Sucharita Das

Classics Crime Inspirational

1.1  

Sucharita Das

Classics Crime Inspirational

রক্ষকই ভক্ষক

রক্ষকই ভক্ষক

5 mins
722


 ছাদে টবের গাছগুলোকে একটু পরিস্কার করছিল তিন্নি। রোজ তো বেড়িয়ে যায় সকালে।ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে হয়ে যায় প্রায় প্রায়। তাই প্রত্যেক রবিবার ই তিন্নি গাছপালা গুলোর একটু পরিচর্যা করে। আগাছা গুলোকে উঠিয়ে একটা বালতিতে রাখছিল সে‌। হঠাৎই পাশের বাড়ির ছাদের দিকে চোখ পড়লো ওর। একটা ষোলো সতেরো বছরের মেয়ে ওই বাড়ির ছাদে কাপড় জামা শুকোতে দিচ্ছে। নতুন এসেছে মনে হয়। দু একবার চোখাচোখি হতে হাসলো তিন্নিকে দেখে। দেখে তো মনে হচ্ছে নতুন কাজের মেয়ে। কে জানে যদি অন্য কেউ হয়, তিন্নি অতো আগ্ৰহ দেখালো না আর। মেয়েটিও কাপড়জামা শুকোতে দিয়ে নেমে গেল। পরদিন থেকে তো আবার সেই ব্যস্ততা। কর্ম ব্যস্তময় জীবনে অপরদিকে তাকানোর ফুরসৎ কোথায়। সকালে অনি কে ব্রেকফাস্ট করে দিলে ও খেয়ে বেরোলে তারপর তিন্নি ও কোনো রকমে খেয়ে বের হয় স্কুলের জন্য। সারা সপ্তাহ আবার সেই একই জীবন। আবার সেই রবিবারের অপেক্ষা।


আজকাল যা অসময়ের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছুটির দিনে একটু কাচাকাচি করবে তার ও জো নেই। ওয়াশিং মেশিনে একগাদা জামাকাপড় জড়ো করে রাখা আছে।সব আজকে কাচতেই হবে। বেশ কিছুটা কাপড় কাচা হয়ে গেলে মেশিনে আধ শুকিয়ে যাওয়া কাপড়গুলো নিয়ে ছাদে গেল তিন্নি। কাপড়ে ক্লিপ লাগাতে গিয়ে দেখলো সেই মেয়েটি আজ ও কাপড় শুকোতে দিচ্ছে ওই বাড়ির ছাদে। আজ তিন্নি নিজেই জিজ্ঞেস করলো মেয়েটিকে কোথায় বাড়ি ওর। মেয়েটি বললো কাঁথি তে। ওর মামা নাকি ওকে এখানে দিয়ে গেছে । বাবা,মা নেই তাই মামা ,মামীর সংসারে অবাঞ্ছিত । কারুর মাধ্যমে খবর পেয়ে, এখানে কাজের জন্য দিয়ে গেছে ওকে। তিন্নি মেয়েটিকে বললো," ভালো করে থাক এখানে।এরা তো খুব ভালো। স্বামী, স্ত্রী আর দুই মেয়ে। মেয়ে দুটো ও তো প্রায় তোর ই সমবয়সী। এরা মানুষ হিসাবেও ভালো,পাশাপাশি থাকি তো জানি। " মেয়েটি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললো। তিন্নি বললো, "তোর নামটাই তো জানা হলো না , কি নাম তোর?" মেয়েটি বললো, 'জ্যোৎস্না'। 




সেদিন রাত্রি বেলা তিন্নি আর অনি ডিনার করছে। হঠাৎই পাশের বাড়ি থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠল। ওরকম আর্ত চিৎকার এর আগে তো কখনও শোনা যায় নি। তিন্নি খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর অনি কে জানতে চাইলো," কিছু শুনতে পেলে তুমি?" অনি তো শেয়ার মার্কেট নিয়ে ব্যস্ত ফোনে। আনমনে বললো ,"কই না তো"। তিন্নির মন কিন্তু ওইদিকেই পড়ে আছে। কে চিৎকার করলো এরকম? রাত্রি বেলা কারুর বাড়ি গিয়ে ওইভাবে কি হয়েছে জানতে চাওয়া টাও ঠিক লাগে না।কে কি ভাববে। কিন্তু সারারাত তিন্নি ঘুমাতে পারে না। সেই আর্ত চিৎকার সারারাত ওর কানে বাজতে থাকে। ভোরের দিকে একটু চোখ টা লেগে গিয়েছিল ওর। ভাগ্যিস আজ ছুটি ছিলো। একটু দেরি করেই উঠলো ও। উঠে দেখে অনি মর্নিং ওয়াক এ থেকে ফিরে ও এসেছে। দুজনে মিলে চা খেলো বসে। অনি এরপর ছুটির দিন হলে একটু নিউজ পেপারে চোখ বোলায়। তিন্নির গত কাল রাতের কথা মনে পড়তেই ও দৌড়ে ছাদের দিকে গেল। ভাবলো কাজের মেয়েটিকে একবার জানতে চাইবে কিছু হয়েছে কিনা কারুর। পাশের বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে তিন্নি মেয়েটিকে আজ দেখতে পেলো না। নেমে এলো সে ছাদ থেকে। কিন্তু রান্না করতে করতে তিন্নির মন আজ বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। মাঝে আর একবার ও ছাদে গিয়েছিল , কিন্তু মেয়েটিকে তখন ও দেখতে পেলোনা ও। বিকালে তিন্নি ব্যালকনিতে বসে চা খাচ্ছিলো। হঠাৎই দেখে পাশের বাড়ির ব্যালকনিতে কাজের মেয়েটি ওই বাড়ির দাদা কে চা দিচ্ছে। ওই বাড়ির বৌদিকে দেখতে পেলোনা তিন্নি। কিন্তু কাজের মেয়েটা মানে জ্যোৎস্না কি অসুস্থ নাকি। এরকম ধীরে ধীরে চলছে কেন ও?




তিন্নির মনে একটা অজানা কৌতুহল হল। ও ছাদে গিয়ে আবার দেখতে গেলো মেয়েটিকে। হ্যাঁ ওই তো জ্যোৎস্না দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। তিন্নি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল ও যেদিকে দাঁড়িয়েছিল সেদিকে। কিন্তু মেয়েটার মুখটা এরকম শুকনো কেন? ওর কি শরীর ভালো নেই। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলো তিন্নি। হঠাৎই ওই বাড়ির দাদা টিকে দেখে আতঙ্কে জ্যোৎস্না তাড়াতাড়ি নীচে চলে গেল। কি ব্যাপার কিছুই তো বুঝতে পারছিল না তিন্নি। মেয়েটা এতো ভয় পেয়ে গেল কেন? সেদিন রাত্রিতেও তিন্নি সেরকমই চিৎকার শুনতে পেলো আবার। না আর তো নেওয়া যাচ্ছে না ব্যাপারটা। কাল সকালে তিন্নি জানবে ব্যাপারটা কি। কে এরকম চিৎকার করে। পরদিন স্কুলে যাবার পথে তিন্নি পাশের বাড়ির কলিং বেল টা বাজালো। বেশ কিছুক্ষণ পর কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিল। তিন্নি দেখলো মেয়েটার চোখমুখে কিরকম একটা ভয়ার্ত ভাব। দরজা খুলে তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে চাইছে। তিন্নি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই ওই বাড়ির দাদা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। তারপর তিন্নি কে বললো , "আপনার বৌদি আর মেয়েরা তো নেই, দুদিন ধরে।ওরা ওদের মামার বাড়ি গেছে একটা অনুষ্ঠানে। দু'দিন পর ফিরবে ওরা। কিছু কি দরকার আছে?" তিন্নি বললো, "না না সেরকম কিছু না । আসলে বৌদির সঙ্গে একটু দরকার ছিলো। ও ইচ্ছা করেই রাত্রি বেলার চিৎকার এর কথা বললো না"। কিন্তু ওর মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগলো। বাড়িতে কেউ নেই দুদিন ধরে। তাহলে এই চিৎকার কেন আসছে বাড়ি থেকে রাত্রি বেলা? কিছু তো একটা হচ্ছে এই বাড়িতে।




তিন্নি স্কুলে গিয়েও অন্যমনস্ক । স্কুল থেকে ফেরার সময় পাশের বাড়ির দিকে নিজের অজান্তেই চোখ চলে গেল ওর। দেখলো জ্যোৎস্না জানলা দিয়ে ওকে ইশারা করে ছাদে যেতে বলছে। তবে কি মেয়েটা কিছু বলতে চাইছে ওকে? তিন্নি তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলে সোজা ছাদে চলে গেল। দেখলো জ্যোৎস্না দাঁড়িয়ে আছে ওর জন্য। ওকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো মেয়েটা। তিন্নি কিছুই বুঝতে পারছিল না। জানতে চাইলো জ্যোৎস্না কে," কাঁদছিস কেন‌ কি হয়েছে বল্ আমাকে।"জ্যোৎস্না শুধু বললো," ও দিদি তুমি আমাকে বাঁচাও। ঘরে বৌদি নেই। দাদাবাবু রোজ রাতে আমার উপর অত্যাচার করে। ও দিদি আমি এবার মরে যাব গো। আর সহ্য করতে পারছি না আমি। দাদাবাবু এখন নেই , একটু বেরিয়েছে, তাই তোমাকে বলতে এসেছি।" তিন্নির আর বুঝতে বাকি রইলো না গত দুদিন ধরে কিসের জন্য পাশের বাড়ি থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসছে। তিন্নি জ্যোৎস্না কে বললো, "তুই আমার ঘরে চলে আয় । বাকিটা আমি দেখছি।" 




 পরের ঘটনা তিন্নি কে মানুষ হিসাবে আরও লজ্জা দিয়েছিল। জ্যোৎস্নার বাড়িতে ওর মামার নাম্বারে তিন্নি ফোন করে ওর মামাকে সব ঘটনা জানালে, জ্যোৎস্না র মামা উত্তরে বলে "গরীব মানুষকে এই টুকু সহ্য করতে হয় ম্যাডাম। ওকে ওখানেই থাকতে বলুন। এখানে আমি আনতে পারব না। " তিন্নি এরপর পাশের বাড়ির বৌদিকে ফোনে সমস্ত ঘটনা জানায়। সেখানেও তিন্নি হতাশ হয়। বৌদি বলে "ওই মেয়েকে এখনই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলো । ওর চরিত্রের ঠিক নেই।তোমার দাদা ওরকম মানুষ ই না।"এরপর আর কাকে কি বলার আছে। তিন্নি জ্যোৎস্না কে সঙ্গে নিয়ে লোকাল থানায় একটা ডায়েরি করে রাখে। ওরাই জ্যোৎস্না কে একটা হোমে রাখাবার ব্যবস্থা করে দেয়। তিন্নি জানে না প্রকৃত অর্থেই সে জ্যোৎস্না কে বাঁচাতে পারলো কি না? কারণ ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় সময়ের অভাবে, সাহায্যের অভাবে অনেক কিছুই করা যায় না। আজকাল ব্যস্ত জীবনে কেউ কাউকে সেভাবে চেনে না, একটা মানুষ আপাতদৃষ্টিতে দেখতে ভদ্র হলেও সেটা তার ভদ্রতার মুখোশ কিনা,সেটাও তিন্নির অজানা। জ্যোৎস্নার মতো বহু গরীব মেয়ে শহরে ছড়িয়ে আছে, রোজ অত্যাচারিত হচ্ছে তারা। যতদিন না মনুষ্যত্বের জাগরণ হচ্ছে মানুষের মধ্যে, ততদিন আমরা হাত,পা থেকেও নিরূপায়। যেখানে রক্ষকই স্বয়ং ভক্ষক রূপে বিরাজমান, সেখানে কার কি ই বা করবার আছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics