রুম নম্বর -৪০১
রুম নম্বর -৪০১
পরপর তিনবার কনিং বেলটা বেজে উঠলো। হোটেলে উঠে সবে মাত্র অজিত ফ্রেশ হতে বাথরুমে গেছে, এরই মধ্যে কার এমন কি জরুরী দরকার পরলো যে এমন ভাবে বেলটা বাজিয়েই যাচ্ছে। নাহ্ কারো সাথে তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট কিছু নেই।কিছু আন্দাজ করতে পারলো না অজিত। তবে হোটেলের কোনো স্টাফই হবে হয়ত। তবেকি আসার সময় তাড়াহুড়ায় কোনো কিছু ভুলে ফেলে এসেছে? তাই হবে হয়ত। এই ভাবতে ভাবতে অজিত ভেজা মাথাতেই তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে হোটেলের দরজা খুলে বাইরেটা উঁকি দিল।
নাহ্ কেউ নেই। দু একবার উপর নিচে দেখে অজিতের চোখ গেল ঠিক উল্টো দিকে হোটেলের আরেকটা রুম এর দিকে। একই রকমের আরেকটা রুম।রুম নম্বর ৪০২। তার টা ৪০১। অজিত মুহূর্তে ভাবলো তবে নিশ্চই উল্টো দিকের রুমের কোনো গেস্ট দুটো রুম এর মধ্যে গুলিতে ফেলেই ভুল করে বেল বাজিয়েছে, পরে বুঝতে পেরে চলে গেছে। অজিত আর ভাবলো না। ঘরে ফিরে এলো।
ঘরে ফিরে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে অজিত এবার মধুমিতার কাছে এসে বসলো। মধুমিতা তার অফিসের জুনিওর, অফিস ট্রিপে এইবার সে ওকেই নিয়ে এসেছে। যদিও এতবড়ো প্রজেক্ট এর কাজে একজন ইন্টার্নকে নিয়ে আসার কারণ নিয়ে অফিসের অনেকেই ভ্রু কুঁচকেছিল। মধুমিতার উপরেও অনেকে তির্যক দৃষ্টি ফেলেছিল। একটা নতুন মেয়ে ক'দিন এসেই বস কে বাগিয়ে নিয়ে, এত বড়ো প্রজেক্টের ট্রিপে আসতে পেরেছে,সেটা অনেকেরই গায়ে লাগাবার কারন বটেই। যদিও অনেকেই ,বলতে গেলে সবাই জানে এর পেছনের আসলে কারণটা কি! মধুমিতা অতিব যৌবনা, পরিপূর্ণ, ও আকর্ষনীয়। তাই তার পক্ষে বস কে খুশি করে প্রমোশন পাওয়া শুধু সময়ের খেল মাত্র।
কিড়িং কিড়িং... করে আবার তিনবার বেলটা একসাথে বেজে উঠলো। অজিতের এবার মাথা গরম হয় উঠলো।
সে সবে অফিস এর ম্যানেজার এর সাথে ফোনে কোনো বিষয়ে আলোচনা করতেই মানিব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করছিল, আর এক হাতে কাচের গ্লাসে একটু করে রঙিন পানিও ঢালতে শুরু করেছিল। মেজাজটা তার খিঁচকে গেলো। তাড়াহুড়োয় উঠে এসে সে দরাম করে দরজাটা খুলতে গিয়েই হোঁচট খেলো। খোলা দরজার বাইরে ছিটকে গিয়ে হতে ধরা গ্লাস ও মানিব্যাগ সব এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেলো।
অকারণে এরকম বেল বাজানোয় সে মনে মনে গালাগালি দিতে দিতে মেঝে থেকে উঠতে গিয়েই অজিত এবার ছিটকে সরে এলো। একটা হোটেলের কার্ড যেনো তার দৃষ্টি কে মূহুর্তে আচ্ছন্ন করে দিল। যেন হৃদপিন্ড ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো ।
হটাৎ করে সে ফিরে গেলো এক বছর আগের একটা ঘটনায়। সে বারও অফিস ট্যুরের সে এমনি একটি হোটেলে অনামিকা কে নিয়ে এসছিল। আর সেখানেই সে তার সাথে চূড়ান্ত ফুর্তি করে নেশার ঘোরে তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অনামিকাও ছিলো মধুমিতার মতই তার জুনিওর। অনামিকা মা হতে চেয়েছিল। আর তাই সেই খবর দিতেই একদিন সে অজিতকে ডেকে পাঠিয়েছিল একটি হোটেলে। অফিসের বাইরে এই হোটেলেই তার এব্যাপারে আলোচনা করা ঠিক মনে হয়েছিল। হোটেলের কার্ড ও দিয়েছিল সে তাকে ,কিন্তু অজিত সেসব দেখেনি, মানিব্যাগ এর একটা কোনায় রেখে দায় সেরে ছিল। সেদিন সে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে হোটেলের নামটুকু পর্যন্ত দেখার সময় হইনি। অনামিকা জানতো তার পরিবার এসব মানবে না,তাই পরিবারকে ছেড়ে সে সেদিন উঠে এসেছিল হোটেলে। কিন্তু অজিত কথা রাখেনি, নাহ্ দেখা করতেও আসেনি পর্যন্ত, বিয়ে তো দূরের কথা। সেদিন তাকে প্রত্যাখ্যান করে দায়িত্ব থেকে সরে গেছিলো। যদিও অজিত পরে জেনেছিল সেদিন অনামিকা তাকে বহুবার ফোন করার পরও না পেয়ে শেষমেশ লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে হোটেলের রুমেই আত্মহত্যা করে প্রাণ দিয়েছিল।
অজিতের হাত পা ভয়ে কাঠ হয়ে এলো। গলার কাছটা শুকিয়ে এসেছে। চোখে অন্ধকার। তার শরীরে একফোঁটা আঙ্গুল নাড়াবার মত শক্তি নেই। বিস্ফোরিত চোখে ভয়ে সে , হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে মানিব্যাগ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আশা একটা হোটেলের কার্ড এর দিকে দেখলো, তাতে লেখা আছে , হোটেল লারিকা। রুম নম্বর ৪০১।
এতক্ষণে তার কাছে কনিং বেল বাজানোর ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। হ্যাঁ সবটা পরিষ্কার। এক বছর আগে অনামিকা তার জন্য যে ঘরটায় আত্মহত্যা করেছিল , সেটা আর কোনো ঘর নয়, আজ সে যে ঘরে মধুমিতা কে নিয়ে উঠেছে, সেই , সেই ঘর। আর তার আসার পর থেকেই কলিং বেলটা বাইরের কেউ বাজাচ্ছে না। এতক্ষন ধরে যে, কলিং বেল বাজাচ্ছিল সে আর কেউ নয় , সে আজ থেকে এক বছর আগে ওই ঘরেই আত্মহত্যা করা অজিতেরই জুনিওর - অনামিকা ! এক বছর আগে যার জন্য সে নিজেকে শেষ করেছিল, আজ এক বছর পর তাকে কাছে পেয়েই যেন সে আবার ফিরে এসেছে প্রতিশোধ এর স্পিহা নিয়ে ।
মুহূর্তে বাইরে ভীষণ ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলো। অজিতের চোখের সামনে এখন আর কোনো পার্থিব বস্তুর উপলদ্ধি নেই। যেন গুমোট বাধা অন্ধকারে সে মিলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, আর সেই ভয়ংকর অন্ধকারের মধ্যেই যেন অসতি দূরে একটা আবছায়া আকার নিয়ে শুরু করেছে, অজিতের চোখ বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করেছে, ক্রমে ক্রমে সে আকার টি সম্পূর্ণ নারী রূপ ধারণ করে এগিয়ে আসছে অজিতের ই দিকে... অজিতের হৃদপিন্ড একবার জোরে কেপে উঠে শান্ত হলো। জ্ঞান হারিয়ে সামনের ফ্লোরে লুটিয়ে গেলো অজিতের সংজ্ঞাহীন দেহটা।