বাবা
বাবা
হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন রমাদেবী।মূলতঃ বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণেই।হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে মুম্বাই থেকে কলকাতায় পৌঁছাতে একমুহূর্ত বিলম্ব করেনি সৈকত।খড়গপুর আই.আই.টি থেকে পাশ করার পর প্রথমে ব্যাঙ্গালুরুতে কর্মজীবন শুরু করে বর্তমানে মুম্বাইতে কর্মরত।রমাদেবী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন,সৈকতও মুম্বাই ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দিল।কিন্তু ঠিক সে সময়ই দেশ জুড়ে শুরু হল লকডাউন।দোকান-পাট,পরিবহন সব বন্ধ হয়ে গেল।সৈকত ভাবল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফেরা যাবে।কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া তো দুরস্ত,দেশে রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। যার মধ্যে সবথেকে বেশি সংখ্যক আক্রান্তের সংখ্যা মহারাষ্ট্রে।তবু এসবের মাঝেই কিছুদিনের মধ্যে সৈকত স্পেশাল পারমিশন করিয়ে মুম্বাই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।কিন্তু সৈকতের মা রমাদেবী ছেলেকে বকে-ঝকে ছেলের মুম্বাই ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা বানচাল করে দিলেন।তাঁর বক্তব্য, "ওই মরার শহরে আর তোকে ফিরে যেতে হবেনা। তাতে তোর চাকরি থাকলে থাকবে না থাকলে না থাকবে।"
কিন্তু সৈকতের দোটানা মনোভাব দেখে রমাদেবী ছেলেকে একেবারে দিব্যি দিয়ে বসলেন,"আর যদি যাস তো আমার মরা মুখ দেখবি।"ব্যস্ এমন কথা শুনতে কোন্ ছেলেরই বা ভালো লাগে?তাই তো মায়ের আদেশ অমান্য না করে একরকম জোর করেই কোলকাতায় থেকে গেল সৈকত।চাকরি নিয়ে সে আদৌ চিন্তিত নয়। কারণ বর্তমানে সে কোম্পানির এমন উঁচু পদে রয়েছে যে তার চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা একেবারেই নেই। কোম্পানির হয়ে বড় বড় সিদ্ধান্ত যে তাকেই নিতে হয়। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সম্মতি সে অনেক আগেই পেয়ে গেছে তার ওপর মহল থেকে। তবু এত সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সৈকত যেন মুম্বাই ফিরতে মরিয়া। মাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে শ্রদ্ধাও করে।তাই মায়ের কাছে তার থেকে যেতে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু ওই লোকটা,যে মায়ের সাথে সবসময় ঘুরঘুর ঘুরঘুর করে; তাকে দেখলেই সৈকতের গা ঘিন-ঘিন করে ওঠে।সেই ছোটবেলা থেকে।রমাদেবীর এতবছর ধরে ছেলেকে বুঝিয়ে আসা কোনও কজেই দেয়নি।
"আচ্ছা বাবু,তুই এমন করিস কেন বল তো ওর সাথে।?ও তোকে কত ভালোবাসে।বাবা বলে না ডাকিস অন্তত কাকু বলেও তো ডাকতে পারিস।এই যে শুনছেন,এসব আবার কি?তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস বাবু,তোর বাবা মারা যাবার পর উনি পাশে এসে না দাঁড়ালে আমরা দুজনেই ভেসে যেতাম।আমাদের জন্য কি না করেছে!তোকে কোনদিন বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি।তুই ওর সাথে এমন ব্যবহার করিস যেন ও আমাদের শত্রু।"
মায়ের কথা শেষ হলে ছেলে তার বক্তব্য রাখে মায়ের কাছে,"সরি মা,এর থেকে ভালো ব্যবহার আমি আর ওনার সঙ্গে করতে পারব না। ওনাকে আমি অসম্মান করিনা বটে তবে ওনাকে আমি আমার বাবার জায়গা কোনদিনই দিতে পারব না। তুমি ওনাকে বিয়ে করেছ তাতে আমার কোনও দুঃখ নেই।কারণ সিঙ্গেল প্যারান্টিং করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। আর উনি যা যা আমাদের জন্য করেছেন তার সবকিছুর জন্য আমি ওনার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর বেশি না।উনি তোমার দ্বিতীয় স্বামী হতে পারেন।কিন্তু জোর করে ওনাকে আমার বাবা বানাতে এসো না। "
মা-ছেলের মধ্যে প্রায়-প্রায়ই এরকম কথোপকথন হয়। আসলে রমাদেবী ছেলেকে তাঁর বর্তমান স্বামী সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়তেই এ ধরনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন কিন্তু সৈকত ভোলবার পাত্র নয়।মা-ছেলের এহেন মন কষাকষির খবর রমাদেবীর বর্তমান স্বামী সমরেশবাবুর কানেও বহুবার গেছে।রমাদেবীর আক্ষেপ,"ছেলেটা যে কেন অমন করে কে জানে?কত করে বোঝাই। "
সমরেশবাবুর কিন্তু এ নিয়ে কোনও রাগ বা বিরক্তি নেই সৈকতের প্রতি।উল্টে তিনি স্ত্রীকে বোঝান,"তুমিই বা বারবার ওকে বলতে যাও কেন এসব কথা?ও যখন এসব পছন্দ করেনা।আমার তো কোনও অসুবিধা হয়না তাহলে তোমারই বা অসুবিধা হয় কেন?দ্যাখো একটা কথা তুমিও জানো,জোর করে কোন কিছুই হয় না ।তাছাড়া ও ছিল বাবা অন্তঃপ্রাণ।যখন বাবাকে হারায় তখন ও নেহাৎই একটা কাঁচা বয়সের বাচ্চা।টিন এজ অবস্থায় শরীর-মন দুটোতেই পরিবর্তন আসে।তার উপর ওর সব থেকে প্রিয় মানুষটা চলে গেল।পরবর্তীতে তুমি আমায় বিয়ে করলে।ও হয়ত তোমাকে বারণ করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু কোনদিনই এ বিয়েটা সমর্থন করেনি।এসব তো তোমাকেও বুঝতে হবে।এই পরিস্থিতিতে অনেকেই বখে যায় কিন্তু ও যে বখে যায়নি সেটাই যথেষ্ট। বাবার মৃত্যুর পরবর্তী যাবতীয় ঘটনা ওর মনে গেঁথে গেছে। ও হয়তো চাইছে এসব মন থেকে মোছার কিন্তু পারছে না। "
রমাদেবী স্বামীর প্রতি একটু অভিমানের সুরেই বললেন,"আমি কোথায় তোমার জন্য ওকে বোঝাই আর তুমি কিনা ওর হয়ে বলছ?"
"কারোর হয়ে বলা নয় রমা।সিম্পল হিউম্যান সাইকোলজি।ব্যাপারটা অত সোজা নয় যদিও তবে প্রত্যেকটা মানুষেরই উচিৎ হিউম্যান সাইকোলজি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা রাখা;তাহলে অনেক সম্পর্কই নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে।সত্যিই তো জোর করে এই বয়সী একটা ছেলে অন্য কাউকে কি করে বাবা বলে স্বীকৃতি দেয়!তাছাড়া ও আমায় কোনদিনও অসম্মান করেনি।যতবার বাড়িতে ফিরেছে তোমার পাশাপাশি আমাকেও কত কিছু দিয়েছে। আর কি চাই?আমি ওতেই খুশি তুমিও এতে সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা কর।ওকে আর কোনওদিন জোর করতে যেয়ো না। বেশি কচলালে লেবুও তেঁতো হয়ে যায়। তোমার এই বেশি বোঝানোর চোটে কোনদিন দেখবে ও আর সত্যিই বাড়ি ফিরতে চাইবে না।"স্ত্রীকে শান্ত ভাবে বুঝিয়ে বললেন সমরেশবাবু।
ফিরতে তো সৈকতও কোলকাতায় আর কোনদিনই চায় না। কিন্তু ওই যে নাড়ির টান।আর যায় কোথায়?উচ্চমাধ্যমিকে আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভালো রেজাল্ট করার পর সৈকত মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিল যে বাড়ি থেকে অনেক দুরে কোথাও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সাথে সাথে ও বাড়ির সাথে টানটা আস্তে আস্তে আলগা করে দেবে।সেই মতো খড়গপুর আইআইটিতে পড়াশোনার জন্য ভর্তি। ছুটিতে খুব কমই বাড়িতে আসত।এমনকি অনেক সময় এমনও হয়েছে সবাই ছুটিতে বাড়ি ফিরে গেলেও ও হোস্টেলেই থেকে গেছে।সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ক্যাম্পাসিং-এর মাধ্যমেই ব্যাঙ্গালুরুর বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজের সুযোগ পায় সৈকত।পরবর্তীতে সে এখন মুম্বাইতে কর্মরত। কোলকাতায় ভালো সুযোগ পেয়েও সে আর ফিরতে চায় না এখানে।কারণ তো সেই একটাই 'ওই লোকটা'।
বহুবছর পর আবার সৈকত টানা এতগুলো দিন বাড়িতে থাকল।শেষ কবে এতগুলো দিন বাড়িতে ছিল ওর মনে পড়ে না। অনেকেই আছেন যারা ছুটির অভাবে এতদিন বড়ির লোককে ঠিকমতো সময় দিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তারা এই লকডাউনটা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছেন।সৈকতের ক্ষেত্রেও হয়তো সেরকমটা হতে পারত।কিন্তু সেই যে আবার 'ওই লোকটা '।ঘেন্না করে।কোনদিন মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেনি যে সে ওই লোকটাকে ঠিক কতটা ঘেন্না করে।মায়ের সাথে একঘরে থাকতে দেখলে ওর গা গুলিয়ে ওঠে।তাই তো মায়ের ঘরের সোজাসুজি সে তার বাবার একটা পেল্লায় ছবি বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রেখেছে।মাকে কি সে কিছু বোঝাতে চায় নাকি মাকে সে অস্বস্তিতে ফেলতে চায়?যখনই আসে ছবিটাতে মালা,ধূপ দিয়ে পুজো করে।বাবার জন্মদিনে আজও সে কেক কাটে সে যেখানেই থাকুক না কেন। তারপর সেই কাটা কেক বাবার ছবিতে ঠেকিয়ে সে খায়।বাবার প্রতি অসীম ভালোবাসা আর বাবার শিক্ষার জন্যই সে আজও ওই লোকটাকে সহ্য করে আসছে।তার বাবার শিক্ষার মান এত নিম্ন নয় যে সে কাউকে মুখের ওপর অপমান করবে তাই তো পারেনা,ইচ্ছা হলেও ওই লোকটাকে উচিৎ জবাব দিতে পারেনা।তার প্রয়াত বাবার শিক্ষার জন্যই সে ওই লোকটার প্রতি প্রতিপালিত হতে থাকা তার ভিতরের যাবতীয় রাগ-অভিমান-ঘৃণাকে সে এতদিন ধরে দমন করে এসেছে।
ঘরে বেশিরভাগ সময় সৈকতের ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মাধ্যমে অফিসের কাজ করেই কাটছে আজকাল।বাকি সময়ের মধ্যে স্নান-খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া অবসর যতটুকু পায় বাড়ির ছাদে গিয়েই কাটায়।কখনো চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে তো কখনো শুধু শুধু। ছাদ যে সৈকতের বড্ড প্রিয়।একলা মনের যন্ত্রণাগুলো সে যে শুধু অন্ধকার ছাদের সাথেই ভাগ করতে পারে।আর কেই-ই বা আছে তার আপন?আজকাল দোকান-বাজারের হালটা সৈকতই ধরেছে।বাইরের যাবতীয় খুঁটিনাটি কাজ সৈকতই করে।মা এবং তথাকথিত 'ওই লোকটা 'কে একদমই বাইরে বেরোতে দেয়না সৈকত। দুজনেই ষাটোর্ধ্বো।তার উপর সৈকতের মা সবেমাত্র রোগ থেকে উঠলেন।করোনা যে রুগি মানুষ, বয়স্ক ব্যক্তি এবং দশ অনুর্ধ্ব বাচ্চাদের জন্য বেশি ক্ষতিকারক তা তো সে জানে। তাই সৈকত বাইরের সব কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে। এতে অবশ্য সৈকতেরও একটা লাভ হয়েছে আর সেটা হলো,এসব করতে তার বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বেশ কিছটা সময় কেটে যায়। বাড়ির দমবন্ধ করা পরিবেশের হাত থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুক্তি পায় সে।যেন বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে বাড়ি ফেরে সে।
মায়ের ওষুধগুলো সবে কিনেছে।শরীরটা যেন ভালো ঠেকছেনা সৈকতের। কদিন ধরেই শরীরটা ভালো নেই বাড়িতে মাকেও কিছু জানায়নি সে।আজ যেন গাটা গরম ঠেকছে,গলাটাও ব্যথা। কালবিলম্ব করেনি সৈকত। বাড়িতে ওষুধগুলো পৌঁছে দিয়েই দৌড় লাগালো নারসিংহোমে।সৈকতের অনুমানই সত্যি হলো। সৈকত কোভিড পজিটিভ। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। নিজের জন্য নয়।সে মরতে ভয় পায় না।মনে মনে সে ভাবল,"সংসারে আমার এমন কে আছে,যার আমি চলে গেলে কিছু যাবে আসবে?বরং মরে গেলেই ভালো। মাকে আর ওই লোকটাকে একসাথে দেখতে হবেনা।"
কিন্তু চিন্তা অন্য জায়গায়। ওই দুই বয়স্ক ব্যক্তির শরীরে যদি এই মারণ রোগ থাবা মারে?তাহলে ওদের কি হবে?কে দেখবে ওদের?ও তো নিজেই এখন নার্সিংহোমে ভর্তি!কে তাহলে ওদের নিয়ে চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করবে?এসব নানা কথা ওর মাথায় ঠায় ঘুরপাক খেতে লাগল।পরে মাথাটা কিছু ঠান্ডা করে বাড়িতে ফোন করে পুরো বিষয়টা জানাল সৈকত তারপর মাকে বলল যে,অবশ্যই ওঁরা দুজন যেন করোনার টেস্ট করায় এবং পুরো বাড়িটাকে যেন স্যানেটাইজ করা হয়।তাই করা হলো। তবে রমাদেবী এবং সমরেশবাবু দুজনের রিপোর্টই নেগেটিভ আসে।সৈকত নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।নার্সিংহোম কতৃপক্ষের কড়া নির্দেশ, এহেন কোনও রুগির বাড়ির লোকজন রুগির সাথে দেখা করতে পারবেন না,সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। কর্তব্যপরায়ণ সমরেশবাবু কিন্তু রোজই নিয়ম করে দুবেলা নার্সিংহোমে যান। সৈকতের সাথে দেখা করতে দেয়না তো কি হয়েছে?ওয়েটিং রুমে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন ,ডাক্তারের পরামর্শ নেন,কোন কিছুর প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা করেন,তারপর বাড়ি ফেরেন।সৈকতের মা রমাদেবীও স্বামীকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সমরেশবাবু স্ত্রীকে বোঝান, "তুমি সবে রোগ থেকে উঠেছ।তোমার নার্সিংহোমে যাওয়া ঠিক হবেনা।বরং তৈরী থাকো ছেলে করোনা জয় করে ফিরলেই আমরা সবাই মিলে উৎসব পালন করব।"
একটু আশাহত হয়েই রমাদেবী পরবর্তী কথাগুলো তাঁর স্বামীকে বললেন,"সিনিয়র সিটিজেন তো তুমিও। তুমি যে বড় ওখানে দুবেলা যাও?তোমার যদি এই রোগটা হয়ে যায় তখন আমার কি হবে একবার ভেবে দেখেছো?"
"কিছুই হবেনা। কারণ সৈকত আছে যে।সৈকত তোমার কিছু হতেই দেবেনা।বরং তোমার কিছু হলে আমাদের দুজনেরই দেখার কেউ থাকবে না। তুমিই যে আমাদের মাঝের সেতু।আর তাছাড়া আমার কিছু হবেনা।আমি তো ভালোভাবেই প্রোটেকশন নিয়ে তবেই বাইরে বেরোই।এত চিন্তা কোরোনা তো।"এই বলে সমরেশবাবু নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
সমরেশবাবুর এহেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোজ রোজ নার্সিংহোমে আসার বিষয়টা সৈকতের কাছেও আর গোপন থাকল না।ডাক্তার-নার্সদের মাধ্যমে সে সবই জানতে পারল।
"ডাক্তারবাবুরা,আমরা এমনকি সিকিউরিটি পর্যন্ত আপনার বাবাকে বোঝায় যে রোজ রোজ এভাবে না আসতে ।কোন কিছুর প্রয়োজন হলে আমরাই ফোন করে ডেকে নেব।বয়স্ক মানুষ তো।কিন্তু আপনার বাবা ঠিক নিয়মমাফিক আসেন।আপনার বাবার জন্য আমাদেরই ভয় লাগে।"বক্তব্যটি হেডনার্সের ।একটু থেমে পুনরায় সংযোজন করলেন,"আমি তো সেদিন বলেই ফেললাম,কি ছেলের পিছন পিছন আপনিও কি এখানে ভর্তি হতে চান নাকি?"
সৈকত ভারী অবাক হয়ে গেল।বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সৈকত প্রশ্ন করল,"আচ্ছা আমার মা আসেনা?"
জনৈক নার্স উত্তর দিলেন,"আপনার বাবার কাছ থেকেই শোনা;আপনার মা আসতে চেয়েছিলেন অনেকবার কিন্তু আপনার বাবা-ই আপনার মাকে এখানে আসতে বারণ করেন।আপনার মা তো অসুস্থ ছিলেন,তাই।"তারপর আরো বললেন,"ভালোই করেছেন আপনার বাবা,আপনার মাকে সঙ্গে করে না এনে।এই রুগ্ন শরীরে এ পরিবেশে বাইরে বেরোনো এক্কেবারে উচিৎ নয়। "
নার্সের কাছ থেকে সবকিছু শুনে সৈকত যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল।সারাদিন নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে-শুয়ে কি যেন আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।
অবশেষে ঘরে ফেরার পালা। নার্সিংহোম সৈকতকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। খবরটা শোনবার পরই সমরেশবাবুর ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বাহ্ রে!ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবেনা। একগাল হাসি নিয়ে সমরেশবাবু হাজির সৈকতের সামনে।নার্সিংহোমের সাথে প্রয়োজনীয় সব কাজকর্ম সেরে ফেলার পর সৈকতকে তিনি বললেন,"চলো এবার তবে বাড়ি ফেরা যাক।তোমার মা যে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।"
ফেরার পথে গাড়িতে বসে সারাটা রাস্তা সৈকত যেন কেমন বেখেয়াল হয়ে থাকল।এই প্রথম সে 'ওই লোকটা'কে নয় বরং নিজেকে ঘেন্না হচ্ছে তার।বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই রমাদেবী দরজাটা খুললেন।রমাদেবীকে দেখামাত্রই সমরেশবাবু হাসি-হাসি মুখ করে বললেন,"আরে চুপিসারে কেন?ছেলে আমাদের করোনা যোদ্ধা। করোনাযুদ্ধ জয় করে বাড়ি ফিরেছে।শাঁখ বাজাও,উলু দাও,ভালো-ভালো রান্না করো।আহা রে! ছেলেটা কতদিন ভালো করে খায়নি।"
সৈকত এখন পুরোপুরি সুস্থ। তবুও এত সকালে ছেলেকে উঠতে দেখে রমাদেবী বললেন, "এত সকালে উঠে কি করছিস?আরো ক'দিন ভালো করে রেস্ট নে।ঠিক করে খা,ঘুমো।"রমাদেবী আরো অবাক হলেন যখন সৈকতকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখলেন।রান্নাঘরে ছেলেকে এটা-ওটা ওটকাতে দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলেন, "কিছু খুঁজছিস?"
"আচ্ছা মা,কেক তৈরী করার সবকিছু কি বাড়িতে আছে?না কিছু দোকান থেকে আনতে হবে?"রমাদেবীর কাছে জানতে চায় সৈকত।
"তা আর থাকবে না কেন?কয়েক সপ্তাহ আগেই তো তোকে কেক করে খাওয়ালাম।কেন কেক খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে বুঝি?আমাকে বললেই তো পারতিস্।রান্নাঘর ঘাঁটার কি আছে?সর্
দেখি।"রমাদেবী ছেলেকে বললেন।
সৈকতও ঘাড় নেড়ে বলল,"উঁহু ওই কেক নয়।জন্মদিনে যে কেক খাওয়া হয় সেই কেক বানানোর জিনিষপত্র বাড়িতে আছে কি?"
"হ্যাঁ তা-ও আছে।মনে নেই গত মাসে তোর জন্মদিনে আমি চকলেট কেক বানালাম।আচ্ছা ওই কেক খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে?আচ্ছা দাঁড়া আমি বানিয়ে দিচ্ছি।"রমাদেবী ছেলেকে বললেন।
"হ্যাঁ ওই কেক।তবে তুমি বানাবে না,আমি বানাবো।তুমি শুধু কীভাবে তৈরী করতে হয় আমায় বলে বলে দেবে।"সৈকত মাকে আরো খানিক অবাক করে দিয়ে তার মনের ইচ্ছা মায়ের কাছে প্রকাশ করে।
রমাদেবীর সাহায্যে আর সৈকতের মেহনতে অবশেষে তৈরী হল একটা চকলেট কেক। কেকের উপর সৈকত খুব সুন্দর করে লিখল ' হ্যাপি বার্থডে বাবা' আর সঙ্গে যুক্ত করে দিল প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি। কেকের ওপরে লেখা আর মোমবাতি দেখে রমাদেবী বিস্মিত হয়ে গেলেন।সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেকে জানালেন,"তুই কিনা শেষে তোর বাবার জন্মদিনের ডেট ভুল করলি?আমি তো ভাবতেই পারছিনা।তুই তো রেকর্ড করে ফেললি রে!সেইজন্যই বার্থডে কেক বানানোর এত হুড়োহুড়ি। যাকগে ভুল দিনে বানিয়েছিস তো কি হয়েছে?বানিয়েই যখন ফেলেছিস,যা বাবার ছবির সামনে রেখে আয়।"
"আমি তো ভুল দিনে বানাইনি,আমি তো একদম ঠিক দিনেই বানিয়েছি।"মায়ের ভুল শুধরে দিয়ে সৈকত কথাগুলো বলে।
"কিন্তু আজ তোর বাবার জন্মদিন কোথায়?.........."রমাদেবীর কথা শেষ না হতে হতেই সৈকত কেকটা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
দালানে তখন সমরেশবাবু টেবিলে কাগজটা রেখে চেয়ারে বসে সবে দেশ-দুনিয়ার খবরের প্রতি মনোনিবেশ করেছেন।এমন সময় সৈকত সমরেশবাবুকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে বলে ওঠে,"জীবনে প্রথমবার কেক বানালাম।জানিনা কেমন হয়েছে?দোকান খোলা থাকলে অবশ্য আপনাকে আর কষ্ট করে এ কেক খেতে হত না। "
সমরেশবাবু ঠিক কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না।তিনি সৈকতকে প্রতিউত্তর দেওয়ার মতো কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।শুধু হতবুদ্ধির মতো বসে রইলেন।ছেলের এহেন কান্ড দেখে রমাদেবীও হতবাক।খানিকক্ষণ সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল যেন।সবাই চুপচাপ। সময় যেন থমকে গেল।
সকলের নিরবতা ভাঙিয়ে সৈকতই প্রথম কথা বলল,"আগে যদি জানতাম আপনার জন্মদিন তাহলে কিছু একটা গিফ্টের ব্যবস্থা অবশ্যই করতাম।আজই হঠাৎ করে জানতে পারলাম কিনা। "
সমরেশবাবুর জন্মদিন যারা মনে রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সমরেশবাবুর বাল্যবন্ধু প্রিয়তোষ। প্রতিবছর নিয়ম করে এই বিশেষ দিনের সকালবেলায় প্রিউয়বন্ধুটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেন না।আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রিয়তোষবাবুর শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েই সমরেশবাবু বন্ধুকে মজা করে বলেছিলেন,"আর কেন?বয়স তো অনেক হলো। এখন তো আমি শ্মশানের দিকে মুখ করে বসে আছি।আর তুই কিনা আমায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাস্?"
ঠিক সেই সময়ই সমরেশবাবুর ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল সৈকত ।কথাগুলো তার কানে আসে।তাই সকাল থেকেই এই আয়োজন।
সমরেশবাবু আর রমাদেবী দুজনেরই চোখে জল।কি বলবেন কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। সৈকত আবার রমাদেবীকে বলে,"আজকে কিন্তু এমনি খাবারে হবেনা মা,স্পেশাল মেনু চাই।"
হতভম্বের মতো আর চেয়ারে বসে থাকতে পারলেন না সমরেশবাবু ।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সৈকতকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।সৈকত এতক্ষণ নিজেকে বশে রেখেছিল বটে,আর পারল না। সমরেশবাবু সৈকতকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই সৈকতের দুচোখ ছেপে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। রমাদেবীও কাছে এসে সৈকতকে জড়িয়ে ধরলেন। অভিমানের মেঘ সরিয়ে, আবেগ কাটিয়ে ,তিনজনের সামলাতে একটু সময় লাগল। তারপর সৈকত ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দেওয়ালে টাঙানো তার বাবার ছবির দিকে।হাতদুটো জড়ো করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বাবাকে জানাল,"আমাকে ক্ষমা ক'রো বাবা।আমি ওনার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে আসলে আমি তোমার শিক্ষারই অপমান করেছি।অজান্তে আমি মস্ত বড় ভুল করে বসেছি।আমি বুঝতে পারিনি,তুমি আবার অন্য রপে আমার কাছে ফিরে এসেছ।"
সমরেশবাবু ধীরপায়ে সৈকতের কাছে গিয়ে কাঁধে তার হাতটা রাখলেন আর বললেন,"বাবা-মা সবসময় সন্তানকে ক্ষমা করে দেয় সৈকত, তা সে যত অন্যায়ই করুক না কেন। আর তুমি তো কোনও অন্যায় করোনি।তুমি আমাকে মেনে নিতে পারোনি ঠিকই কিন্তু আমার সাথে কোনওরকম দুর্ব্যবহারও করোনি।আমার কোনওদিনও খারাপ লাগেনি, আমার বরং স্বাভাবিকই লেগেছে সেটা।"
তারপর কেক কাটা হলো। সমরেশবাবু সৈকতের তৈরী করা কেকের প্রশংসায় যাকে বলে পঞ্চমুখ।কিন্তু সৈকতের মাথা থেকে সমরেশবাবুকে তার জন্মদিনের দিনে উপহার না দিতে পারার আফসোসটা কিছুতেই যাচ্ছেনা,"ইস্ আগে যদি জানতাম, অনলাইনেই কিছু একটা আনিয়ে নিতাম।আজ অর্ডার দিলেও তো সেই দেরিতেই আসবে।আচ্ছা তাই না হয় হবে।আপনার গিফ্টটা কিন্তু ডিউ রইল।"
সমরেশবাবুও গদগদ হয়ে উত্তর দিলেন,"ডিউ কি বলছ হে?আজ যা আমায় তুমি দিলে তা এযাবৎ আমার জীবনের সেরা গিফ্ট।আজ আমার জন্মদিনে তুমি আমায় বাবা বলে স্বীকৃতি দিলে এর থেকে বড় গিফ্ট আর কি হতে পারে?তার উপরে জীবনে প্রথম কেক বানালে তাও আবার আমার জন্যে।আমি ভাবছি এত খুশি রাখব কোথায়?
"তবুও "সৈকত সেই আফসোসের সুরেই কথাটা বলল।
সমরেশবাবু খানিকক্ষণ যেন কি একটা ভাবলেন তারপর সৈকতকে বললেন,"এসবের পরেও তুমি এখনও আমায় কিছু দিতে চাও?"
সৈকতও বলল"হুম্, এতক্ষণ ধরে তাই তো বলছি।"
"তুমি তো দেখছি ভারি নাছোড়বান্দা। "সৈকতকে হেসে কথাটা বললেন সমরেশবাবু। তারপর আরো বললেন,"আচ্ছা একান্তই যদি আমায় কিছু দিতে চাও তাহলে আমি যা চাইব দিতে পারবে?এর জন্য অবশ্য তোমায় বাইরেও যেতে হবেনা বা অনলাইনেও কিনতে হবেনা।"।সমরেশবাবুর এহেন কথায় রমাদেবী আর সৈকত দুজনেই অবাক হলেন।তবুও সৈকত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,"বেশ,বলেই দেখুন না।"
"তাহলে বাবা আজকের এ শুভ দিনে যখন সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটেই গেল তখন তোমার আমার সম্পর্কের মাঝে এই 'আপনি' শব্দের ব্যবধানটুকু মুছে দিয়ে আমায় 'তুমি' বলে সম্বোধন করে মধুরেণ সমাপয়েৎ করো।ব্যস্ এটুকুই আমি চাই।বলো দিতে পারবে না?"
সৈকতও আর দেরি না করে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল,"বেশ দিলাম তোমায়। "
