সারপ্রাইজ
সারপ্রাইজ


বছর সতেরোর মিষ্টি মেয়ে রুপালী পা টিপে টিপে নিশব্দে হেঁটে মৈনাকের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
মৈনাক একমনে চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা ল্যাপটপে কিছু প্রজেক্ট তৈরী করছিলো।
-হু.....হ, ধাপ্পা, বলেই রুপালী মৈণাকের গলাটা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
-আরে রুপু!
উফফস, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি একদম।
দস্যি হয়েছিস খুব না। কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিস বুঝতেই পারিনি।
কখন এলি কলেজ থেকে?
-এইতো কিছুক্ষণ হোলো।
-তুমি কখন এসেছো?
-এইতো সাড়ে দশ টা হবে।
- ওহ তার মানে আমিও বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি তখনই এসেছো।
-হয়তো। আমি তো পকেট রোড দিয়ে এলাম তাই দেখা হয়নি।
-দাদাভাই আমি কিন্তু তোমার উপর খুব রাগ করে আছি। রুপু পেছনদিকে মুখ ঘুড়িয়ে বললো।
-কেন রে পাগলি। তোর আবার কি হোলো।
- তুমি বলো রাগ হবো না কেনো শুনি। সেই কবে তুমি অফিসের কাজে দিল্লী গিয়েছিলে। আর ঠিকমতো ফোন ও করতে না। পূজোতেও এলেনা কত্ত মিস করেছি জানো।
-ওলে আমার সোনা বোনটি। কি করবো বল বুনু। অনেক চাপ ছিলো যে কাজের। সামনের মাসের মধ্যেই সব কম্পলিট করতে হবে তো তাই।
-তাই বলে পূজোয় আসবে না। তুমি তো জানোই দাদাভাই মায়ের পায়ের সমস্যার কারণে কোথাও বেড় হতে চায়না। বাবা যখন ছিলো তখন পূজোয় প্রত্যেকদিন ঘুড়তে নিয়ে যেত। আজ দুবছর হোলো বাবা নেই।
আর এবার তুমিও ছিলেনা।
-ইসসস! বুনু আমার ক্ষমা করে দে।
দে না মা ক্ষমা করে। এই দ্যাখ কান ধরে উঠ বোস করছি। আর কক্ষনোএমন ভুল হবে না। বলেই মৈণাক উঠ বোস করতে লাগলো।
-ঠিক আছে উঠবোস করতে হবে না। ওঠো। ওঠো বলছি।
মৈনাক উঠে দাঁড়ালো।
আগে বলো তুমি এর মধ্যে আবার কোথাও যাবে নাকি?
-এর মধ্যে কোথাও বলতে, এইতো শুধু অফিসেই কাজ আছে।
-না, কলকাতার বাইরে যাবে না তো।
-নাহ আপাতত তো যাব না।
-ঠিক আছে।
-কেনো রে।
-না এমনি বললাম।
বাবু, রুপু তোরা খাবার ঘরে আয়, খেয়ে নে। অনেক বেলা হোলো যে। রান্নাঘর থেকে মিনতি দেবী বললেন।
দুজনেই একসাথে বললো,
হ্যাঁ মা আসছি।
*****
দুজনে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো।
মিনতি দেবী তাদের খাবার পরিবেশন করছিলেন।
-কিরে বাবু, কাজ কর্ম সব কেমন চলছে?
-হুম, সব ঠিক আছে মা।
-খুব পরিশ্রম হয়েছে না রে এই কটা মাস?
-বাব্বা পরিশ্রম বলে পরিশ্রম। দারুণ খেটেছি মা এই ব্রিজ টা বানানোর পেছনে।
-এই দাদাভাই, তুমি কোন ব্রিজ টা ডিজাইন করেছো গো। কলকাতা শহরে তো বর্তমানে ছোট বড় মাঝারি মিলিয়ে মোট ৬টা নতুন ব্রিজ তৈরী হচ্ছে। তুমি কোনটা করছো আমি জানিই না।
-এ কিরে, তুই জানিস না। বাড়ির মানুষ গুলোই জানিস না।
-ও কি করে জানবে বাবু। আমিও তো জানি না তুই কোন ব্রিজটা করছিস।
-হা ভগবান!
-তুই কি কখনো তোর কাজের ব্যপারে কিছু বলিস আমাদের যে জানবো।
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে বলছি। আমাদের এখানকার টাউন ক্লাব ময়দানের সামনে যে নতুন ব্রিজ টা হচ্ছে সেটা।
-ও ওই ব্রিজটা ওটা তো আমি প্রায়ই টিউশন যাওয়ার সময় দেখি। ব্রিজটা খুব একটা বড় না কিন্তু খুব সুন্দর।
- হুম আসলে সামনে বড় খেলার মাঠ আর চিলড্রেন পার্ক থাকার কারণে ব্রিজটাকে সুন্দর করে বানানো হয়েছে। নইলে তো ওতো সুন্দর করে বানানোর কোন দরকার পড়েনা।
-কবে থেকে ওই ব্রিজ দিয়ে যাতায়াত শুরু হবে রে?
-এইতো সামনের মাসে ৫ তারিখে।
-কিরে বাবু রুপু কে এবার কি উপহার দিচ্ছিস। পূজোয় তো কিছু দিসনি। তাই নিয়ে কত কান্না কাটি করেছে। কি আর করবো তোর হয়ে আমিই ওকে ডবল সেট কিনে দিয়েছি।
-উপহার দেবো? কেনো কিসের জন্য।
-এ কিরে! রুপুর জন্মদিনটা ভুলে গেলি নাকি?
-ওহ হ্যাঁ তাই তো। রুপুর তো জন্মদিন আছে। কবে যেন।
মিনতি দেবী বলতে যাচ্ছিলেন রুপালী তাতে বাধা দেয়,
খাওয়া বন্ধ করে মুখ ভাড় করে বললো,
-মা, একদম বলবে না, আমার কবে জন্মদিন। দাদাভাই বলুক কবে। দেখি কত ভালোবাসে আমাকে।
-দাড়া দাড়া বলছি।
মমমম... জানুয়ারী...ফেব্রুয়ারী...
মনে মনে মাসের নামগুলো আওড়াতে থাকে।
-ও, সামনের মাসের ৫ তারিখেই তো রুপুর জন্মদিন।
এবারে রুপু হেসে বললো-যাক ভোলোনি তাহলে।
-আরে ভুলবো কেনো। তুই তো আমার আদরের একমাত্র বোন।
-তাহলে এবার কি উপহার দিচ্ছিস রুপুকে।
-বল বুনু তোর কি উপহার চাই।
-তুমি যা দেবে তাতেই আমি খুশি দাদাভাই।
-ঠিক আছে উপহারটা তবে তোকে তোর জন্মদিনের দিন দেবো। সারপ্রাইজ থাক তবে।
-ঠিক আছে।
-এই রুপু এবারের জন্মদিন কোথায় করবি কাকে কাকে বলবি কিছু ঠিক করেছিস?
-না মা। কোন প্ল্যান করিনি। তবে এবার আমি অন্য কিছু ভাবছি।
-বাব্বা বুনু তুই আবার ভাবতেও শিখে গেছিস।
-এই দাদাভাই চুপ করবে।
-আচ্ছা আচ্ছা এই যে মুখে কুলুপ আটলুম।
-কিরে ভাবা হোলো।
-হ্যাঁ মা। ভাবছি এবার তো আমি আঠারোয় পা দেবো। আমি সাবালিকা হয়ে যাব। স্বাধীন চিন্তা ধারা হবে আমার।তাই খোলা আকাশের নীচে কোন জায়গায় করবো।
- হুম বেশ তো বাড়ির ছাঁদ আছে উঠোন আছে কর না।
-এই দাদাভাই আবার কথা বলছো।
-ওহ সরি সরি।
-বাড়িতে নয়, বাইরে কোন জায়গায়।
আচ্ছা দাদাভাই তোমার ডিজাইনের ব্রিজ টা তো ৫ তারিখেই উদবোধন হবে তাই না।
- হুম
-আচ্ছা ওই ব্রিজের এক কোণে করলে কেমন হবে।
-একদম না। ব্রিজে কেউ জন্মদিন করে। গাড়ি ঘোড়া আজকাল যেভাবে চলে। খবরদার রুপু ওসব মাথাতেও আনবিনা।
-ওহ মা। প্রথমদিন ওতো গাড়ি যাবেনা। আর তাছাড়া তুমি দাদাভাই তো থাকবেই নাকি।
-তুই এতো ভাবিস কি করে রে। দারুণ আইডিয়া। ঠিক আছে ওইদিন ওখানে আমার কলিগরাও থাকবে। ছোট্টকরে সেলিব্রেট করা যাবে।
-থ্যাঙ্ক ইউ দাদাভাই।
-তুই আর মা তৈরী হয়ে থাকিস। আমি একসময়ে এসে তোদের নিয়ে যাব। আর যদি না আসতে পারি তাহলে তুই মা কে নিয়ে বেড়িয়ে যাস বুঝলি।
-ঠিক আছে।
-তোদের ভাই বোনের মাথা খারাপ আছে বুঝলি।
দুজনেই খিল খিল করে হেসে উঠলো।
এমন সময় মৈনাকের ফোনটা বেজে উঠলো।
প্রথমে কয়েকবার ফোন টা কেটে দিলেও আবারো রিংটোন বেজেই যাচ্ছে।
-কিরে বাবু ধর ফোন টা। কেটে দিচ্ছিস কেনো?
-না মা। রং নাম্বার।
-তবুও ধর না। রং নম্বরেও তো জরুরি ফোন আসতে পারে।
-বুনু তোর খাওয়া হয়েছে।
- হুম
-যা হাত ধুয়ে নিজের ঘরে যা।
-আচ্ছা।
রুপালী চলে যায়।
-মা,
-হুম বল কিছু লাগবে।
-মাংস টা খুব স্বাদ হয়েছে। কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটু গরম করে এনে দাও না।
-আচ্ছা দাড়া এক্ষুণি আনছি।
মিনতি দেবী রান্নাঘরে চলে গেলেন।
এবারে মৈণাক ফোন টা রিসিভ করে বললো।
-হ্যালো, অসময়ে কেনো ফোন করেন। আপনি তো জানেন আমি এইসময়ে বাড়িতে থাকি।
-কিন্তু, স্যার, খুব আর্জেন্ট ছিলো।
-কি হয়েছে তাড়াতাড়ি বলুন।
-ব্রিজের এখানে একটু গোলমাল হয়েছে স্যার। আপনাকে আসতে হবে।
-আবার কিসের গোলমাল। নিশ্চই আপনি মুখ খুলেছেন কারো সামনে।
-না স্যার আমি কেউকে কিছু বলিনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে রাখুন।
আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।
মা আমি উঠছি। আমার খাওয়া হয়ে গেছে।
-এই যে বললি মাংস গরম করতে। দাড়া হয়ে গেছে। আনছি।
-এখন আর খাবো না রাতে খাবো।
*****
মৈনাক তৈরী হচ্ছিলো এমন সময় মিনতি দেবী মৈনাকের ঘরে প্রবেশ করলেন।
-বাবু, কোথাও বেড় হচ্ছিস।
-হ্যাঁ মা। আমি ব্রিজের ওখানে যাচ্ছি।
-ওহ
-কেনো কিছু বলবে।
-তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিলো। থাক পরে বলবো।
-আরে বলোনা। কি বলবে।
-বাবু,সত্যি করে কয়েকটা প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিবি।
-এ আবার কেমন কথা মা।
-তুই কি কোন খারাপ কাজ করছিস নাকি রে?
-কি বলছো এসব মা।
-সত্যি করে বল। তোকে আসার পর থেকেই দেখছি কেমন চিন্তায় আছিস, ভয়েও আছিস মনে হচ্ছে।
মৈণাক মুখ ঘুড়িয়ে বলতে থাকে,
-কিসব ফালতু কথা বলছো মা।
আ....আ...মি কো....থায় ভয়ে আছি। আর চিন্তাতেও নেই।
তুমি এসব ভুলভাল চিন্তা করছো।
-তবে যে মুখ ঘুড়িয়ে নিলি। চোখে চোখ রেখে আমার কথার উত্তর দে না।
মিনতি দেবী মৈণাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
-কিরে আমি কিছু ভুল বলছি। মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া খুব মুশকিল কিন্তু।
-তোমার বয়স হয়েছে মা। তাই এসব ভুল ধারণা হচ্ছে।
-দ্যাখ বাবু, শুধু আজ নয়। তোকে আমি মাঝে মাঝেই দেখি খুব ভয়ে থাকিস। কি যেন চিন্তা করিস, কথা বলেই যাই উত্তর দিস না। কেউ ফোন করলে আমাদের সামনে ধরিস না। আড়ালে গিয়ে কথা বলিস। এসবের মানে কি।
-ওহ এই ব্যপার। ওসব কিচ্ছু না মা। আসলে কাজের চাপ খুব তো তাই।
মিনতি দেবী মৈণাকের হাত ধরে বললো,
-বাবু, বলনা তুই কোন খারাপ কাজ করছিস না তো। অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করছিস না তো।
মৈণাক মিনতি দেবীর হাত ছাড়িয়ে নেয়।
-না মা আমি কোন খারাপ কাজ করছি না।
-তবে যে তুই রুপু কে সোনার সীতাহার, রতনচূড়, মানতাসা, হীরের দুল, আমায় কানপাসা গড়িয়ে দিলি এতো টাকা তুই পেলি কোথায়। তারপর ওতো দামী একটা গাড়ি, বাইক কিনলি গতবার পূজোয়। আবার নাকি ফ্ল্যাট কিনবি ভাবছিস। আমার খুব ভয় করে বাবু। তুই কোন খারাপ পথে চলে যাসনি তো।
মৈণাক চুপ করে থাকে।
-দ্যাখ, বাবু তোর বাবা দুবছর হোলো চলে গেছেন। এখন তুই আর রুপুই আমার ভরসা। তোর বাবার পাড়ায় একটা সন্মান ছিলো এবং এখনও সবাই তার নামেই আমাদের সন্মান দেয়। তারপর আবার রুপুর বিয়ে দেওয়ারও ব্যপার আছে। তাই বলছি কোন খারাপ কাজে জড়িয়ে গিয়ে তোর সাথে সাথে আমাদের জীবনটাও নষ্ট করে দিস না।
মিনতি দেবীর চোখ ছল ছল করে উঠলো।আঁচলের খুটে চোখ মুছলেন।
যেদিন শুনতে পারবো তুই অসৎ পথে এতদিন উপার্জন করেছিস সেদিন মনে করবি আমি তোর কাছে মরে গেছি।
-মা... আ..
মৈণাক চিৎকার করে উঠলো।
মিনতি দেবী কোন উত্তর না করে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন।
****
-কি ব্যপার মিস্টার রায়, আমি আপনাকে বারবার বলেছি আমি যখন বাড়িতে থাকবো তখন ফোন করবেন না। খুব দরকার হলে ম্যাসেজ করবেন।
-স্যার, ব্যাপারটাই এমন হয়েছে যে আপনাকে ফোন করতে বাধ্য হয়েছি।
-কেনো কি হয়েছে?
-স্যার, আপনাকে আমি বার বার বলেছিলাম এতোটা দুর্নীতি ভালো নয়।
আর মাত্র দশ দিন বাকি এই ব্রিজের উদবোধন হবার আর দেখুন ব্রিজের কি অবস্থা।
-কি হয়েছে
-আসুন আমার সাথে। ব্রিজের নীচে আসুন।
ওপর দিকে তাকিয়ে দেখুন স্যার কিভাবে ফাটল ধরেছে। রেলিঙের ধারগুলোর কিছু কিছু জায়গায় পলেস্তরা খসে পড়েছে।
আসুন ওই থামটার কাছে দেখুন একটা ঘুষি মারতেই কতখানি পলেস্তরা ঝড়ে পড়ছে।
-এসব আমাকে বলছেন কেনো।
-সেটা আপনি ভালো করেই জানেন স্যার।
-দেখুন মিস্টার রায়। আমার দায়িত্ব ছিলো ব্রিজ টার ডিজাইন করা ব্যস। বাকি কি কি মেটারিয়ালস লাগবে সমস্ত দায়িত্ব ছিলো অখিলেশ স্যারের।
-ঠিক বলছেন স্যার। অখিলেশ স্যার প্রতিবারের মতো এবারও সঠিক হিসেব দিয়েছিলেন। কিন্তু আপনিও প্রতিবারের মতো সেই হিসেবের কারসাজি করেছেন।
-মিস্টার রায়, আঙুল উচিয়ে চিৎকার করে উঠলো মৈণাক। ভুলে যাবেন না মিস্টার রায় আপনি আমার থেকে জুনিয়ার। কথাগুলো ভেবে চিন্তে বলবেন।
-আঙুল টা নামিয়ে কথা বলুন স্যার। না আমি ভুলিনি স্যার যে আমি আপনার থেকে জুনিয়ার সেটা কর্মস্থানের ক্ষেত্রে তাই আমি এখনো আপনাকে স্যার বলেই সম্বোধন করছি কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন বয়সের দিক থেকে আমি আপনার থেকে অনেক সিনিয়ার।
-দেখুন মিস্টার রায় আমি হিসেবের কারসাজি করেছি তার কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে।
-না কোন প্রমাণ নেই তবে সাক্ষী আছে।
-কে
-আমি আর সমস্ত মেটারিয়ালস যেখান থেকে এসেছে সেই শপের ম্যানেজার
-তুমি কি আমাকে ব্ল্যাক মেইল করছো।
ভুলে যেওনা এর সাথে তুমিও জড়িত, কারণ তুমিও আমার কাছ থেকে প্রচুর টাকা নিয়েছো।
-না স্যার ব্ল্যাক মেইল নয়, আমার তো কষ্ট হচ্ছে অখিলেশ স্যারের জন্য। ওই সৎ মানুষটার চুরির অপবাদ লেগেছে।
আর টাকার কথা বলছেন? আপনার দেওয়া একটি টাকাও আমি নিজের জন্য খরচ করিনি। সমস্ত টাকা আমি সেই সমস্ত শ্রমিক দের দিয়েছি যারা এই ব্রিজ বানানোর সময় অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছে কিন্তু পারিশ্রমিকের টাকা আপনার পকেটে ঢুকেছে। তার সমস্ত খসড়া আমার কাছে আছে স্যার।
স্যার প্রতিবার আপনি নিজেও পাপ করেন আর আমাকে দিয়েও করানোর চেষ্টা করেন আর সমস্ত দুর্নীতির জবাব দিতে হয় অখিলেশ স্যার কে। একবার ভাবুন তো স্যার এই ব্রিজটা ভেঙে গেলে কত মানুষের প্রাণ যেতে পারে। অন্তত সিমেন্ট বালি লোহা এসব তো প্রয়োজন অনুযায়ী দিতেই পারতেন। এতো টা চুরি স্যার।
-দেখুন আমার সেসব দেখার দরকার নেই। কে মরলো কে বাঁচলো। এই ইমোশানাল ডাইলোগ নিজের কাছেই রাখুন।
- আপনার তোর কোন ঠিক ভুলের জ্ঞানই নেই দেখছি।
ওই দেখুন অখিলেশ স্যার এসেছেন। কি চিন্তিত দেখাচ্ছে ওনাকে। চলুন ওনার কাছে।
-একি ব্রিজের উদবোধনের আগেই মালবাহী লরি এদিক দিয়ে যাচ্ছে কেনো অখিলেশ স্যার, মিস্টার রায় জিজ্ঞাসা করলেন।
-আমি নিয়ে এসেছি। ব্রিজটার মান দেখার জন্য। ওই ওই দ্যাখো মিস্টার রায় কিভাবে দুলছে ব্রিজটা। একটা লরি যেতেই এমন দুলছে আর দিনভর গাড়ি চললে কি হবে ভাবোতো একবার। সামনেই চিলড্রেন পার্ক। হে ভগবান! আমি তো ঠিক ঠাক প্রয়োজনীয় জিনিসের হিসেব দিয়েছিলাম। কিন্তু এমনটা কি করে হোলো বুঝতেই পারছি না।
আমি DM কে কি জবাব দেবো। আর মাত্র দশ দিন পর সমস্ত যানবাহন চলবে এই ব্রিজ দিয়ে।
-স্যার ব্রিজের যা অবস্থা এখনি দুর্বল সেতুর বোর্ড লাগাতে হবে বোধ হয়।
অখিলেশ বাবু কিছু বললেন না, খালি নিষ্পলক দৃষ্টি তে ব্রিজটার দিকে চেয়ে রইলেন।
******
আজ ব্রিজের উদবোধন।
এই কদিন সবাই খুব ব্যস্ত ছিলো। এর মধ্যেই অনেক ইঞ্জিনিয়ার এসে পরীক্ষা করেছেন ব্রিজটা, সবাই এক কথা বলেছেন এই ব্রিজ খুবই দুর্বল ও বিপজ্জনক যেকোন মুহুর্তে ভেঙে পড়তে পারে। তাই এটাকে এখনি নিষিদ্ধ করা উচিৎ। কিন্তু এই সমস্ত বার্তাই ইমেইলে এসেছিলো,আর সমস্তই অফিসিয়াল ইমেইল ফলো করে মৈণাক। তাই মৈণাক সমস্ত মেইল ডিলেট করে দিয়েছে। এমনকি সেই এতোদিন ল্যাপটপে হিসেবের কারচুপি করে আসছে যা কেউ ধরতে পারছিলো না।
-এই মৈণাক তাড়াতাড়ি মেইল টা চেক করোতো।
_কেন স্যার?
-DM এর অফিস থেকে মেইল এসেছে। অবনী বাবু ফোন করে জানালেন।
- আচ্ছা দেখছি। মৈণাক প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে গেলো। একটু ভয় ভয় ও লাগছিলো।
-এইতো পড়ো কি পাঠিয়েছেন।
-হ্যাঁ স্যার
স্যার উনি লিখেছেন, ব্রিজ টা কিছুক্ষণ আগেই উদবোধন হয়েছে,কিন্তু ব্রিজ টা খুবই দুর্বল ও বিপজ্জনক। স্থানীয় মানুষ আর সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অভিযোগ করেছেন। ব্রিজের কিছু অংশ নাকি খসে পড়েছে। তাই ওই ব্রিজটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে।
অখিলেশ স্যার মেইল টা শুনেই ভেঙে পড়লেন।
সারাদিন এই নিয়েই চললো শলা পরামর্শ আলোচনা। মিডিয়া এসে অখিলেশ বাবু কে ঘিড়ে রয়েছেন। নানান প্রশ্ন করেই চলেছেন।
একি টেবিলটা কাঁপছে কেনো? আরে জলের বোতলটাও কাঁপছে। এই ভূমিকম্প! সব্বাই শিগগিরী নিচে চলো। অফিসের একজন স্টাফ চিৎকার করে উঠলো।
হুরমুড় করে সবাই নীচে নেমে এলো।
সবাই নীচে নেমে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রায় ১মিনিট ১৩ সেকেন্ড স্থায়ী ছিলো কম্পন।
-এই শিলাদিত্য, আজ মিস্টার রায় আসেননি।
-না স্যার
-কেনো
-আসলে ওনার আজ মেয়ের জন্মদিন তাই আগেই ছুটি নিয়েছিলেন।
-ওহ।
কিছুক্ষণ পর মৈণাক বলে উঠলো,কি? জন্মদিন? কটা বাজে এখন?
-স্যার সাড়ে চার টা বাজে।
-সর্বনাশ করেছে। আমি তো একদম ভুলে গেছিলাম।
-কি হোলো স্যার
-কিছু না
মৈণাক বাড়িতে ফোন করতে থাকে। কিন্তু ফোন লাগেনা। রুপালীর মোবাইলেও করে কিন্তু লাগেনা।
-স্যার, কিছুক্ষণ আগেই ভূমিকম্প হোলো তাই এখন ফোন করলেও কোথাও লাগবে না।
মৈণাক এবার তার বাইক টা নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়ে চললো বাড়ির দিকে।
বাড়িতে এসে কলিং বেল টিপতেই মিনতি দেবী বেড়িয়ে এলেন।
-কিরে এতো হাপাচ্ছিস কেনো? কি হয়েছে।
-ওপস মা তুমি ঠিক আছো। মৈণাক মাকে জড়িয়ে ধরে বলে
-কেনো আমার কি হবে।
-না আসলে ওই ব্রিজ টা নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিজ্জনক বলে। উদবোধন হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই নিষিদ্ধ হয়েছে। তোমাদের আজ ওখানেই নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো তাই।
যাই হোক তুমি আর বুনু সুরক্ষিত আছো।
-বুনু, রুপু কোথায়। সেতো বেড়িয়ে গেছে। আমার পায়ের ব্যাথার কারণে যেতে পারলাম না।
এবার মৈণাক ধপাস করে বসে পড়ে। মূর্তিমান হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য।
এবার উঠে উর্দ্ধশ্বাসে আবার বাইকটা নিয়ে ব্রিজের দিকে ধাওয়া করে।
ব্রিজের কাছে পৌছতেই দেখে সেখানে ভীষণ ভিড়। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখে সদ্য নতুন ব্রিজ টা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
ধ্বংসস্তূপ থেকে পুলিশ স্থানীয় কিছু লোকজন কেউ কে বেড় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্রমশ।
ভিড়ের মধ্যেই এক একজন এক এক রকম কথা বলছে। কেউ বলছে মেয়েটা বোধ হয় আর বেঁচে নেই। আবার কেউ বলছে বাঁচলেও হাত পা থেতলে যাবে। তখন তো ব্রিজে খালি ওই মেয়েটাই ছিলো।
কার জন্য যেন অপেক্ষা করছিলো।
মৈণাকের সারা শরীর যেন হিম আর অসাড় হয়ে যাচ্ছিলো। ধীর গতিতে সেই ধ্বংস্তূপের দিকে এগিয়ে গেলো।
দেখলো সবাই একটি দেহ কে টেনে হিচড়ে বেড় করার চেষ্টা করছে ।
অবশেষে সম্পূর্ণ বের করা সফল হয়েছে। একজন জল নিয়ে এসে মুখে দিতে রক্ত ধুলোবালি মাখা মুখ টা ক্রমশ পরিষ্কার হতেই মৈণাক চিৎকার করে উঠলো, -বু....নু...
একি হোলো তোর?
একজন বললো আরে প্রাণ আছে এখনো।
*****
আম্বুলেন্স ডাকা হোলো সঙ্গে সঙ্গে।
হাসপাতালে ভর্তি করা হোলো রুপালীকে।
অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত মৈণাক কান্না জড়ানো গলায় বলেই যাচ্ছে -এই বোন, বুনু রে, চোখ খোল না। বুনু এই বুনু চোখ খোল না।
কিছুক্ষণ পর ডক্টর জানালেন O– রক্ত লাগবে।
ব্লাড ব্যাঙ্কে O– রক্ত নেই। আপনাদের মধ্যেই কেউ কে দিতে হবে বা জোগাড় করতে হবে।
পেশেণ্টের পরিবারের কারো কি রক্ত ম্যাচ করবে।
-না ডাক্তার বাবু আমার আর মায়ের A+
বাবার আর বুনুর O-।
-তাহলে কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।
যা করবেন তাড়াতাড়ি করবেন। হাতে বেশী সময় নেই।
-কোথায় যাব। কি করবো কিচ্চু মাথায় আসছে না।
-আমার O- রক্ত। আমি দেবো।
মৈণাক পেছন ফিরে দেখে অখিলেশ স্যার।
-স্যার আপনি দেবেন?
-হ্যাঁ মৈণাক। তোমার বোনের এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী তাই না বলো।
একটু প্রায়শ্চিত্ত করি।
-চলুন ডাক্তার বাবু।
-হ্যাঁ আসুন।
তিন ঘন্টা ধরে অপারেশন চলার পর ডাক্তার বাবু আর নার্স রা বেড়িয়ে এলেন।
-ডাক্তার বাবু বোনের কি খবর।
-এখন বিপদমুক্ত। ঘুমোচ্ছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে জ্ঞান ফিরবে।
ততক্ষণে মিনতি দেবী আর মিস্টার রায় ও অন্যান্য অফিস স্টাফ রাও এসেছেন।
-মা তুমি কার সাথে এলে?
মিনতি দেবী কোন উত্তর না করেই মৈণাক কে না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেলেন।
ঘন্টাখানেক পর নার্স ডাকলেন রুপালী চক্রবর্তীর বাড়ির লোক কে আছেন।
মৈণাক উত্তর দেওয়ার আগেই মিনতি দেবী বললেন, আমি। রুপালীর মা।
-আসুন।
কিছুক্ষণ পর আর ধৈর্য্য না রাখতে পেরে মৈণাক রুপালীর ঘরে প্রবেশ করে। রুপালী নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। মিনতি দেবী কেঁদেই চলেছেন। আর ডাক্তার নার্স আছে।
-বুনু
এই বুনু। ওমন চুপ করে বসে আছিস কেনো। একটু হাস। দ্যাখ সব বিপদ কেটে গেছে। তুই এখন তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবি।
রুপালী নিশ্চুপ
এই বুনু দ্যাখ তোর জন্য জন্মদিনের উপহার এনেছি। কি এনেছি বলতো। দাড়া প্যাকেট টা পকেট থেকে বেড় করি। এই দ্যাখ নুপুর এনেছি তোর জন্য। তোর জন্য সব গয়না গড়িয়েছি শুধু নুপুর টাই বানানো হয়নি। তুই এই নুপুর জোড়া পরে সারা বাড়ি হেটে বেড়াবি নেচে বেড়াবি আর ঝুম ঝুম শব্দ হবে।
এই বুনু কথা বলনা।
-দাদাভাই, এই তোমার সারপ্রাইজ!
-হ্যাঁ বুনু। সোনার নুপুর
-তুমি জানো না পায়ের নুপুর সোনার পড়তে নেই।
-তাতে কি। আমার বোন পড়বে।
-তুমি আমাকে সারপ্রাইজ দিলে তবে আমিও তোমাকে সারপ্রাইজ দেই।
আমায় নুপুর জোড়া পড়িয়ে দাও।
-ওহ হ্যাঁ নিশ্চই। পাগলি বোন আমার।
চাদর টা তুলতেই মৈণাক আৎকে ওঠে। চিৎকার করে ওঠে, ডা....ক....তা...র...বা...বু....
বু..নু....র.... পা...আ..... কো.....থা.....য়?
-সরি মৈণাক বাবু। পা দুটো এমন ভাবে থেতলে গিয়েছিলো যে আমরা কেটে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছি।
মিনতি দেবী আরো উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন।
-কান্না জড়ানো গলায় বললেন, দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। তোর মতো কুলাঙ্গার ছেলের মুখ দেখতে চাই না আমি।
-কি বলছো মা
-খবরদার আমাকে মা বলে ডাকবি না। তোর মা মরে গেছে।
-কি বলছো এসব।
-রায় বাবু আমাকে সব বলেছেন।
মৈণাক রায় বাবুর দিকে তাকাতেই মিস্টার রায় মাথা নত করলেন।
মিনতি দেবী রুপালী কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
রুপালী নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আনমনে বলতে থাকলো, দাদাভাই এটুকুও জানেনা সোনার নুপুর পায়ে পড়তে নেই। আমিও সারপ্রাইজ দিয়েছি দাদা ভাই কে তাই না মা।