রিক্সাওয়ালা
রিক্সাওয়ালা
রিক্সাওয়ালা
পর্ব ১
নাহ, আজও পারলো না, ঘুরে এলো। গ্যারেজের সামনে একটা দোকান থেকে দুটো সিঙ্গাপুরী কলা আর একটা গোল পাউরুটি খেল বলাই। বলাই হালদার। জাতে জেলে, শখে রিক্সাওয়ালা। বাপ ঠাকুরদার বেশ নাম ডাক ছিল এপাড়ায় মাছ ধরাতে ,.... একডাকে সক্কলে চিনত বাপকে খগেন মাছুয়া নামে। কিছু পয়সা কড়িও হয়েছিল। কিন্ত বলাই গেল উল্টো পথে। ছোট থেকেই জয়নুল চাচার রিক্সা তাকে খুব টানতো। বয়স যখন বারো পনেরো ঠিক ঠাওর করতে পারেনা নিজেও কারণ ওদের নাকি বয়সের মা বাপ নেই... এমনটাই ছোট থেকে শুনে আসছে....তখন বিস্ফোরিত চোখে শুনতো চাচার রিক্সা টানার গল্প। যেমন গল্পের গরু গাছে চড়ে, তেমনি তার কাছে রিক্সা হয়ে উঠত পক্ষীরাজ ঘোড়া। হরেক রাস্তা কোনটা গিজগিজে ভিড় আবার কোনটা এক্কেবারে শুনশান.... চোখের সামনে ওর ভেসে উঠত চাচা রিক্সা নিয়ে যাচ্ছে, লোম খাড়া হয়ে যেত রোমাঞ্চে। সে রিক্সার বিভিন্ন যাত্রী, চাচা তাদের সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেয়।চাচা কেমন রিক্সায় ওঠে, কেমন শক্ত হাতে হ্যান্ডেল ধরে তার রপ্ত হয়ে গেছিল। মনে মনে গিঁট বেঁধে নিয়েছিল সে বড় হয়ে রিক্সাওয়ালাই হবে। আপাদমস্তক লাঠি খেয়েচিল বাপের কাছে, তবু এ ইচ্ছে থেকে কেউ তাকে নিরস্ত করতে পারেনি। হয়ে উঠেছিল পাক্কা রিক্সাওয়ালা।
ইদানিং বাজারে টোটো গাড়ি এসেছে। বউ, পাড়াপড়শী , বন্ধুবান্ধব সকলেই তাকে যুক্তি দিয়েছে রিক্সা বিক্রি করে টোটো কেনার কথা। এতে ব্যবসাও ভালো হবে,বেশ কিছু পয়সাও আসবে ঘরে। বাপ যতদিন জীবিত ছিল খেয়ে পড়ে বাঁচছিল ওরা, এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বলাই জানে এমন দশা তার জেদের জন্য। কিই বা তার বয়স .....বছর পঁয়তাল্লিশ হবে। তার বয়সের সব রিক্সাওয়ালাই কমবেশি টোটো কিনে বহাল তবিয়তে আছে। শুধুমাত্র বয়ঃবৃদ্ধ কিছু এখনো রিক্সা রেখে দিয়েছে.... আধুনিক প্রযুক্তিতে নিজেদের মানানসই করতে না পেরে। তার ক্ষেত্রে অবশ্য এমন অসুবিধে হতো না। গাড়ির প্রতি টান দেখে খগেন জুম্মানের সাইকেল গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, হাতের কাজটা যদি শেখানো... যায় এই আশায়। বলাই কিন্তু একরোখা গোঁ ধরা মানুষ। তার প্রাণ ভোমরা ওই রিকশা। বউ এর সাথে কম অশান্তি হয়নি এই রিক্সা নিয়ে। মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে চলে যায় গ্যারেজে, ভাবে আজই এটাকে বেচবো, কিন্ত পারেনা। আজও পারেনি। তাই গ্যারেজের সামনে থেকে কলা পাউরুটি গলাধঃকরণ করে পালিয়ে এসেছে যেমন জেল থেকে আসামি পালায়।
ভরা পেট, আর হাতে তার বাহনের হ্যান্ডেল। গুনগুন করে গাইতে গাইতে ফিরছে বাড়ি বলাই। ওই গান টা রেডিওতে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছে.... কিশোরজীর
"চিঙ্গারি কোই ভড়কে......"। শহর থেকে অথাৎ যেখানে রিক্সা নিয়ে যায় ও প্রতিদিন, সেখান থেকে তার গ্রামটা মিনিট পনেরোর রাস্তা। কিন্তু শহর থেকে ফারাক যেন শত যোজন। শহরের অন্তঃসারশূন্য অহেতুক আড়ম্বর তার গ্রামটাকে ছোঁয় নি। তাই নিষ্পাপ সরলতা আজও জড়াজড়ি করে থাকে সেখানে। নদী পাড় দিয়ে চলে তার গাড়ি। সে নদীর জল স্বচ্ছ কাঁচের মতো। পূর্ণিমার রাতে যখন বলাই ফেরে সে জলে নিজের বাহনের প্রতিচ্ছবি দেখে ..... সে সুখ তার মাথা ঝিম ধরিয়ে দেয়, যেন বাসরঘরের আলো আঁধারিতে ঘোমটা উঠিয়ে দেখল আধফোটা ফুলটাকে। নদীর আরেক পাশে সারি সারি আম কাঁঠাল আর সজিনা গাছ। পথে যেতে যেতে এমন হাওয়া এই শীতের রাতে হাড় কাঁপিয়ে দিলো বলাই এর। তারপর ছোট সাঁকো..... রিক্সা এগিয়ে যায় চাষির জমি চিরে। দুধারে মরশুমি শাক সবজি। ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালং, বেগুন আর সেগুলো ছুঁয়ে নরম বাতাস।
পর্ব ২
বাড়ি ফিরতে বলাই এর আজ অনেকটা রাত হয়ে গেছে। বউ ঘুম চোখেই আলুসানা আর ভাত দিল , খিদের পেটে একপেট খেয়ে লেপের তলায় গায়েব হলো, যদিও ওটাতে আর ঠান্ডা ভাঙে কিনা কে জানে, ইঁদুরে তুলো আর রাখেনি তেমন ....যা আছে তা শুধু তেল চিটকে সোঁদা কভার। সকালে যখন উঠলো তখন সরলার ঘর গেরস্থালির সব কাজই সারা,......উঠোন নিকানো, উনুনে গোবর লেপে পচারা দেওয়া, গুচ্ছের এঁটো বাসন সাফসুতরো করা , আরো যে কত কাজ। বলাই নিমগাছ থেকে একটা সবজে দেখে কচি ডাল ভেঙ্গে তার ক্ষওয়াটে দাঁতে তার পুরো ভাগ চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁতন তৈরি করে ঘষতে ঘষতে ঘাড়ে গামছা নিয়ে পুকুরে গেল। যে তার সারা বছরের অভ্যাস, কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা। বাড়ির টিউবওয়েলের জলে নাকি এমন শান্তি নেই। টেরি কেটে চুল আঁচড়ে বসলো দাওয়াই। বিপত্তি ঘটলো তখুনি।
খাবার দিতে দেরি হচ্ছে দেখে বলাই চিৎকার করে উঠলো সরলার ওপর। আজ সরলাও মেজাজ হারালো। ঝাঁঝিয়ে উঠে জমা লাভা উগড়ে দিল একেবারে.... " কি কাজে যাও পিতিদিন, ঘরের খোঁজ নাও! চারদিন ধরে পেটের কাঁটাটাকেও ফ্যানভাত ছাড়া আর কিচ্ছুটি দিতে পারিনি.... , কে চাপবে ওই রিক্সায়, সারাদিনে ওই তো একটাই, মেয়েটাকে ইস্কুলে আনানেওয়া, ওই তো কাজ" এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে লাগলো সরলা। বলাই লজ্জায় অপমানে রাগে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, দিল ছুড়ে দাওয়ায় রাখা একটা ঘটি সরলার দিকে। সরলা বাবা গো মা গো চিৎকার করে কপালে হাত দিয়ে উঠোনে বসে পড়লো। তার পাঁচ আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না অপরাধী বলাই। ছুটে হ্যান্ডেল ধরলো রিক্সার আর চোখের পলক ফেলতেই তাকে আর দেখা গেল না। সাড়ে দশটার সময় তার বাঁধা ভাড়া। অলোক দাসের একমাত্র মেয়ে ননী দিদিমণি কে স্কুলে পৌঁছে দেয়। অলোক দাস বিশেষ ভরসা করে বলাই কে। তার কারণও নেহাত কম নয়। এ পর্যন্ত একটা দুর্ঘটনাও ছুঁতে পারেনি তার রিক্সাকে। স্বভাব চরিত্রে ও নাম আছে পাড়ায়। বলাই গত ছ'বছর ধরে ননিকে নিয়ে যাওয়া আসা করছে স্কুলে, কেউ বলতে পারবে না যে ওর জন্য দিদিমণির পাঁচটা মিনিটও দেরি হয়েছে। এই নিয়ে বিশেষ গর্ববোধ আছে তার।
যাই হোক, আজ তেমন গল্প করলো না আর ননী দিদিমণির সাথে। নিঃশব্দে পৌঁছে দিয়ে রিক্সা একপাশে রেখে নিজে গিয়ে বসল বাঁধানো বটের নীচে। ভাড়া যে আজ এক্কেবারে আসেনি তা না, গ্যাস সিলিন্ডার, জলের ড্রাম নিয়ে যাওয়ার জন্য ফাঁকা রিক্সা তাক করে যারা এসেছিল, চালক নেই ভেবে সকলে ফিরে গেছে। সবটা দেখেছে বলাই নিজে চোখে। আজ বড় মনটা কেমন করছে তার সরলার জন্য। বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ছে। খগেন মারা গেল, অসুস্থ মা কে সেবা করতে কখন যে বয়স পেড়িয়ে গেল তা ওর মনে নেই। পড়শী, আত্মীয়, মৃত্যুপথযাত্রী মা সকলেই একটা বউ আনতে বললো, নাহলে দেখবে কে ওকে। ব্যাস কে যে দেখলো মেয়ে, কক্ষণ যে বিয়ে হয়ে গেল তার টের না পেতেই সব যেন হয়ে গেল। কিন্ত বিয়ের দিন পানপাতা সরানো ওই মুখটা সে কোনোদিন ভুলতে পারেনি। এমন কালকুলো হুতোম প্যাঁচার যে এমন বউ জুটবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। ফর্সা রঙে টানা টানা
নাক চোখ, বয়সেও তার থেকে অনেকেই কচি। অমন রঙের জন্য কাঠখোট্টা বলাই বউ এর নাম বাসরঘরে রেখেছিল গরী.... ওই হিন্দি সিনেমাতে যেমন গৌরী নামের নায়িকাদের নায়কেরা ডাকে না,.... তেমনই। দিন গেল, রাত গেল... বলাই এর সোহাগী গরীর পেট হলো। ছেলেটা বিয়োনোর পর তার দিকে যেন দেখেই নি আর। স্বাস্থ্য ভেঙেছে, রং তামাটে বেঁধেছে, গালে অযত্নের মেচেতা। আজ খুব বুকটা ফেটে যাচ্ছিল বলাই এর। ভাবতে লাগলো, মেয়েটা যদি বড়লোকের বাড়ির বউ হত এমন তার দশা হত না.... তার কাছে পেয়েছেই বা কি, সকাল থেকে রাত উদযাস্ত শুধু কাজ আর অনাহার। কিছু হাতে করে নিয়ে যায়নি কোনোদিন বউটার জন্য, বিয়ের পেতথম পেতথম বলাই এর বুকের ওপর শুয়ে বলেছিল একজোড়া ব্রোঞ্জের চুরি পড়তে তার বড় সাধ, ওই যেমনটা ঘন্টার মা পড়ে... শাঁখা পলার পাশে এমন চুরি সরলার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এখনও পর্যন্ত বলাই গাঁয়ের মেলা থেকে একগাছ ঝুটা চুড়িও এনে দিতে পারেনি। নিজেকে আজ খুব দুষলো সে। কোন অধিকারে আজ তার গায়ে হাত দিল। সেই গানটাও মনে পড়তে লাগলো, ওই যে প্রজাপতি ব্রহ্মার মন্ত্র না কি বলে যেটা দুজনে গেয়েছিল.... যদিদং হৃদয়ং মম, তদিদং হৃদয়ং তব..." আর মনে নেই রুখাশুখা বলাই এর। না আজ বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে সরলার কাছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে। রিক্সা ধরলো বলাই। ওষুধের দোকান থেকে ব্যান্ডেজ আর পেনকিলার নিলো দুটো সঙ্গে নিল নিলুর দোকানের একঠোঙা চপ।
পর্ব৩
বাড়িতে ঢুকতেই আজ কেমন যেন লাগলো বলাই এর। রিক্সা রাখলো বেড়ার পাশে। ঝাঁপ খুলে উঠানে পা রাখলো। অন্ধকার চারিদিক, তুলসীমঞ্চ শুকনো পরে আছে। সন্ধে প্রদীপ নেই। ঠাওর করলো নাহ মেয়েটা রাগ করেছে বড়। আঁধার ভেদ করে ঘরে ঢুকতেই..... সরলা বসে আছে ছেলে গদাইকে নিযে, তার মাথাতেও লাল ওষুধ লাগানো। গদাই শুয়ে আছে মেঝেয়। জিজ্ঞাসা করলে সরলা অদ্ভুত শান্ত মুখে উত্তর দিলো আতা পাড়তে উঠে গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙেছে। রাতটা গেল কোনোরকমে। বলাই এর পুঞ্জীভূত সমস্ত প্রেম নিভে গেল এক নিমেষে। সাময়িক চিকিৎসা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সারলাই করিয়েছে। বাপ হয়ে কিচ্ছু করতে পারেনি। আজ আর কিছু মুখে দেয়নি বলাই। না খেয়েই বেরিয়ে গেল রিক্সা নিয়ে অলোক দাসের বাড়ির দিকে। সরলাও যেন এমন অমানবিক স্বামীর প্রতি উদাসীন.... রা কাড়েনি কাল থেকে, মনে হচ্ছে বোবায় ধরেছে।
ননীকে নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা হলো। আজ সারাটা রাস্তা গদাই এর মুখটাই মনে পড়লো। গড়নে তার মতো হয়নি। মায়ের ধাঁচ পেয়েছে ভাগ্যিস। অমন রং, নাক, মুখ। হোলো যখন কে যেন বলে উঠলো বলাই এর ছেলের ....গদাই। বড়লোকদের ছেলে মেয়ের কেমন ভালো ভালো নাম হয়, তারও যে ইচ্ছে হয়নি তা নয়, কিন্ত লজ্জা লেগেছিল। কেউ যদি বলে বাপ রিক্সা টানে..... ছেলের নাম রেখেছে দেখ!! আসলে তাদের মত লোকেদের অনেক শখই বিসর্জন দিতে হয়, কিছুটা টাকাকড়ির অভাবে আর কিছুটা অভাবী মানুষের স্বভাবসিদ্ধ লোকলজ্জায়। এত কিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল। কাল থেকে খালি পেটও ছিল। হ্যান্ডেল নিয়ন্ত্রণ হারাল, সামনের চাকা বেঁকে ঢুকল সামনে থেকে রুদ্ধশ্বাসে আসা টোটো গাড়িতে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে বলাই দেখলো অনেক কিছু হয়ে গেছে.... টোটোর হেড লাইট ভেঙে ঝুলছে, চারিদিকে থিকথিকে লোক ওকে দুষছে, আর সর্বোপরি যে ক্ষতি হলো তা বলাই ভাবতে পারেনি স্বপ্নেও। ননী দিদিমণি মাটিতে পড়ে আছে, মুখ কেটে গেছে, দাঁত ভেঙেছে সামনের একটা, হড়হড় করে রক্ত বেরোচ্ছে। বাচ্চা মেয়ে ভয়ে যন্ত্রনায় চিৎকার করে কাঁদছে মা মা বলে।
বাজারেই অলোক দাসের সারের দোকান। কে একটা খবর দিয়েছে, ছুটে এসেছে সে। একমাত্র মেয়ে ননী। আজ অলোক দাস বলাই কে তুলোধুনা করে ছাড়লো সক্কলের সামনে। এদ্দিনের এত গরিমা, তার সময়ানুবর্তিতা সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল এক নিমেষে। আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না সে... লোকে মুখ নাড়ছে, হাত পা ছুড়ছে, কোন শব্দ নেই....। বলাই ননীর মুখে গদাই এর মুখ দেখতে পাচ্ছে। সে ছুটে গেল গ্যারেজের দিকে, না আজ আর চাপলো না রিক্সায়, আর হয়তো রিক্সায় চাপবেই না....।
এদিকে দুর্ঘটনার খবর পৌছালো বাড়িতে। উদ্বিগ্ন সরলা অসুস্থ ছেলে নিয়ে সারারাত অপেক্ষা করতে লাগলো ওই মানুষটার। কত কি যে মনে এলো.... ছাইপাশ গিলতে গেল নাকি... না না নেশা তো তার নেই.... তবে অলোক দাস কি পুলিশে দিলো তাকে... বালিশ ভিজে যাচ্ছে, ভয়ে , অভিমানে, অনাদরে। ভোর হতে না হতেই পাশের বাড়ির লোকু কড়া নাড়লো, কি যেন বলল বিড়বিড় করে। ছুটে বেরিয়ে গেল সরলা... প্রথমে ঘন্টার মাকে ছেলেটাকে একটু দেখতে বললো, আর তার পর বড় রাস্তার দিকে। হাপাচ্ছে সরলা অভুক্ত শরীরে, ওই তো ভিড় জমেছে গ্যারেজের কাছে। সরলা বসে পড়লো সেখানেই। পা পাথর হয়ে গেছে, কি হয়ে গেল আজ, ও ভাবতে পারছে না। অবসন্ন শরীর টেনে নিয়ে গেল, যেমন শবদেহ নিরুদ্দেশ করতে অপরাধী ছেঁচড়ে নিয়ে যায়, তেমনই। ভিড় সরিয়ে দেখল বলাই.... অচেতন হয়ে পড়ে আছে। বিজ্ঞ লোকে সাময়িক পরীক্ষা করে বললো সারারাত এই খোলা জায়গায় বসে থেকে শীতে প্রাণ গেছে তার।
বলাই রিক্সাওয়ালা.. মরলো। সেদিন রিক্সা বিক্রি করেও মোহমুক্ত হতে পারলো না। তাই পড়েছিল গ্যারেজের দিকে চেয়ে সারারাত, তীক্ষ্ণ শীতে। তার রিক্সার দিকে তাকিয়ে যে রিক্সায় আর কোনোদিনও ও হাত দেবে না, লাল শালুটা দিয়ে একবারও মুছবে না, আর কোনোদিনও না, কখনো না। সবাই বলল স্বার্থপর বলাই মরলো। ভাবলে না একবারও ছেলেটার কথা, সমত্ত বউটার কথা। কে জানে ভেবেছিল কিনা, হয়তো ভেবেছিল, তবু ভালোবাসা যে অন্ধ। একটা বিষম ঘোর। যে ওই ঘরের বশবর্তী থাকে তার যে আর ভালো মন্দ জ্ঞান থাকেনা। সে বস্তুই হোক, বা হোক না অপর কোনো হৃদয়। তাই কতবার ভুল জেনেও, বুঝেও মানুষ আত্মসমর্পণ করে, নিবেদন করে নিজেকে হেলায়। বলাই এর পকেট থেকে একটা কাগজের প্যাকেট উদ্ধার হয়েছিল। সরলার হাতে পুলিশ তুলে দিল, সকলকে জানালো সরলা রিক্সা বিক্রির কিছু টাকা আর বিক্রয় রসিদ ছিল ওই প্যাকেটে। টাকা দিয়ে ছেলেটার চিকিৎসা আর লেখাপড়ার সামগ্রী কেনা হলো। গায়ের লোক ভুললো বলাইকে, রিক্সাস্ট্যান্ড ভুললো, অলোক দাস তার মেয়ের জন্য এখন টোটো গাড়ি ভাড়া করেছে, পিতৃহীন গদাই অবহেলায় অযত্নে বড় হতে লাগল... সকলেই ভুললো রিক্সাওয়ালাকে। ভুললো না শুধু লোকের বাড়ি বাড়ি রান্না করা মেয়েটা, সরলা। যে শেষ সম্বল তার কাছে ছিল তাই দিয়ে এতটুকু জীবন কাটানো বড় সহজ মনে হয়েছিল তার। সেদিন প্যাকেটে আরেকটা বস্তু ছিল যা সরলা লজ্জায়, অপমানে, অভিমানে কাওকে বলতে পারেনি.... টাকার পাশে রাখা ছিল একগাছ ব্রোঞ্জের চুরি আর কাঁচা হাতের লেখায় একটা কাগজ, তাতে লেখা ছিল শুধু "গরীব"।