STORYMIRROR

শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Others

স্বপ্নের মৃত্যু

স্বপ্নের মৃত্যু

4 mins
262


আকাশের বুকে ঘন কালো মেঘ বাসা বেঁধেছে। থেকে থেকে বিদ‍্যুতের তীব্র ঝলকানির আলোয় সেই কালো মেঘের দানবকে দেখা যাচ্ছে। আকাশের চাঁদ,তারারা সব ঢাকা পড়ে গেছে সেই দানবের কালো ছায়ায়। চারিদিক জুড়ে কালো মেঘ তার ঘন মোটা চাদর ছড়িয়ে চলেছে একটু একটু করে। বাতাসও ধীরে ধীরে তার বেগ বাড়াচ্ছে। নারকোল, সুপাড়ি গাছ গুলো হাওয়ার তালে দোলনার মত দুলছে।


মাটির ঘরের এক চিলতে দাওয়ায় বাঁশের খুটিতে পিঠ ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বাদল আর ননী বসে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। কপালের ভাজে ভাজে চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছে। আজ রাত পেরোলেই কালকে সকালে ধানক্ষেত থেকে সোনালী ধান ঘরে তুলে আনার কথা। আর ঠিক একসপ্তাহ পড়ে যে... নবান্ন, কিন্তু তার আগেই এই দূর্যোগ। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের দানবের দাপাদাপি। কি... জানি কি... হবে! সোনার ফসল কি... সব শেষ হয়ে যাবে এই সব ভেবে চলেছে আপন মনে।


----------পরিবেশের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে, বাদল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠল, এবার ধান ঘরে তুলতে না....পারলে, আমারে মরতে হবে বউ!

------ননী সাথে সাথে স্বামীর মুখের ওপর হাত রেখে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল, এই রকম কথা বলছো কেনে?তোমার কিছু হলে আমাদের কি... হবে?

------------বাদল বলে উঠল, কি.. আর করবু বল, কিছুই করার নাই আমার, মোড়ল মশাইয়ের কাছ থেকে নগদ টাকা ধার নিয়েছি যে, ফসল উঠলে দিয়ে দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ধান আর ঘরে আনতে পরবোনি, আজ রাতেই সব শেষ হয়ে যাবে। মোড়ল মশাইতো আর ছেড়ে দেবেনি আমাদের কথা ভেবে, টাকা সুদে আসলে উশুল করে লিবে।

---------ননী কপালে হাত ঠেকিয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রনাম ঠুকে বলে উঠল, রক্ষে করো ঠাকুর... রক্ষে করো।

---------বাদল দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, ঠাকুর কোন কালেই আমাদের রক্ষে করেনিরে আজও করবেনে!!! যদি করতো তাহলে আমাদের এই রকম অবস্থা হোতনে বউ।

-------ননী বলে উঠল, চলো আমরা নাহয় গিয়ে এই ভোর রাত থেকেই ধান কাটতে শুরু করে দিই....!

---------বাদল হেসে বলে উঠল, পাগল হলি বউ অত ধান আমরা কি... আর কেটে উঠতে পারব! যে... যাব! বাদল আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠল, আমার হাতে যাদু আছে গ্রিরামের সবাই বলে, আমি ধানের চারা পুতলে ধানক্ষেত সোনালি ধানে ভরে ওঠে, কিন্তু শেষ রক্ষে হয়নারে বউ! প্রত‍্যেক বছর কিছু কিছু ভাবে আমার ফসল নষ্ট হয়েই যায়।

বাদলের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রচন্ড জোড়ে বাজের শব্দ, সেই শব্দে সবার বুক কেঁপে উঠলেও বাদলের বুক কাঁপলনা, কারন তার বুক যে সোনার ফসল নষ্টের ভয়ে কাঁপছে। লাল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল আকাশের বুক। ঘরের মধ‍্য শুয়ে থাকা বাদল ননীর মেয়ে ফুলি ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ননী ছুটে ঘরে গিয়ে মেয়েকে বুকের মাঝে আগলে নিল। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল তারসাথে ঝোড়ো হাওয়া। বৃষ্টি আর হাওয়ার তান্ডব নৃত‍্য শুরু করেছে একসাথে প্রকৃতির বুকে। এই তান্ডব তখনই থামবে যখন সবকিছু একেবারে শেষ হয়ে যাবে তখন। ঝড় জলের দাপট সহ‍্য করে একই ভাবে বাদল ঠাঁই বসে আছে দাওয়ার। বাদলের দৃষ্টি এখন স্থির হয়ে আছে আকাশের দিকে।

*********************

দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা তান্ডব করার পর প্রকৃতি যেন শান্ত হলো। প্রকৃতির বুকে শান্তি বিরাজ করতে লাগল, কিন্তু বাদলের বুকে তখন প্রবল ঝড় চলছে, আর এই ঝড় থামবেনা কারন সবকিছু তো.... শেষ। রাতের গভীরতা কেটে গিয়ে ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটতে শুরু করছে। পাখিরা এতক্ষন ধরে মরনপন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার আনন্দকে উপভোগ করার জন‍্য ডানা মেলে উড়ে চলেছে দূর থেকে বহু দূরে।

বাদল কোমড়ে গামছাটা ভালো করে বেঁধে ছুটল ফসল দেখার জন‍্য মাঠের পথে। ননীর বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল সত‍্যি বাদল যদি কিছু করে বসে, তাই মেয়েকে কোলে নিয়ে সেও ছুটল বাদলের পিছন পিছন। কিন্তু বাদলকে ধরা যাচ্ছেনা, বাদল কেমন পাগলের মত ছুটছে।

---------- ননী পিছন থেকে চিৎকার করে ডাকছে দাঁড়াও.... ফুলির বাবা দাঁড়াও.... আমি আসতেছি।কিন্তু বাদলের কান পর্যন্ত সেই কথা পৌঁছাছেনা।

ননী অনেকটা দূর থেকেই লক্ষ‍্য করল বাদল ধপ করে বসে পড়ল। ননী প্রানপন ছুটতে ছুটতে এগিয়ে গেল। ফুলি তখন ঘুমের ঘোর কাটিয়ে ভয়ের চোটে কাঁদতে শুরু করেছে। ননীর সেদিকে খেয়াল নেই, ননীর এখন একটাই চিন্তা যে করেই হোক বাদলকে ঠিক রাখতে হবে। ননী সামনে তাকিয়ে দেখল ধানক্ষেতের প্রত‍্যেকটা ধান গাছ শুয়ে পড়েছে মাটির ওপর, এবং তার ওপর দিয়ে খরস্রোতা নদীর মত বয়ে চলেছে জল।

--------বাদল বুক চাপড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, বউ কি.... হবে!!! সব..শেষ, সব.... শেষ, আমার এতদিনের এত পরিশ্রম, রক্ত জল করা কষ্টের ফসল কেমন ভেসে যাচ্ছে দেখ বউ, কেমন ভেসে যাচ্ছে....

--------ননী স্বামীর কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল, সব ঠিক হয়ে যাবে, একটু সময় লাগবে, তুমি আবার চাষ করবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

-----------বাদল বিড় বিড় করে আওড়াতে লাগল, কিছু ঠিক হবেনে...!!!! কিছু ঠিক হবেনে!!!! সব...শেষ, সব.... শেষ,

---------ননী কোন রকমে বাদলকে উঠিয়ে, বলল চলো.... বাড়ি চলো।

বাদল নির্বিকার ভাবে হেঁটে চলল ননীর সাথে সাথে, আর আওড়াতে লাগল কিছু... ঠিক হবেনে!!! কিছু ঠিক হবেনে...!!! সব....শেষ, সব... শেষ!!!

********************

ননী স্বামীকে মাটির দাওয়ায় বসিয়ে, মেয়েকে পাশে বসিয়ে জল আনতে গেল। জল নিয়ে এসে দেখল বাদল বসে নেই, মেয়ে চুপচাপ বসে আছে। ননী মেয়েকে কোলে নিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল........

---------ও ফুলির বাবা শুনতে পাচ্ছো, কোথায় গেলে গো...??? কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। ননী আবার ছুটতে শুরু করল রাস্তা দিয়ে। কিছুটা রাস্তা ছোটার পর দেখল বাদল দৌড়াচ্ছে গঙ্গার পথে। ননী চিৎকার করতে করতে প্রানপন ছুটতে লাগল, কেউ আছোগো তোমরা.... আমার স্বামী কে আটকাও...., ওকে বাঁচাও...।

বাদলের দৌড়ের সাথে ননী কিছুতেই তাল মেলাতে পাড়ছেনা, বাদলকে তখন যেন যমরাজ স্বয়ং টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের কাছে। ননীর দম বন্ধ হয়ে আসছে ছুটতে ছুটতে। হঠাৎ আবঝা ভোরের আলোয় ননী দেখল বাদল গঙ্গার জলে ঝাঁপ দিল। ননী চিৎকার করে উঠল না.... বলে। ননী গঙ্গার পাড়ে গিয়ে মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে নিজেও ঝাঁপ দিল গঙ্গার স্রোতস্বীনি জলে। ছোট মেয়ে ফুলি কি.... বুঝল কে জানে, ও.....কাঁদতে কাঁদত ধীর পায়ে জলের মধ‍্যে নামতে লাগল, আর একটা সময় জলের মধ‍্যে কোথায় যেন তলিয়ে গেল।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy