শ্রবণ বিভ্রাট
শ্রবণ বিভ্রাট
সেদিন অফিসে পৌঁছনো মাত্র বসের ফোন। বললেন, "আমার শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়েছে তাই অফিসে আজ যাব না। আপনি সব দিক সামলে নেবেন।"
ফোনটা রেখেছি অমনি বসের ল্যান্ড-লাইন ক্রিং ক্রিং করে উঠল। আমি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলাম।
বসের স্ত্রী ফোন করছেন। আমি ধরেই বললাম, "হ্যালো আমি ইমন বলছি।"
ম্যাডাম বললেন, "আপনি ফোন ধরলেন কেন? সে এখনও অফিসে পৌঁছায়নি?"
আমি বললাম, "না মানে স্যার তো বললেন, মানে বললেন...মানে!"
ম্যাডাম বললেন, "তখন থেকে কী মানে মানে করে যাচ্ছেন? ও কি চাইনিজ ভাষায় বলেছে নাকি? যা বলেছে ভণিতা ছেড়ে চটপট বলে ফেলুন।"
খেয়েছে! স্যারের কি তাহলে শরীর খারাপ হয়নি? স্যার কী বাড়িতে না বলে অন্য কোথাও চলে গেছেন! এখন কী বলি!
বললাম, "ম্যাডাম আপনার কান ভাল আছে?"
ম্যাডাম রেগে গেলেন বোধহয়, বললেন, "কী কথার কী উত্তর! হ্যাঁ কান মোটামুটি ঠিকই আছে। এবার স্যার কী বলেছেন বলুন।"
আমি বললাম, "মানে স্যার বললেন স্যারের শরীর খারাপ তাই আজ অফিস আসবেন না।"
কিছুক্ষণ ওদিকে চুপচাপ। ম্যাডাম বোধহয় চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক্ খেলেন! যাকে বলে বাক্যহারা হয়ে গেছেন।
আরও কয়েক সেকেন্ড পরে ম্যাডাম বললেন, "শরীর খারাপ! অফিসে যাবে না! আচ্ছা!"
বলে ফোন রেখে দিলেন ম্যাডাম।
বসের চেম্বার থেকে বেরিয়ে দেখলাম অপর্ণা মিত্রের চেয়ার ফাঁকা।
আমাদের অফিসটা ছোট। সব মিলিয়ে জনা পনেরো স্টাফ। তারমধ্যে পার্মানেন্ট স্টাফ বলতে আমি, বস ছাড়া আর তিনজন। বাকি সবাই কন্ট্যাক্টচুয়াল স্টাফ।
গ্রুপ ডি জীবনদাকে অপর্ণার কথা জিগ্যেস করতে বলল, "আসেনি।"
অপর্ণাও আসেনি? এদিকে স্যারও বাড়িতে না বলে কোথায় সটকেছেন!
কোনও যোগাযোগ আছে নাকি দুটো ঘটনার মধ্যে?
হ্যাঁ থাকতেই হবে। বসও আসেনি আর ওদিকে যে অপর্ণাকে কোনদিন অফিস কামাই করতে দেখিনি সেও আজ আশ্চর্যজনক ভাবে অনুপস্থিত!
কেস জন্ডিস মনে হচ্ছে! অপর্ণা সবসময় বসের সঙ্গে চিপকে থাকে! বস আর অপর্ণা ডেটিং-ফেটিংয়ে চলে গেছে সিওর।
এখন আমার কী করা উচিত? ম্যাডামকে কী সাবধান করে দেব?
হ্যাঁ বাঙালি হিসেবে সেটাই করা উচিত। আমরা অন্যকে অযাচিত উপদেশ দেওয়া পরম কর্তব্য বলে মনে করি।
স্যারের ল্যান্ডফোন থেকেই আবার ম্যাডামকে ফোন করলাম।
ম্যাডাম বললেন, "কলিং বেল বাজছে, কেউ এসেছে, কাজের মেয়ে নেই আমাকেই দরজা খুলতে হবে, আপনি যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।"
আমি বললাম, "হ্যাঁ ম্যাডাম, আসলে একটা জরুরি কথা বলার ছিল। মানে বলছি অপর্ণাকে তো জানেনই নিশ্চয়ই, খুবই সাংঘাতিক টাইপের। তাই বি কেয়ারফুল ম্যাডাম। অপর্ণা যেন স্যারকে কবজা করতে না পারে সেইদিকে কড়া নজর রাখতে হবে আপনাকে... নইলে আপনারই সর্বনাশ হবে..."
ম্যাডাম "আচ্ছা, ঠিক আছে" বলে ফোন কেটে দিলেন।
স্যারের চেম্বার থেকে বেরোতেই আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল! দেখি অপর্ণা মিত্র তার চেয়ারে বসে আছে।
যাহ্ বাবা এ আবার কখন এল?
আমাকে দেখেই অপর্ণা বলল, "ওহ্ যা ফেঁসেছিলাম আজ! বড় একটা ফাঁড়া গেল! মাস্কের দড়ির সঙ্গে অটোর হুক আটকে কান প্রায় ছিঁড়েই যাচ্ছিল। অনেকটা কেটে গেছে। একটা নার্সিং হোমে গিয়ে স্টিচ দিয়ে এলাম।"
আমি দেখলাম অপর্ণার কানে ব্যান্ডেজ।
আমার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠল। এই রে ম্যাডামকে, বস আর অপর্ণাকে নিয়ে খারাপ ইঙ্গিত দিয়েছি। স্যার যখন জানতে পারবেন, কী হবে আমার?
চাকরি যদিবা নাও যায়, বহুদূরে কোথাও ট্রান্সফার হবেই।
এসিতেও আমার সারা শরীর ঘামতে লাগল।
আমার ফোন বেজে উঠল। স্যারের ফোন। হয়ে গেল!
স্যার কিছু বলার আগে আমিই বললাম, "এখন কেমন আছেন স্যার?"
স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, "এখন বাড়িতে চলে এসেছি। অফিস যাওয়ার সময় রাস্তায় হঠাৎ পেট এমন মোচড় দিয়ে উঠল যে ড্রাইভারকে বললাম রাস্তাতেই এক বন্ধুর বাড়ি পড়ে সেখানে দাঁড় করাতে। তারপর দৌড়ে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে বার তিনেক ওয়াশরুমে যেতে শরীরটা ঠিক হল। ঘরে ফিরতে মিসেস বলল..."
আমি তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিয়ে বললাম, "পরে শুনব স্যার, এখন আপনি রেস্ট নিন। বেশি করে ওআরএস খান, নইলে ডিহাইড্রেশন হয়ে যেতে পারে!"
স্যার এক দাবড়ানি দিয়ে বললেন, "আরে থামুন তো। হ্যাঁ ঘরে ফিরতে মিসেস বলল..."
আমার বুকে এক হাজার ড্রাম একসঙ্গে বাজছে!
স্যার বলে যাচ্ছেন, "মিসেস বলল, ইমন বাবু খুব ভাল মানুষ। তোমার জন্য খুব চিন্তা করেন। করোনা কত সাংঘাতিক, করোনা যেন স্যারকে কবজা করতে না পারে সেদিকে আমাকে কড়া নজর রাখতে বললেন..."
করোনা!!! বলে কী! মানে ম্যাডামের কানে এখনও অল্প হলেও সমস্যা তাহলে আছে। অপর্ণাকে করোনা শুনেছেন!
স্যার বলে চলেছেন, "আপনার একটা টিএবিল আটকে আছে না? কাল অফিসে গিয়েই ওটা অ্যাপ্রুভ করে দেব...."
আমার মনের মধ্যে টেলিভশনের বিজ্ঞাপনের মত একটার পর একটা এক্লেয়ার্স চকলেট ফাটছে.....
