শহিদের স্ত্রী
শহিদের স্ত্রী
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীরাধা। মুখে কোন বিকার নেই, দেখে বোঝা যাচ্ছে না ওর ভিতরে কি ঝড় বয়ে চলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে শ্বাশুড়িমা বনানী আর ননদিনী কেয়া। তারা নিঃশব্দে চোখের জলে ভাসছে। সারা গ্রামের লোক আজ ওদের দরজায় কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই, সব নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ আগে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কফিন বন্দি হয়ে এসে পৌঁছেছে রাতুলের দেহ। আর্মির উচ্চপদস্থ অফিসাররা দাঁড়িয়ে আছেন, শেষ সম্মানটুকু জানানো চলেছে। কিন্তু শ্রীর মনে তখন ঘুরে চলেছে ওর জীবনের বিশেষ ঘটনার স্মৃতি গাঁথা ছবি।
রাতুলের সাথে ওর আলাপ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে। রাতুল ওর এক স্কুল বন্ধুর আর্মি ডিপার্টমেন্টের কলিগ। আলাপের পরই রাতুল ওকে ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল “যদি সময় সুযোগ করে একবারও ফোন করেন ভালো লাগবে কারণ যেখানে কাজ করি সবসময় বাড়ি যাওয়ার সুযোগ ঘটে না। বাড়ির লোকের সাথেও সেই ফোনের মাধ্যমে সম্পর্ক জিইয়ে রাখি। বেশি বন্ধুবান্ধব নেই তাই বান্ধবী হিসেবে আপনি যোগাযোগ রাখলে ভালো লাগবে”
শ্রী হেসে বলেছিল “ঠিক আছে, চেষ্টা করবো শুধু আপনার ডিউটি আওয়ারগুলো জানা থাকলে ভালো হয়”
“এক্ষুনি জানিয়ে দিচ্ছি, আর অপেক্ষা করবো ফোনের”
“ঠিক আছে চেষ্টা করবো” অন্য কেউ হলে হয়তো ফোন করতোই না কিন্তু রাতুলের অনুরোধটা উপেক্ষা করতে পারলো না ও। ডিউটির সময় বুঝে একদিন সকালে ফোন করলো। রাতুল বোধহয় তখন সবে মাঠ থেকে ফিরেছে এক্সারসাইজ করে বা দৌড়ে। ফোন ধরতে শ্রী বলল “সুপ্রভাত”
রাতুলের গলায় যেন খুশি উপচে পড়লো “আপনি! কি সৌভাগ্য আমার। আমি তো আশাই ছেড়ে দিচ্ছিলাম আপনার ফোনের অপেক্ষা করতে গিয়ে”
“অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়”
“তাই... তাহলে তো আমাকেও একবার চেষ্টা করতে হবে”
“কীসের চেষ্টা?”
“পরে বলবো। তা কি করছেন আপনি?”
“চা খাচ্ছি। এবার কলেজ যাবো। আর আপনি?”
“ফোনের ওপারে আমার জোরেজোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার আওয়াজ বুঝতে পারছেন না? এই মাঠ থেকে ফিরলাম। এবার দিনের বাকি কাজ শুরু হবে”
“বেশ তাহলে আপনি আপনার কাজে যান আমি আমার কলেজ”
“হ্যাঁ পরে কথা বলবো। এটা আপনার নম্বর তো, সেভ করে রাখলাম”
কথার স্রোত বয়ে চলল কখনো এদিক থেকে ওদিক আবার ওদিক থেকে এদিক। এক রাতে গল্পের মাঝে রাতুল বলে বসলো “আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি শ্রী। তোমাকে ছাড়া এখন সব অন্ধকার দেখছি যে। তুমি তাড়াতাড়ি এসে এই প্রেমে পাগল প্রেমিকের হাত ধরো নাহলে যে আমি হারিয়ে যাচ্ছি”
ফোনের এপাশে তখন শ্রী লজ্জায় লাল হচ্ছে। তবু রাতুলের চাপাচাপিতে বলল “হাত ধরতে তো অসুবিধে নেই কিন্তু বাবা মাকে জানাও সব তবে না”
রাতুল আর একদিনও সময় নেয়নি, ওর মাকে জানিয়ে বলেছে শ্রীর বাবা মায়ের মতামত নিয়ে নিতে। এক মাসের মধ্যে পাকা দেখা পাকা কথা থেকে বিয়ে সব হয়ে গেলো। মধুচন্দ্রিমা করতে ওরা গেলো একদিনের জন্য দিঘা। ছুটি তো আর নেই, রাতুল ফিরে গেলো কাজের জায়গায়। আবার সেই ফোনে কথার স্রোত বয়ে চলল।
একরাতে গল্প করার সময় শ্রী বলল “আর কতদিন এভাবে আলাদা হয়ে থাকবো বল না”
“অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় তুমিই বলেছিলে না”
“তাতো বলেছিলাম কিন্তু সেটা আমার দিকেই আবার ঘুরে আসবে তা ভাবিনি তো”
“অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে। কাল আমাদের একটা স্পেশ্যাল ডিউটি আছে, ওটা শেষ করেই তোমার কাছে আসছি আমি। এবার তোমার জন্য একটা জ্যান্ত পুতুলের ব্যবস্থা করবো”
“যাহ্”
কিন্তু রাতুল এলো সশরীরে নয় অন্যের কাঁধে চেপে।
শ্রী রাতুলের কফিনের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে বলল আমার জ্যান্ত পুতুল দিয়ে তো গেলে না। এখন আমার সময় কাটবে কি করে। এভাবে আমাকে অনন্তকালের জন্য অপেক্ষায় রেখে গেলে! এই কি তোমার ভালোবাসা নাকি প্রতিশোধ, সেই যে তুমি নেবে বলেছিলে ফোন করিনি বলে? জানো মা আমার জন্মের পর নাম রেখেছিল রাধা। দিদা শুনেই বলেছিল বদলে দে এখনি বদলে দে। এই নামের মেয়েরা কৃষ্ণ প্রিয়া রাধার মতো সুখী হয় না। মা পাল্টে রাখলো শ্রীরাধা। কিন্তু রাধার বিরহ তো আমার অঙ্গের সাথে জুড়ে গেলো। কৃষ্ণ মথুরাবাসীদের বাঁচাতে রাধাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আর ফেরেননি, তুমিও আমাদের সুরক্ষিত রাখতে চলে গেলে আর ফিরলে না। তোমার জন্য গর্ব হচ্ছে কিন্তু কান্নাও পাচ্ছে। তবু চেপে আছি দাঁতে ঠোঁট কামড়ে। শহিদ বীরদের জন্য চোখের জল ফেলতে নেই যে!