স্বপ্নের হাতছানি
স্বপ্নের হাতছানি
বিল্টুর সাথে বই এর বন্ধুত্ব সেই ভাবে কোনদিন হয়েই ওঠেনি। বিল্টুর কাছে পড়াশোনা করার কথা ভাবাটা অনেকটা রূপকথার গল্পের মত। সকাল শুরু হওয়ার আগেই সেই কাকভোর থেকে শুরু হয়ে যায় বিল্টুর কাজের জীবন, আর সারাদিন ধরে চলতে থাকে। বিল্টু আর বিল্টুর বোন ফুলি আর ওদের মা এই হচ্ছে ওদের ছোট্ট সংসার, ওরা রেল লাইনের ধারে বস্তিতে থাকে।
***************************************
বিল্টু তখন খুব ছোট, বোনটা তখনও মায়ের পেটে, বিল্টুর বাবা নেশা করে ঘরে ফেরার পথে রেল লাইনে কাটা পড়ে। বিল্টু তখন সবে অ আ ই ঈ চিনতে শিখেছে, আর তার সাথে কিছু ছড়ার বুলি। কিন্তু হঠাৎ করে ওদের জীবনে ছন্দ পতন ঘটে গেল। বিল্টুর আর এ বি সি ডি শেখা হলনা। বাবার মৃত্যুর এক মাস যেতে না.. যেতেই বোন এল ওদের সংসারে। ওদের দুজনের দুবেলা খাবার জুটছিলনা তখন ঠিকমত তারপর আর এক সদস্য বাড়ল। তারপর বিল্টু যখন একটু বড়ো হল তখন দেখত মা... কোন ভোরে উঠে রান্ন সেরে বেড়তো তারপর দুপুরে কোনরকমে ওদের খাইয়ে আবার বেড়িয়ে যেত।
--------একদিন বিল্টু জিজ্ঞাসা করেছিল, মা..... কোথায় যাও.... তুমি....???
---------বিল্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে ওর মা বলেছিল, কাজে যাই বাবা!!! না.... গেলে খাবার জুটবে কেমন করে।
---------বিল্টু বলেছিল আমিও যাবো তোমার সাথে কাজে.....
--------বিল্টুর মা হেসে বলেছিল, যাবি তোর বোন একটু বড় হোক তখন। আর এখন থেকে বোনের সব দায়িত্ব তোর।
---------বিল্টু বলেছিল আচ্ছা মা.... আমি আর স্কুলে যাবো না....????
--------বিল্টুর মা... বলেছিল তোকে স্কুলে পাঠানোর ক্ষমতা যে.... আমার নেই বাবা!!!
সেইদিন বিল্টু মায়ের চোখে জল দেখেছিল তারপর আর কোনদিনও বিল্টু পড়াশোনার কথা বলেনি। বিল্টু বোনের দেখাশোনা, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সবকিছু করত। তারপর বোন যখন একটু বড়ো হলো তখন বিল্টু মায়ের সাথে কাজে লেগে পড়ল।
বিল্টুর মা নিজের কানের দুলজোড়া বিক্রি করে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা চায়ের দোকান খোলে। সেই কাকভোর থেকে চা হয় আর তার সাথে চপ, পেঁয়াজি, ঘুগনি এইসবও হয়। বিল্টু প্লাটফর্মে ট্রেন ঢোকার সাথে সাথে গরম চায়ের কেটলি নিয়ে ছুটতে থাকে আর জোড়ে জোড়ে বলতে থাকে, চায়ে.... গরম...., গরম....চায়ে। তারপর লোকজনেকে দোকানে আসার জন্যও ঢাকতে থাকে। মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দেয়। আর ফুলি দোকানে পাতা চৌকির ওপর বসে ছড়া বলতে থাকে,
"আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ,
হিরে দাদার মড়মরে থান
ঠাকুরদাদার বৌ"।
বিল্টু মনোযোগ দিয়ে শোনে ভুল হলে আবার শুধরে দেয় ছোটবেলায় বিল্টু একসময় এই সব ছড়া বলতো।
তারপর শহরের বুকে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বড় রাস্তার মোড়ে সিনেমা হলের সামনে মায়ের হাতের তৈরী ঘুগনি নিয়ে বিক্রি করতে বসে বিল্টু যতক্ষন পর্যন্ত শো চলে ততক্ষন। বিল্টু স্বপ্ন দেখে ওর বোন ফুলি পড়াশোনা করে মস্ত অফিসার হবে একদিন। সিনেমা হলের থেকেই একটু দূরেই একটা মস্ত বড় পুরনো বাড়ি আছে। সবাই খুব যায়, বিল্টুও একদিন ভীতরে ঢুকেছিল সাহস করে সবার পিছন পিছন, কিন্তু ভীতরে ঢুকে দেখে চারিদিকে বই...আর বই... এ যেন মস্ত বইএর দোকান। বিল্টু সেদিন বাড়ি এসে মাকে বলেছিল ওর দেখা বইএর দোকানের কথা। তখনও বিল্টু জানতোনা ওটাকে বইএর দোকান নয় লাইব্রেরী বলে। তারপর একদিন এক দিদি বিল্টুর কাছে ঘুগনি খাওয়ার সময় ফোনে কথা বলতে বলতে বলেছিল..........
------------সিনেমা হলের পাশে পুরনো লাইব্রেরীর সামনে আমি অপেক্ষা করছি তুই চলে আয়।
---------বিল্টু তখন কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, দিদি তুমি ঐ মস্ত বড় বইএর দোকানটাকে কি বললে যেন লাই......
--------মেয়েটি হাসতে হাসতে বলেছিল, ওটা লাইব্রেরী বইএর দোকান নয়।
---------বিল্টু জিজ্ঞাসা করেছিল ওখানে কি... হয় অত বই... দিয়ে??
--------মেয়েটি বিল্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছি ওখানে সবাই পড়তে আসে।
--------বিল্টু উৎসাহের সাথে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমিও পড়তে যেতে পাড়বো ওখানে।
---------মেয়েটি বলেছিল পাড়বে, তবে তার আগে লাইব্রেরী কার্ড করতে হবে!!!
----------বিল্টু মনে মনে উচ্চারণ করেছিল সেইদিন লাইব্রেরী।
তারপর বিল্টু একদিন ফুলির হাত ধরে লাইব্রেরীর ভীতরে গেছিল ফুলিকে দেখাতে।
-----------ফুলি অবাক বিস্ময়ে বলেছিল, এটা কোন জায়গা রে... দাদা....???
----------বিল্টু বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, লাইব্রেরীরে বোন... লাইব্রেরী,এখানে সবাই পড়তে আসে, তুই যখন বড় হবি তখন এখানে পড়তে আসবি।
--------ফুলি ঘাড় নেড়ে বলেছিল আচ্ছা।
*****************************************
আজও সেই একই ভাবে সময় স্রোতে এগিয়ে চলেছে বিল্টুর জীবন। রোজ কাজের শেষে বিল্টু একবার করে লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে মস্ত বড় বাড়িটা এবং লোহার গেট টাকে দেখতে থাকে আর মনে মনে বলত থাকে, আমি না পড়তে পাড়লাম তো... কি হয়েছে??? ফুলি তুই ঠিক একদিন এইখানে পড়তে আসবি। আর আমি তোর কাছ থেকে তোর পড়ার গল্প শুনব। তুই অনেক বড় হবি বোন এখানে আসা ঐ... দাদা, দিদিদের মত, তখন আর আমাদের কোন কষ্ট থাকবেনা।
