ব্যাতিক্রম
ব্যাতিক্রম
অন্ধকারের গাঢ়ত্বে রাতের গভীরতা মাপার ক্ষমতা নীলের কখনোই ছিল না। তাইতো সেই ছেলেবেলা থেকে আজকের ব্যস্ত কর্মজীবন অবধি কত বিনিদ্র রজনীই যে, সে কাটিয়েছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই।
সদ্য অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে নীল হাসপাতালের ডক্টরস রুম এর দিকেই এগোচ্ছিল,বড্ড ধকল যাচ্ছে তার আজকাল। মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীর নম্বর নিয়ে ডক্টরি পাস করেও সে অন্যান্য ডক্টরদের মত শুধুই দুটো - পাঁচটা ডিউটি করতে পারেনি। তার স্বপ্ন, একটা মানুষও যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়,আর তাই সে সেচ্ছায় অসহায়ের সেবায়, সারাদিন হাসপাতালেই কাটায়। যত রুগীই হোক না কেনো, কিংবা যত রাতেই যে কোনো জরুরী পরিষেবারই দরকার পড়ুক,নীল কখনো না বলতে পারেনি। শুরু শুরুতে অনেকে বারণ করতো,কিন্তু নাহ্ ব্যাতিক্রমীরা বোধ হয় এমনই হয়।
হটাৎ পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া এক ওয়ার্ড বয় এর মুখে একটা নাম শুনে যেন থমকে গেলো।
"দয়িতা চক্রবর্তী।"
হ্যাঁ দয়ীতা চক্রবর্তীই । ঠিক এই নামটাই উচ্চারণ করেছে ওয়ার্ড বয়।
৭ বছর আগের ঘটনা :
#########
বাবা মরা একটা কিশোর ছেলেকে আজ শুধু মাত্র আর্থিক ও সামাজিক নিন্মবিত্তের কারণে মার খেতে হয়ছে , শুধু মার নয় ভাঙ্গা ঘর টুকু জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে অচ্ছুৎ হবার কারণে। যদিও আসল কারণ ছিলো অন্য, আর সেটিই ছিলো প্রকট। এই অচ্ছুত ছেলেটি ভালোবেসেছিলো উচ্চবৃত্ত গ্রাম প্রধানের একমাত্র মেয়েটিকে।
ভালোবাসা নিষ্পাপ। তাইতো দুটি মন উঁচু নিচুর ভেদ করতে পারেনি। চেয়েছিলো এক হতে। কিন্তু পারেনি। মুখোষধারি সামাজিক পার্থক্য আলাদা করেছিল সেদিন দুটো কিশোর কিশোরীকে, সেদিনের অসহায় নীল আর দয়িতাকে।
হাসপাতালের বাইরে :
#############
"এটা পুলিশ কেস। পুলিশ না আসা অবধি কোনো ট্রিটমেন্ট হবেনা। " ওয়ার্ড বয় একজন মাঝ বয়সি বিধ্বস্ত মানুষকে এই কথাটাই বারবার বলে যাচ্ছিল।
"দয়া করুন। মেয়েটা আমার মরে যাবে। দয়া করুন। " মাঝ বয়সী ভদ্রলোক হাত জোড় করে গুনগুন করছিল।
" দেখুন আপনার মেয়েকে শশুর বাড়ির লোক পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে। এটা মার্ডার কেস। পুলিশ না আসা অবধি কিছু করার নেই। আর হসপিটালে এত রাতে কোনো ডক্টরও নেই। একজনই আছে, কিন্তু ওনার এখন ডিউটি নেই, তাও ইমার্জেন্সী কেস বলে উনি এই মাত্র একটা অপারেশন করতে ঢুকেছেন। ওনার পক্ষে আর সম্ভব নয়।" কথা গুলো এক নাগাড়ে বলে গেল ওয়ার্ড বয়টি।
ভদ্রলোক যেন হতাশায় হাউমাউ করে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদা কাঁদা গলায় বলে উঠলো আমি ওনার পায়ে ধরতে রাজি, দয়া করতে বলুন। প্লিজ। নয়ত আমার একমাত্র মেয়ে ... কথা শেষ হলো না, ভদ্রলোকের গলা কেঁপে উঠলো।
নীল আবার চমকে উঠলো। এ লোকের গলা তার পরিচিত। ডক্টরস চেম্বারে ঢুকতে গিয়েও সে সরে এলো বাইরের লনটায়। দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারলো ভদ্রলোক আর কেউ নয়, ইনি দয়িতার বাবা ,তাদের সেই গ্রাম প্রধান। নাহ্ মানুষটা অনেক বদলে গেছে। নদীর মত শান্ত হয়ে গেছে।
নীল এগিয়ে এলো। ওয়ার্ড বয়কে ইশারা করে বললো পেসেন্টকে অপারেশন রুম এ নিয়ে যেতে। নাহ্ নীল আজ আর সেই সাত বছর আগের পরিচয়হীন যুবক নেই। সে আজ প্রতিষ্ঠিত। নামের আগে একটা ডক্টর উপমা সমাজ উচ্চারণ করে।
জানিনা হয়তো দায়িত্ব বোধ মানুষকে সমস্ত সম্পর্কের চাইতে অনেকটা উচুতে নিয়ে যায়।একটা অন্য মাত্রা দেয়। আর তাই এই মুহূর্তে সে একজন ডক্টর হয়ে একজন মুমূর্ষ রুগী ও অসহায় পরিবারের বিপদে কি করে সরে যাবে। সে যে সেচ্চায় এই যুদ্ধে সামিল হয়েছে। তাই হোক না যতই সে রুগীর নাম দয়িতা কিংবা তার পরিবার।
নীল কে দেখে দয়ীতার বাবার কি অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই অনুমে়য়। চরমতম লজ্জায় সে লোকটি মাটিতে মিশে বোধ হয় পুরনো সব পাপ এর পায়িশ্চিত্য করেছিল। পরিবারের কিছুটা পাপের দায় হতো মেয়েটির ও ভোগ করবার ছিল, আর তাই আজ তার (দয়িতা) এই অবস্থা।
অপারেশন রুমে :
#######
প্রিয়জনকে ভালোবাসতে গেলেও বোধকরি আঘাত পেতে হয়। অপারেশন রুমে আজ দীর্ঘ সাত বছর পর নীলের মুখোমুখি দয়িতা শুয়ে। শশুর বাড়ির অত্যাচারে তার শরীরের অনেকটা পুড়ে গেছে। নাহ্ মুখটায় আগুনের তেমন আঁচ আসেনি। আজও বড্ড সরল সে মুখ। সেই লাবণ্য, সেই টানা টানা চোখ। মেয়েটা আজও গাঢ় করে কাজল পরে! নীল মুহূর্তকলে হারিয়ে যাচ্ছিল ছোট বেলায়। কখনো কি সে ভেবেছিল তাদের আবারও দেখা হবে, এভাবে !
নীল নিজেকে সামলে নিল। আজ তাকে শেষ বারের মত ভালোবাসার প্রমাণ দিতেই হবে। সে ট্রে থেকে দুটো ফর্সেপ তুলে নিলো। একদিন অচ্ছুত হওয়ার কারণে তার বাড়ি জ্বলেছিল , যাকে ভালোবাসার অপরাধে তাকে সবটা মুখ বুঝে মেনে নিতে হয়েছিলো। আজ বিধাতার কি নিঠুর পরিহাস । সেই অচ্ছুত ছেলেটার হতেই মেয়েটির বাঁচা মরা নির্ভর করে আছে। আজ তাকে এই অচ্ছুৎ হতেই মেঁয়েটির সমস্ত শরীরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটু একটু করে ভালোবাসা জুড়ে জুড়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে মানবতা।