Moumita Chakraborty

Tragedy

2  

Moumita Chakraborty

Tragedy

অপূর্নতা

অপূর্নতা

4 mins
307



স্টেশন চত্বর অন্যদিনের তুলনায় বেশ শুনশান। সামনের ফাঁকা সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চে মা কে বসিয়ে টিকিট আনতে গেল ঋদ্ধি,.... ঋদ্ধিমা। আজ বনধ ডেকেছে যেন কোন পার্টি। তাই একটু সুবিধেই হল তার মা কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। নাহলে স্টেশনের একটা বেঞ্চেও তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এখন বন্ধের দিনে ট্রেন বাসের পরিষেবা মোটামোটি স্বাভাবিকই থাকে তা সে ভয়েই হোক বা ভক্তিতে। দুটো টিকেট কেটে ফিরে এলো ঋদ্ধি মায়ের কাছে। ধুবুলিয়া থেকে কৃষ্ণনগর যাবে ওরা, ওখানেই ডাক্তারের চেম্বার। এপয়েন্টমেন্ট মিস করা যাবে না মোটেও। না হলে আবার একটা মাস পিছিয়ে যেতে হবে এই স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের। হঠাৎই তার চোখ পড়ল একটা ছেলের দিকে। নাহ, আগে কোনোদিন দেখেনি ও। আসলে মেয়ে হিসেবে ও তো বরাবরই একটু গেছো, তাই এলাকার এলিজিবল ব্যাচেলরদের তথ্য ওর ঝুলিতে থাকবেই। তাই বন্ধুদের সাহায্যের কাজেও আসে, কখনো নিজেরও। কিন্তু এটাকে তো ফার্স্ট টাইম দেখছে!!! দেখতে দেখতে মন যেন ভরে গেল ঋদ্ধির। খুব যে লম্বা তা নয়, তবে মুখমণ্ডলে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস আছে। গৌরবর্ন, উন্নত নাসিকা.... সে যাক গে যাক,... ঋদ্ধির পছন্দ হল ছেলেটার হাতদুটো। জামার আস্তিন গোটানো হাত দুটো দেখেই যেন বাহুবন্ধনে লেপ্টে যেতে ইচ্ছে করল চিরকালের মত তার। চোখের পলক ফেলতেই ট্রেন এল, আর স্বপ্ন হয়ে উড়ে গেল সে। 


সারাটাদিন ছেলে মেয়ে সকলের সাথে টো টো করে ঘুড়ে বেড়ানো ঋদ্ধিমা যেন কি যেন খুঁজছে। তুলনামূলক বেশ শান্ত দেখে মা জিজ্ঞেস করল"কি হয়েছে রে তোর"? ব্যাস বলার অপেক্ষা.... ঝরঝর করে ছেলেটার বর্ণনা দিয়ে বলল"আর আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করো না মা, আমি ঐ পোলাটারেই বিয়ে কমু আর মন পাতিয়ে সংসার কমু এই তোমায় কথা দিলাম ... বলেই মাকে সজোরে একটা চুমু খেলো। মাস দুয়েক এমনই অন্বেষণ চললো মনে মনে। হঠাৎই পাড়ার পুষ্পদির ছেলের অন্নপ্রাশনে আবার সেই দেবদর্শন। সাদা শার্টে আজকে যেন আরো স্নিগ্ধ অথচ সুঠাম লাগলো তাকে। আর পারলো না ঋদ্ধি, অনুষ্ঠান শেষে পুষ্পদির কাছ থেকে জানলো ছেলেটা পুষ্পদিরই ব্যাচমেট, নাম স্বর্ণাভ চ্যাটার্জী, গতবছর স্কুলে চাকরি পেয়েছে। প্রায় পায়ে মাথা ঠুকে মোবাইল নম্বরটা ও নিয়ে এসেছে। বাড়ি এসে নিজেকে সব ভাবে প্রস্তুত করলো যেন কোনোভাবেই রিজেক্ট না হয়ে যায় স্বর্ণাভর কাছে। ঈশ্বর যা রূপ দিয়েছেন ওকে তা যে কোনো ছেলেকেই তাক লাগিয়ে দেয়, কিন্ত তার চরিত্র নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে। মানে ছেলেবন্ধুদের সাথে ঘোরাফেরা করে বলে। সে অবশ্য নিজে কোনোদিনও এনিয়ে অপরাধ বোধে ভোগেনি। বন্ধুর সংজ্ঞায় ছেলে মেয়ে আলাদা হয় না...এই তার যুক্তি। তবুও যদি স্বর্ণাভ সে দিকেও আঙ্গুল তোলে তাও সে বিনা বাক্য বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করবে আর নিজেকে নিবেদন করবে তার কাছে। অন্য ঋদ্ধি জাগছে তার ভেতরে সে বেশ বুঝতে পারছিল। মনে মনে যে কত কিছু সে ভেবে নিয়েছে.... আর সারাদিন রবি ঠাকুরের ওই গানটা হেড ফোনে শুনছে.. " কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া, তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া"।  


আজ যথারীতি এগারোটা নাগাদ সেই আরাধ্য নম্বর এ ফোন করল...রিং হচ্ছে আর বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে যেন ভয়ে আনন্দে ঋদ্ধির। ওপার থেকে গম্ভীর অথচ প্রাণোচ্ছল আওয়াজ এলো "হ্যালো... কে বলছেন?" ঋদ্ধি নিজেকে সামলালো এবং এত দিনের মহড়া ডায়লগ বলতে শুরু করলো.... মানে অকপট সত্যি সবটা বললো এক নিঃশ্বাসে। ওপার থেকে কিছুক্ষণ চুপ, তারপর যে রেসপন্স এলো তাতে ঋদ্ধি চোখে অন্ধকার দেখছে। স্বর্ণাভ এনগেজড, এমনকি কিছুদিন পরই বিয়ে ওদের। ঋদ্ধি এক অপরিচিত পুরুষের কাছে শুধুমাত্র বন্ধুত্বের জন্য, কথা বলার জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। স্বর্ণাভ রাজি হলো কারণ এই বয়সের মেয়ে যদি খারাপ কিছু করে বসে , তার থেকে হ্যাঁ বলে আপাতত বাঁচে আর কি। ঋদ্ধিমা মনে মরলো, কিন্ত বাঁচিয়ে রাখলো স্বর্ণাভকে... হৃদয়ের তলদেশে। যাইহোক, প্রথম দিকটাই ঋদ্ধির চেষ্টায় টুকটাক কথা হতে হতে সত্যিই বন্ধুত্বের আবর্তে জড়িয়ে পড়লো উভয়ই। সময় গেল.... ঋদ্ধির স্বর্ণাভদার বিয়ের দিন এসে উপস্থিত হল। ঋদ্ধিও নিমন্ত্রিত ছিল, কিন্ত যেতে পারেনি আসলে যাওয়া যায় না। বিয়ের আগে ওর স্বনাভদার কাছে একটা আবদার ছিল.... একটা সন্ধ্যে কাটাতে চেয়েছিল মানুষটার সাথে। কে জানে কিসের বশে স্বর্ণাভ এমন বেপরোয়া প্রস্তাবে বেহিসেবী হয়েছিল। সেদিন সন্ধেয় রেস্টুরেন্টে নানা অছিলায় বারবার ছুঁতে চেয়েছিল স্বর্ণাভকে। শীতে তার হাতটা কতটা হিমশীতল হয়েছে তা জানানোর জন্য ঋদ্ধিমা ভরে দিয়েছিল স্বর্ণাভর হাতের ওমে। দীর্ঘ সময় অমনভাবে থাকতে চেয়েছিল..... যে হাতটা আর কিছুদিনের মধ্যে কোন মন্ত্রবলে অন্যের হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। আজ সব চৌকাঠ, সব দরজা ভেঙে স্বর্ণাভর বুকে আছড়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল ঋদ্ধির। কিন্তু না.... কাছের মানুষের কাছে একটু আদরের জন্য, যত্নের জন্য যতই হ্যাংলামি করতে ইচ্ছে হোক না কেন, আমি সত্ত্বা নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য আর সব আবেগকে ছাপিয়ে যায়। পরিণত স্বর্ণাভ সবটা বুঝতে পারছিল। এই কদিনে মেয়েটার প্রতিও তার যেন একটা টান জন্মে গেছিল, কিন্ত ভালোবাসা কি!! না তো... ওর এক ও অদ্বিতীয় ভালোবাসা তো অন্বেষাই। তবে এ কেমন মায়া! কোনো কোনো সময় কোনো সম্পর্ক গিঁটে আটকাবে না জেনেও মানুষ পিছলে যায় সেদিকেই.... হয়ত কিছুটা জেনেশুনেই.... সুতো কেটে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না আর এ জীবনে। আলতো করে আদর হাতে  ঋদ্ধির চোখের ওপর আছড়ে পড়া ছটফটে অবাধ্য চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে স্বনাভ বলল..... মন খারাপ করিস না.... যদি পরজন্ম থাকে তবে পারলে এমনভাবে ভালোবাসিস... দেখিস ঠিক তোরই হব... এই কথা দিলাম।


 বছর দুই কেটে গেছে। স্বর্ণাভর বিয়ের প্রথম এক বছর ঋদ্ধিমা গোঁ ধরেছিল এ জীবনে বিয়ে করবে না, কোনোরকমে কিছু একটা করে একার পেট চালিয়ে নেবে। কিন্তু চাকরিবিহীন আর পিতৃবিহীন এ সংসারে মেয়েরা যে ভাই এর বোঝ হয় তা মা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেওয়ায় বিয়েতে রাজি হয়েছিল হঠাৎই শান্ত হওয়া মেয়েটা। এই দুবছরে স্বর্ণাভর সাথে বার পাঁচেক কথা হয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শাসন করে রেখে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এখন সুখী গিন্নি হয়েছে ঋদ্ধি.... মানে লোকে তাই বলে.... চাহিদা বলে তার কিছু নেই, অল্পেই যেন খুশি। শুধু ছেলের জন্মের পর ছেলের ডাকনামটা যেটা সম্বোধন করে সকলে সব সময় ডাকবে, ও ডাকবে, সারাটা খন ঘরে বাজবে রবি ঠাকুরের গানের মতো.... সেই নাম টা দিতে চেয়েছিল.....স্বর্ণাভ........


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy