শঠে শঠ্যাং...
শঠে শঠ্যাং...


বর্ষাকালে নীল আকাশকে কালো মেঘের চাদরে মুড়ে অবিরত ধারায় যেমন বৃষ্টি ঝড়তে থাকে, ঠিক তেমন গত কাল রাত থেকে চলছে সান্যাল বাড়িতে, বৃষ্টি..... নয় ঝগড়া! আর ঝগড়া হলো বাবা.. মাকে নিয়ে। সকাল বেলায় চায়ের টেবিলে বসে থেকে শুরু হয়েছে, বিকেল হয়েগেছে তবুও মীমাংসা হয়নি! সান্যাল বাবুর দুই ছেলে , একজন সরকারি আর একজন বেসরকারী চাকরি করেন, এবং গ্রাম ছেড়ে শহরের বুকে থাকেন ছেলে, মেয়েকে ভালোভাবে মানুষ করবেন বলে। সন্যাল বাবুও বেসরকারী কর্মচারি ছিলেন। চাকরি ছেড়েছেন এই বছর দুয়েক হলো। পেনশন নেই। তারপর বয়স হয়েছে আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করেছে শরীরে। তাই এখন বাবা মাকে দেখার দায়িত্ব নিয়ে ছেলে আর ছেলের বউ দের মধ্যে ঝামেলা চলছে। সন্যাল বাবুর সম্পত্তি বলতে গ্রামের এই পাঁচকাঠা জমির ওপর দোতলা বসত বাড়িটুকু, আর ব্যাঙ্কের বেশ কিছু টাকা।
সন্যাল বাবুর ছেলেদের এখন একটাই ইচ্ছা, বাড়ি বিক্রি করে টাকা সমান ভাবে ভাগ করে নেওয়া।ছেলেদের মধ্যে ঝামেলা চলছে কে. বাবাকে নেবে আর কে মাকে নেবে! যেহেতু সম্পত্তি ভাগ দুজনে সমান ভাবে নেবে, তাহলে বাবা মার ভাগও সমান নিতে হবে! বড়ছেলে বলছে মাকে নেবে, ঠিক তখন ছোট ছেলে বলে উঠছে
-কেন? ছোট থেকে বাবা তোকে আমার থেকে বেশি ভালোবেসে এসেছে, সব সময় সবকিছুতে বাবু বাবু করে এসেছে, বাবা তোর কাছেই থাকবে, আর মা আমার কাছে থাকবে।
বড়ছেলে সাথে সাথে বলে উঠছে, না.... বাবা তোর সাথে থাক, মা আমার সাথে থাকবে।
আসলে বয়স হলে কি.... হবে! মাতো সংসারের কোন.. না... কোনো কাজে লাগবেই! আর বাবা তো... লাগবেনা, তাই... বাবাকে কে নেবে সেই নিয়ে ভাগাভাগি চলছে!
সান্যাল বাবু চায়ের কাপটা নিয়ে দোতলার ঝুলবারান্দায় বসলেন। সূর্যের তেজ তখন কমে এসেছে, লাল আভা ছড়াচ্ছে আকাশের বুকে। চায়ের কাপ দিয়ে তখনও ধোঁয়া উঠছে। সান্যাল বাবুর তখন চা.... খাওয়ার দিকে মন নেই, কারন মন তখন সামনে বিস্তৃিত সবুজ মাঠের ওপর নিবদ্ধ, যেখানে কচি কাঁচারা ফুটবল খেলছে, আর থেকে থেকে গোল.... গোল..... করে চিৎকার করে উঠছে। সান্যাল বাবুর মন হারিয়ে যেতে লাগল ফেলে আসা শৈশবের বাঁকে।
সন্যাল বাবু ছোট বেলায় কত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই গ্রামের মধ্যে। গ্রামের প্রত্যেক অলিতে গলিতে পড়েছে সান্যাল বাবুর পায়ের ছাপ। ফুটবল থেকে শুরু করে এমন কোনো খেলা নেই যে.... খেলেননি। পুকুড়ের জলে নেমে ডুব সাঁতার, মড়া সাঁতার এই সবও চলত তখন সবার সাথে মিলে। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে কাদার মধ্যে ফুটবল খেলার যে... কি মজা সে... যারা খেলেছে তারাই জানে। সেইবার মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক একসপ্তাহ আগে পাশাপাশি সমস্ত গ্রামের ছেলে দের নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতা। বাড়িতে বাবা মাকে না..... জানিয়েই সান্যাল বাবু ছুটেছিলেন খেলতে, কিন্তু খেলা শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি সান্যাল বাবু! খেলা শেষ হওয়ার আগেই স্যানাল বাবুর বাবা, মাড়তে মাড়তে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন ওনাকে। সান্যাল বাবুদের দল ফুটবল খেলায় হেরে গেলেও, পরেরদিন মাংস দিয়ে বোনভোজন হয়েছিল, ওটা বাদ যায়নি। কত আনন্দের, মজার দিন ছিল শৈশব। সময়ের অতল গভীরে হারিয়ে গেছে, রয়ে খেছে কিছু রঙিন স্মৃতি। হঠাৎ সান্যাল বাবু হারিয়ে যাওয়া শৈশবের বাঁক থেকে বর্তমানের কঠিন বাস্তবে ফিরে এলেন শঙ্খধ্বনির আওয়াজে। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধ্যা হয়েগেছে প্রকৃতির বুকে সান্যাল বাবু বুঝতে পারেননি। সূর্য ডুবে গিয়ে আকাশের বুকে একফালি চাঁদ উঠেছে।
************************************
সন্ধ্যের পর বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে। রাতের খাবার সেরে যে..... যার ঘরে ঢুকে পড়েছে। সান্যাল বাবু খাটে হেলান দিয়ে বসে চোখে চশমা পড়ে, খুব মনযোগ দিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়ছেন। সন্যাল গিন্নি রান্নাঘরের সমস্ত কাজ সেরে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। গিন্নির হাতের চুড়ির আওয়াজ পেয়ে সান্যাল বাবু কাঁপা কাঁপা হাতে বইটা বন্ধ করে, চশমাটা খুলে সাইড টেবিলে রেখে শরীর টাকে বিছানায় এলিয়ে দিলেন। সান্যাল গিন্নিও লাইট বন্ধ করে চুপচাপ খাটের এক সাইডে শুয়ে পড়লেন।
--সান্যাল বাবু বলে উঠলেন, গিন্নি কি.... ঠিক করল ছেলেরা মিলে?
--সান্যাল গিন্নি বলে উঠলেন, ঐ..... তো আমাকে ছোটন নেবে দুমাস, আর তোমাকে বাবু। তারপর আমি বাবুর কাছে দুমাস থাকবো আর তুমি ছোটনের কাছে।
--সান্যাল বাবু চুপচাপ শুয়ে রইলেন, শুধু জোড়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন।
--সান্যাল গিন্নি শোয়া ছেড়ে উঠ
ে বসে বলে উঠলেন, আচ্ছা তুমি তো..... কোনদিন আমাকে ছেড়ে কোথাও থাকনি!তোমার ঔষুধ দেওয়া থেকে সমস্ত কিছু আমি হাতে হাতে করে এসেছি। আমা জানি, তোমার কোনটা খেতে ভালো লাগে, কোনটা খারাপ, তোমার কখন কখন চা.... খেতে ইচ্ছে হয়, তোমার ওষুধ কোন কোন সময়ে আছে, তুমিতো কিছুই জানোনা! তাহলে তুমি বাবুর কাছে গিয়ে থাকতে পাড়বে একা একা? আমার তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে গো!শেষ বয়সে কিনা ছেলেরা আমাদের ছাড়াছাড়ি করে দিচ্ছে। এও....দেখতে হল।
-সান্যাল বাবু শিরা উঠে যাওয়া হাল্কা কাঁপতে থাকা হাতাটা গিন্নির হাতের ওপর রেখে বলে উঠলেন, অত চিন্তা করোনা গিন্নি....! সব ঠিক হয়ে যাবে কাল সকালেই। আমরা কোথাও যাবনা....!এইখানেই থাকব, আর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমাদের কেউ ছাড়া ছাড়ি করাতে পারবে না।
---------সান্যাল গিন্নি স্বামীর বুকে মাথা রেখে বলে উঠলেন, কি.... হবে সকালে। তুমি কি..... কিছু করবে। তবে বেশি উত্তেজিত হওনা তাহলে তোমার শরীর খারাপ করবে।
--সান্যাল বাবু গিন্নির মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন, ঘুমিয়ে পরো, সারাদিন তোমার অনেক খাটা খাটনি হয়েছে। এই বয়সেও একা হাতে তোমাকে সংসার ঠেলতে হচ্ছে। বিনে পয়সায় রান্নার লোক পেয়ে যাবে তাইতো ছেলেদের তোমাকে নেওয়ার এত তাড়া।
************************************
রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের মোটা চাদরকে সড়িয়ে নতুন দিনের নতুন আলো ফুটে উঠেছে। সন্যাল বাবু বসে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চায়ের চমুক দিচ্ছেন, আর সন্যাল গিন্নি ঠাকুর ঘরে। ঠিক তখন দুই ছেলে এবং ছেলের বউরা নাতি নাতনিদের নিয়ে, নিচে নেমে এলেন। সান্যাল গিন্নি পূজো সেরে সবাইকে জল খাবার বেড়ে দিলেন লুচি আলুরদম।
-বড়ছেলে বলে উঠলেন, বাবা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
--সান্যাল বাবু বলে উঠলেন হ্যাঁ... বলো।
--বড়ছেলে বলতে শুরু করলেন, কালকে বাড়ি দেখতে লোক আসবে, ওনাদের পছন্দ হয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে আমরা তোমাদের নিয়ে চলে যাব। আর তাছাড়া.... মায়ের মুখে নিশ্চয়ই সব শুনেছ কি... ঠিক হয়েছে!
------------সান্যাল বাবু একই ভাবে খবর কাগজ পড়তে পড়তে বলে উঠলেন, হ্যাঁ.... শুনেছি।
-ছোটছেলে বলে উঠলেন, তাছাড়া আমার আবার বেশি ছুটি হবেনা, মেয়েটার স্কুল, টিউশন সব কামাই হচ্ছে, পড়াশোনারও ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু হয়ে গেলে ভালো।
-সন্যাল বাবু খবরের কাগজটা রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলেন, বাড়ি আমার তাই বিক্রি করব কি.... করবনা এটা সম্পূর্ন আমার সিদ্ধান্ত। আর তোমার মায়ের দায়িত্ব আমি নিয়েছি, তাই যতদিন আমি আছি ততদিন তোমার মায়ের দায়িত্ব কাওকে নিতে হবে না!আর হ্যাঁ..... দায়িত্ব তো.... তোমরা নিতে চাওনি, চেয়েছো বিনে পয়সার রান্নার লোক, যাতে তোমাদের বউরা পায়ের ওপর পা তুলে থাকতে পারে। তবে তার আর দরকার নেই। আমরা এখানেই থাকব, আর আমাদের দেখাশোনা যে করবে তাকেই আমার এই বাড়িটা লিখে দেব। আর তোমাদের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি করার দরকার নেই, তোমরা আজকেই চলে যেতে পারো।
-সন্যাল বাবুর দুই ছেলে একসাথে গর্জে উঠে বললেন, তা.....কে দেখবে তোমাদের! আর আমাদের সাথে এই রকম ব্যবহার করছ, আমরা চলে গেলে আর কিন্তু আসবনা, তখন বুড়ো বুড়ি মরে পড়ে থাকবে এইখানে।
-সান্যাল গিন্নি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
-সান্যাল বাবু বলে উঠলেন কেঁদনা গিন্নি কাদের জন্য কাঁদছ, তোমার স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার দাম যেখানে নেই, সেখানে এই চোখের জলের দাম থাকে! আর তোমরা.... নিজেদের কাছে আমাদের নিয়ে গিয়ে কত দেখতে, সে.... নিয়েও আমার সন্দেহ আছে! তবে একটা কথা কি..... জানো "ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয়না"। তাই আমার যা....কিছু আছে যে..... দেখবে সেই পাবে, তাই আশাকরি লোকের অভাব হবেনা। আর অভাব হলেও তোমাদের কাছে যাবনা....! আর তোমাদের কানাকড়িও দেবনা। দরকার হলে কোন আশ্রমে দান করে সেখানেই বুড়ো বুড়ি থেকে যাব যে কটাদিন বাঁচব। আশাকরি তোমরা সব বুঝতে পেরে গেছ, তোমাদের আর কিছু বলার নেই!!
সন্যাল বাবুর কথায় ওনার ছেলে এবং ছেলের বউদের চোখ গুলো বড় বড়,এবং মুখ গুলো হাঁ... হয়ে গেছে, আর লুচির টুকরো গুলো পাতে পড়ে রয়েছে। এতটা মনে হয় ওনারা আশা করেন নি!
--সন্যাল বাবু বলে উঠলেন, কই....গিন্নি আর দুখান লুচি দাওতো দেখি, বড্ড খিদে পেয়েছে।
সান্যাল গিন্নি মুচকি হেসে লুচি দিলেন স্বামীর পাতে। আর সান্যাল বাবু বেশ আয়েশ করে মুখে তুললেন লুচির টুকরো।