শক্তিরূপেন সংস্থিতা
শক্তিরূপেন সংস্থিতা


গোটা শহর জুড়ে পূজোর আমেজ। আজ দশমী প্রায় নব্বই শতাংশ বাঙালির মন খারাপ। আবার এক বছরের অপেক্ষা করে মা এর দেখা পাবে। বেহালা চৌরাস্তার মৌ এর ও মন খারাপ তাই সে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে নীল আকাশে ভাসা মেঘের আনাগোনা দেখছে। বারান্দা থেকে পাড়ার মণ্ডপ দেখা যায় তবে এই বছর তার পূজোটা কেমন যেন কাটলো। টেবিলের উপর রাখা ফোনটা বেজে উঠলো হঠাৎ মৌ এগিয়ে গিয়ে দেখলো তার ছোটবেলার বান্ধবী তরী ফোন করেছে।
- 'হ্যাঁ বল।'
- 'কিরে মৌ নিচে আসবি না? আর একটু পরেই তো ভাসান। আমি মণ্ডপে অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি আয়।'
- 'আমি যেতে পারবো না রে। তোরা থাক ওখানে। আমি রাখছি।' ফোন কেটে দেয় মৌ।
মৌ ওরফে মৌবানি দত্ত, মাথায় একরাশ চুল, মুখখানা এতটাই নিষ্পাপ এবং মিষ্টি যে হাতে একটা কলসী আর পাশে একটা পেঁচা থাকলে সবাই মৌ কে দেখে লক্ষী মানতে বাধ্য হবে। একাদশ শ্রেণীতে পড়ে মৌ বেহালার এক নাম করা স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছাত্রী মৌ। সর্বদা ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করে নতুন শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। ছোটবেলা থেকে মৌ কে তার মা নিজেই পড়িয়েছে তবে নবম শ্রেণী থেকে মৌ কে টিউশনে ভর্তি করিয়ে দেন মৌ এর বাবা, মা। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার সূত্রে মৌ শুরু থেকেই তার টিউশন স্যার অতনু-র ভারী পছন্দের হয়ে ওঠে। নবম ও দশম শ্রেণীতেও যথারীতি মৌ ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করে। একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হবার তখন বেশ কিছুদিন বাকি একদিন মৌ কে তার টিউশন শিক্ষক অতনু ফোন করে,
- 'মৌ আজ বিকেলে একবার ক্লাসে এসো।'
- 'আজ বিকেলে? কিন্তু স্যার এখনো তো আমাদের বই দেয়নি।'
- 'হ্যাঁ জানি বই দেয়নি তবে আগে থেকে নিজেকে তৈরি করতে হবে তো। আমার কাছে আগের বছরের কিছু নোট আছে সেগুলো তোমাকে দেবো তুমি মুখস্ত করো।
- 'আচ্ছা স্যার আমি তাহলে বিকেলে চলে যাবো।'
সেদিন মৌ এর শ্রদ্ধেয় স্যার অতনু এক অন্য উদেশ্য নিয়েই মৌ কে ডেকেছিল যেটা মৌ জানতে পারেনি।
- একি স্যার আপনি এটা কি করছেন? আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।
- আরে ভয় পাচ্ছো কেন মৌ। দেখো আজ বাড়িতে কেউ নেই। তোমার কাকিমা বাইরে গেছে। সামনের সপ্তাহ দিয়ে তোমার স্কুল শুরু হয়ে যাবে তখন আর এমন সুযোগ আসবে না। তুমি আমাকে পছন্দ করো সেটা আমি জানি।
- স্যার আমি আপনাকে আমার বাবার মত শ্রদ্ধা করি প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।
হঠাৎ কলিং বেল এর আওয়াজে মৌ এর চেতনা ফিরলো। দরজা খুলতেই মৌ দেখলো তরী দাঁড়িয়ে রয়েছে।
- কিরে পূজোর সময় ও এমন পাগলী সেজে ঘুরে বেড়াবি? নতুন জামা পড়ে চটপট আয় নীচে যাবো।
- আমি নিচে যাবো না রে তরী।
- কেন যাবিনা শুনি একটু?
- কাল বিকেলে তুই কাকু, কাকিমার সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছিলিস। মা ও মণ্ডপে কাজ করছিলো তাই ভাবলাম নিচে গিয়ে বসি কিছুক্ষন।
- তারপর?
মৌ এর চোখ টা ঝাঁপসা হয়ে এলো।
- 'ওই মেয়ে।'
- 'হ্যাঁ আন্টি আমাকে ডাকছেন?'
- 'হ্যাঁ তোমাকেই। ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?'
- 'মণ্ডপে কিছুক্ষন বসতে যাচ্ছি।'
- 'তোমার লজ্জা নেই না? এত কিছু হলো তারপর এত সাধারণ ভাবে ঘুরছো যেন কিছুই হয়নি।'
- 'আপনি এভাবে কেন বলছেন আমি কি করেছি?'
- 'তুমি কিছু করোনি? এক হাতে নিশ্চই কখনো তালি বাজে না। নিশ্চই তোমার উস্কানিতেই উনি তোমার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পেয়েছিল।'
তরী জোর করে মৌ কে নীচে নিয়ে গেল। মৌ মণ্ডপের কাছে যেতেই মণ্ডপে উপস্থিত সকলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মৌ এর মা মণ্ডপে সিঁদুর খেলার আয়োজন করছিল চারিপাশের এই আচমকা নিস্তব্ধে সেও ফিরে দেখলো মৌ কে ঘিরেই সেই নিস্তব্ধতা। মৌ এর মা এগিয়ে গেল তাদের দিকে।
- 'এই তরী ওকে নিয়ে এলি কেন আবার।'
- 'কেন ও আসবেনা
কেন কাকিমা?'
- 'না মানে...'
- 'মানে কি? তুমিও কি এটাই বলতে চাইছো যেটা ঘটেছে তাতে মৌ কে ঘর বন্দি হয়ে থাকতে হবে?'
- 'তরী সবাই তো তোর আমার মত ভাবে না রে মা।'
- 'না ভাবলে ভাবাতে হবে। আজ দুর্গা মায়ের বিসর্জনের সাথে কিছু মানুষের নিচু মানসিকতা বিসর্জন দেওয়ার ও প্রয়োজন।'
তরী এগিয়ে গেল মণ্ডপের ঠিক সামনে বানানো একটি স্টেজের দিকে। পূজোর কয়েকদিন ওদের পাড়ায় নাচ গানের অনুষ্ঠান হয় সেই স্টেজেরই মাইক এ পারার ক্লাবের সেক্রেটারি সিন্দুরখেলা আরম্ভ হওয়ার সময় ঘোষণা করেছিল। তরী স্টেজে উঠে সেই মাইক এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
- 'এখানে উপস্থিত বা অনুপস্থিত সকলকেই আমার প্রণাম। ছোটবেলা থেকেই আমাদের কে শেখানো হয় বড়দের সন্মান দিতে আর আমরা সেই বড়রা আদেও সেই সন্মান এর যোগ্য কিনা সেটা বিচার না করেই তাদের সন্মান দিতে শুরু করি। এখানে উপস্থিত আমার বান্ধবী মৌ, যাকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত আপনাদের এই পাড়ার শ্রেষ্ঠ মেয়ে বলে মনে হত আজ সেই মৌ আপনাদের চোখে এই পাড়ার কলঙ্ক হয়ে উঠেছে। আচ্ছা ওর দোষ টা কি? ওর দোষ এটাই যে ও ওর শিক্ষক কে নিজের বাবার মত শ্রদ্ধা করতো আর এতটাই বিশ্বাস করতো যে ওর মাথাতেও কখনো আসেনি যে এমন একটা ঘটনা ওর সাথে ঘটতে পারে? যেখানে ওর স্যার এর স্ত্রী আচমকা বাড়িতে ফিরে সমস্তটা দেখে নিজেই মৌ কে উদ্ধার করে তার স্বামীকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে সেখানে আপনারা কে মৌ কে বিচার করার?'
আশেপাশে উপস্থিত সকলের চোখ তখন স্টেজ এর দিকে। ততক্ষনে আরো অনেকেই পৌঁছে গেছে মণ্ডপের কাছে। তরী দেখলো ভিড়ের মাঝে সেই ভদ্রমহিলেটিও আছেন যে আগের দিন মৌ কে কিছু কথা শুনিয়েছিলেন। তরী আবার বলে উঠলো,
- 'কাকিমা আপনি আমার মায়ের মত। আপনাকে একটা কথা বলছি, একজন মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের পাশে না থাকতে পারেন অন্তত তাকে অপমানটা করবেন না। আজকাল একজন ধর্ষিতা কে এমন নজরে দেখা হয় যেন সমস্ত ঘটনাটার দায় তার একার। আচ্ছা আপনার মেয়ে তনিমাদির ও তো ব্রেকআপ হয়ে গেছে দীপ্তদার সাথে। যেহেতু ওরা আমার স্কুলেই পড়ে তাই জানি আর কি। তা এত বছর এর সম্পর্কে ওদের প্রেমটাও নিশ্চই অনেক দূর গড়িয়েছিল। কি তনিমাদি? কাকিমা কে বলোনি বুঝি যে প্রত্যেক রবিবার তুমি দীপ্তদার বাড়িতে যেতে যখন দীপ্তদার মা, বাবা কেউ বাড়িতে থাকতো না?'
- 'আহ তরী কি করছিস নেমে আয়।'
- 'না মৌ আজ না। তা কাকিমা একটা মেয়ে যখন নিজের ইচ্ছায় নিজের সবটুকু উজাড় করে একজন কে ভালোবাসে এবং কোনো কারণে যখন সেই সম্পর্ক টা টেকে না তখন তো আপনারা সেই মেয়েটার দিকে এমন ভাবে তাকান না? আজকাল তো অনেকে লিভ ইন করার পরেও সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলে। তাদের কে তো আমরা খুব সহজেই মেনে নি? কারণ তারা ভালোবাসার নাম করে সেই জিনিসগুলো করে যেটা মৌ এর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর শিক্ষক ওর সাথে করতে চেয়েছিল। হ্যাঁ আজ তার স্ত্রী ঘটনাস্থলে না পৌঁছালে হয়তো সে সফল ও হয়ে যেত। ভাবতে খুব অবাক লাগে জানেন যেখানে ওনার স্ত্রী এর মত মানুষ ও এই পৃথিবীতে আছে সেখানে আপনাদের মত কিছু মানুষ ও আছে যারা সব কিছুর জন্য একজন মেয়েকেই দায়ী করেন। পারলে আজ মায়ের ভাসানের সাথে নিজেদের এই মানসিকতাগুলো কেও ভাসিয়েদিন আর যদি না পারেন তবে দয়া করে মায়ের মূর্তির সামনে হাত জোড় করে আশীর্বাদ চাইবেন না। যে দেশে রক্ত মাংসের দেবীদের দিনের পর দিন অপমান করা হয় সেই দেশে মুর্তিরূপী ঠাকুরকে পূজো করার কোনো মানে হয়না।'
তরী স্টেজ থেকে নেমে মৌ এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আগের দিন যে মহিলাটি মৌ কে অপমান করেছিল সে মৌ এর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলো। আস্তে আস্তে সিঁদুর খেলা শুরু হয়ে গেল। পাড়ার সমস্ত মহিলারা মৌ এর গালে কপালে সিঁদুর লাগিয়ে দিল। দশমীর শেষ বেলায় পৌঁছে মৌ কে স্বয়ং দেবী দূর্গা মনে হলো।