Rima Goswami

Crime Fantasy Thriller

3.8  

Rima Goswami

Crime Fantasy Thriller

রঙ্কিনী মন্দিরের নরবলি

রঙ্কিনী মন্দিরের নরবলি

11 mins
418



ঋতুপর্ণার অন্যতম প্যাশন ধর্ম বিষয়ক বই পড়া এবং এমন এমন স্থানে যাওয়ার যেখানে আছে প্রাচীন মন্দির ও লৌকিক মিথ । ঋতুপর্ণা ছেলেবেলা থেকেই একটু শান্ত স্বভাবের মেয়ে । বেনারস ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে মা বাবার কাছে কিছুদিন হাওড়াতে কাটিয়ে আবার তার মাথার পোকা নড়ে উঠলো । খবর আছে সিমলিপাল বলে এক অখ্যাত স্থানে আছে রঙ্কিনী মাতার মন্দির । অনেক দৈবিক ও লৌকিক মিথ তাকে ঘিরে । কৌশিকি অমাবস্যার দিন নাকি আজও সেই মন্দিরের ভিতর নরবলি হয় । মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ বেয়ে পরের দিন নেমে আসে শোনিত ধারা । ওই এলাকার সকলে মন্দিরের চত্বর এড়িয়েই চলে । অথচ এক সময় নাকি মা রঙ্কিনীর আশির্বাদ নিয়েই গড়ে উঠেছিল সিমলিপালের জমিদারির রমরমা । সেই জমিদারি ও আজ নেই আর জমিদার ও নেই । তাদের বংশের শেষ বংশধর এক পাগল এখনো বাস করে আজও । ঋতু শাস্ত্র সমন্ধে ভীষণ ভাবে ওয়াকিবহাল তো রঙ্কিনী মাতার মন্দিরের রহস্য উন্মোচন করে সিমলিপালের মানুষ গুলোকে ভয় মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় । আসলে দেবতা তো আমাদের পসিজিভ ভাইবস দেন । সেই দেবতার মন্দির কি করে নেগেটিভিটি ছড়াচ্ছে এটা জানা ওর মনে হয় খুব দরকার । ও তাই সত্য ওর বন্ধু কাম ভালোবাসাকে নিয়ে রওনা দিল সিমলিপালের দিকে । কলকাতা দুর্গাপুর হাইওয়ে হয়ে ধীরে ধীরে সুইফট ডিসায়ারটা এন এইচ ছেড়ে  গ্রামের কাঁচা মেঠো পথ ধরলো । কাল রাতেই সিমলিপাল গ্রামের সেই বহু অপেক্ষিত ভয়াবহ কৌশিকি অমাবস্যা । গ্রামের মোড়ল সপ্তম গুহর বাড়িতে থাকার কথা ঋতুপর্ণা আর সত্যের । ওরা যখন সপ্তম বাবুর বাড়ি পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে । অন্ধকার ও নিস্তব্ধতাকে চিরে ঝি ঝি পোকার শব্দে চারদিক যেন আরো ভয়াবহ আবহাওয়া নির্মাণ করেছে । গাড়িটা একটা মাটির দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে ঋতু আর সত্য নেমে এলো । 


মাটির দাওয়াতে বসে বিড়ি খাচ্ছিল সপ্তক বাবু । ঋতুপর্ণা আর সত্যকে দেখেই বেশ লজ্জিত হয়ে বিড়িটা সযত্নে লুকিয়ে ফেলে দেয় । ঋতু নিজের পরিচয় দিতেই সপ্তক বাবু বেশ আপ্যায়ন করেই ওদের ভিতর বাড়িতে নিয়ে গেলেন । রাতের বেলা আটার রুটি আর দেশি মোরগের ঝোল খেয়ে ঋতু সপ্তক বাবুর বয়স্কা স্ত্রীর সাথে শুতে গেল ।সপ্তক বাবুর সাথে শুতে গেল সত্য । মোড়ল গিন্নি পানের বাটা নিয়ে ঋতুকে জানালো এই রঙ্কিনী মাতার অভিশাপ এক অলঙ্কার চুরির রহস্যের সঙ্গে জড়িত । এদিকে সত্যকে নানান বকবক করে জ্বালিয়ে খেল মোড়ল মশাই । উনি কি করে শিকার করেছিলেন এক বুনো শুয়োরকে । গ্রামের সকলে মিলে কেমন ভালোবাসে তাকে । ওনার ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল পর্যন্ত খায় । সত্য শেষের দিকের কথা গুলো আর শুনতে পায়না কারণ ততক্ষণে মশার কামড় উপেক্ষা করে নিদ্রা দেবী নেমে এসেছে ওর দুচোখে । সত্যকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে সপ্তক বাবুও ঘুমিয়ে পড়েন।  কাল সকালে আবার তোড়জোড় করতে হবে রঙ্কিনী মাতার পুজোর । মা এবার কাকে বলি হিসেবে গ্রহণ করবে এই চিন্তায় সকলের বুক শুকিয়ে যাচ্ছে । ঋতু ঘুমানোর আগে একটা রিসার্চ সেরে নেয় মনে মনে । 


সকালে ঘুম ভেঙে ঋতু দেখে মোড়ল গিন্নি ততক্ষণে স্নান সেরে মাথায় গামছা জড়িয়ে শাড়ি পড়ছে । ঋতুকে ঘুম ভাঙতে দেখে মোড়ল গিন্নি বললেন , বাছা আজ গ্রামের মহা পুজো । তবে দিনটা বড্ড ভয়ানক । আমরা নির্জলা উপবাস করি । অথিতিকে না খাইয়ে রাখতে নেই তবু অনুরোধ ভেবে যদি তোমরাও উপোস দাও । জোর করব না তবুও কি জানো তো বড্ড ভয় লাগে ,কি থেকে কি হয় । 

ঋতু জানায় সারা গ্রাম উপোস দিলে তারাও দেবে । গিন্নিমা একটা পাট ভাঙা শাড়ি দেয় ঋতুকে । উনি বলেন স্নান সেরে শাড়িটা ঋতু পড়ুক তারপর উনি ঋতুকে নিয়েই যাবেন মন্দিরের বাইরে পুজো দিতে । পরিপাটি হয়ে ঋতু দেখে সত্য একটা সাদা ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবি পরে তৈরি । সত্য ঋতুকে দেখে জানায় তার রাত মশার অত্যাচারে কি বিভীষিকাময় ছিল । ঋতু সত্যর এই অবস্থা দেখে বেশ মজা নেয় । সত্য , ঋতু আর গিন্নি মা যায় জমিদার বাড়ির পাশে থাকা মন্দিরের কাছে । ভাঙা জমিদার বাড়ির পাশে একটা ভগ্ন প্রায় টেরাকোটা কাজের মন্দির । চারদিকে অজস্র গাছপালা এলাকাটাকে ঘিরে রেখেছে ফলে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলোর অভাব এখানে । মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করার ক্ষমতা নেই কারো । প্রবেশ পথ ও শিকড় বাকরে ঢেকে গেছে । দেখেই বোঝা যায় দরজার ব্যবহার নেই বহুকাল । মন্দিরের বাইরে চাতালে পুজো দিচ্ছে গ্রামের মেয়ে বৌরা । একটা ঝুড়ি নেমে আসা বট গাছের পাশে এক সাথে সার দিয়ে বাঁধা আছে একশো আটটি পাঠা । গিন্নিমা বেশ গর্ব করে বললেন ওনার কর্তা সপ্তক গুহ একশো পাঠা উৎসর্গ করবেন মা রঙ্কিনীকে এবছর । বাকি আটটি অন্য সকল গ্রামবাসীদের কেউ কেউ দিয়েছে । ঋতুর মন খারাপ হয়ে গেল এই নিরীহ পশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে । ঋতু বললো , গিন্নিমা মাতা রঙ্কিনী তো মা অদ্যাশক্তির এক অনন্ত রূপক । তিনি মা তাই তার অহংকার তার সন্তান , তার অলঙ্কার তার সন্তান । সেই সন্তান কেবলমাত্র মানুষ নয় , এই পৃথিবীর সকল জীব । এই পাঠা গুলোর রক্ত মাকে তুষ্ট করবেন না । 


ঋতুর কথার মাঝে এসে হাজির হলেন এই এলাকার তান্ত্রিক পুরোহিত ভটাচর্য্য মশাই । ওনার পরনে লাল কৌপিন কিন্তু মুখে একটা প্রশান্ত ভাব । উনি বললেন মকর রাশিতে বাস করে এই কন্যা । এই কন্যার নামে জড়িত আছে ঋ .. 

এই কন্যা সুলক্ষনা ও বীরাঙ্গনা । ঋতু অবাক হয় ভটাচর্য্য মশাইকে দেখে । উনি ঋতুকে বলেন ওনার সাথে যেতে । ঋতু আর সত্য ওনাকে ফলো করে । উনি জমিদার বাড়ির দুর্গা দালানের কাছে নিয়ে যায় ওদের । ওখানে বসে যায় তিনজন । পরিচয় দেবার পর ভটাচর্য্য মশাই ওদের বলতে শুরু করেন … 


দেবী রঙ্কিনী এখানকার অধিবাসীদের দেবী নন। আসলে তিনি ছিলেন মল্ল রাজপুতানার রাজপুতদের আরাধ্যা দেবী। মা দুর্গারই এক রূপ। ভয়ঙ্করী হলেও তিনি আদিশক্তি,তিনিই পরমেশ্বরী, আবার তিনিই করুণাময়ী, অনন্তরূপা। কোন এক মল্ল জাতির শাসক এখানে আসেন জমিদার মোহন সিংহের কালে । তিনি রঙ্কিনী মাতার এই মূর্তি দিয়ে যান জমিদার বাবুকে । জমিদার বাবু প্রথমে অষ্ট ধাতু নির্মিত মূর্তিটি দেরাজে তুলে রাখলেও পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাকে নিজের গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন । টেরাকোটার মন্দিরে মায়ের মূর্তি স্থাপনের দিন ছিল কৌশিকি অমাবস্যা । তাই বছর বছর এই দিনটাতে মায়ের বাৎসরিক পুজো হয়ে আসছে । বহুকাল আগে বর্তমান পাগল জমিদার বাড়ির ওয়ারিস কর্ণ সিংহের পিতা বিজয় সিংহের কালে রঙ্কিনী মাতার মন্দিরের মহার্ঘ গয়না সকল চুরি যায় । পরের দিন ছিল কৌশিকি অমাবস্যা আর সেদিন রাতেই প্রথম একটি মানুষের দ্বিখন্ডিত দেহ মেলে মায়ের মন্দিরে । মায়ের বলির হাঁড়ি কাঠের কাছে পড়ে ছিল দেহটা আর মাথাটা মায়ের মূর্তির কোলের কাছে । মায়ের মুখে লেগে ছিল রক্তের দাগ । মূর্তি পাথরের হলেও একটি রুপোর খাঁরা থাকত মায়ের কাছে । সেটাতেই লেগে ছিল রক্তের ধারা । সকলে ভেবে নেয় এই লোকটা অলঙ্কার চুরির সাথে জড়িত । মা তাকে নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছে । লোকটার পরিচয় পাওয়া যায় । লোকটা ছিল পাশের বাগদি পাড়ার এক বাগদি লোকের । জমিদার বাবু রাগের মাথায় হানা দিয়ে সব মিলিয়ে ওই পাড়ার মোট একশ আটটি পুরুষকে বিনা প্রমানে তুলে এনে মায়ের মন্দিরে বলি দিয়ে দেয় । ব্যাস তারপর পরের বছর পাওয়া যায় জমিদার বাবুর ও তার বড় ছেলের দ্বিখন্ডিত দেহ । ছোট জন ও মন্দিরের মধ্যেই পড়ে ছিল তখন সে দশ বছরের ছেলে মাত্র। সেই থেকে ওই ছেলে পাগল হয়ে যায় । একে একে সকলে মরে যায় জমিদার বাড়ির । মায়ের কোন ইচ্ছায় রয়ে যায় পাগল ওয়ারিস কর্ণ সিংহ । জমিদার বাবুর মৃত্যুতে চিরকালের মত বন্ধ হয়ে যায় মন্দিরের কবাট । তবুও নরবলি বন্ধ হয়নি । কেউনা কেউ ঠিক মরেছে এই দিনে । এই প্রথা চলে আসছে কালের নিয়মে । এখন শেষ বংশধর কর্ণ সিংহ ও বৃদ্ধ হয়ে গেছেন । মাথার ঠিক নেই , গ্রামের মানুষের দয়ায় বেঁচে আছেন । উনিও আজ আছেন কাল নেই । এই পর্যন্ত বলে ভটাচর্য্য বাবু থামলেন । অনেক ক্ষণ কথা বলার ফলে হাঁপিয়ে উঠেছেন বেশ । ঋতু ওনাকে জানতে চায় , গয়না গুলোর হদিস কি আর পাওয়া যায়নি ? 


উনি মাথা নেড়ে না সূচক ইঙ্গিত করেন । উনি এও জানান যে জমিদারের ওই নৃশংসতা আর একশো আটটি মানুষের রক্তের অভিশাপ বয়ে যাচ্ছে এই সিমিলিপাল গাঁ । সব কথার শেষ ভটাচর্য্য মশাই ঋতুকে অনুরোধ করে যদি ঋতু পারে এই নারকীয় খেলা শেষ করতে তাহলে উনি চির কৃতজ্ঞ থাকবেন । ঋতু জানায় তার সব জ্ঞান দিয়ে চেষ্টা করবে । উনি চলে যান পুজোর কাজে । 


ঋতু বলে এই মন্দিরের ভিতরটা সে দেখবে তবে ভীত গ্রামের মানুষ তাকে কিছুতেই অনুমতি দেবে না । তাই সত্য পাহারায় থাকবে আর ঋতু যাবে ভিতরে । সত্য বলে রিস্ক হয়ে যাবে । গেলে দুজনেই যাবে । ওরা লোকের চোখ এড়িয়ে ওই পুরোনো বন্ধ দরজা দিয়ে ঢুকতে পারবে না তাই ভেবে নেয় পিছনের দিকের জরাজীর্ণ দেওয়ালে সিদ কেটে ওরা ভিতরে ঢুকে যাবে । জমিদার বাড়ির গা ঘেঁষে তৈরি মন্দিরের পিছনে একটা মজা নদীর মত । সেখানে উপস্থিত হয় ওরা । টেরাকোটা মন্দিরের ক্ষতি হচ্ছে জেনেও বাধ্য হয়ে মন্দিরের একাংশর ক্ষতি করেই ওরা ভিতরে ঢুকে যায় । অন্ধকার মন্দিরের ভিতরে মাকড়সার জালে ও ধুলোতে ভর্তি । টর্চ জ্বলতে ওরা দেখে বেদীতে বিরাজিতা দেবী রঙ্কিনী । মায়ের মূর্তি দেখে ঋতুর দীর্ঘ ঐশ্বরিক শিক্ষা তাকে বলে , এই মাতৃ মূর্তি কি করে অলঙ্কার হারানোর রাগে তার অহংকার .. তার সন্তানদের জীবন হরণ করতে পারেন ? মাকে হাত জোড় করে প্রণাম করে ঋতুপর্ণা । সত্য এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ করে আবিষ্কার করে মোড়ল সপ্তক গুহর ছেলেটিকে । সত্য ডাকলো ঋতুকে । ওরা দেখলো ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি একুশ বছর হবে । ছেলেটি মুখ , হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মন্দিরের এক কোনে । ওকে বাঁধন খুলে দিতেই ছেলেটা কেঁদে উঠলো । ঋতু ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলো বন্ধ মন্দিরের ভিতরে সে এলো কি করে ? 


ছেলেটার হাঁটু কাঁপছে , দাঁড়াতে পারছে না । ছেলেটা ওদের একটা বিশাল দেওয়াল মূর্তি দেখালো ইশারায় । ওরা ওখানে এগিয়ে যেতে ছেলেটা কাঁপা হাতে ওই দেওয়ালে একটু চাপ দিতেই একটা গুপ্ত রাস্তা খুলে গেল । ছেলেটাকে ফলো করে ওরা নেমে গেল সেদিকে । কিছুটা যেতেই ওরা দেখলো এই টানেল জমিদার বাড়ির সঙ্গে যুক্ত । ঋতুর বুঝতে বাকি থাকে না যে জমিদার বাড়ির ভিতরে এই টানেল দিয়ে মানুষ এনে প্রতি বছর হত্যা করা হয় । সবাই ভাবে বন্ধ মন্দিরে মানুষের রক্ত আসে কোথা থেকে । জমিদার বাড়ির কাছে এসে মোড়লের ছেলে জানায় তাকে একটু আগেই ওই পাগল কর্ণ সিংহ তুলে এনে এখানে বেঁধে দেয় । লোকটা আদতে পাগল নয় , ও পাগল সেজে এই নারকীয় খেলা খেলে । 


ঋতু ছেলেটাকে বলে এই ত্রাস এখনই শেষ করা যায় তবুও শেষটা একটু নাটকীয় হওয়াটা বাঞ্চনীয় । ওকে আবার ওই পথে এনে হাত পা বেঁধে রেখে দেয় সত্য আর ঋতু । ওরা লুকিয়ে থাকে একপাশে । ভয় একটাই যদি মন্দিরের ভাঙা অংশ চোখে পড়ে যায় কর্ণ সিংহর ? কিছু করার নেই , এটুকু রিস্ক নিতেই হবে । 


অনেক অপেক্ষার পর মাঝ রাতে সুড়ঙ্গ পথে উঠে আসে জমিদার বংশের শেষ ওয়ারিস কর্ণ সিংহ । বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে এসেছেন । মন্দিরে প্রবেশ করে প্রথমেই সে অজস্র গয়নায় মাকে সাজিয়ে দেয় । তারপর হাতে রুপোর চন্দ্রহাঁস খাড়া নিয়ে এগিয়ে এসে ছেলেটির বাঁধন খুলে দেয় । ছেলেটাকে শেখানো বুলি সে আউরে দেয় .. 

দাদু তুমি পাগল নও ! মায়ের চুরি যাওয়া গয়না তোমার কাছে ? 


বুড়ো হেসে উঠলো জোরে । 

ছেলেটাকে বললো , মরার আগে জেনে নে কেন এই কর্ণ সিংহ আজীবন পাগল সেজে কাটিয়ে দিল । 


সেবার গয়না গুলো ওই ধেনু বাগদিকে দিয়ে আমার বাবা বিজয় সিংহ রায় এই সব গয়না চুরি করায় । ব্যবসার জন্য পুঁজি জোটাতে না পেরে বাবা একাজ করেন । আমি সবটা লুকিয়ে দেখেছিলাম । বরাবরই আমার শরীরে হাজার হাতির বল । মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত আমি । তাই ওই শিশু কালেই আমি ঐ ধেনুকে মন্দিরে ভুলিয়ে এনে এক কোপে কেটে ফেলি মায়ের কাছে । মায়ের অলঙ্কার নেওয়ার শাস্তি । ধেনু মরে আর গয়না বাবাকে দিয়ে যেতে পারেনা । বাবা ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে বাগদিদের নিরীহ মানুষ গুলোকে বলি দিয়ে দেয় । বাবার ধারণা ছিল গয়নার খোঁজ বাগদিদের কোন লোককে দিয়ে গেছে ধেনু । আসলে গয়না আমি নিজের কাছে রেখে ছিলাম । ওই শয়তানি মেনে নিতে পারিনি আমি । পরের বছর বাবাকে আমি  নিজের হাতে মায়ের চরণে সমর্পণ করি । দাদা দেখে ফেলে সেটা তাই দাদাকেও । আমি বাবাকে আর দাদাকে মেরে ওখানেই বসে ছিলাম । মনের কষ্টে আর পালাতে পারিনি । সকলে ভাবে মা আমাকে ছেড়ে দাদা আর বাবাকে গ্রহণ করেছে । আমি ভাবি পাগলের অভিনয় করে আমি এই নরবলি চালু রাখলে কেমন হয় ? তাই পাগল সেজে প্রতি বছর এই ভাবে বছরে একদিন আমি মাকে অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে মাকে তার প্রিয় ভোগ চড়াই । এবার গ্রামের মোড়লের ছেলেকে ভোগ পেয়ে মা খুশি হবেন । 


কথার মাঝে হাততালির শব্দে ঘুরে দাঁড়ায় কর্ণ সিংহ । ঋতুপর্ণা ওর দিকে এগিয়ে আসে । কর্ণ ঋতুর মধ্যে মাকে যেন দেখতে পায় । হাত থেকে খাড়াটা পড়ে যায় । কর্ণ বলে তার সাধনা সফল হয়েছে । আজ মা রঙ্কিনী তার সামনে দাঁড়িয়ে । 


বিড়বিড় করে ওঠে কর্ণ … ওম কালী কালী মহাকালী কালীকে পাপহারিণীধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে…

ওঁ কালিকায়ৈ বিদ্মহে শ্মশানবাসিন্যৈ ধীমহি। তন্নো ঘোরে প্রচোদয়াৎ ওঁ।।


সত্য অবাক হয়ে যায় মন্ত্রচ্চারনের পর ঋতু কেমন পাল্টে যায় নিমেষে । ফর্সা ঋতু কালো বর্ন ধারণ করে । ধীরে ধীরে ঋতু পরিবর্তিত হয়ে যায় মাতা রঙ্কিনীতে । কর্ণ গদগদ হয়ে বলে মা এলি ? 

রঙ্কিনী রূপী ঋতুপর্ণা হুঙ্কার ছাড়ে … 

আমার অলঙ্কার আমার অহংকার আমার সন্তান । সে নর হোক বা বোবা জীব । তুই কে সামান্য সোনার অলঙ্কারের জন্য ওদের হত্যা করার ? নে এবার শাস্তি ভোগ কর … 


কর্ণের মাথাটা হাত দিয়েই ছিঁড়ে ফেলে দেবী । ফিনকি রক্তের ধারা বয়ে যায় মূর্তির দিকে । সত্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । ধীরে ধীরে কর্ণের দেহটা শান্ত হয়ে যায় কাঁপতে কাঁপতে । ঋতুও নিজের রূপে ফিরে আসে । আর সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । 

মোড়লের ছেলেটা এইসব ঘটনার আগেই ছুটে বেরিয়ে যায় বাইরে । মোড়ল এতক্ষন দুই অতিথি আর ছেলেকে না পেয়ে মন্দিরের আসেপাশে ঘুরছিল কেঁদে কেঁদে । সে মাকে বলছিল একশো আটটা পাঠা খেয়ে হলো না রে মা ! ওই ছেলে মেয়ে গুলোকে খাবি ? 

এই সময় ছেলেকে সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় পেয়ে মোড়ল ছেলেকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে । ছেলেটা বলে শাবল দিয়ে মূল ফটক ভেঙে সবাইকে যেতে । ভেতরে পাগল কর্ণ আর দুই অতিথি । সব শুনে মশাল জ্বেলে সবাই দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে আসে । 

সবাই দেখে অলঙ্কারে সুসজ্জিত দেবীর চোখের কোলে জলের ধারা । মাটিতে পড়ে কর্ণর মুন্ডহীন দেহ । ঋতু আর সত্য অচেতন । 

পরের দিন সকালে জ্ঞান অর্জন করে সত্য আর ঋতু কিছুই মনে করতে পারেনা । সকলে জানতে পারে আসল অপরাধী ওই কর্ণ সিংহ রায় । মা নিজে তাকে শাস্তি দিয়েছে । মা কোনদিন নিজের সন্তানের উপর অত্যাচার সহ্য করেন না । একদিন না একদিন ঠিক নিজে এসে অপরাধীদের শাস্তি দেন । ভটাচর্য্য মশাই মন্দির সুদ্ধ করে পুনরায় সবার জন্য মন্দির খুলে দেন । উনি কিন্তু খুব জানেন কে মায়ের রূপে এই অভিশাপ শেষ করেছেন ।।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime