ রেখোনা কিন্তু।"
কোন্ পুরুষ-মানুষ না চায় বাবা হতে?কিন্তু মহুলের মাতৃত্বে খুশির চেয়ে চিন্তার ভাঁজই সকলের কপালে।
আজ বহুদিন পর অজিত-মহুলের মুখোমুখি সাখ্যাৎ হবে।মহুলের প্রতিক্রিয়া কি হবে জানা নেই।অজিত শুধু যতীনবাবুকে বলল,"বাবা আপনি এগোন,আমি একটু দোকান থেকে আসছি।দোকান থেকে সোজা আপনাদের বাড়িই যাব।"
যতীনবাবু ফিরে গেলেন বাড়িতে।আর অজিত ছুটল দোকানে,স্ত্রীয়ের জন্য পছন্দসই জিনিষ কিনতে।জামা-কাপড়,খেলনা,বেলুন,চকোলেট, আইসক্রিম, রঙ,আঁকার খাতা আরো কত কি।
খবরটা তো খুশির কিন্তু সত্যিই খুশির তো?কেউ চায় না এই দুনিয়ায় আবার একটা মহুল আসুক।আর মহুল তো নিজেও বোঝেনা এই মাতৃত্বের স্বাদ ঠিক কেমন।
কেনাকাটা সেরে অজিত সোজা গেল মহুলদের বাড়ি। মহুল তখন খেলায় মত্ত। পিছন দিক্ থেকে পা টিপে টিপে খানিক ঢোঁক গিলে অজিত ভয়ে ভয়ে মৃদুস্বরে ডাকল,"মহুল।"
অজিত একেবারেই আশা করেনি, মহুল এরকম প্রতিক্রিয়া দেবে।বহুদিন পর অজিতের সেই পরিচিত গলা শুনে মহুল ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলল,"স্যার তুই এসে গেছিস?"
মহুলের দরদি কন্ঠস্বর শুনে অজিত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সজোরে বুকে জাপটে ধরল মহুলকে।হাউহাউ করে সে কি তার কান্না!বুকের ওপর চেপে বসা পাথরটা কিছুটা হলেও সরল অজিতের, আর মহুলের হয়ত অভিমানের পারদ কিছুটা হলেও কমেছে। অজিত যতীনবাবু আর কমলাদেবীর উপস্থিতির কোনওরকম তোয়াক্কা না করেই আবেগপ্রবণ হয়ে মহুলের গালে,কপালে পরপর চুম্বন করতে লাগল।সে কি বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস তার!যতীনবাবু আর কমলাদেবীই খানিক লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে অন্য জায়গায় সরে গেলেন।তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর যতীনবাবু আবার উপস্থিত হলেন মেয়ে-জামাইয়ের সামনে।যদিও তখন অজিত মহুলকে জড়িয়ে ধরেই বসে আছে।যতীনবাবু অযথা একটু গলা খ্যাঁকরালেন।তাঁর গলার শব্দে অজিতের ঘোর যেন কাটল আর সে মহুলকে তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করল।
অজিতের কাঁধে হাত রেখে যতীনবাবু বললেন,"আমি বলেছিলামনা বাবা,সময় দাও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য কলছিলাম,মহুল যেন কি খুঁজছে। তারপর গত পরশু আমার ভাগ্না সৃজন এসেছিল আমাদের বাড়িতে।ও ভেবেছিল তুমি এসেছ।"
সত্যি সেদিন যখন মহুলের পিসতুতো দাদা সৃজন ওদের বাড়িতে আসে,মহুল তখন ঘরের ভিতর ছিল।গলা শুনে প্রথমটা অতটা বুঝতে পারেনি।অজিত এসেছে ভেবে ছুট্টে ঘর থেকে দালানে এসে যেই দেখে অজিত না,এসেছে তার দাদা সৃজন,বিমর্ষ হয়ে মহুল সেদিন বলেছিল,"আমি ভেবেছিলাম স্যারটা এসেছে।"বলেই আবার তার ঘরে ফিরে যায়।
মহুল আর অজিতকে আরো কিছুটা সময় একান্তে কাটাতে দেওয়ার অভিপ্রায়ে যতীনবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।মহুল অজিতের কাছ থেকে অত উপহার পেয়ে সেগুলো সে নেড়েচেড়ে দেখাতেই মশগুল। অজিত আবার মহুলকে জড়িয়ে ধরে ।অনুতপ্ত অজিতের আজ যেন তার বুকটা ভারি হাল্কা বলে বোধ হচ্ছে। তবু সে মহুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলতে থাকে,"বড় সস্তায় আমায় মাফ করে দিলে মহুল, বড় সস্তায় আমায় মাফ করে দিলে।"
মহুলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় অজিতের মনে নানা দুর্ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। যেমন,তাদের এই অনাহূত সন্তানের ফলে মহুলের কোনও ক্ষতি হবে না তো?কিংবা এ সন্তান আবার মহুলের মতোই হবে না তো?
ডাক্তারের ঘরে ঢুকতেই ডাক্তার প্রথমটা অজিতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।তারপর মহুলকে দেখে চিনতে পারলেন। প্রবীণা ডাক্তার মহাশয়া বললেন,"আপনাকে দেখেই প্রথমটা মনে হয়েছিল,কোথায় যেন দেখেছি,তারপর আপনার স্ত্রীকে দেখে চিনতে পারলাম।আসলে আমি অতশত সোশ্যাল মিডিয়া বুঝিও না,টিভিও খুব একটা দেখিনা আর কাগজও বলতে গেলে শুধু চোখ বোলানোর সময়টুকু পাই ।তাই আপনাদের বিষয়টা প্রথম প্রথম নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। পরে আমার মেয়েই আপনাদের ব্যাপারে জানায়।ওর মোবাইলেই আপনাদের ছবি দেখেছিলাম। "তারপর হাসিমুখে আরো যুক্ত করলেন,"আপনাদের মতন কিছু ভালো মানুষ আছেন বলেই আজো পৃথিবীটা চলছে।"
বয়স্কা ডাক্তারের কথা শুনেই অজিতের ভিতরটা যেন জ্বলে উঠল।অজিতের মনে হল ডাক্তারের কথার প্রতিবাদ করা উচিৎ।ইনিও সেই একই ভাবলেন।ভালো মানুষ, দেবতা ইত্যাদি ইত্যাদি আরো না জানি কত বিশেষণ।কিন্তু আসলে সে একটা আস্ত জানোয়ার। প্রথমে সে তার ভিতরের ভালো মানুষটাকে মেরেছে তারপর একটা নিষ্পাপ, সরল মেয়ের বিশ্বাসকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে।অজিত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। যতীনবাবু অজিতের ভাবগতিক বুঝতে পেরে তাই আগে ভাগেই অজিতের কথার আগে কথা রাখলেন,"হ্যাঁ, তা যা বলেছেন।ও আছে বলেই তো আজ আমরা নিশ্চিন্ত আমার মেয়ের ব্যাপারে। না হলে আমাদের তো মনে মনে ভয় চিরকাল,আমাদের অবর্তমানে ওর কি হবে?ও যা আমার মেয়েকে রেখেছে,তা আপনি ভাবতেও পারবেন না।"
"তা দেখেই বুঝতে পারছি।"ডাক্তারও স্মিত হাসি হেসে প্রত্যুত্তরে জানালেন।
"আর তাই তো সবসময় ও আমার মেয়ের চিন্তাতেই মশগুল। এই দেখুন না আমার মেয়ে সন্তানসম্ভবা জানার পর খুশির চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তাই করে আসছে।একবার বলছে যা হয়েছে ঠিক হয়নি।একবার ভাবছে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মহুলের কোনও কষ্ট হবে না তো?একবার ভাবছে ওদের সন্তান সুস্থ-স্বাভাবিক জন্মাবে তো?"যতীনবাবু ডাক্তারকে জানালেন।
ডাক্তার খানিকক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করার পর বললেন,"আপনার সব প্রশ্নের একে একে উত্তর দিচ্ছি। প্রথমতঃ যেটা হয়েছে সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে এটা না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক। এটা বিজ্ঞানেরই একটা অংশ।এবার মহুল যেহেতু আর পাঁচটা বাকি মেয়েদের মতো নয়,তাই আপনি যে বলছেন বিষয়টা ঠিক হয়নি,সেটা তাহলে আগে ভাবা উচিৎ ছিল।আসলে এসব উত্তেজনা দমন করা সত্যিই বড়ো কঠিন,তা আমি মানি।তাই দোষারোপ করে কোনও লাভ নেই। যা হয়ে গেছে সেটাকে মেনে নিতে হবে। অযথা মনে চাপ বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই।দ্বিতীয়তঃ এখন দুনিয়ার অগ্রগতির সাথে সাথে বিজ্ঞান,প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে।আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রই বা পিছিয়ে থাকে কেন?তাই এখন ক্যান্সারের মতন রোগও যেমন সেরে যায় ঠিক তেমনি গর্ভস্থ ভ্রূণ সুস্থ না অসুস্থ সেটাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগে থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়। এমনও হয়েছে যমজ সন্তানের একটি ভ্রূণকে নষ্ট করে দিতে বাধ্য হয়েছি এই কারণে যে সেটি সুস্থ-স্বাভাবিক ছিল না বলে।তাই মা বা সন্তানের এতটুকু যদি কোনওরকম ঝুঁকি থাকে আমি নিজে থেকেই সেরকম ব্যবস্থা নেব।আপনাদের বলে দিতে হবেনা। মহুল আর ওর সন্তানের সবরকম পরীক্ষা করে তবেই আমি সিদ্ধান্ত নেব।আর এবার আসছি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরে।আচ্ছা একটা কথা বলুন তো........."ডাক্তার যতীনবাবু আর কমলাদেবীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,"আপনারা দুজন তো সুস্থ-স্বাভাবিক তাহলে আপনাদের সন্তান এরকম কেন হল?মানে এটা তো বুঝবেন যে কোনও কিছু নিশ্চিৎ করে আবার সবসময় আগে থেকে বলাও সম্ভব নয়। ঝুঁকি তো নিতেই হয়। শুধু এক্ষেত্রে নয় জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই।তার উপরে মহুলের ক্ষেত্রে একটু বেশিই ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষও হঠাৎ রোগের কবলে পড়ে। আবার এমনও দেখা গেছে মহুলের মতো মেয়েও সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়েছে যদিও সিংহভাগই তার নারী নির্যাতনের ঘটনা। "
অজিত মনে মনে বলে উঠল,"এটাও তাই।নারী নির্যাতনের ঘটনা।আমি তো শুধু ভালোমানুষ সেজে থাকার নাটক করছি মাত্র। "
যতীনবাবু অজিতের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন,অজিতের কাঁধে হাত রেখে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন।
প্রবীণা ডাক্তার বলে চললেন,"আমি আবারও বলছি,মেডিক্যাল সাইন্স এখন অনেক উন্নত। তাই মহুল আর মহুলের ভিতরে বেড়ে ওঠা সন্তানকে পরীক্ষা করব।তারপরেই চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করব।এবার আপনারা,সময় নিয়ে ভালোভাবে ভেবেচিন্তে জানান যে,এ সন্তান চান কি না?তবে বেশি সময় নেবেন না।কারণ ভ্রূণ বেড়ে গেলে তখন তাকে এ পৃথিবীতে না আনার সিদ্ধান্তটা গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে ক্ষতি করতে পারে।তাই খুব তাড়াতাড়ি আমি আপনাদের পরের ডেটটা দিচ্ছি। আজকে আমি যা ওকে দেখার দেখে নিচ্ছি।কিছু পরীক্ষা করার আছে করিয়ে আনুন,কিন্তু ফাইনাল ডিসিশনটা পরের বারই কিন্তু জানানো চাই।"
"আমি শুধু মহুলকে চিনি।মহুলের যদি কষ্ট না হয় তাহলে আমার এ বাচ্চায় কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু মহুলের সামান্য সমস্যা হলেও এ বাচ্চা আমি চাইনা।"অজিত জানায়।
"আমি তো আগেই বলেছি মা বা বাচ্চার কোনও অসুবিধা যাতে না হয় সেটা দেখাই আমার প্রথম কাজ।কিন্তু আপনি ঠিক করে ভেবে দেখুন,যদি আরেকটা মহুল এই দুনিয়ায় এসে যায়, সেদিন আপনি সামলাতে পারবে তো?সেদিন মহুল বা সন্তানকে দুরে সরিয়ে দেবেন না তো?"অজিতের দিকে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিয়ে প্রবীণা ডাক্তার মহাশয়া চশমার ফাঁক দিয়ে অজিতকে বেশ ভালোভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকলেন।
"কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি পিছিয়ে যাওয়ার মানুষই নই।যে দায়িত্ব একবার নিই,শেষপর্যন্ত পালন করি।"দৃঢ়চেতা অজিত জানায়।
"এটাই তাহলে আপনার শেষ কথা?সরে যাবেন না তো পরে?কি থেকে কি হয় কারোর নির্দিষ্ট জানা নেই।ভবিতব্য আমরা কেউই দেখতে পাইনা।আমি আমার চিকিৎসার সেরাটা ওকে উজাড় করে দেবো কথা দিলাম।আপনি ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত তো?"ডাক্তার শেষবারের মতো প্রশ্ন করলেন।
"একদম কোনও দ্বিমত নেই। "অজিত প্রত্যুত্তরে জানায়।
"বেশ,নিশ্চিন্ত হলাম।কিন্তু যেহেতু মহুল বাকিদের থেকে আলাদা,তাই আগে ওকে তৈরি করতে হবে মানসিক ভাবে মা হয়ে ওঠার জন্য। আমি তো আছি তবে প্রয়োজনে আলাদা কাউন্সিলিং করাতে হবে।"ডাক্তার জানালেন।
"ওর ভালোর জন্য যা যা প্রয়োজন আপনি তাই করুন, কোনওকিছুতে আটকাবে না।,তাতে যত টাকা লাগবে আমি দেব।বাকিটা আমি সামলে নেব।শুধু ও একটু ভালো থাকুক। "অনুরোধের সুরে বলে ওঠে অজিত।
"সত্যিই মহুল আপনাকে কতটা বোঝে জানিনা।কিন্তু ও সৌভাগ্যবতী।আজকালকার দিনে এমন স্ত্রী দরদি স্বামী পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি যে কতটা গভীরে ওকে ভালোবাসেন তা আপনার কথাবার্তাতেই স্পষ্ট। "বিস্ময়ের সুরে ডাক্তার বললেন।
অজিতের নিজেকে সপাটে দুটো থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছা হল।এ প্রশংসা তাকে যেন চাবুক হয়ে দগদগে ঘা উপহার দিচ্ছে। যত তার প্রশস্তি বাড়ছে ততই বাড়ছে চাবুকের যন্ত্রণার ভার।
"হ্যাঁ,ও আছে বলেই তো আমরা একেবারে চোখ বন্ধ করে নিশ্চিন্তে আছি।আমার মেয়ের স্বামীভাগ্য আমার থেকেও ভালো।" সিক্ত চোখে কমলাদেবী বলে উঠলেন।
সমস্তরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে সবাই মিলে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত মহুলের ভবিষ্যৎ সন্তানকে। অজিত মহুলের কোনও ব্যাপারে সামান্যতমও ফাঁক রাখতে চায় না।মহুলের তদারকির জন্য সর্বক্ষণের আয়ার ব্যবস্থা করেছে সে,যদিও মহুলের গর্ভাবস্থাকালীন এবং পরবর্তী সময়েও কিছুদিন মহুলের মা কমলাদেবী মহুলের কাছে থাকবেন বলেই মনস্থির করেছেন, তবুও অজিত মহুলের জন্য আয়ার ব্যবস্থা করতে ছাড়েনি।প্রথমটা ভাবা হয়েছিল অজিতের সুবিধা-অসুবিধার কথা মাথায় রেখেই, যদি মহুলকে বাড়িতেই রাখা হয় আপাতত। কিন্তু অজিত মহুলকে কাছে রাখতে আরো দশটা লোক রাখতেও রাজি কিন্তু মহুলকে কাছ ছাড়া করতে নারাজ।তাছাড়া মহুল অজিতের কাছে থাকলে অজিত তাকে সবসময় কাছে পাবে,কিন্তু বাপের বাড়িতে থাকলে অজিত সর্বক্ষণ মহুলকে কাছে পাবে না। যতীনবাবু যদিও অজিতকে বলেছিলেন এ সময়টুকু অজিত তাদের সাথেই থাকতে পারে,তাদের কোনও অসুবিধা নেই।কিন্তু অজিত রাজি হয়নি।আসলে অজিত জানে নিজের বাড়িতে নিজের স্ত্রীকে যতটা সোহাগ করতে পারবে শ্বশুর বাড়িতে তা করা সম্ভব নয়। তাই এরকম ব্যবস্থা। কিন্তু এত আয়োজন যার জন্য, সে বেচারি ঠিকঠাক বুঝতেও পারছে না যে আসলে ব্যাপারটা কি।ছোটবেলায় মহুল, যদিও মানসিক দিক দিয়ে এখনও সে ছোটই ,একবার মা ও বাবার সাথে আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিল তাদের নবাগত সন্তানটিকে দেখতে।তখন তার বাবা যতীনবাবু মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিলেন, "ওই দ্যাখ্ মা জ্যান্ত পুতুল।"
সেই থেকে মহুলের মাথায় ওই জ্যান্ত পুতুল শব্দটা রয়ে গেছে। কোনও ছোট্ট দুধের শিশুকে দেখলেই সে নিজে থেকেই বলে ওঠে, "জ্যান্ত পুতুল।"
সবাই তাকে বুঝিয়েছে,তার পেটের ভিতরেও ওরকম একটা জ্যান্ত পুতুল আছে,তাই তাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।'মা' হওয়ার বিষয়টা তার খুব একটা বোধগম্য হয়নি। সে শুধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে জ্যান্ত পুতুলটা পেট থেকে বাইরে বের হবে আর সে তার সাথে খেলবে।বাধ্য মেয়ের মতো তাই মহুল বড়দের কথা শুনছে।বড়দের কথা না শুনলে,ভালোভাবে না থাকলে,ওষুধ-পত্তর ঠিকঠাক করে না খেলে যে পুতুলটা রাগ করে পেটের ভিতরেই থেকে যাবে।আর বাইরে বের হবেনা। তখন কি হবে?তখন তো মহুলের মন খারাপ হয়ে যাবে।
স্কুল থেকে যখনই সময় পায় ফোনে বা ভিডিও কলে অজিত যেমন মহুলের খোঁজ নেয় তেমনি অজিত যতক্ষণ বাড়ি থাকে আর ছুটির দিনগুলোর প্রতিটা মুহূর্তই সেই-ই সবকিছু করে মহুলের জন্য। আয়া তো দুর কমলাদেবীকে পর্যন্ত কাছে ঘেঁষতে দেয় না।কমলাদেবী তাই আয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রয়োজনের বাইরে আয়া যেন অযথা তাঁর মেয়ে-জামাই-এর আশেপাশে ঘুরঘুর না করে।আসলে এ ব্যাপারে কমলাদেবীর বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলেছে,বহুবার। তার মধ্যে একবার এমন হয়েছিল, একদিন মহুল কিছুতেই দুধ খেতে চাইছিলনা।সকালবেলা,অজিতের স্কুল ছুটি সেদিন।নিজে হাতে সে মহুলকে গ্লাসভর্তি দুধ দেয়। চকলেট খেতে ভালোবাসে বলে,দুধে চকলেট মিশিয়ে দিয়েছিল।তবুও মহুল কিছুতেই দুধ খেতে নারাজ।অনেক বোঝাবার পরও যখন মহুল কিছুতেই দুধ খাবে না বলে মনস্থির করেছে,তখন অজিত নিজে চেয়ারে বসে মহুলকে তার কোলে বসিয়ে জোর করে দুধ খাইয়েছিল সে বার।কমলাদেবী তখন ভিতরের ঘরে ছিলেন।ঘর থেকে দালানে আসতেই, এ দৃশ্য চোখে পড়তেই তিনিই লজ্জিত হয়ে আবার ঘরে ঢুকে যান।
আয়া রমার বহু বাড়িতে কাজের অভিজ্ঞতা আছে।কিন্তু এরকম বাড়ি এই প্রথম দেখছে সে,আর এরকম স্বামীও সে প্রথম দেখছে ।সে তো অজিতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যদিও অজিতের এসব ভালো লাগে না এবং সে রমাকে বহুবার অনুরোধ করেছে এসব প্রশংসা বন্ধ করতে।যদিও রমা অজিতের অনুরোধে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে উল্টে প্রশংসার বহর আরো বাড়িয়েছে। তাকে আবার সমর্থন জানিয়েছেন স্বয়ং কমলাদেবীও।
"হ্যাঁ,আমি তো তাই বলি, আমার জামাইয়ের মতো জামাই দুনিয়ায় দুটো নেই।এত ভালোবাসে আর খেয়াল রাখে আমার মেয়ের যে কি বলব।ওদের দুটোকে একসাথে দেখলে চোখ দুটো জুড়িয়ে যায়। এত সুখও ভগবান লিখেছিলেন আমার মেয়েটার ভাগ্যে।আমারই না নজর লেগে যায়!"কথাগুলো বলতে বলতে কমলাদেবীর চোখ চিকচিক করে ওঠে।
"হ্যাঁ, আমি তো সবার কাছে দাদার কথা বলি।দেবতা ,পুরো দেবতা।মন্দিরে মূর্তি দেখেছি,কিন্তু জ্যান্ত দেবতা এই প্রথম দেখলাম। "রমা বলতে থাকে।
"হ্যাঁ,বাইরে দেবতা আর ভিতরে শয়তান।"মনে মনে কথাগুলো বলে ওঠে অজিত।কিন্তু সশব্দে বলতে পারল না। শুধু কমলাদেবী আর রমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,"আপনারা থামবেন।"
কমলাদেবী চুপ করে গেলেও রমা থামতে নারাজ। সে বলে চলল,"সে আপনি যাই বলুন দাদা।আমি তো বলব।তবে আরেকটা কথা দাদা।আপনি যেভাবে বৌদির জন্য করছেন, তাতে আমাকে না রাখলেও পারতেন। বিশেষ করে আপনার ছুটির দিনগুলোতে তো আমার না আসলেও চলে।এমনিও যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন ততক্ষণ আপনিই সবকিছু করেন,আমাকে বা মাসিমাকে কাছে পর্যন্ত ঘেঁষতে দেন না,আর ছুটির দিনগুলোতে তো কথাই নেই। আপনিই যদি সব করবেন,তাহলে মাইনে দিয়ে আমায় রাখা কেন?"
"সত্যি বলতে কি রমা,আমি ওকে বারণ করেছিলাম। আমি যেখানে আছি সেখানে লোক রাখার প্রয়োজনটাই বা কি?এতবছর তো আমিই করলাম, কিন্তু ও শুনলে তবে তো?আমার মেয়ের একচুল অসুবিধাও ও হতে দিতে চায় না।"কমলাদেবী বললেন।
কমলাদেবী আর রমার কথাবার্তায় অজিত একটু বিরক্তই হল।আর কিছু না বলে তাই পাশের ঘরে চলে গেল।সত্যি অজিত মহুলের কোনওরকম অসুবিধা হতে দিতে চায় না।মহুল তার প্রাণের থেকেও প্রিয়।শুধু সে রাতের ওই একটা 'ভুল' আজও ওকে কুড়ে কুড়ে খায়।মহুল আর ফিরে না এলে ও হয়তো এতদিনে নিজেকে শেষই করে ফেলত।অজিত বাকিটা জীবন মহুল আর তাদের সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায়। তাই দিন যত যাচ্ছে সন্তান আগমনের চিন্তা-খুশি সব মিলিয়ে অজিত যেন তার কাছে এ যাবৎ সঞ্চিত যত ভালোবাসা আছে তার সবটুকু নিঃশেষে উজাড় করে দিচ্ছে মহুলের উপর।যে মহুলকে সে নিজে হাতে অল্প অল্প করে পরিণীতা হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সন্তানসম্ভবা সেই মহুলকেই আবার যেন সে নিজের হাতেই শৈশবে ফিরিয়ে এনেছে। মহুলের প্রতি অজিতের ভালোবাসার বহর দেখলে মাঝে-মধ্যে যেন মনে হতে পারে এরা স্বামী-স্ত্রী নয় বরং অন্যকিছু।যখন মহুল কোনও বিষয়ে বায়না করে বা জেদ ধরে তখন যেন অজিত স্বামী থেকে বাবা হয়ে ওঠে।স্নেহশীল বাবা যেমন মেয়ের যাবতীয় দায়িত্ব নেন ,তাকে বড়ো করেন,সচেতন করেন,তার অধিকার সম্বন্ধে বোঝান।পিতৃস্বরূপে অজিতও মহুলের কাছে ঠিক যেন তেমনি।এমনিতেই বিয়ের আগে তাদের সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যার।গুরু-শিষ্যা হোক বা স্বামী-স্ত্রী। মহুলের প্রতি অজিত বরাবরই অপত্য স্নেহই দান করে এসেছে।
এদিকে মহুলের ভারী মন খারাপ। দিন দিন সে মোটা হয়ে যাচ্ছে। মোটা হওয়া এক্কেবারেই মহুলের নাপসন্দ।আবার তার পেটটা কেন বড়ো হয়ে যাচ্ছে সেটাও সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অজিত তাকে বুঝিয়েছে, পুতুলটা পেট থেকে বের হয়ে গেলেই সে আবার আগের মতন রোগা হয়ে যাবে আর পেটটাও ছোটো হয়ে যাবে।যাক্ এ কথা শুনে মহুল এখন খানিক নিশ্চিন্ত।একদিন মহুল ঘরে বসে তার পুতুলগুলো নিয়ে খেলছে,আর দালানে তখন অজিত দাড়ি কাটছিল।হঠাৎ মহুলের চিৎকার,"ও স্যার।"মহুলের চিৎকারে চমকে গিয়ে অজিতের বাঁ গালটা কিছুটা গেল কেটে।তাতে অজিতের কি?অজিত পড়িমরি করে দৌড়ে গেল মহুলের কাছে।ঘরে গিয়ে দেখে,মহুল ঠিকই আছে।যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অজিত। মহুলের কাছে গিয়ে শান্তস্বরে প্রশ্ন করল,"কি হয়েছে মহুল?"
মহুল মুখটা খানিক কাঁচুমাচু করে অজিতকে জানাল,"দ্যাখ্ না পুতুলটা আমায় মেরেছে।"
অজিত দেখল,মেঝেতে একটা ছেলে পুতুল কিছুটা দুরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
অজিত তখন স্মিত হাসি হেসে সেই পুতুলটাকে দেখিয়ে মহুলকে বলল,"ও তাই বুঝি তুমিও পুতুলটাকে মেরেছো।"
নিষ্পাপ মহুল তখন ঘাড় নেড়ে জানাল যে,"না না ওই পুতুলটা আমায় মারেনি তো এই পুতুলটা আমায় মেরেছে।"বলে নিজের পেটে হাত দিয়ে দেখাল।
মাতৃগর্ভে সন্তানের পদাঘাত যে খুব স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে তা সরলমতি মহুলের বোধগম্য হয়নি। তাই সে তার গর্ভে বেড়ে চলা ভবিষ্যৎ সন্তানের এরকম শক্তি প্রদর্শনকে তার অকারণ বেয়াদপি বলেই হয়েছে।
অজিত তখন মহুলকে বুঝিয়ে বলল,"না না মহুল,ও তোমায় মারেনি।ও তোমায় আদর করেছে।আসলে ও তো তোমার পেটের ভিতরে আছে তাই তুমি বুঝতে পারোনি।পুতুলটা তো তোমায় ভালোবাসে বলো,ও কি তোমায় মারতে পারে?"
"ও পুতুলটা আমায় মারেনি, আদর করেছে। তাহলে ঠিক আছে।"বাধ্য ছাত্রীর মতো তার প্রিয় স্যারের কথা মেনে নিল।
প্রসবের দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল,অজিতের উৎকন্ঠা,ভয়,মানসিক উত্তেজনাও যেন পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল।সন্তান সুস্থই জন্মাবে এ ব্যাপারে ডাক্তার এক্কেবারে নিশ্চিৎ,এরপর বাকিটা উপরওয়ালার হাতে।সকলের একটাই প্রার্থনা,মহুল আর তার বাচ্চার সুস্থতা।অবশেষে এল সেই দিন।মহুলের মা-বাবা,ওর পিসতুতো দাদা সৃজন,অজিত আর কিছু চেনা-পরিচিত সকাল-সকাল হাজির নার্সিংহোমে। অজিত একাই একশো।কেউ কিছু সাহায্য করার অভিপ্রায়ে এগিয়ে আসার আগেই ওই সবকিছুর ব্যবস্থা করে ফেলছে।আজ অজিত দারুণ ব্যস্ত। নিঃশ্বাস ফেলার সময় পর্যন্ত তার কাছে নেই।অজিতের একান্ত অনুরোধে, প্রয়োজনীয় সমস্ত সুরক্ষা গ্রহণ করে,ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে সে অপারেশন থিয়েটারে মহুলের সাথে হাজির।মহুল বেচারি এরকম অজানা পরিবেশ,সাথে ডাক্তার, নার্সদের উপস্থিতি দেখে থতমত খেয়ে গেছে। অজিত মহুলের বাঁ হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে,তারপর মাথায় আলতো করে একটা চুমু খেয়ে মহুলকে বোঝায় যে,তার পুতুলটাকে পেট থেকে বের করে আনতেই এনারা সাহায্য করতে এসেছেন।মহুল আশ্বস্ত হল।তারপর টানটান উত্তেজনার পর এল সেই সুসময় যা বয়ে আনল সুখবর।এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিল মহুল।মা এবং কন্যা দুজনেই সুস্থ আছে।অজিতের দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে আনন্দাশ্রু,যেন এতদিন বুকে জমা রাখা দলাপাকানো পাপ আজ গলে জল হয়ে গেল।চারিদিকে খুশির আবহাওয়া। ডাক্তারেরও মানসিক উত্তেজনা কমল।তাঁর উপরেও তো কম চাপ ছিলনা,মহুলকে তার সুস্থ সন্তান প্রসব করাতে।অজিত-মহুলের সন্তান আগমনের সুখবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে আবার অজিতের প্রশংসার বন্যা বয়ে গেল।সবাই বলাবলি করতে শুরু করল,ছেলেটা করে দেখাল।ওরকম একটা মেয়েকে বিয়ে করে সুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। অজিত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, মহুল আর তাদের সন্তানের যাবতীয় দেখভালের জন্য। প্রয়োজনে সে তাদের জন্য জীবনও দিয়ে দিতে পারে,কিন্তু সে কোনওদিনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা।তাই সে এসব প্রশংসার ধার ধারে না। এখন থেকে অজিতের ব্যস্ততা আরো বেড়ে গেল।মহুল তো ছিলই , এবার তাদের কন্যা।
এখনও অজিত মেয়ের নাম ঠিক করে উঠতে পারেনি।অনেক নামই বাছা হয়েছে যদিও,কিন্তু অজিতের কিছুতেই মনঃপূত হচ্ছে না। যদিও মেয়ের দুষ্টুমি দেখে মহুল নিজে তার নামকরণ করেছে 'দুষ্টুপরী'।অজিতের কাছে একদিন সে একটা পরীর গল্প শুনেছিল।সেখান থেকেই এই নামটা মাথায় আসে তার।
দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া শেষে অজিত-মহুল আর ওদের মেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটা আরেক প্রস্থ মায়ের দুধ খেয়ে বাবা আর মায়ের মাঝখানে শুয়ে দুষ্টুমি করছে। ঘুম পাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে মহুল বেচারি নিজেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।তাই সে এখন বাবার সাথেই শুধু খুনসুটি করছে। মহুল তার মেয়েকে ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারে না তাই তাকে সবসময় সঙ্গ দেয় বাড়ির লোকজনেরা।মহুলের মা আছেন,আয়া আছেন কিন্তু সবদিক সামলে মহুলের দিকে সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অজিত ।নিজে বাবু হয়ে বসে,সামনে মহুলকে বসিয়ে পিছন দিয়ে মহুলের হাতদুটোকে ধরে মেয়েকে ধরে রাখে।মেয়ে হওয়ার পর মহুল আবার যেন পরিণীতায় পরিণত হয়েছে। মেয়েকে শাসনও করে আজকাল, দুধ না খেলে বা দুষ্টুমি করলে।আগের মতো সে আর এখন খেলনা পুতুল নিয়ে খেলা করে না।এখন যে তার জীবনে 'জ্যান্ত পুতুল ' এসে গেছে।আর এই 'জ্যান্ত পুতুল ' তার মায়ের খেলনাগুলোয় বেশ ভালোই ভাগ বসিয়েছে।মহুল অবশ্য তাতে কোনও রাগ করেনি।ঘুমন্ত মহুলের পাশে নিজের মনে খেলে চলেছে তার 'দুষ্টুপরী'।অজিত মোবাইলটায় একটু চোখ বুলিয়ে নেয়।আবার সেই শুরু হয়েছে,অজিতকে ভগবান বলে সাব্যস্ত করা। আবার কেউ সামাজিক মাধ্যমে অজিত-মহুল আর ওদের কন্যাকে নিয়ে লেখালেখি করেছে।তাতে স্তুতিবাক্য ঝড়ে পড়েছে অজিতের প্রতি।সংবাদ সংস্থাগুলো আরো একবার অজিতের সাথে যোগাযোগ করেছিল,অজিতের সাক্ষাৎকার নেওয়ার উদ্দেশ্যে, কিন্তু অজিত সাফ মানা করে দেয়।যতই সবাই অজিতকে মাথায় করে রাখুক না কেন,সত্যিটা অজিত কোনওদিনই অস্বীকার করতে পারবেনা।মহুলের ক্ষমা করাতে তার বুকের ভার লঘু হয়ে গেলেও,সে পুরোপুরি ভারমুক্ত হয়নি,আর হবেওনা কোনওদিন।তার অনুতাপ তাকে কোনওদিন নিজেকে ক্ষমা করতে দেবেনা,এটাই ওর শাস্তি। এসব ভাবতে ভাবতে সে খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল।ঘোর কাটল তার মেয়ের বাবার জামা ধরে টান মারাতে।মেয়েকে খানিক আদর করে ,তার সাথে একটু খুনসুটি করতে করতে এবার অবশেষে মহুলের 'দুষ্টুপরী' নিদ্রামগ্ন হল।মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে, তার কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে অজিত নিজের ডান হাতটা কপালে রেখে বেশ চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ল।সামনে তার অনেক দায়িত্ব। মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে,যাতে সে বড়ো হয়ে তার বাবার অবর্তমানে তার এই সহজ-সরল,বোকা মা-টার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে হাসিমুখে বহন করতে সক্ষম হয়। যদিও অজিত চায় তার আগে মহুলই যেন এই পৃথিবী থেকে চলে যায়। কারণ সে মহুলকে কারোর ভরসায় রেখে যেতে বড্ড ভয় পায়। তা সে যতই নিজের সন্তানই হোক্ না কেন।মহুলকে তার মতো কেউ বুঝে উঠতে পারেনা,আর এখানেই অজিতের যাবতীয় দুশ্চিন্তা। কে জানে মহুলকে বুঝতে না পেরে যদি কেউ তার সাথে দুর্ব্যবহার করে!অজিতের অবর্তমানে না জানি সবাই মিলে ওকে কি শাস্তিটাই না দেবে!তখন তো অজিত মরেও শান্তি পাবে না। তাই অজিত মহুলকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসলেও সে চায় যে,মহুলই তার আগে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করুক।এটাই মহুলের জন্য মঙ্গল। স্বামী হয়ে স্ত্রীর মৃত্যু চাওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে ভালো না মনে হলেও কখনও কখনও প্রিয় মানুষের ভালোর জন্য তার খারাপ চাওয়াটাই বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। অজিত ভবিষ্যৎ দেখেনি। তাই জানেনা,কি আছে কপালে?শুধু মহুলের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আগে-ভাগে সবরকম ব্যবস্থা ভেবে রাখা।তা সে মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করাই হোক্, যাতে সে ভবিষ্যতে তার মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারে বা অজিতের অবর্তমানে মহুলকে যাতে চরম দুর্দশায় না পড়তে হয় তার জন্য তারই মৃত্যু কামনা করা।এইসব কথা ভাবতে ভাবতে অজিতের চোখ বুজে এল।চোখ খুললেই তার সামনে পর্বতপ্রমাণ নতুন দায়িত্ব, যা সে নিতে প্রস্তুত।
---------সমাপ্ত--------