শ্যামাঙ্গী
শ্যামাঙ্গী
মধুপুর গ্রামের জমিদার বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকার এবং সকলের চোখের নীলমণি হলেন শিব চরণ রায়। তিনি বাড়ির সবার বিরুদ্ধে গিয়ে গ্রামের চিকিৎসালয়ের একমাত্র চিকিৎসক রামনাথ বাবুর কন্যা শ্যামাঙ্গীকে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেন। এই বিয়েতে শিব চরণ বাবুর পরিবার অর্থাৎ বাবা,মা, দিদি, বোন, পিসি,মাসি সবাই প্রচুর বিরোধীতা করে ছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিব চরণ বাবুর জেদের কাছে মাথা নত করেন ঠিকই, কিন্তু শ্যামাঙ্গীকে কোনদিনও জমিদার বাড়ির পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নিতে পাড়বেন না..... এই কথা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেন। এই বিয়েতে শিব চরণ বাবুর পরিবারের অমতের প্রধান কারন ছিল দুটি, এক শ্যামাঙ্গীর গায়ের রং চাপা তবে মুখশ্রী ভালো, আর দুই হল ওনাদের মত আভিজাত্য, প্রভাব, প্রতিপত্তি কোনটাই শ্যামাঙ্গীর বাবার ছিলনা! তিনি একজন সামান্য কবিরাজ, এবং ওনার কাছে রোগ দেখাতে আসা অর্ধেক রুগির টাকা পয়সা দেওয়ার সামর্থ্য ছিলনা, তাই মাস গেলে ঘরে টাকা আসার পরিমানও ছিল খুব সামান্য।
ছোট বেলায় মা.... হারা কন্যা শ্যামাঙ্গী রামনাথ বাবুর একমাত্র অবলম্বন। তিনি নিজের যে.... টুকু পুঁথিগত বিদ্যা ছিল তিনি সব মেয়েকে দিয়েছেন। মধুপুর গ্রামের মানুষের কাছে রামনাথ কবিরাজ হলেন স্বয়ং দেবতা, তিনি যমের দূয়ার থেকে রুগী কে ফিরিয়ে আনতে পাড়েন বলে গ্রামের সবাই বিশ্বাস করে। শ্যামাঙ্গী বাবার হাতে হাতে কাজ করে নিজেও কিছুটা পারদর্শী হয়েছিল কবিরাজি ঔষধ তৈরীর ব্যাপারে।
মাস কয়েক আগে জমিদার বাড়ির গিন্নিমার শরীর খারাপ হয়েছিল খুব,একেবারে যায় যায় অবস্থা, যমে মানুষের টানাটানি, বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা পর্যন্ত ছিলনা, তখন টানা কয়েক মাস ধরে শ্যামাঙ্গী নিজের সেবা যত্ন এবং ঔষধ দিয়ে সারিয়ে তুলেছিলেন গিন্নি মাকে। এই যাতায়াত থেকেই শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে শিবচরণ বাবুর পরিচয়, এবং বন্ধুত্ব। গিন্নিমা তখন শ্যামাঙ্গীকে খুব ভালো বাসতেন একেবারে নিজের সন্তানের মত, কিন্তু যবে থেকে শুনেছেন তার একমাত্র ছেলে এবং জমিদার বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকার এই শ্যামাঙ্গীকে বিবাহ করতে চায় তখন থেকেই গিন্নিমার ভালোবাসার পরিবর্তন হয়েছে, এবং সে জায়গায় একটা অবহেলা এবং তাচ্ছিল্য এসেছে সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পারে শ্যামাঙ্গী।
অবশেষে শ্যামাঙ্গীর জীবনে সেই সুন্দর দিন এসে উপস্থিত হয় । রামনাথ বাবু তার সাধ্যমত চেষ্টা করে চলেছেন অতিথিদের খুশি করার, কিন্তু জমিদার বাড়ির লোকেরা আগে থেকেই মনে মনে পরিকল্পনা করে রেখেছেন, তারা কিছুতেই খুশি হবেন না....!!! তাই অনেক কটুকথা, অপমান সহ্য করতে হয়েছে রামনাথ বাবুকে। মেয়ের সুখের কথা ভেবে তিনি সব সহ্য করে, নীরবে চোখের জল ফেলে কন্যাদান করলেন হাসিমুখে। এবং শিব চরণ বাবুর হাত ধরে একটা কথাই বললেন
আমার মা মরা মেয়েটাকে একটু দেখবেন ছোটো কর্তা!!!! মেয়েটা আমার বড়ই অভাগী!!! কপলে সুখ সহ্য হয় না !
শিব চরণ বাবু শ্যামাঙ্গীর বাবাকে আস্বস্থ করে বলেছিলেন, আপনি চিন্তা করবেননা!!!! শ্যামাঙ্গীকে আমি ভালো রাখার আপ্রান চেষ্টা করব, এবং সব রকম বিপদ থেকে আগলে রাখব।
************************************************
বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্বামীর হাত ধরে শ্যামাঙ্গী নব বধূর সাজে জমিদার বাড়িতে পা..... রেখেছিল। কিন্তু এই পা রাখার জন্য তাকে নানা... রকমের কথার বান সহ্য করতে হয়েছে, যে..... গুলো সোজা গিয়ে বিঁধেছে শ্যামাঙ্গীর বুকে, এবং কোমল অন্তর কে.... ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে, তার চাপা রং... এর জন্য আত্মীয় স্বজন সবার মুখ টিপে টিপে হাসা,এক অন্য রকম কষ্টের অনুভূতির সৃষ্টি করেছে, আবার অনেকে মুখের ওপর এও বললেন...... "বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা" !!!!!! সবকিছু মুখবুজে সহ্য করে হাসি মুখে সংসারের স্রোতে গা..... ভাসিয়ে দিয়েছিল শ্যামাঙ্গী।
একটা একটা করে পার হয়ে গেল বছর, তবুও শ্যামাঙ্গী জমিদার বাড়ির বংশ রক্ষার জন্য বংশধরের জন্ম দিতে পারলোনা!!!! ঠাকুরের কাছে মানতের পর মানত!!! অনেকের অনেক রকম পরামর্শ,, তাবিজ,, কবজ কোনকিছুতেই কোন কাজ হলোনা!!! যত বছর পার হতে লাগল শ্যামাঙ্গী ততই যেন সংসারের চক্ষুশুলে পরিনত হতে লাগল!!! কিন্তু শিব চরণ বাবুর ভালোবাসায় কোনো খাদ ধরা পড়লনা!!! তিনি শ্যামাঙ্গীকে সবার কথার বান থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন আপ্রান। আর এই চেষ্টাই গিন্নিমার মনে চরম রাগ, ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল, এবং তিনি ধরে নিয়েছিলেন শ্যামাঙ্গী ওনার একমাত্র ছেলেকে বস করেছে, না.... হলে ওনার হীরের টুকরো ছেলে এই রকম কয়লার পিছনে ছুটে বেড়ায়!!!! আসলে উনি ভুলে গেছিলেন হীরে কয়লার খনিতেই উৎপন্ন হয়। গিন্নিমার তীব্র রাগ এবং ঘৃণার ফলে শ্যামাঙ্গীর জীবনে এক ভয়াবহ করুন পরিনতি নেমে এল যা কল্পনারও অতীত!
গিন্নি মা নিজের বিশ্বস্থ দাসী কে.... দিয়ে বিষ আনিয়ে গরম দুধের সাথে মিশিয়ে শ্যামাঙ্গীকে খাওয়াবেন বলে ঠিক করলেন, এবং স্বামীর সাথে মিলে পরিকল্পনা করলেন। শ্যামাঙ্গী নামের অলক্ষীটা মরলে ! ওনার পছন্দ করা পাত্রির সাথে ছেলের আবার বিবাহ দেবেন।
শ্যামাঙ্গী নিজের চোখে সবকিছু দেখে এবং কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারছিলনা মন থেকে!!!কারন শ্যামাঙ্গী নিজের মায়ের স্থানে বসিয়ে ছিল গিন্নিমাকে, আর মা..... কখনও সন্তানের সাথে এই রকম করতে পারে সেটা শ্যামাঙ্গীর কল্পনারও অতীত! তাই কিছুটা নিজের ভাগ্যের ওপর অভিমান করে, কোন রকম প্রতিবাদ না..... করে শ্যামাঙ্গী জেনে বুঝে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল নিজের সাথে। সবার চোখের সামনে শ্যামাঙ্গী একটু একটু করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছিল.....সবাই দর্শক হয়ে দেখে গেছিল সেই করুন পরিনতির দৃশ্য। শ্যামাঙ্গীর নিথর দেহটাকে আগলে শিব চরণ বাবুর তীব্র আর্তনাদে সারা জমিদার বাড়ি কেঁপে উঠেছিল। শ্যামাঙ্গী মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে ডেকে..... উঠেছিল মা......... বলে!
গিন্নিমার পরিকল্পনা কিছুটা সফল হলেও পুরোটা হয়নি! হ্যাঁ...... শ্যামাঙ্গী নামের অলক্ষীটা বিদায় হয়ে ছিল চিরদিনের মত ঠিকই! কিন্তু তার সাথে তার একমাত্র সন্তানেরও জীবনে নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এসেছিল! শিব চরণ বাবু শ্যামাঙ্গীর মৃত্যুর আসল কারন জানতে পেরে সহ্য করতে পারেননি, কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি নিজের আপনজনেদের এই রকম কদর্য রূপ! মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে জমিদার বাড়ির একটা বদ্ধ ঘরে বন্দী হয়ে পড়ে রইলেন বাকি জীবন। আর জমিদার বাড়ির কর্তাবাবু আর গিন্নিমা নিজেদের করা অপরাধের করুন পরিনতি চোখের সামনে দেখে, প্রতিনিয়ত বিবেক দংশন এবং তিল.... তিল.... করে মৃত্যুর আগুনে জ্বলতে লাগলেন!!!! আর অপেক্ষা করতে লাগলেন পুরোপুরি ভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য!!!! কিন্তু কষ্ট থেকে অত সহজে কি মুক্তি লাভ করা সম্ভব! আজও সবসময় গিন্নিমার কানে ভেসে আসে সেই বেদনাভরা ডাক মা