শেষ উষ্ণতা
শেষ উষ্ণতা
শেষ উষ্ণতা
কলমে - কৃষ্ণ ব্যানার্জী
( 20/04/2023 )
আমাদের ডাক্তারদের জীবনটা কতোটা কঠিন তা শুধু আমরাই জানি। অনেকেই হয়তো অনেক কিছু বলেন বা ভাবেন আমাদের কিন্তু আমাদের জায়গাই দাঁড়িয়ে কেউ একটি বারের জন্য ভাবেন না। কিছু ডাক্তারের জন্য সমগ্র ডাক্তার সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে এই বিক্রিত মতামত তৈরি হয়। কিন্তু যে সকল ডাক্তার মনে প্রাণ দিয়ে এটাই বিশ্বাস করেন একজন পিড়িত, রোগগ্রস্থ, মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তিকে তার দেহের শেষ উষ্ণতা থাকা পর্যন্ত প্রাণপণে চেষ্টা করেন তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে। কখনো সফল হয় আবার কখনো বিষয়টা নাগালের বাইরে চলে যায়। আমরা অনুতপ্ত হই, কখনো কখনো অনুতাপ এতটাই গভীর হয়ে ওঠে যে আমরাও আমাদের অপারকতার জন্য দিনেরপর দিন অনুতাপ প্রকাশ করি কারণ আমাদের লড়াই ততক্ষণ পর্যন্ত চলে যতখন পিড়িতের দেহের শেষ উষ্ণতা রয়েছে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করে চলি আমরা। যাক এবার আসল গল্পে ফিরি।
সেদিন সকাল সাতটায় সময় আমার একটা ওটি ছিলো। আমি ওটি করে বেড়িয়ে রাউন্ডে যাব মেডিকেল ওয়ার্ডে। আমার আজো মনে আছে সেদিন ওটি করতে দুইঘন্টা সময় লেগেছিল। ওটিতে আমরা যে তিনজন ডাক্তার ছিলাম তারা প্রত্যেকেই খুব আনন্দিত ছিলাম এই ভেবে যে আজকের অপারেশনটা 200% সফল। পোষাক ছেড়ে বেড়িয়ে আমাদের যে রেস্ট রুমটা রয়েছে সেখানে গিয়ে একটু চায়ের অওডার করে গোল টেবিলকে ঘিরে সাজানো চেয়ারে বেশ আরাম করেই বসলাম। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে চা এসে উপস্থিত হয় আমাদের টেবিলে। সবে এক চুমুক চা পান করেছি হঠাৎ এমার্জেন্সি থেকে একটি ওয়াচমেন ছুটতে ছুটতে এসে বলে ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি চলুন একটি বাচ্চা এসেছে প্রচন্ড খারাপ অবস্থা আপনাকে ফোন করা হচ্ছিলো পাওয়া গেলনা বলেই ছুটে এলাম। এটা আমার খুব খারাপ অথবা ভালো একটি অভ্যাস যে ওটি চলা কালিন আমার ফোনটা বন্ধ থাকে যদিও ওটি শেষ করেই আবার সেটা অন করেদেই আমি কোন কারণ বসত আজ সেটা অন করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আজো আমি নিজের কাছে প্রচন্ড অনুতপ্ত এই ভেবে যদি সেদিন আমার ফোনটা খোলা থাকত তাহলে হয়তো বাচ্চাটিকে আরো কয়েক মিনিট সময় দিতে পারতাম তাতে হয়তো জীবন দিতে পারতাম আর সেই কারণে আমি নিজের কাছে আজও অপরাধী।
খবরটা পাবার সাথে সাথেই আমরা তিনজনই চায়ের কাপ টেবিলে নাবিয়ে রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম একটি ফুলের মতো ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে বেডে শোয়ান রয়েছে। বয়স মেরে কেটে দশ। দেহের উত্তাপ 104 ডিগ্রির কাছাকাছি অথবা সামান্য অধিক। মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে একটি সুন্দর পুতুলের মতো। সেই সময় তাপমাত্রা মাপের অবকাশ না থাকার ফলে নার্সকে সেলাইন চালিয়ে তারমধ্যে জ্বর নাবাবার ঔষধ মিশিয়ে চালাতে বললাম। কথামতোই কাজ হলো, তারপর তাকে ভেন্ডিলেশনে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। আধাঘন্টা পর মনে হলো মেয়েটি বোধহয় চিকিৎসায় সারাদিচ্ছে। মেয়েটি এবার চুখ খুলল। আমরা মনে মনে ভাবলাম মেয়েটি এযাত্রা প্রাণ ফিরে পেল। বাইরে থেকে বাড়ির লোকজন ভিতরে তাকাতে সে হালকা করে হাত নেড়ে তাদের বোঝাতে চাইল সে এখন ঠিক রয়েছে। আমরা যার যার ওয়ার্ডে রাউন্ডে চলে গেলাম। কয়েকটি পেশেন্ট দেখা হয়েছে মাত্র এমন সময় আবার ফোন এলো মেয়েটি চিকিৎসায় সারা দিচ্ছেনা। আবার ছুটে এলাম। এলাম বটে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না কয়েক মুহুর্তের মধ্যে ঠিক কি ঘটলো। দেহের উত্তাপ তখনও শেষ হয়ে যায়নি। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করলাম ছোট্ট বাচ্চাটির বুকের উপর পাম্প করে রক্ত চলাচলকে স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করে গেলাম মেয়েটির দেহের শেষ উষ্ণতা পযর্ন্ত। শেষ রক্ষা করতে পারলামনা। অবশেষে তার দেহের শেষ উষ্ণতাটুকুও হারিয়ে গেল। ধিরে ধিরে শীতল হয়েগেল তার দেহটা।
সেই মুহুর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিল আমার, মনে হচ্ছিলো সকল শিক্ষা বেকার। একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে যে কিনা পৃথিবীর কিছুমাত্র দেখেনি আমার এতদিনের প্রাকটিশ কোন কাজেই লাগলনা সেই মুহুর্তে। তারপর এক সপ্তাহ আমি হসপিটালে আসতে পারলামনা। মনথেকে নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছিলো বারবার। আজও জানতেই পারলামনা ঠিক কি হয়েছিল ছোট্ট মেয়েটির। আমার স্ত্রী আমাকে অনেক করে বোঝাল যে যেটা ঘটবার সেটা ঘটবেই ভবিতব্যের উর্ধে কিছুই নয়। নিয়তি যদি থেকে থাকে তাকে আটকাবার খমতা ভগবানের নেই সেখানে তুমি একজন মানুষ। একটা যুদ্ধে হেরে তুমি যদি থেমে যাও তাহলে জীবন যুদ্ধে তুমি একজন পরাজিত সৈনিক হয়েই থেকে যাবে। বৌয়ের কথাটা পিনের মতো বিধেছিল বুকে আমি আবার হসপিটালে যেতে শুরু করলাম। প্রায় দশবছর কেটে গিয়েছে এমন দুঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি আমাকে, তবে কোনো একটা স্থান থেকে আজো নিজেকে অপরাধী বলেই মনে হয়।
🙏 সমাপ্ত 🙏
( উক্ত গল্পটির সাথে বাস্তব কোনো চরিত্রের মিল নেই, দয়াকরে এটিকে গল্প হিসেবেই গ্রহন করবেন। বানান ভুল থাকতে পারে তাই আগেথেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।)
