শিক্ষক
শিক্ষক
শ্রী ভবতোষ ভট্টাচার্য্যকে চেনে না ; এই শহরে তেমন কাউকে পাওয়া যাবে না । গান্ধীস্মৃতি বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ভবতোষ বাবু অবসরের পরও নিজ বাটিতে বিনামূল্যে শিক্ষা দিয়ে চলেছেন আজ দশবছর ধরে ।
সেই সৌম্য মূর্তি ; গোল গোল কাঁচের চশমায় এখনও আগেকার দ্যুতি খেলা করে । পরিবর্তন শুধু চুলে - এক মাথা সাদা চুলে বেশ প্রাজ্ঞবিজ্ঞ মনে হয় ।
খাওয়া দাওয়া সংযত এবং অপরিবর্তিত। তবু কোথায় যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে - মেজাজটা আজকাল একটু খিটখিটে হয়ে গেছে ।
বিপত্নীক এই শিক্ষকের কিন্তু সন্তানতুল্য ছাত্রদের নিয়ে খুব গর্বিত ।
কন্যা প্রসন্ন কুমারী যেমন আগেও দেখেছে ছাত্র অন্ত:প্রাণ পিতাকে , এখনও তিনি তেমনই রয়ে গেছেন। অথচ মেজাজ যাচ্ছে বদলে ।
কন্যাটি একদিন তার পিতাকে বলে - বাবা ! একটা কথা বলি -----
কেউ তাঁকে কিছু বলুক তিনি তা সহ্য করতে পারেন না । কন্যার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হল না ।
বিস্মিত হলেন ভবতোষ । হয়তো ক্ষুব্ধও । স্কুল জীবনে প্রধান শিক্ষকও তাঁর কথা মানতেন। কোনদিন কোন অনুজ্ঞা করেননি । আজ কি না যে মেয়েকে জন্ম দিয়েছেন তার কথা শুনতে হবে !
- যা বলবি বল কিন্তু জ্ঞান দিবি না । বিয়ে হবার পর তোর আজকাল ওই স্বভাবটা বেড়েছে।
প্রসন্ন বলে - ইদানিং তোমার মেজাজ দিনকে দিন চড়ে যাচ্ছে । কোন নি কোন ছাত্র এবসেন্ট হলেই তোমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে । তার চেয়ে বলি কি জানো ---
- হুমম্ বল শুনি।
- বাবা তোমার জ্ঞানগম্যি তো কম নয় । গল্প , কবিতা কিছু লিখো না ! আর হ্যাঁ, তুমি ফেসবুক কর না কেন ?
- কি বুক ?
- ফেসবুক ।
- আমি তো ওসব জানিনে রে ।
- সব জেনে যাবে । আজই একটা একাউন্ট খুলে দিচ্ছি ।
- না না মা থাক । পেনশনের টাকায় চালিয়ে যাচ্ছি কোনরকম। আবার একটা নতুন একাউন্ট - মানে - কত খরচ হবে শুনি !
প্রসন্ন হাসল ।
- বাবা ! এটা কোন ব্যাঙ্ক একাউন্ট নয় যে খরচ হবে
এটা এক এমন একাউন্ট ব্যাকের লকারের মত । তোমার গল্প , কবিতা লিখে ওখানে পোস্ট করে দিলে দেখবে হাজার হাজার মানুষ তোমার ভক্ত হয়ে উঠবে। এ জন্য কারও একটি পয়সাও খরচ হবে না।
- সে তো বুঝলাম । কিন্তু আমি কি পারব ?
- আলবাত পারবে । আমি এখনই একাউন্ট খুলে দিচ্ছি।
আর আজ তোমাকে সব শিখিয়ে দেব।
হাসলেন ভবতোষ বাবু । আজ তাঁকে তাঁরই কন্যার কাছে হাতেখড়ি নিতে হবে । জীবন কি বিচিত্র ।
ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিল কন্যা । সব কিছু দেখিয়ে শিখিয়েও দিল । তবু ভুল করলেন ভবতোষ বাবু । অজানা অচেনা অনেকেই ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় ; তিনি নির্বিচারে এক্সেপ্ট করে যান । দেখতে দেখতে তাঁর বন্ধু সংখ্যা সীমায় পৌঁছে যেতেই শুরু হয় খেলা ।
ভবতোষ বাবুর ফ্রেণ্ডলিস্টে আট থেকে আশি সবাই আছে। আর তিনি নিজে গর্ব বোধ করেন । দু'চারটে গল্প কবিতা পোস্ট করেন । ভীষণ সুন্দর লেখা। অনেকেই রি- অ্যাক্ট করে ।
একদিন তিনি বাড়িতে ভাতঘুম দিচ্ছেন । হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল ।
ফোন তুলতেই অপর প্রান্তের জমজমাটি কন্ঠস্বর - হ্যালো ! আই এম রাকেশ আস্থানা স্পিকিং ফ্রম দেহলি পুলিশ ক্রাইম ব্রাঞ্চ।
পুলিশ, ক্রাইম ব্রাঞ্চ - ভবতোষ বাবুর মুখ শুকিয়ে গেল ।
এরপর অপর প্রান্ত বলতে লাগল - আচ্ছা জী! তো আপ হি হ্যায় ও বেত্তমিজ । বুঢ়াপ্পা মে ভি ইতনা শখ ।
ভবতোষ বাবু আরও ঘাবড়ে গেলেন ।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন - আপ কৌন হ্যায় সার ?
- ম্যায় দেহলী পুলিশ কা কমিশনার রাকেশ আস্থানা বোলতা হুঁ। সামওয়ান ইউটিউবার আপকা নামপর হি এক কমপ্লেন দর্জ কিয়া ।
ভবতোষ বাবু হিন্দিতে তেমন অভ্যস্ত নন । তবে বুঝতে পারেন ।
- কমপ্লেন ? কিস বারে মে ?
- ফিলহাল আপকে সাথ পূজা নামকি কোই লড়কি সে চ্যাট হুয়া থা ?
- হাঁ , হুয়া তো থা । এক লড়কি মেরা কবিতা পড়কে খুশ হুই তো বধাই দিয়া ।
- সমঝ গয়া । ও লড়কি ইউটিউব পর আপকা এক অশ্লীল ভিডিও পোস্ট করকে সব কো বোলা ভিডিও ভাইরাল করনে কে লিয়ে । আপকা পতা হ্যায় সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট কেয়া হোগা অগর উস ভিডিও চালু হো যায়ে তোৎ?
- ম্যায়নে তো এয়সা কুছ নেহি কিয়া !
বিস্ময় প্রকাশ করেন ভবতোষ বাবু ।
- কুছ নেহি কিয়া? লেকিন ও ভিডিও স্ক্যিপ্ট অভিভি মেরে টেবল পর হ্যায় । ইস নাম্বার পে হোয়াটস অ্যাপ হ্যায় আপকা ?
- হ্যায় ।
- তো ভেজু ভিডিও।
মিঃ আস্থানা ভিডিও পাঠিয়ে দিলেন। ভবতোষ বাবুর ভিডিও দেখে অজ্ঞান হয়ে যাবার দশা । কোনমতে সামলে ফোনে বললেন - ইয়ে ঝুটা হ্যায় ।
- অভিভি কহ রহা হো ঝুটা হ্যায় ? ঠিক হ্যায় তো লিগেল কারবাই করে ? অগর আপ লড়েঙ্গে তো লড়কিকো জলদি হি পকড় লিয়া যায়েগা। অউর আপ নেহি চাহতে হ্যায় তো ম্যায় ইউটিউবার কো বোল দেতা হুঁ; ও আপকা সাথ বাত করেঙ্গে । দেখিয়ে ও কেয়া বোলতা হ্যায়; আপ উসে বোলিয়ে ইউটিউব সে ভিডিও ডিলিট করনে কে লি
য়ে ।
ফোন কেটে গেল । দুশ্চিন্তা গ্রাস করল মনে । ভবতোষ বাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ।
এক মিনিট, দু'মিনিট ---- সময় যায় । আবার ফোন বাজে । ভবতোষ বাবু কথা বলে জানতে পারেন ফেক ভিডিও ডিলিট করতে হলে ষাট হাজার একশ পঁচাশি টাকা ওর একাউন্টে জমা করতে হবে ।
একাউন্ট ডিটেইলস পাঠিয়ে দেওয়া হয় । ভবতোষ বাবুর এবার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করে ।
ভবতোষ বাবু বিপদে পড়লে মেয়ের পরামর্শ নেন। এক্ষেত্রে লজ্জায় তিনি মেয়েকে ছেড়ে সরাসরি চেনাজানা উকিলকে ফোন করে ঘটনাটা বললেন ।
- তাহলে কি আমায় থানায় যেতে হবে ?
- কেন যাবেন ? আপনি তো কিছু করেননি। থানা পুলিশ ওদেরই করতে দিন । আর অজানা অচেনা লোকগুলোকে ফ্রেণ্ডলিস্ট থেকে ব্লক করুন ।
তার পরও অনেক বার ফোন আসে । এক সময় ফোন সুইচ অফ করে দেন ।
প্রসন্ন বাবার ফোন সুইচড অফ জেনে ঘাবড়ে গিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে ।
অনেক জোরাজুরি করার পর প্রসন্ন জানতে পারে রাকেশ আস্থানার নাম । ফোন খুলে দেখে ট্রু-কলার বলছে ফোন এসেছিল দিল্লী থেকে । করেছিল রাকেশ আস্থানা যে এখন দিল্লী পুলিশের ডি জি । ছবিতে হুবহু রাকেশ আস্থানার পুলিশের বেশে দাড়ি কামানো , গোঁফ কামানো এক পরিচিত মুখ ।
মেয়ে এবার হেসে গড়িয়ে পড়ল ।
- বাবা ! এই ভদ্রলোক তোমাকে ফোন করেথে ?
- হ্যাঁ - এইই তো !
- এ কে জানো ? মিঃ রাকেশ আস্থানা । দিল্লী পুলিশের ডি জি । আর তিনি সরাসরি তোমাকে ফোন করবেন ?
- কেন! করতে পারেন না ? উল্টে প্রশ্ন করেন ভবতোষ বাবু।
- বাবা ! এত বড় অফিসার। দিললী পুলিশের ডাইরেক্টর জেনারেল । তিনি একজন সাধারণ লোককে ফোন করবেন - এটা প্রোঠোকলের বাইরে । যেমন ধর তুমি । সরকারি চাকরি করতে - তুমি কি বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারতে ? প্রপার চ্যানেলে যোগাযোগ করতে হত । তেমনি রাকেশ আস্থানাও ফোন করতে পারেন না প্রোটোকল ভেঙে । এটা ভুয়ো ফোন।
- না মা , আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ।
- আচ্ছা , ঠিক আছে । তুমি এক কাজ কর ।
- কি ?
- রমেশ দত্ত - নামটা মনে আছে ? সেই যে তোমার অতিপ্রিয় ছাত্রটি । বখাটে হয়ে গিয়েও তোমাকে কি সম্মানটাই না করত ---
- হাঁ হাঁ মনে পড়েছে । ওর কিছু আবর আছে নাকি ?
প্রসন্ন হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পাচ্ছে না ।
ভবতোষ বাবু বললেন - ও রমেশ - মানে আমাদের রমা - ও তো এখন মিনিস্টার হয়ে মহাকরণে বসে ।
- একদমই । কই ? ওকে ফোনে ধর দেখিনি ! পাবে না ।
আরে করেই দেখ না ।
ভবতোষ বাবু রমেশের ফোন নং খুঁজে পেলেন না ।
কন্যা বলল - দাঁড়াও গুগল সার্চ করে দেখি ।
তারপর রমেশের নং লাগিয়ে দিতে অন্য দিক থেকে হ্যালো গুড মর্নিং বলতে না বলতেই ভবতোষ বাবু বললেন - রমেশ বলছ ?
- কে রমেশ - আমি স্যারের পি এ বলছি ।
- একবার ফোনটা ওকে দাও না মা । একটু কথা বলি ।
- শুনুন ! এটা আপনার বাড়ি না । আপনাকে এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে ।
এরপরে প্রতি সপ্তাহে এপয়েন্টমেন্ট নিয়েও রমেশের নাগাল পান না ভবতোষ বাবু । মহাকরণে যান আর ফিরে আসেন । কিছু না কিছু একটা অজুহাত দেখিয়ে দেয় পি এ ।
ভবতোষ বাবু মনে করলেন এরা বদমায়েশি করছে । মহাকরণের অলিন্দে ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখলেন একটা কক্ষের দরজায় পেতলের সাইনবোর্ড। তাতে লেখা শ্রী রমেশ কুমার দত্ত মন্ত্রী-
ভবতোষ দরজায় এসে দাঁড়ালেন । কপাট ফাঁক করে দেখলেন রমেশ - রমেশই তো - সিগারেট ফুঁকছে বসে বসে। আর সিলিং এর দিকে মুখ উঁচিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে।
আর দ্বিধা করলেন না । পর্দা সরিয়ে গটগট করে ঢুকে পড়লেন ।
পি এ দৌড়ে এসে ভবতোষ বাবুকে ধরে ফেলল ।
- করেন কি? চলুন । এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসবেন ।
প্রায় ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছিল । রমেশ ভবতোষ বাবুর মুখ দেখে চিনতে পারল ।
- আরে আরে মাস্টারমশাই যে ! ছেড়ে দিন।
ভবতোষ বাবুর চোখে জল চলে এল । সেই রমেশ তাকে চিনতে পেরেছে।
বললেন - আমি জানতাম, তুমি এমন ধারারই ছেলে। সব প্রোটোকল ভেঙে দিতে পার ।
রমেশ দত্ত - কি ব্যাপার মাস্টার মশাই ? আপনি হঠাৎ আমাকে শরণ করেছেন ? কোন বিফদ হয়নি তো ?
ভবতোষ বাবু চোখ মুছতে মুছতে বললেন - না না বাবা, কোন বিপদ আপদ হয়নি । এমনি দেখা করব বলে এলাম ।
- এমনি ? আপনার কি মাথা খারাপ আছে ? এমনি এমনি আমার সঙ্গে দেখা করে আমার অমূল্য সময়টা নষ্ট করলেন ? আপনি তো আজব মানুষ মশাই ! এই সিকিউরিটি কি করছ তোমরা ?
ভবতোষ বাবূ তাঁর অপরাধ কবুল করলেন এবং চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন ।
তাঁর মনে ঝড় বয়ে গেল । কি না করেছেন তিনি এই রমেশের জন্য ! খাওয়া দাওয়া পরিধান শিক্ষাদান - নাহ্ এবার তাঁকে নতুন করে পাঠ নিতে হবে কন্যার কাছে। আধুনিক মানসিকতার সাথে পরিচিত হতে হবে । কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকার চেয়ে মরেই সুখ । মেয়েকে বেশীদূর লেখা পড়া করাননি । আর যাকে করিয়েছি তার মর্য্যাদাবোধ নেই ।
( শেষ )