STORYMIRROR

সাইনি রায়

Romance Fantasy Others

3  

সাইনি রায়

Romance Fantasy Others

করোনা ভাইরাস ও দ্বিতীয় বসন্ত

করোনা ভাইরাস ও দ্বিতীয় বসন্ত

12 mins
203

অবশেষে সেপারেশনটা হচ্ছেই।দুপক্ষেরই মিউচুয়ালি দিতে কোনও অসুবিধা নেই। সবকিছু ঠিকঠাক। প্রসেসিং সবেমাত্র শুরু হবে হবে,এমন সময় শহরে এক নতুন উৎপাৎ। অবশ্য শুধু নিজের শহরে কেন,আজ তা শহর,জেলা,রাজ্য,দেশ,কাল,সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এই নবীন আপদের নাম করোনা ভাইরাস,যার জন্য মানুষ হয়েছে গৃহবন্দি।,চিড়িয়াখানায় খাঁচায় বন্ধ জন্তু-জানোয়ারের মতো। আর প্রকৃতির কটাক্ষে পশু-পাখি আজ নির্বিঘ্নে মুক্তির স্বাদ লাভ করছে।নাগরিক জীবন আজ স্তব্ধ। চতুর্দিকে লকডাউন। সবারই জীবন থমকে গেছে।কাজ থেকেও আজ যেন সবাই কর্মহীন। যেখানে আজ সামান্য ছোঁয়াচটুকু লাগা মানা,সবাই সবার থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে সেখানে সুষ্ঠুভাবে কোন কাজ সম্পন্ন হবে কি করে?সবার মতো পর্ণা আর রোহনেরও সেই একই অবস্থা। লকডাউনের কারণে আজ দুজনে একসাথে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।তাই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিভোর্সটা একটু পিছিয়ে দেওয়ার।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার এগোবে।রোহনের অবশ্য এতে ভালোই হল। রোহন ভাবল,এই সুযোগে আরো কটা দিন যদি পর্ণার সাথে এক ছাদের নীচে কাটানো যায়। এই ডিভোর্সটা হচ্ছে সম্পূর্ণ একপেশে, পর্ণার তরফ থেকে।রোহন আজও সেই প্রথম দিনের মতোই পর্ণাকে ভালোবাসে। সে চাইলে পর্ণাকে কোর্টে তুলতে পারত কিন্তু যেখানে সমস্ত প্রচেষ্টা বিফলে গেছে সেখানে আর শুধুশুধু কোর্টরুমড্রামা করে আর কি লাভ?পর্ণা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ডিভোর্সের ব্যাপারে।রোহন মন থেকে এই ডিভোর্স চায় না তো বটেই কিন্তু পর্ণা যদি এতে ভালো থাকে তাই সে এই ডিভোর্সে রাজি হয়েছে।ভালোবাসার মানুষের ভালোর জন্যে এও একধরনের স্বার্থত্যাগ।
পর্ণার বাবা মনে করেন এই ডিভোর্সের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী পর্ণার মা।বিবাহিতা মেয়ের জীবনে অহেতুক খবরদারি আর জামাইয়ের প্রতি বিরূপ মনোভাবই এই ডিভোর্স হওয়ার একমাত্র কারণ। অনেকবার তিনি মেয়েকে বুঝিয়েছেন, "শোন্ মা ,রোহন হয়তো তোর থেকে কম রোজগার করে কিন্তু ছেলেটা ভালো।তোর মার কথা শুনিস না।"
"কে বলল আমি ওকে পয়সার জন্য ছাড়ছি?একদমই না।সে হলে আমি ওকে বিয়েই করতাম না। "প্রত্যুত্তরে বাবাকে জানিয়েছিল পর্ণা।
স্ত্রীকেও বারবার বারণ করেছিলেন যাতে পর্ণার মা বিবাহিতা মেয়ের জীবনে নাক না গলান।কিন্তু পর্ণার মা সেদিকে কর্ণপাত করেননি। ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত যখন পাকা তখন একদিন স্ত্রীকে রেগেমেগে বলেই ফেললেন,"শান্তি পেলে তো মেয়ে জামাইয়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে?এরকম মা যেন কারোর না জোটে।মা তো নয় যেন শত্রু। "
তারপর থেকে পর্ণার বাবাও পর্ণার মায়ের থেকে দুরে দুরে অবস্থান করেন আজকাল।তাতে অবশ্য পর্ণার মায়ের ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি এখন ব্যস্ত ডিভোর্স পরবর্তী মেয়ের জীবন গোছাতে। "আরে চিন্তা করিস না। আমি তো আছি।সে তোর বাবা যাই বলুক। সবকিছু মিটে গেলে এখানে চলে আসবি।আমি আবার তোর বিয়ে দেব।এবার কিন্তু আমি ছেলে বাছব।জানি ভুল মানুষ মাত্রই করে।কিন্তু আমি আর তোকে ভুল করতে দেব না। আরে তোর জন্য কত ছেলে পাওয়া যাবে।ছেলেরা সব বসে আছে।"
"আহ্ মা,তোমার যত সব বাড়াবাড়ি। বাবা ঠিকই বলে।আমি একে আমার ডিভোর্সের জ্বালায় জ্বলছি আর তুমি আমার এক্ষুণি দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবছ?সত্যিই মা তুমি পারো।ডিভোর্সই হলনা আর তুমি........................"কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই রাগ করে ফোনটা কেটে দিল পর্ণা। 
পর্ণার মা কোনদিনই জামাইকে মেনে নিতে পারেননি। কারণ তাঁর মতে তাঁর মেয়ের তুলনায় তাঁর জামাই অত্যন্ত মামুলি। রোহন কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করেছে,বি.এস.সি পাশ।সল্টলেকের একটা আই.টি কোম্পানিতে চাকরি করে।এম.এন.সিতে চাকরি করেনা শুনে পর্ণার মা নাক সিঁটকেছিলেন।চাকরি করে যেটুকু জমিয়েছে সেটুকু আর অন্য সম্পত্তি বলতে পর্ণার শ্বশুর মশাই-এর তৈরী করা দুকামরার একতলা বাড়ি। শ্বশুর-শাশুড়ি অবশ্য বেঁচে নেই। তাতে কিন্তু খুশিই পর্ণার মা কারণ মেয়েকে বুড়ো-বুড়ির দায়িত্ব নিতে হবেনা এই ভেবে।এদিকে পর্ণা সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। মোটা মাইনের চাকরি করে।শিক্ষিতা,সুন্দরী। এরকম মেয়ে ওরকম একটা নিম্নমানের ছেলেকে পছন্দ করবে এটা ভাবতেই পারেননি পর্ণার মা। ওরকম ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে শুনে মেয়ের পছন্দে হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন।যে ক্ষোভ তিনি আত্মীয়-পরিজন,চেনা-পরিচিতদের কাছেও চেপে রাখতে পারেননি। দুঃখ করে বলেছিলেন,"কি যে করল মেয়েটা?বড় কাঁচা কাজ করল।শক্তপোক্ত বটগাছকে ধরে আঁকড়ে বাঁচা যায় কিন্তু খড়কুটো আগলে আর কতক্ষণ?ও যে নিজে ভেসে যাবে!"মেয়ে যখন মাকে প্রথম রোহনের কথা জানায়,রোহনের ব্যাপারে সবকিছু শুনে তিনি আপত্তি তুলেছিলেন। মেয়েকে বুঝিয়েছিলেন। অশান্তিও হয়েছিল বহু। কিন্তু পর্ণা তার সিদ্ধান্তে অনড়ই থেকেছে বরাবর।এমনকি বিয়ের আসরেও পর্ণার মা পর্ণাকে বুঝিয়েছিলেন,"এখনও ভেবে দ্যাখ্।তুই চাইলে এই মুহুর্তে বিয়ে ভেঙে দিতে পারি।"
পর্ণা শুধু হেসে বলেছিল,"কি যে রসিকতা করো না মা।"
মেয়ের হাসি মুখের উত্তরে মায়ের মাথায় সেদিন যেন বাজ পড়েছিল। চারহাত এক হওয়া আটকায়নি সেদিন।কিন্তু জামাই সম্বন্ধে পর্ণার বাবা বরাবরই তার স্ত্রীর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছেন।পর্ণার মায়ের যেমন মানুষের বিচার টাকা-পয়সা বা সম্পত্তি দিয়েই হয়,পর্ণার বাবা মনে করেন একজন মানুষের বিচার শুধুমাত্র তার চরিত্র দিয়েই করা উচিৎ।কারণ এই দুনিয়ায় টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি,ধন-দৌলত আছে এমন অনেক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে কিন্তু আজকালকার এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে দাঁড়িয়ে একজন সচ্চরিত্রবান,শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষ খুঁজে পাওয়া বড্ড মুশকিল। আর রোহনের এই দুটো গুণই আছে।মা-বাবার অবর্তমানে একা বড় হয়েছে। বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরা এক্ষেত্রে বখে যায়। কিন্তু রোহন উপরন্তু ভদ্র,নম্র,বাজে কোনও নেশা করেনা।প্রত্যেক মেয়ে তো এরকম স্বামীই চায়। পয়সা একটু কম কামায় তো কি হয়েছে?বাকিটা স্ত্রী হিসেবে পর্ণারও তো কিছু দায়িত্ব আছে। অর্ধাঙ্গিনী তো আর এমনি বলা হয়না। পর্ণার বাবা তাই রোহনকে জামাই নয় বরঞ্চ ছেলের মতোই স্নেহ করেন।রোহনও পর্ণার মা-বাবার আপদে-বিপদে সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছে।তবু পর্ণার মায়ের মন জিততে পারেনি রোহন।
                এই লকডাউনে রোহন অফিসের সমস্ত কাজ ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মাধ্যমেই সারছে।আর সরকারি নির্দেশ যতক্ষণ না আসছে ততক্ষণ স্কুল-কলেজ সবকিছু বন্ধ। তাই স্কুল যতক্ষণ না খুলছে পর্ণার ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কাজের অবকাশে ল্যাপটপ থেকে মুখটা সরিয়ে রোহন স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগল। পুরোনো সেইসব দিনের কথা যেদিন পর্ণার সাথে হয় প্রথম পরিচয়, তারপর প্রেম,বিয়ে সেইসব সুখের দিনগুলো। 
রোহন-পর্ণার প্রথম আলাপ বাসে।রোহন যাচ্ছিল অফিসে আর পর্ণা তার স্কুলে। রোহন আগেভাগেই সিট পেয়ে গিয়েছিল। সিটে বসেই রোহন লক্ষ্য করেছিল একটা মেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বাসে উঠল।ওর সিটের সামনেই দাঁড়াল।কিন্তু ভিড় বাসে দাঁড়াতে ওর প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে দেখে সিটটা ছেড়ে দেয় রোহন।এরপর প্রায় প্রত্যেকদিনই সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অবস্থা ক্রমে এমন দাঁড়াল যে দুজনে এক বাস ছাড়া উঠতই না।এইভাবে রোহন-পর্ণার আলাপ-পরিচয়-প্রেম।এসব কথাই রোহন বসে বসে ভাবছিল,এমন সময় ভারি কিছু একটা পড়ার আওয়াজ পেল রোহন।রোহন একছুট্টে ঘর থেকে বেরিয়ে দালানে গিয়ে দেখে পর্ণা বেঁহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।পড়ি-মরি করে পর্ণাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের খাটে শুইয়ে দেয় রোহন,চোখে-মুখে জল ছিটোতে থাকে।তারপর ফোন করে ফ্যামিলি ডক্টরকে।এদিকে পর্ণার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আসতে আসতে জ্ঞান ফিরতে থাকে পর্ণার। গা গরম দেখে পর্ণার মনে অন্য ভয় দানা বাঁধে। কিন্তু রোহন তাকে আশ্বস্ত করে বলে,"আরে তুমি যেটা ভাবছ সেটা নয়।তোমার তো সিজন চেঞ্জ হলেই সর্দি-গর্মি হয়ে জ্বর হয়। আর লকডাউনে কাজের লোক নেই, খাটনি হচ্ছে তাই মাথা ঘুরে পড়ে গেছ।চিন্তা কোরোনা আমি ডাক্তার ডেকেছি।"
কিন্তু পর্ণা ভয়ে,উৎকন্ঠায় রোহনের হাতদুটো চেপে ধরে অনুরোধ করতে থাকে,"দোহাই তোমার, ওসবে হবে না।আমায় হসপিটালে নিয়ে চল।আর যদি না নিয়ে যেতে চাও তাহলে আমিই যাচ্ছি।"এই বলে পর্ণা জোর করে বিছানায় উঠে বসতে গেল।
পর্ণাকে ধরে ফেলে রোহন বিচলিত হয়ে বলে, "আমি কি তাই বললাম নাকি?"এই বলে রোহন পর্ণাকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালে। সেখানে দুজনেরই পরীক্ষা হল এবং রিপোর্ট নেগেটিভই এল।পর্ণাকে জ্বরের ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হল।সাথে দুজনেরই জীবন আরো সুরক্ষিত করতে হাসপাতাল থেকে বলা হল যে,দুজনে কিছুদিন যেন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকে।যা মারণ ভাইরাস। কোত্থেকে কি ছোঁয়াচ লেগে যায়। এখন দেখছে নেই আবার পরে দেখবে হয়ত উপসর্গ ধরা পড়েছে। তাই হাসপাতাল থেকে বারবার সাবধান করা হল।রাতে পর্ণা রোহনকে অন্য ঘরে শোয়ার জন্য অনুরোধ করল।কিন্তু রোহন পর্ণার কোনও কথাই শুনল না। 
"তোমার যদি সত্যিই করোনাও হত তাহলেও তোমার সাথে একই ঘরে থাকতাম।ভালই হত,এমনিতে তো মরেই আছি না হয় করোনা হয়ে মরতাম।মৃত্যুটা অন্তত কনফার্ম হত।ডিভোর্সের পর তো জ্যান্ত লাশ হয়ে ঘুরব।ও বাঁচাও বাঁচা নাকি!"পর্ণার দিকে তাকিয়ে রোহনের অকপট স্বীকারোক্তি। 
পর্ণা শুধু রোহনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।
এদিকে পর্ণার মা মেয়ের অসুস্থতায় দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। একে মেয়ে অসুস্থ তার ওপর শহরে লকডাউন। কিন্তু রোহন পর্ণার মাকে আস্বস্ত করে।যতদিন না পর্ণা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে সবটা একা হাতে সামলেছে রোহন।রান্না-বান্না ,ঘরদোর পরিষ্কার, জামাকাপড় কাচা থেকে শুরু করে আবার নিজের অফিসের কাজ ,অথচ কোনও বিরক্তি নেই ওর চোখে-মুখে। পর্ণাকে কার্যত খাট থেকে নামতেই দেয়নি রোহন প্রয়োজন ছাড়া। 
                 এখন পর্ণা দিব্যি সুস্থ। খাটে বসে ফোনে মায়ের সাথে কথা বলছে।বারবার ঘুরেফিরে রোহনের কথাই বলছে পর্ণা। কিভাবে এ-কদিন সে তার সেবা করেছে ঘরের সব কাজ সামলে সে কথাই পর্ণা তার মাকে বলে চলেছে। পর্ণার মা তাতে খুশি তো হননি উপরন্তু বিরক্তি প্রকাশই করেছেন।কারণ তাঁর মতে রোহন যেটা পর্ণার জন্য করেছে সেটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। 
"তুই আর সোহাগ করিস না তো বাপু।পরে কি করবি সেটা ভাব।যে অতীতকে একদিন ভুলতে হবে তাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা কিসের?"মেয়ের ওপর রাগ করেই কথাগুলো বললেন পর্ণার মা। 
               ব্যাস যেই না পর্ণার মা কথাগুলো মেয়েকে শুনিয়েছেন, অমনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল মেয়ে। তারপর রীতিমতো মাকে ভর্ৎসনা করে বলতে থাকে,"তুমি মা না অন্যকিছু। কোথায় মেয়ের ঘর না ভাঙে সে চেষ্টা করবে তা না করে উল্টে মেয়ের ঘর ভাঙছ।বাবা সাধে তোমায় মন্থরা বলে।ছিঃ।"তারপর আরো সংযোজন করে পর্ণা, "শোন মা তুমি যাকে আমার অতীত বলছ না,সেই আমার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান। ওকে আঁকড়ে ধরেই আমি সারাজীবন বাঁচতে চাই।আর শোন মা দয়া করে তুমি না আমার সাথে আর যোগাযোগ করার কোনওরকম চেষ্টা কোরোনা। আমিও করব না।এই কথাটা আজ আমি বলতে বাধ্য হলাম। "
ওই ঘরেই পর্ণার বাবা একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে আন্দাজ করতে পারলেন যে,ওপারে মেয়ে এপারের মাকে বেশ ভালোই বিঁধেছে।কাগজ থেকে মুখটা সরিয়ে নিয়ে সযত্নে কাগজটা ভাঁজ করে পাশে রেখে দিয়ে স্ত্রীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলেন,"যাক্ বাবা আজ আমার মেয়েটা সত্যিই বড় হয়ে গেছে।ও আজ প্রমাণ করল যে ও আমারও সন্তান।"এই বলে খানিক থেমে আরো বললেন, "যাই বাবা মন্দিরে গিয়ে পুজোটা দিয়ে আসি।"এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এতক্ষণ রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত ছিল রোহন।পর্ণার ক্রমবর্ধমান চড়া গলা শুনে ভিতরের ঘরে এল।দরজার কাছে আসতেই পর্ণা আর তার মায়ের ফোনালাপের সমস্তটাই সে বুঝতে পারল।ছুটে গিয়ে পর্ণার কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে পর্ণাকে একটা ধমক লাগাল রোহন।"মায়ের সাথে কেউ এইভাবে কথা বলে?ক্ষমা চাও।"
পর্ণা শুধু মুখটা কাঁচুমাচু করে মাথাটা হেঁট করে রইল।
রোহনই এবার ফোনটা কানে দিয়ে পর্ণার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল,"মা ওকে ক্ষমা করে দেবেন।জানেনই তো ওর মাথা গরম থাকলে কোনও তাল-জ্ঞান থাকেনা।আমি ওকে বোঝাচ্ছি।মাথা ঠান্ডা হলে দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। "
এতকিছুর পরেও রোহনের এরকম বিনীত স্বভাব দেখে পর্ণার মায়ের কঠিন হৃদয় অবশেষে গলল।চোখে জল এসে গেল।কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "কোন্ মুখে তোমার কাছে ক্ষমা চাইব বাবা?তবু গুরুজন হয়েও তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তোমার মনটা অনেক বড়,জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দেবে। সত্যি,আমার মেয়ের ভাগ্যটা ভালো যে তোমার মত স্বামী পেয়েছে। টাকা-পয়সার মোহে পড়ে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। "

"ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছেন!মা হয়ে ছেলের কাছে ক্ষমা চাইলে যে ছেলের পাপ হবে।"তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পর রোহন ফোনটা নামিয়ে রাখে।পর্ণা তখনও সেই মাথা হেঁট করে বসে।

"মাথা ঠান্ডা হলে মায়ের সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিক করে নিও কেমন।"শান্তস্বরে বলল রোহন।
"যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।আমি কোথায় তোমার হয়ে মাকে অতগুলো কথা শোনালাম আর তুমি কিনা মায়ের হয়ে বলছ।"কথাগুলো বলতে বলতে পর্ণার চোখ দিয়ে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ল।
"এ বাবা পর্ণা তুমি কাঁদছ?"এই বলে রোহন যেই ওর হাতটা পর্ণার কাঁধে রেখেছে অমনি পর্ণা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে।পর্ণাকে সান্ত্বনা দিতে রোহন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ সময় গেল মান-অভিমান কাটাতে।পর্ণা এখন অনেকটা সামলে নিয়েছে। পর্ণাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই রোহন এবার প্রশ্নটা করল,"তাহলে কি ধরে নিতে পারি আমাদের ডিভোর্সটা ক্যান্সেল?"
পর্ণাও খানিক লজ্জা পেয়ে উত্তরে জানাল,"আর কিভাবে বোঝাব তোমায়?হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ ক্যান্সেল ক্যান্সেল ক্যান্সেল। "
রোহন এবার মজা করে বলে ওঠে,"কথাটা কেমন যেন তালাক তালাক তালাক শুনতে লাগল।"
ওর কথা শুনে পর্ণা একটু আলতো করে রোহনের বুকে একটা কিল বসিয়ে দিল।
"এই রে !তরকারিটা বসিয়ে এসেছিলাম।পুড়ে গেল কিনা দেখি।"ব্যস্ত হয়ে রোহন রান্নাঘরের দিকে যাবে বলে পা বাড়াতেই হাতদুটো টেনে ধরে পর্ণা। 
"থাক না রান্না যদি পুড়ে যায় কোনও অসুবিধাই নেই। আমি পোড়া খাবারই খাব।সংসারটা যে পুড়তে পুড়তে বেঁচে গেছে সেটাই যথেষ্ট। "আবেগঘন হয়ে বলে ওঠে পর্ণা। 
"তা বললে কি হয় ম্যাডাম?আমি আমার অসুস্থ বউকে পোড়া খাবার খাওয়াই কেমন করে?"এই বলে রোহন ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে পর্ণার পাশে বসে রোহন।
পর্ণার একটা হাত ধরে স্মৃতি রোমন্থন করে রোহন।"আচ্ছা পর্ণা, সেই দিনটা মনে পড়ে?যেদিন আমি তোমায় হাঁটু মুড়ে, হাতে গোলাপ নিয়ে নন্দনে প্রোপোজ করেছিলাম?"
পর্ণা রোহনের কাঁধে মাথা রেখে ভাবুক হয়ে বলে"হ্যাঁ, সবকিছু মনে আছে।"
"আচ্ছা পর্ণা, আমরা যখন আবার নতুন করে সব শুরু করছি, তাহলে যদি আগের মতো বিয়ে করি আবার। "
"মানে?"পর্ণা অবাক হয়ে রোহনকে প্রশ্ন করে।
"মানে দ্বিতীয় ইনিংস যখন শুরু করতেই যাচ্ছি তখন যদি প্রথম থেকে আবার সবকিছু শুরু করি।এই যেমন ধরো বিয়ে তারপর হানিমুন।কেমন হবে বল?"প্রশ্নটা করার সময় রোহনের চোখে-মুখে একরকম উন্মাদনা লক্ষ্য করে পর্ণা। ভারি লজ্জা লেগে যায় তার।
নতুন বউয়ের মতো লজ্জায় রাঙা হয়ে পর্ণা জানায়,"বিয়ে আমাদের তো আর সত্যিই ভাঙেনি যে আবার বিয়ে করব আমরা!"
"তাতে কি?চলো আমরা আবার শুরুর দিনগুলোয় ফিরে যাই।"রোহনের গলায় আশাবাদীর সুর।
"শখ ভারি মন্দ না ।"কথাটুকু বলেই রোহনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে বাইরের জানলার দিকে তাকানোর বাহানা করে পর্ণা। 
রোহন আবার পর্ণার মুখটা নিজের মুখের সামনে ঘুরিয়ে এনে বলে,"না শোন না।আমি ভাবছি সামনের বিবাহবার্ষিকীতে আবার আমরা বিয়ে করব,তারপর হানিমুন। কেমন হবে বল?দ্বিতীয় ইনিংস, দ্বিতীয় বিয়ে কিন্তু পাত্র-পাত্রী সেই একঘেয়ে। "কথা শেষে দুজনেই হেসে ফেলে।
রোহন আরো বলে,"বিয়ে, হানিমুন তো ঠিক হলো।চলো এবার শুরুর থেকে শুরু করা যাক। "
"শুরুর থেকে শুরু মানে?"বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হল না পর্ণার। 
রোহন পর্ণার গালদুটো আলতো করে চিপে দিয়ে বলে,"হ্যাঁ ম্যাডাম। শুরুর থেকে শুরু মানে দ্যা প্রপোসাল।লকডাউনের বাজারে নন্দনে গিয়ে এখন হাঁটু মুড়ে বসে তোমায় প্রপোজ করলে পুলিশ এসে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেবে।করতে যাব এক হয়ে যাবে আরেক।তারপর টি.ভি.তে লোকজন দেখবে তুমি আমি দুজনে কান ধরে ওঠবোস করছি।ছি: ছি:ছি: কি লজ্জা। অতশতয় কাজ নেই।আমি আজই এই মুহুর্তে তোমায় প্রোপোজ করেগা এই ঘরমেই।"তারপর কি যেন ভেবে আবার বলতে শুরু করে,"দাঁড়াও হাম আভি ফুল লাতা হ্যায়।"
                "এক মিনিট তুমি ফুল পেলে কোথায়?দোকান-বাজার তো সব বন্ধ। "কৌতুহলভরা পর্ণার প্রশ্ন। 
"আরে গোলাপ ফুল না সাহি অন্য ফুলই সাহি।"এই বলে রোহন ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
"অন্য ফুল?"পর্ণাও অধীর আগ্রহে রোহনের অপেক্ষা করতে লাগল। 
রোহন ফিরল হাতদুটো পিছনে করে।
পর্ণা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার বৃথা চেষ্টা করে।শেষমেশ কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞাসাই করে ফেলল,"হাতে কি?"
"উঁহু, এরকম ভাবে না।আগে চোখ বোজো।সেই নন্দনের দিনের মতো। আমি হাঁটুগেঁড়ে বসে তোমায় প্রপোজ করব।যতক্ষণ না চোখ খুলতে বলি চোখ খুলবেনা কিন্তু। "রোহন পর্ণাকে আবদারের সুরে বলে।
"আচ্ছা বেশ "পর্ণাও তার আবদারে রাজি হয়ে যায়। 
"পর্ণা আমার সাথে ঘর বাঁধবে?"সেদিনও ওই একই কথা বলেছিল রোহন।'উইল ইউ ম্যারি মি?'বা 'আমাকে বিয়ে করবে?'কথাগুলো বড় সেকেলে মনে হয়েছিল রোহনের কাছে তাই একটু আলাদা কিছু বলার চেষ্টা করেছিল।সেদিনের মতো আজও পর্ণা ধীরে ধীরে চোখ খুলল।সেদিন রোহনের হাতে রক্তগোলাপ দেখে পর্ণার চোখে জল চলে এসেছিল আর আজ?রীতিমতো হেসে খুন সে।কারণ?বাড়িতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই গোলাপ ছিলনা।তাই ঝোল করবে বলে কিনে রাখা ফুলকপি হাতে নিয়েই পর্ণাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় রোহন।আর তা দেখেই হেসে খুন পর্ণা। হেসে কুটোপাটি খেয়েই চলেছে, হাসি আর থামেনা তার।ওর ওই হাসি দেখে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে রোহন।বৃষ্টি নামলে গুমোট ভাব কেটে গিয়ে যেমন সব ময়লা ধুয়ে গিয়ে চারিদিক সতেজ সবুজ হয়ে যায়। ঠিক তেমনি আজ পর্ণার হাসি প্রমাণ করছে,অভিমানের মেঘ সরে গিয়ে আজ ওদের সম্পর্কে নতুন সূর্যোদয় হয়েছে।
--------------------------------------------------------------------




 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance