Debdutta Banerjee

Thriller

3.2  

Debdutta Banerjee

Thriller

সবুজ দ্বীপের রহস‍্য

সবুজ দ্বীপের রহস‍্য

5 mins
1.1K


উথাল পাথাল ঢেউয়ের মাঝে একভাবে হাল ধরে বসেছিল বিজন। দুদিন হয়ে গেলো ঝড় আর থামার নাম নিচ্ছে না। কার মুখ দেখে যে এবার সাগরে নেমেছিল ওরা!!

সরকারের তরফেও তেমন কোনো ঘোষনা ছিল না। শ্রাবণের শেষেও এবার তেমন রুপালি শস‍্য ওঠেনি ওদের জালে। কানাই, মোহন, মদনা সবাই কারী কারী রুপালি মাছ নিয়ে ফিরেছে। নিজের ছোট নৌকাটা নিয়ে মাত্র দুজনকে নিয়ে জলে নেমেছিল বিজন। দু দিন ভর ঘুরেও মনের মত মাছ পায়নি। একটু সাহস করেই সাগরের এদিকটায় এসেছিল। জন্মের থেকেই বিজন এই সাগরকে নিজের হাতের তালুর মত চেনে। কিন্তু এবার সব হিসাব গন্ডগোল হয়ে গেছিল যেন। চারদিনের দিন একবার দেখা দিয়েছিল ঐ রূপার ঝাঁক। পবন আর জামিরুলকে নিয়ে ওদের পেছনে ছুটেছিল বিজন। পশ্চিম আকাশে যে একটা ধুসর কালো দৈত‍্য আস্তে আস্তে শক্তি সঞ্চয় করছে দেখেও পাত্তা দেয়নি, ও। গাঙের দেশের লোকেরা ঐ শত্তুরকে ভয় করে না। কিন্তু মাঝ রাতে দৈত‍্যটা যখন সব আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন ওরা তিনজনেই ভয়ে ঠকঠক করে কেঁপেছিল। ওদের ছোট্ট নৌকাটা উথাল পাথাল ঢেউ-এর মাথায় মোচার খোলার মত দুলছিল। পাল গুটাবার আগেই ছিড়ে চলে গেছিল। শক্ত হালটা ধরে দাঁড়িয়েছিল বলে বিজন ছিটকে পড়েনি। জামিরুল আর পবন ছিটকে গেছিল জলে। কে জানে উত্তাল সমুদ্রের বুকে ওরা কোনো ঠাই পেল কি না। তবে টানা বহুক্ষণ ওরা নিজেদের জলে ভাসিয়ে রাখতে পারবে বিজন জানে। হয়ত ওরা ভালো কোনো বোট পেয়ে গেছে এতক্ষণে। হয়তো ফিরতে লেগেছে ঘরের পানে। বিজন নিজের ছোট্ট নৌকা আঁকরে পড়ে রয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে। খাবার, জল, কিছুই আর নেই অবশিষ্ট। 

ভোর রাতের দিকে ঝড়ের তান্ডব কমে আসতেই দূরে এই সবুজ দ্বীপটা চোখে পড়েছিল ওঁর। প্রথমে একটু ঘাবরে গেলেও পরে আনন্দ হয়েছিল ভূখন্ডটা দেখে। তবে ও যে নিজের চেনা গন্ডির বাইরে চলে এসেছে বুঝতে পেরেছিল। কারন ওর চেনা সমুদ্রে এমন কোনো দ্বীপ নেই। 

আপাতত ভূখন্ডটায় গিয়ে পৌঁছনোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে বিজন। একা ঐ অশান্ত সমুদ্রে হাল ধরে থেকে হাত দুটো ছিড়ে যাওয়ার জোগাড়। অবশেষে ও পৌঁছে যায় ঐ একটুকরো সবুজের কাছে। দীর্ঘ সময় ঘোলাটে লবনাক্ত জল দেখে দেখে চোখ দুটো ক্লান্ত, ঐ এক টুকরো সবুজ দেখে ও তৃপ্ত হয়। 

বালির চড়ায় নৌকাটাকে টেনে তুলতে ঘাম ছুটে যায়। একটা শুকনো গাছের গুড়িতে কাছাটা বেঁধে নেমে আসে বিজন। দ্বীপটা বেশ বড়, ঢেউ খেলানো জমি উঠে গেছে ধাপে ধাপে। নারকেল গাছের সারির ফাঁঁকে ঝোপ জঙ্গলে ঢাকা উপত‍্যকায় মানুষের চিহ্ন নেই। আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে ও। প্রথম টিলাটায় উঠে যতদূর নজর যায় দেখে, না, জনবসতি বা জন্তু জানোয়ার চোখে পড়ে না। এই দ্বীপে মানুষ থাকে না। আপাতত খাওয়ার জল আর কিছু খাবার জোগাড় করা দরকার। ঝুনো নারকেল পড়ে রয়েছে বেশ কিছু। একটা নারকেল ভেঙ্গেই আপাতত তেষ্টা মেটায় সে। এরপর একটা গাছের শক্ত ডাল হাতে ও দেখতে বের হয় দ্বীপটা। 

দুটো টিলা পার হয়ে ছোট্ট ঝরণাটা দেখতে পেয়েছিল বিজন। বেশ কিছু তরমুজ হয়ে আছে বালির ঢিপিতে। কলাগাছ ও রয়েছে ও ধারে। ঝরনার জল আকন্ঠ পান করে দেহে বল পায় ও। এরপর গাছের পাকা কলা আর তরমুজ খেয়ে একটা বড় পাথরের নিচে বিশ্রাম করে কিছুক্ষণ। কয়েকটা পাখি ছাড়া আর কোনো জন্তু চোখে পড়েনি ওঁর। তবে ঝরণার পাশে এক জায়গায় কিছু পোড়া কাঠ আর ছাই দেখে বেশ আনন্দ হয়েছিল বিজনের। মানুষের যাতায়াত না থাকলে আগুনের চিহ্ন থাকত না। হয়তো লোক আসে এই দ্বীপে। দিনের আলো থাকতে থাকতে ওকে একটা রাত কাটাবার আস্তানা জোগাড় করতেই হবে । 

ঝরণা বরাবর সমুদ্রের দিকে হেঁটে যেতে গিয়ে গুহাটা চোখে পড়েছিল ওর। ভীতরে উঁকি দিয়ে চমকে উঠেছিল। একটা অচেনা মানুষের দেখা পেলে যে মনে এত আনন্দ হবে ও আগে বোঝেনি। ও একা নয়, আরেকজন রয়েছে এই দ্বীপে, এই চিন্তাতেই ও খুশি হয়েছিল। বেঁঁটে , চুল দাড়িতে ঢাকা লোকটার বয়স বোঝা যাচ্ছিল না। ওকে দেখে লোকটাও বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। দু চোখে কৌতূহল নিয়ে বাঙ্গাল টানে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল -''আইছো, কবে থিকা বৈয়া রইছি আমি। তা আমার খবর পাইলা ক‍্যমনে?''

অবাক বিজন প্রথমে কথা বলতেই ভুলে গেছিল। তারপর বলে নিজের দুর্দশার কথা। 

লোকটা মনে হয় না খুব একটা অবাক হয়েছে। ওকে বলে -''বড্ড দেরি কইরা আইলা । আইস তোমারে সব দেখায় বুঝায় দিলেই আমার ছুটি। ''

লোকটার সাথে গুহায় ঢুকতে ঢুকতে বিজন ভাবছিল একা থাকতে থাকতে লোকটার বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। গুহার ভেতরটা বেশ বড়। বেশ কিছুটা ভেতরে আরেকটা বাইরে যাওয়ার মুখ। সেদিকে এসে বিজন অবাক। ছোট্ট একটা সমতল জায়গায় চারদিকে ফলের গাছ। কিছু বুনো ফুলের ঝোপ। লোকটার সাথে আরেকটা গুহায় ঢোকে ও। একটা ছোট্ট মশাল হাতে লোকটা এগিয়ে চলেছে। কয়েকটা জায়গায় ছাদ এত নিচু যে প্রায় বসে বসে যেতে হয়েছে। গুহাটা একটু গিয়েই দু ভাগ হল লোকটা ওকে নিয়ে ডানদিকে গেল। একটা বড় হলের মত জায়গায় সাতটা বড় বড় কাঠের বাক্স, লোকটা একে একে সাতটা বাক্সর ঢাকনা খুলতেই বিজনের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এত সম্পদ ও কল্পনাতেও দেখেনি কখনো। এ যে সাত রাজার ধন। কুবেরের রত্ন ভান্ডার নাকি? এসব তো একবারে নিয়েও যাওয়া যাবে না। এ যে গুপ্তধন!!

বৃদ্ধ মশালটা একটা খাঁঁজে গুজে দিয়ে ওকে বলে-'' এই দ্বীপের রাজা হইলা তুমি। এসব তোমায় ..... যাও। দেইখা বুইঝা নাও। ''

বিজনের পাগল পাগল লাগছিল। এত সম্পদ!! ও একটা একটা করে বাক্সর সামনে গিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাইছিল ঐ রত্ন, আর সম্পদ। কম্পিত পদক্ষেপে ও এগিয়ে যায় ঐ দিকে।

কতক্ষণ এই সব মোহর আর ধন সম্পদের মধ‍্যে ও আটকে ছিল মনে নেই। পেটে টান পড়তেই ও উঠে এসেছিল। কিন্তু কোথায় সেই বৃদ্ধ ? টিমটিমে মশালের আলোয় লোকটাকে আর কোথাও দেখতে পেল না ও।

হঠাৎ করে একটা ভয় এসে চেপে ধরল ওকে। সমুদ্রের এক প্রাচীন প্রবাদ মনে পড়ে যায়!! লোভে পাপ, পাপে মৃত‍্যু। মশালটা নিয়ে গুহা পথ ধরে বাইরে আসার জন‍্য ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে ও। 

অনেক ছোটাছুটির পর ঐ খোলা চত্তরটায় আসতে পারে বিজন। গুহার মধ‍্যে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর। রাত শেষ হতে চলেছে প্রায়, শুকতারা উঠেছে ওধারে। বৃদ্ধকে যে গুহায় দেখেছিল প্রথম সেটা আর খুঁজেই পেল না ও। অনেক্ষণ ছোটাছুটির পর ও বুঝল ও পথ হারিয়েছে। অনেক কষ্টে ঝরণাটা খুঁজে পেয়েছিল আবার। ঝরণা বরাবর হেঁটে ও এসে পৌছাল সেই প্রথম গুহাটার কাছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধ নেই কোথাও।  মশালটা ভালো করে জ্বালিয়ে বড় গুহাটায় ঢুকল ও, যেটায় রয়েছে প্রচুর গুপ্তধন।  আবছা আলোয় এবার দেখল গুহার দেওয়ালে লেখা কথাগুলো। " যক্ষের গুহায় স্বাগত। এই অগাধ ধন সম্পদের মালিক এখন তুমি। শর্ত একটাই, থাকবে পাহারায়।''

পাগল পাগল লাগছিল ওর। 

যেখানে গুহাটা দু ভাগ হয়েছে সেখান থেকে ও বা দিকে চলল এবার। বহুক্ষণ পর গুহাটা থেকে বেরিয়ে এল বালুর চড়ে। ঐ তো নীল সমুদ্র। খোলা আকাশের নিচে এসে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছিল বিজন। দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হয়ে একটা নতুন ঝলমলে দিন শুরু হয়েছে।

ফল আর ঝরণার জল খেয়েই কেটে গেল দিনটা। বেশ বড় দ্বীপ। উপকুল বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বিজন ঠিক বিকেলে পৌঁছে গেল যেখানে ও এসে নেমেছিল সেই তটভূমিতে। গাছের গুড়িটা থাকলেও নৌকাটা কোথাও চোখে পড়ল না আর। ঠিক সেই মুহুর্তেই বিজন বুঝতে পারল সে কতবড় বিপদে পরেছে। 

এই জন‍্যই বৃদ্ধ বলেছিল সে এখন থেকে এই দ্বীপের রাজা। 


দিন মাস বছর যায়, বিজন পাথরে দাগ কেটে হিসেব রাখে দিনের। ঐ কুবেরের সম্পদ ছুঁঁয়েও দেখে না আর। পাহাড়ের মাথায় বসে দেখে সমুদ্রের বুকে কোনো কালো বিন্দু যদি চোখে পড়ে, যদি কেউ আসে এদিকে। বিজন ফিরতে চায়। কিন্তু কেউ না এলে যে তার মুক্তি নেই।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller